শস্যের বিনিময়ে বই: ভারতে খাদ্যসংকটের সুযোগে যেভাবে পাঠাগার সমৃদ্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২: ২৯
Thumbnail image
ভারতীয় উপমহাদেশের বই নিয়ে নিজেদের পাঠাগার সমৃদ্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ছবি: সংগৃহীত

পিএল–৪৮০ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের একটি বিশেষ কর্মসূচির নাম। ১৯৫৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘পাবলিক ল’ ৪৮০’ বা ‘ফুড ফর পিস’ কর্মসূচির অধীনে এটি চালু করা হয়। এটি ছিল মূলত সোভিয়েত–মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধকালীন কূটনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি আগাগোড়াই একটি কূটনৈতিক চাল হলেও, শিক্ষা সম্প্রসারণে এই কর্মসূচি খুবই ব্যতিক্রম একটি ভূমিকা রেখেছে।

১৯৯৬ সালে অনন্যা বাজপেয়ি, তখন ডক্টরাল শিক্ষার্থী। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেনস্টেইন লাইব্রেরিতে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বইয়ের ঐতিহাসিক সংগ্রহ আবিষ্কার করেন তিনি।

বর্তমানে ভারতের অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর অনন্যা সম্প্রতি বিবিসিকে বলেন, ‘আমি অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ, হার্ভার্ড ও কলম্বিয়ার মতো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দক্ষিণ এশিয়া লাইব্রেরিতে সময় কাটিয়েছি। কিন্তু শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অসীম সম্পদ রয়েছে, তার সঙ্গে কিছুই তুলনীয় নয়।’

১৩২ বছর পুরোনো শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কিত ৮ লাখের বেশি বই রয়েছে। এটি এই অঞ্চলের গবেষণার জন্য বিশ্বের অন্যতম প্রধান সংগ্রহ। কিন্তু এই বিশাল দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য সংকলন সেখানে কীভাবে পৌঁছাল?

এর উত্তরই হলো প্রজেক্ট পিল–৪৮০।

তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডুইট ডি. আইজেনহাওয়ার কর্তৃক স্বাক্ষরিত ‘পাবলিক ল’ ৪৮০’ শীর্ষক আইনের অধীনে এই কর্মসূচি চালু করা হয়। এই আইন ভারতসহ অন্যান্য দেশকে মার্কিন শস্য স্থানীয় মুদ্রায় কিনতে সাহায্য করেছিল। এতে দেশগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের কিছুটা নিরসন করে, একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বৃত্ত কমিয়ে দেয়। ভারত ১৯৫০ এবং ১৯৬০–এর দশকের খাদ্য সংকটের সময়ে এই খাদ্য সহায়তার অন্যতম বৃহৎ গ্রাহক ছিল।

এই কর্মসূচির অধীনে স্থানীয় মুদ্রার তহবিল আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ন্যূনতম খরচে সরবরাহ করা হয়। এই তহবিল ব্যবহার করে ভারতীয় ভাষায় লেখা স্থানীয় বই, সাময়িকী, ফনোগ্রাফ রেকর্ড এবং অন্যান্য মাধ্যম সংগ্রহ করা হয়। এতে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়সহ দুই ডজনের বেশি প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষণার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। অবশ্য ওই সময় ভারতের ‘প্রাচীনত্ব আইন’ অনুযায়ী পাণ্ডুলিপি বাদ দেওয়া হয়েছিল।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজিটাল সাউথ এশিয়া লাইব্রেরির পরিচালক জেমস নাই বলেন, ‘পিএল–৪৮০ শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় এবং আরও ৩০ টির বেশি মার্কিন সংগ্রহে চমৎকার এবং অপ্রত্যাশিত প্রভাব ফেলেছে।’

দক্ষিণ এশিয়া থেকে এই বিশাল সংগ্রহ গড়ে তোলা সহজ কাজ নয়।

১৯৫৯ সালে দিল্লিতে ৬০ জন ভারতীয় সদস্যের একটি বিশেষ দল গঠন করা হয়। শুরুতে সরকারি প্রকাশনা সংগ্রহে মনোযোগ দেওয়া হলেও, পাঁচ বছরের মধ্যে এই কর্মসূচি বই এবং সাময়িকী অন্তর্ভুক্ত করতে সম্প্রসারিত করা হয়। মরিন এলপি প্যাটারসন দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক একটি শীর্ষস্থানীয় গ্রন্থপঞ্জিকার ছিলেন। তিনি বলেন, ১৯৬৮ সালের মধ্যে ২০টি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় এই ক্রমবর্ধমান সংগ্রহ থেকে বই–পুস্তক ও নথিপত্র পাচ্ছিল।

১৯৬৯ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে প্যাটারসন উল্লেখ করেন, পিএল–৪৮০ কর্মসূচির শুরুর দিনগুলোতে ভারতীয় দলটিকে একটি বিশাল এবং বৈচিত্র্যময় দেশের বই সংগ্রহের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছিল। শৌখিন বই বিক্রেতাদের খুঁজে খুঁজে বের করতে হয়েছে।

ভারতের বিশালতা এবং সাহিত্যিক জগতের জটিলতার কারণে, কোনো একক বিক্রেতা এই সংগ্রহের দায়িত্ব নিতে পারেনি।

পরিবর্তে, বিভিন্ন প্রকাশনা কেন্দ্র থেকে বিক্রেতাদের নির্বাচন করা হয়েছিল, যারা নির্দিষ্ট ভাষা বা ভাষা গোষ্ঠীগুলোর ওপর মনোযোগ দিতেন। এই সহযোগিতা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছিল। বিক্রেতারা নিশ্চিত না হওয়া শিরোনামগুলো অনুমোদনের জন্য পাঠাতেন। চূড়ান্ত নির্বাচন দিল্লি অফিসের হাতে ছিল।

কর্মসূচিটি সমস্ত ভাষায় ভারতীয় কথাসাহিত্য সংগ্রহের ওপর জোর দিয়েছিল। প্যাটারসন লেখেন, এই নীতির ফলে অনেক গোয়েন্দা গল্প এবং সাময়িক জনপ্রিয় উপন্যাস সংগৃহীত হয়েছিল।

১৯৬৩ সালে বই সংগ্রহের পছন্দ ‘গবেষণা স্তরের বিষয়’–এ সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল। অনেক ভাষায় কথাসাহিত্য বাছাই অর্ধেকে নেমে আসে। ১৯৬৬ সালের মধ্যে ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তান থেকে ৭ লাখ ৫০ হাজারের বেশি বই ও সাময়িকী পাঠানো হয়েছিল আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এর মধ্যে ভারত ৬ লাখ ৩৩ হাজারটির বেশি বই–পুস্তক সরবরাহ করেছিল।

১৯৬৭ সালে এক মার্কিন লাইব্রেরি বৈঠকের প্রতিবেদনে বলা হয়, আমরা ১০০ থেকে ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতের ইতিহাস, ভারতের হস্তশিল্প, হিন্দু সংস্কৃতি এবং ব্যক্তিত্ব: একটি মনঃসমীক্ষণমূলক গবেষণা এবং আরও অনেক কিছু পাঠিয়েছি।

তবে, প্রশ্ন থেকে যায় পিএল–৪৮০ কর্মসূচির মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়া থেকে বই অপসারণ কি এই অঞ্চলের সাহিত্যিক সম্পদ কমিয়ে দিয়েছে? এই বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গ্রন্থাগারিক টড মাইকেলসন–অ্যামবেলাং।

স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনার মধ্যে পিএল–৪৮০ তহবিলের আওতায় তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া কেন্দ্র একুশ শতকের মধ্যে ২ লাখ শিরোনামের বই–পুস্তক সংগ্রহ করেছে।

মাইকেলসন-অ্যামবেলাং বলেন, পিএল–৪৮০–এর মতো কর্মসূচির মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়া থেকে বই অপসারণ ‘জ্ঞান বৈষম্য’ তৈরি করে। গবেষকদের প্রায়ই এই সাহিত্য সম্পদে পেতে পশ্চিমে যেতে হয়।

এদিকে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই সময় ভারত থেকে সংগৃহীত সব বই এখনো তাদের কাছে রয়েছে কিনা তা স্পষ্ট নয়। ভারতের ফ্লেম ইউনিভার্সিটির মায়া দোদের মতে, অনেক বই, যা বর্তমানে ভারতে পাওয়া যায় না, সেগুলো শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সংগ্রহে পাওয়া যায়। এসব বইয়ের ওপর ‘পিএল–৪৮০’ স্ট্যাম্প বা ছাপ থাকে।

তবে এর পক্ষে মাইকেলসন-অ্যামবেলাং যুক্তি দিয়েছেন—বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই, পিএল–৪৮০ কর্মসূচির মাধ্যমে আসা বই দক্ষিণ এশিয়ায় এখনো পাওয়া যায়। তবে সংরক্ষণ একটি চ্যালেঞ্জ, কারণ সাদা পিঁপড়া, পোকামাকড় এবং তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার নিয়ন্ত্রণের অভাবে বইগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর বিপরীতে, পশ্চিমা দেশগুলোর গ্রন্থাগারে সংরক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ প্রচেষ্টার কারণে বেশির ভাগ উপকরণ ভালোভাবে সংরক্ষিত থাকে।

এরপরও মাইকেলসন-অ্যামবেলাং পশ্চিমা গ্রন্থাগারগুলোকে ‘ঔপনিবেশিক আর্কাইভ’ বলতে চান। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, ‘আংশিকভাবে এ কারণেই এগুলোকে ঔপনিবেশিক আর্কাইভ বলা যায় যে, এই গ্রন্থাগারগুলো একাডেমিকদের জন্য কাজ করে, প্রায়ই তারা নিজস্ব প্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরের ব্যক্তিদের বাদ দেয়। লাইব্রেরিয়ানরা দক্ষিণ এশীয় উপকরণ ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যগুলো বোঝেন, তবে কপিরাইট আইনগুলো এ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা তৈরি করে, এটি বৈষম্য আরও বাড়িয়ে তোলে।’

পিএল–৪৮০ কর্মসূচির সমাপ্তি ঘটল যেভাবে

জেমস নাই বলেন, ১৯৮০–র দশকে কর্মসূচিটি শেষ হওয়ার পরে, আর্থিক বোঝা আমেরিকান গ্রন্থাগারগুলোর ওপর পড়ে। আমেরিকার গ্রন্থাগারগুলোকে এখন সম্পদ নির্বাচন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং সরবরাহের খরচ বহন করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় এখন দিল্লির লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের ফিল্ড অফিসের মাধ্যমে বই ও সাময়িকী কিনতে বছরে ১ লাখ ডলারের বেশি খরচ করে।

অবশ্য অনন্যা মিসেস বাজপেয়ি মনে করেন, শস্যের বিনিময়ে বই সংগ্রহের এই চুক্তি একটি ইতিবাচক ফলাফল এনেছে। তিনি সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, কিন্তু শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর গবেষণা ভারতীয় ও ইউরোপীয় ভাষা—ফরাসি, জার্মান, মারাঠি এবং হিন্দি—এবং ভাষাবিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, নৃতত্ত্ব এবং আরও অনেক বিষয়ে বিস্তৃত ছিল। তিনি বলেন, ‘রিজেনস্টেইন লাইব্রেরিতে আমি কখনোই আমার প্রয়োজনীয় বই খুঁজে পেতে ব্যর্থ হইনি।’

তিনি বলেন, ‘বইগুলো নিরাপদে আছে, এগুলোর মূল্যবান, চাইলেই পাওয়া যায়। আমি ভারতের প্রতিটি অঞ্চলে গ্রন্থাগার, আর্কাইভ এবং প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছি এবং আমাদের দেশের বই সংক্রান্ত গল্প সর্বত্রই করুণ। এখানে বইগুলো হারিয়ে গেছে, ধ্বংস হয়েছে, অবহেলিত পড়ে রয়েছে বা প্রায়ই প্রয়োজনের সময় পাওয়া যায় না।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কারা পরিদর্শক হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক

ট্রাম্পের অভিষেক: সি আমন্ত্রণ পেলেও পাননি মোদি, থাকছেন আরও যাঁরা

ট্রাম্পের শপথের আগেই বার্নিকাটসহ তিন কূটনীতিককে পদত্যাগের নির্দেশ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে: সলিমুল্লাহ খান

সংস্কারের কিছু প্রস্তাবে মনঃক্ষুণ্ন বিএনপি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত