Ajker Patrika

গনির পতনে পাকিস্তানের আনন্দের কিছু নেই

হামিদ মীর, পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
আপডেট : ১৭ আগস্ট ২০২১, ১১: ২৫
গনির পতনে পাকিস্তানের আনন্দের কিছু নেই

কাবুল থেকে গত রোববার আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির এভাবে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় তাঁর মন্ত্রিসভার জ্যেষ্ঠ সহকর্মীরা হয়তো চমকে উঠতে পারেন, কিন্তু ইসলামাবাদে কেউ আশ্চর্য হয়নি। কারণ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আগেই এমন কিছুর স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। গত বুধবার ইমরান বলেছিলেন, গনি প্রেসিডেন্ট থাকলে তালেবান আলোচনার পথেই হাঁটবে না। যদিও পালিয়ে যাওয়ার আগের দিনই টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে আফগানিস্তানের মানুষের উদ্দেশে গনি বলেন, ‘আপনাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে পরবর্তী অস্থিতিশীলতা, সহিংসতা এবং স্থানচ্যুতি থেকে জনগণকে রক্ষা করা।’ অথচ এর পরদিন পদত্যাগ না করেই তিনি নীরবে পিঠটান দিলেন দৃশ্যপট থেকে।

ন্যূনতম প্রতিরোধ ছাড়াই হেরাত ও মাজার-ই-শরিফের মতো শহরগুলোর অসহায় পতন দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, ৩১ আগস্টের আগেই তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেবে। অবশ্য দোহা থেকে তালেবান নেতারা আশ্বাস দিচ্ছিলেন, জোর করে তাঁরা কাবুল দখল করবেন না। এমনকি কাবুলে ঢোকার কয়েক ঘণ্টা আগেও তাদের মুখপাত্র সুহাইল শাহীন দাবি করেন, তাঁদের যোদ্ধারা কাবুলে ঢুকবে না। এর ঘণ্টাখানেক পরেই তালেবানযোদ্ধারা আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট প্যালেসে বসে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করছিলেন। কাবুল দখলের এই ঘটনাকে জায়েজ করতে এখন তালেবান বলছে, বিশৃঙ্খলা ও লুটতরাজ থেকে শহরটিকে বাঁচাতে তারা সেখানে গেছে।

২০ বছর আগে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ তালেবান ও আল-কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধকে ক্রুসেড (ধর্মযুদ্ধ) হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। ক্রুসেড শব্দটি যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ নিতান্ত সাধারণ অর্থেই উচ্চারণ করে এবং তাতে ধর্মীয় আবেগের তেমন কোনো লেশ থাকে না। তারপরও ওই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই শব্দটি ব্যবহার করায় নিশ্চিতভাবেই লাভবান হয় তালেবান। তারা মার্কিন প্রতিরোধের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পেরেছে ধর্মের দোহাই। ২০ বছর আগে বুশ যখন তাঁর ক্রুসেড শুরু করেন, তালেবান তখন কাবুল ছেড়ে পালিয়েছিল। এখন তালেবানযোদ্ধারা বসে আছেন প্রেসিডেন্ট প্যালেসে আর মার্কিন কূটনীতিকেরা পালাচ্ছেন কাবুল থেকে। এই ক্রুসেডে দিন শেষে তাহলে জয় হয়েছে কার?

তালেবানের কাছে কাবুলের পতন নিয়ে কতিপয় পাকিস্তানি মন্ত্রী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অত্যন্ত মজাদার মন্তব্য করেছেন। মানবাধিকারবিষয়ক মন্ত্রী ড. শিরিন মাজারি কাবুলের পতনকে ভিয়েতনামের সাইগনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। পরিকল্পনামন্ত্রী আসাদ ওমর লিখেছেন, ‘আফগানিস্তানের সেনাবাহিনী কেন কোনো প্রতিরোধ ছাড়া এভাবে ভেঙে পড়ল, তা সবাইকে বিস্মিত করেছে। সেনারা মূলত তিনটি কারণে যুদ্ধ করে–হয়তো কোনো উদ্দেশ্যে, নয়তো নেতার জন্য কিংবা টাকার জন্য। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের পর নগদ অর্থের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। সেহেতু যুদ্ধ করার কোনো কারণই নেই!’

কাবুলের এমন অসহায় আত্মসমর্পণ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক পরাজয় হিসেবে বিবেচিত হলেও এটি পাকিস্তানের জন্য উদ্‌যাপনের কোনো কারণ হতে পারে না। প্রথমত, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে নাইন-ইলেভেনের পর পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ‘নন-ন্যাটো অ্যালাই’ বা ন্যাটোর বাইরে ‘সামরিক মিত্র’ হিসেবে তকমা দেওয়া হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে ঘাঁটি ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে প্রতিদান হিসেবে কোটি কোটি ডলারও পেয়েছে পাকিস্তান। ইমরান খানের মন্ত্রিসভা পরিপূর্ণ জেনারেল পারভেজ মোশাররফের মন্ত্রিসভার সেই সদস্যদের দিয়ে, যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছিলেন।

হামিদ কারজাই ও আশরাফ গনিদের মতো লোকদের সরাসরি ওয়াশিংটন থেকে আফগানিস্তানে বসানো হয়নি। ইসলামাবাদের সাহায্যেই তাঁরা ওই অবস্থানে গেছেন। ২০১৪ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে আশরাফ গানিকে দেওয়া গার্ড অব অনারের কথা আমি ভুলতে পারি না। ২০১৬ সালে মার্কিন থিংকট্যাংকের কাছে আশরাফ গনির সাফাই গেয়ে পাকিস্তানের বর্তমান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মুঈদ ইউসুফ যে দীর্ঘ রচনা লিখেছিলেন, সে কথাই-বা কী করে ভুলে যাই? তিনি লিখেছিলেন, আশরাফ গনি প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়তে থাকা একজন বিচক্ষণ নেতা। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পক্ষ থেকে আশরাফ গনিকে দেওয়া আরও এক গার্ড অব অনারের কথাও আমার মনে পড়ছে।

২০২০ সালে পাকিস্তান যখন যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি করার উদ্যোগ নেয়, মূলত তখন থেকেই ইমরান খান ও আশরাফ গনির সম্পর্কে অবনতি ঘটতে থাকে। ওই চুক্তির কারণে কোনো যুদ্ধবিরতি ছাড়াই ৫ হাজার তালেবান বন্দীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন গনি। সেই থেকে পাকিস্তান ও তালেবান নিয়ে আস্থাহীনতায় পড়েন গনি। তিনি পাকিস্তানকে চাপে রাখতে ভারতের ঘনিষ্ঠ হতে থাকেন। তালেবান অবশ্য গনির চেয়েও চতুর। তারা ভিন্নপথে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালায় এবং দিল্লিকে নিরপেক্ষ রাখতে চেষ্টা করে। পাকিস্তান ছিল গনির বন্ধু কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই বন্ধুত্ব অটুট রইল না। এর মানে এই নয় যে পাকিস্তানের কিছু মন্ত্রীর জন্য গনির পালিয়ে যাওয়ার উদ্‌যাপনের মতো ঘটনা হতে পারে।

মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তালেবানের মাধ্যমে কাবুলকে সামরিক কায়দায় দখলের বিরোধিতা করে ওয়াশিংটন পোস্টে একটি কলাম লেখেন। তিনি লিখেছেন, ‘আফগানিস্তানে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অভিন্ন। আমরা আলোচনার ভিত্তিতে শান্তি চাই, গৃহযুদ্ধ চাই না। আমাদের প্রয়োজন স্থিতিশীলতা এবং উভয় দেশে মাথাচাড়া দেওয়া সন্ত্রাসবাদের অবসান।’

তালেবান এরই মধ্যে বিভিন্ন জেল থেকে হাজারো বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে। মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্য পাকিস্তানি তালেবান নেতা মৌলভি ফকির মুহাম্মদও রয়েছেন, যিনি আল-কায়েদার আয়মান আল জাওয়াহিরির সঙ্গে নিজের ঘনিষ্ঠতার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করে পাকিস্তানে ‘ওয়ান্টেড আসামি’ হিসেবে চিহ্নিত। তাঁর মতো লোকেরা কি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মানসিকতা থেকে সরে আসবেন? নাকি যুক্ত হবেন তেহরিক-ই-তালেবানের নেতা নুর ওয়ালি মেহসুদদের সঙ্গে? যে মেহসুদ সিএনএনে দেওয়া সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কাবুলের প্রেসিডেন্ট প্যালেসে বসে থাকা তালেবান নেতাদের কাছে আমরা এর জবাব চাই।

গত বছর সই হওয়া দোহা শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন এখন যুক্তরাষ্ট্র ও অংশীজনদের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল। সামরিক কায়দায় তালেবানের কাবুল দখল করাটা দোহা চুক্তির লঙ্ঘন। আশরাফ গনির পালিয়ে যাওয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। অনেকে এটিকে যুক্তরাষ্ট্রের পালিয়ে যাওয়া হিসেবেই দেখছেন। ‘সালিসকারীদের বধ্যভূমি’ হিসেবেও আফগানিস্তানের পরিচিতি রয়েছে। তালেবান দাবি করতেই পারে তারা যুক্তরাজ্য ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো মহান সালিসকারীদের পর তারা যুক্তরাষ্ট্রকেও নিজেদের বধ্যভূমিতে বধ করেছে। তবে আফগানিস্তানকে বধ্যভূমি বানিয়ে তালেবান ও তাদের পাকিস্তানি সমর্থকদের আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো কারণ নেই। এই বধ্যভূমিকে শান্তির স্বর্গে পরিণত করাটাই আসল চ্যালেঞ্জ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত