Ajker Patrika

রয়টার্সের প্রতিবেদন /চাকরি হারানো মার্কিন সরকারি কর্মকর্তাদের ডাকছে চীন

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৫, ১৫: ১২
চাকরি হারানোর পর কার্যালয় থেকে নিজের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছেন এক মার্কিন কর্মকর্তা। ছবি: সংগৃহীত
চাকরি হারানোর পর কার্যালয় থেকে নিজের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছেন এক মার্কিন কর্মকর্তা। ছবি: সংগৃহীত

এক গোপন চীনা প্রযুক্তি সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত একটি নেটওয়ার্ক সম্প্রতি ছাঁটাই হওয়া মার্কিন সরকারি কর্মীদের নিয়োগের চেষ্টা করছে। এমনকি তারা চাকরির বিজ্ঞাপনও দিয়েছে। এই প্রচারণা উন্মোচনকারী এক গবেষকের বরাত দিয়ে এমনটাই জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিসের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক ম্যাক্স লেসার বলেছেন, নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া কিছু কোম্পানি ‘সাবেক (মার্কিন) সরকারি কর্মচারী এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) গবেষকদের লক্ষ্য করে তৈরি হওয়া ভুয়া কনসালটিং ও হেডহান্টিং ফার্মের একটি বৃহত্তর নেটওয়ার্কের অংশ।’

চারটি কনসালটেন্সি এবং নিয়োগকারী সংস্থা, যারা ব্যাপকভাবে এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত, তাদের সম্পর্কে খুব কম তথ্যই জনসাধারণের কাছে সহজলভ্য। রয়টার্সের প্রতিবেদন এবং লেসারের গবেষণা অনুসারে, কিছু ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর ওয়েবসাইটের বিষয়বস্তু একই রকম, একই সার্ভারে হোস্ট করা অথবা অন্যান্য ডিজিটাল সংযোগ রয়েছে।

কোম্পানি চারটির ওয়েবসাইট স্মিয়াও ইন্টেলিজেন্স নামক একটি ইন্টারনেট পরিষেবা কোম্পানির সঙ্গে একই আইপি অ্যাড্রেসে হোস্ট করা হয়েছে। রয়টার্সের অনুসন্ধানের সময় স্মিয়াও ইন্টেলিজেন্সের ওয়েবসাইটটি বন্ধ ছিল। স্মিয়াও ইন্টেলিজেন্স এবং এই চারটি কোম্পানির মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয় করতে পারেনি রয়টার্স।

সংবাদ সংস্থাটির পক্ষ থেকে এই চার কোম্পানি এবং স্মিয়াও ইন্টেলিজেন্সকে খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা বহুবার ব্যর্থ হয়েছে। রয়টার্স এই কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ফোন কল, ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। এমনকি ফোন নম্বর বন্ধ হয়ে গেছে বলেও অনুমান করা হচ্ছে। এসব কোম্পানি যেসব ঠিকানা দিয়েছিল সেগুলোরও কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি এবং পরে নিয়োগ বিজ্ঞাপনগুলো লিংকডিন থেকে মুছে ফেলা হয়েছে।

ম্যাক্স বলেন, এই প্রচারণা চীনা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ‘সুপ্রতিষ্ঠিত’ কৌশল অনুসরণ করেই পরিচালিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এই কার্যকলাপ যে কারণে তাৎপর্যপূর্ণ তা হলো—এই নেটওয়ার্কটি সাম্প্রতিক ব্যাপক ছাঁটাইয়ের শিকার প্রাক্তন ফেডারেল কর্মীদের আর্থিক দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে চাইছে।’

কোম্পানিগুলো চীনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত কিনা অথবা কোনো প্রাক্তন ফেডারেল কর্মীকে নিয়োগ করা হয়েছে কিনা, তা রয়টার্স নিশ্চিত করতে পারেনি। এই বিষয়ে তিন গোয়েন্দা বিশ্লেষক রয়টার্সকে বলেন, এই নেটওয়ার্কটি একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ যে কীভাবে বিদেশি সংস্থাগুলো প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বিলিয়নিয়ার প্রযুক্তি টাইকুন ইলন মাস্কের ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সির বরখাস্ত বা অবসর নিতে বাধ্য করা কর্মীদের কাছ থেকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে।

বিশ্লেষকেরা বলেছেন, একবার নেটওয়ার্কে যুক্ত হলে ফেডারেল কর্মীদের সরকারি কার্যক্রম সম্পর্কে ক্রমশ সংবেদনশীল তথ্য শেয়ার করতে বা অতিরিক্ত ব্যক্তিদের সুপারিশ করতে বলা হতে পারে, যাদের ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত অংশগ্রহণের জন্য লক্ষ্যবস্তু করা হতে পারে।

ওয়াশিংটনে চীনা দূতাবাসের একজন মুখপাত্র রয়টার্সকে ইমেইলের মাধ্যমে জানিয়েছেন, চীন এই প্রচারণায় জড়িত কোনো সংস্থার বিষয়ে অবগত নয় এবং বেইজিং ডেটা গোপনীয়তা ও নিরাপত্তাকে সম্মান করে।

হোয়াইট হাউসের এক মুখপাত্র বলেছেন, চীন ক্রমাগত গুপ্তচরবৃত্তি ও জবরদস্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ‘মুক্ত ও উন্মুক্ত ব্যবস্থাকে’ কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। মুখপাত্র বলেন, ‘বর্তমান ও প্রাক্তন সরকারি কর্মচারী উভয়কেই এই সরকারগুলোর সৃষ্ট বিপদ এবং সরকারি তথ্য সুরক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে।’

সিএনএন গত ২৮ ফেব্রুয়ারি জানায় যে, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা বিশ্বাস করে—রাশিয়া ও চীন অসন্তুষ্ট মার্কিন সরকারি কর্মচারীদের লক্ষ্যবস্তু করছে এবং তারা বহু বছর ধরেই এই কাজ করে আসছে।

রয়টার্স এ মাসের শুরুতে জানিয়েছিল, শীর্ষ নিরাপত্তা ছাড়পত্র থাকা কিছু মার্কিন সরকারি কর্মীকে স্ট্যান্ডার্ড এক্সিট ব্রিফিং দেওয়া হয়নি। এই ব্রিফিংয়ে বিদেশি শত্রুরা যোগাযোগ করা হলে কী করতে হবে তা অন্তর্ভুক্ত থাকে।

এই নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত একটি কোম্পানি রিভারমার্জ স্ট্র্যাটেজিক। তারা তাদের ওয়েবসাইটে নিজেদের ‘পেশাদার ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি পরামর্শক সংস্থা’ হিসেবে অভিহিত করে এবং ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে তাদের লিংকডিন পেজে দুটি চাকরির তালিকা পোস্ট করেছিল, যা পরে মুছে ফেলা হয়। তাদের লিংকডিন পেজ এখন আর অ্যাকসেস করা যাচ্ছে না।

এক বিজ্ঞাপনে সরকারি সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংস্থা বা বহুজাতিক করপোরেশনে অভিজ্ঞ ‘ভূ-রাজনৈতিক পরামর্শক উপদেষ্টা’ চাওয়া হয়েছিল, সেখানে লিংকডিন পোস্টের একটি স্ক্রিনশট অনুসারে দেখা গেছে যে ২০০ টিরও বেশি আবেদন জমা পড়েছিল।

অন্যটিতে এমন একজন মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ চাওয়া হয়েছিল যিনি ‘ওয়াশিংটনের ট্যালেন্ট পুল সম্পর্কে গভীর ধারণা ব্যবহার করে নীতি বা পরামর্শের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রার্থীদের চিহ্নিত করতে’ এবং ‘স্থানীয় পেশাদার নেটওয়ার্ক, থিংক ট্যাংক এবং একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে’ সক্ষম হবেন।

রিভারমার্জ স্ট্র্যাটেজিসের ওয়েবসাইটে তালিকাভুক্ত মার্কিন ফোন নম্বরটি আর চালু নেই। ওয়েবসাইটের কন্টাক্ট পেজে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত তালিকাভুক্ত একটি আলাদা চীনা ফোন নম্বর হলো শেনজেন সি জুন সফটওয়্যার কোম্পানি লিমিটেডের তালিকাভুক্ত একই নম্বর।

রিভারমার্জ স্ট্র্যাটেজিক সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত তাদের ওয়েবসাইটে দুটি ঠিকানা দিয়েছিল, একটি সিঙ্গাপুরে এবং অন্যটি কলোরাডোতে। সিঙ্গাপুরের ঠিকানাটি ম্যানেজমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট অব সিঙ্গাপুরের ক্যাম্পাসের মধ্যে একটি হোস্টেল ভবনের দিকে নির্দেশ করে, কিন্তু রয়টার্সের অনুসন্ধানে সেখানে কোম্পানিটির কোনো কার্যালয় খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাদের অন্য ঠিকানাটি কলোরাডোর বোল্ডারে অবস্থিত নর্থওয়েস্ট রেজিস্টার্ড এজেন্ট নামক একটি ব্যবসায়িক পরিষেবা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত।

লিংকডিনে রিভারমার্জের এক কর্মচারী পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সকে বলেছেন, চীনে একটি নেটওয়ার্কিং অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে পরিচিত এক ব্যক্তি তার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং রিভারমার্জ স্ট্র্যাটেজিসের জন্য চাকরির তালিকা প্রচার করতে সাহায্য করতে বলে।

কলোরাডোর সেই ব্যক্তি জানান, ‘এরিক’ নামে পরিচিত সেই ব্যক্তি এবং ‘উইল’ নামে আরেকজন যোগাযোগকারী প্রতি দুই বা তিন মাস পর পর তাঁকে ১-২ হাজার ডলার করে বেতন দেওয়া হবে—এমন চাকরির তালিকা পোস্ট করার জন্য দেন।

রয়টার্সের অনুসন্ধানের প্রতিক্রিয়ায়, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই-এর এক মুখপাত্র সতর্ক করে বলেছেন, চীনা গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ‘বর্তমান, প্রাক্তন এবং সম্ভাব্য’ মার্কিন সরকারি কর্মচারীদের লক্ষ্যবস্তু করার জন্য থিংক ট্যাংক, একাডেমিক প্রতিষ্ঠান এবং নিয়োগকারী সংস্থা হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে পারে। চীনা সরকারের এজেন্টরা অতীতেও একই ধরনের কৌশল ব্যবহার করেছে।

২০২০ সালে জুন ওয়েই ইয়েও নামে সিঙ্গাপুরের এক নাগরিক ২০১৫ সাল থেকে একটি বিদেশি শক্তির এজেন্ট হিসেবে কাজ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফেডারেল আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন। কৌঁসুলিরা অভিযোগ করেছিলেন, তিনি রাষ্ট্রীয় সংবেদনশীল তথ্যে অ্যাকসেস থাকা আমেরিকানদের চিহ্নিত ও মূল্যায়ন করার জন্য কাজ করতেন এবং তাদের নামবিহীন এশিয়ান ক্লায়েন্টদের জন্য প্রতিবেদন লেখার জন্য অর্থ দিতেন, যদিও কাজটি আসলে চীনা সরকারের জন্য ছিল তা প্রকাশ করেননি।

আদালতের নথি অনুসারে, চীনা গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ইয়েওকে কীভাবে লক্ষ্যবস্তু নিয়োগ করতে হবে সে সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। বিশেষ করে, এসব মার্কিন কর্মকর্তারা তাদের জিজ্ঞাসা করা যে, তারা ‘কাজে অসন্তুষ্ট কিনা, আর্থিক সমস্যায় ভুগছেন কিনা বা তাদের সন্তানদের ভরণপোষণের দায়িত্ব আছে কি না।’

মার্কিন বিচার বিভাগের সাবেক কৌঁসুলি ডেভিড অ্যারন রয়টার্সকে বলেছেন, বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রায়ই চাকরির নিয়োগের নামে প্রতারণার আশ্রয় নেয় যাতে তাদের অজান্তেই সূত্র নিয়োগ করা যায়।

অ্যারন বলেন, ‘আমি মনে করি, চীনের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের প্রচেষ্টা আরও জোরদার করবে। কারণ, তারা দেখছে যে, সরকারি কর্মচারীদের একটি বড় অংশ হঠাৎ করে নতুন চাকরি খুঁজতে বাধ্য হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, অনেক সাবেক কর্মচারী দেশপ্রেম দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও, অনেকেই প্রতারণামূলক কৌশলের শিকার হতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায় যে কারণে চীনের সঙ্গে পেরে উঠছে না ভারত

মুক্তিযুদ্ধের ম্যুরাল ঢাকা: এনসিপি নেতা-কর্মীদের গলা ধাক্কা

সারা জীবন ‘একজনের কাছে কৃতজ্ঞ’ থাকবেন তামিম, কে তিনি

বিমসটেকে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক আয়োজনের চেষ্টায় মিয়ানমার: রয়টার্স

সচিবালয়ে কর্মরতদের রেশন দেবে সরকার, ক্ষুব্ধ বাইরে কর্মরতরা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত