আবদুল বাছেদ
মেধাতন্ত্র আসলে কী? আমরা কি আসলেই মেধাতান্ত্রিক সমাজে বাস করছি?
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: মেধাতন্ত্র এমন এক সমাজব্যবস্থার ধারণা, যেখানে ব্যক্তি নিজের যোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে যায়। আর সেই যোগ্যতা অর্জনে তার বাবা-মায়ের আর্থসামাজিক অবস্থা কোনো প্রভাব রাখে না। মেধাতন্ত্র একই সঙ্গে আমাদের মধ্যে এক নৈতিক বোধের সৃষ্টি করে। এই ব্যবস্থা এক অভিজাত শ্রেণির জন্ম দেয়, যারা সমাজের বাকি মানুষদের সফল হওয়ার সুষম সুযোগ দেয়।
প্রশ্ন হলো, আমরা কি আসলেই মেধাতান্ত্রিক সমাজে বাস করছি? এর উত্তর হতে পারে আমরা একটি ত্রুটিপূর্ণ মেধাতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য আছি। এর মূল সমস্যা হলো, অভিজাতরা পুরো ব্যবস্থাকে নিজেদের অনুকূলে নিতে প্রতারণা বা ভাঁওতার আশ্রয় নেয়। পুরো ব্যবস্থাকে তারা এমনভাবে সাজিয়ে নেয়, যাতে তারাই এগিয়ে যেতে পারে।
আরেকটু খোলাসা করলে বলতে হয়, আমরা এমন এক সমাজে বাস করি, যা দেখতে অনেকটা মেধাতন্ত্রের মতো। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, কিছু মানুষ আসলেই তাদের ‘নিজেদের যোগ্যতায়’ (পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা যেখানে প্রভাব রাখে না) এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, মেধাতন্ত্রের পেছনে যে নৈতিক বোধ ক্রিয়াশীল বলে ধরে নেওয়া হয়, তা আদৌ বাস্তবায়ন হয়নি। এই সমাজব্যবস্থা সবার জন্য সমান ও ন্যায্য সুযোগের ব্যবস্থা করতে পারেনি এবং পুরো সমাজের জন্য সার্বিকভাবে এটি ইতিবাচক হয়ে ওঠেনি। এমনকি এটি অভিজাতদের জন্যও ভালো কিছু নয়।
আমরা আপনার ‘সুষম সুযোগ’ প্রসঙ্গে আবার আসব। তার আগে মাত্রই আপনার করা মন্তব্যের প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাই। মেধাতন্ত্র নিয়ে খুব সাধারণ সমালোচনা হচ্ছে—অভিজাতরা আদতে অভিজাত নন, তাঁরা ত্রুটিপূর্ণ একটি ব্যবস্থার সুবিধাপ্রাপ্ত অংশ কেবল। এই মতের বিরোধিতা আপনি করবেন বলে মনে হয় না। বরং আপনি আরও কিছুটা এগিয়ে আরও গভীর একটি দাবি করেছেন। বলছেন, আমরা এমন এক সমাজ গড়ে তুলেছি, যেখানে এমন কিছু যোগ্যতা দিয়ে মেধাতন্ত্র গড়ে তোলা হচ্ছে, যা অর্জনে আবার সমাজই তাকে সহায়তা করছে। অর্থাৎ, বিশেষ সুবিধা দিয়ে মেধাতন্ত্র গড়ে তুলে তাকেই আবার সাফল্যের সিঁড়িতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি কি আরেকটু বুঝিয়ে বলবেন?
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: বিষয়টি দুই ভাগে করা যেতে পারে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে যে কেলেঙ্কারি হলো, তা এটি ব্যাখ্যায় সহায়তা করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের সন্তানকে ভর্তির জন্য কিছু খ্যাতিমান ও ধনী লোক ঘুষ দিয়েছিলেন। আমি বলছি না যে এটি কেলেঙ্কারি হওয়ার মতো কোনো ঘটনা নয়। বরং এটি বেশ বড় কেলেঙ্কারিই। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, বিশেষত অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এত এত ধনীর দুলাল থাকার মূল কারণ আসলে এটি নয়।
ধনীরা শুধু ঘুষ দেন বলেই তাঁদের সন্তানেরা ভালো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে পারছে, বিষয়টি এমন নয়। বরং তাঁরা তাঁদের সন্তানদের শিক্ষার পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন বলেই তারা ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুযোগ পাচ্ছে। তাঁরা তাঁদের সন্তানদের বেশ ভালো ভালো কিন্ডারগার্টেন, হাইস্কুলে পড়ান, তাদের জন্য আলাদা করে কোচ রাখেন, শিক্ষক রাখেন, সংগীতের পাঠ দেন। এসবের মধ্য দিয়েই ধনীদের সন্তানেরা অন্যদের চেয়ে বেশি মেধাতান্ত্রিক হয়ে বেড়ে ওঠে।
এখানে তাই মূল সমস্যা এটা নয় যে অভিজাতরা অসদুপায় অবলম্বন করছেন। বরং মেধাতন্ত্রই ধনীদের পক্ষ হয়ে কাজ করছে। যদিও সবাই একই নিয়মের মধ্যে আছে।
সুতরাং আপনি বলতে চাইছেন, আমরা যেই মেধাতান্ত্রিক দুনিয়ায় বাস করছি, তা সংজ্ঞার দিক থেকেই একটি বাজে দুনিয়া, যেখানে গোটা বিশ্ব কারচুপিতে ভরা এবং প্রতিনিয়ত অসাম্য পুনরুৎপাদন করে।
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: হ্যাঁ, এই ব্যবস্থা অসাম্যকে পুনরুৎপাদন করে একে আরও বাড়িয়ে তোলে। এতে পুরো ব্যবস্থা আরও নাজুক হতে থাকে। কারণ, অভিজাতরা তাদের সন্তানদের শিক্ষার পেছনে যেভাবে অর্থ ব্যয় করতে পারে, অন্যরা তা কখনোই পারে না। আর এসব শেষে আপনি যখন সবার মেধা যাচাই করতে যাবেন, তখন দেখবেন অভিজাতদের সন্তানেরা এগিয়ে আছে। এটাই স্বাভাবিক।
তাহলে কি মেধাতন্ত্রই ন্যায্য সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা, যে সমাজে সবার জন্য সমান সুযোগ একটি বাস্তব ধারণা?
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: সমসুযোগের সমাজ গঠনে বর্ণবাদ, নাকি মেধাতন্ত্র—কোনটি বড় বাধা, তা নিয়ে আমি তর্ক করব না। শুধু বলতে চাই, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে স্কলাস্টিক অ্যাসেসমেন্ট টেস্ট (এসএটি) ও কলেজ বোর্ডের রিপোর্টে দেখা যায়, যারা এসএটি পরীক্ষায় ৭৫০ বা এর বেশি স্কোর করেছে, তাদের অধিকাংশের বাবা-মা কমপক্ষে স্নাতক পাস। (যুক্তরাষ্ট্রের অভিজাত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হতে একজন শিক্ষার্থীর গড়ে ৭৫০ এসএটি স্কোর করতে হয়। অভিজাত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একসঙ্গে আইভি লিগ হিসেবে পরিচিত।) সে বছর এসএটি পরীক্ষায় ৭৫০ বা তার বেশি স্কোর করা শিক্ষার্থীদের দেড় হাজারেরই বাবা-মা ছিলেন স্নাতক পাস।
আপনি আরও দেখতে পাবেন, হাইস্কুল পাস করেননি এমন মা-বাবার সন্তানদের মধ্যে এসএটি পরীক্ষায় ৭৫০ বা তার বেশি স্কোর করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশ নগণ্য ও হতাশাজনক। এই সংখ্যা এতই কম যে সেখানে পরিসংখ্যানের কৌশলগুলোও খুব একটা খাটে না। কিন্তু শুধু সংখ্যার দিকে তাকালে আপনি দেখবেন, সে বছর এমন শিক্ষার্থী ছিল মাত্র ৩২ জন।
তাহলে এখানে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে আপনার মা-বাবা বা অভিভাবকের শিক্ষাগত যোগ্যতা আপনার এসএটি স্কোর ঠিক করে দিচ্ছে। এটিই নির্ধারণ করে দিচ্ছে যে আপনি আইভি লিগ কলেজে পড়তে পারবেন কি না। এ-ও তো মেধাতন্ত্রই। একই সঙ্গে এটি সমসুযোগের পথে এক অবিশ্বাস্য বাধাও।
একটি প্রতিযোগিতামূলক সমাজ গঠন কি সম্ভব, যেখানে এমন সুযোগের প্রাপ্যতা বাধাগ্রস্ত হবে না?
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: আমি মনে করি সম্ভব। এখানেই আমি শিক্ষাকে Excellent Education ও Superior Education—এ দুই ধারায় বিভাজনের কথা বলি। Excellent Education হলো এমন এক শিক্ষা, যা একজন মানুষকে এমন কিছুতে দক্ষ করে তুলবে, যার অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে। অন্যদিকে Superior Education হবে এমন এক শিক্ষা, যা একজন ব্যক্তিকে অর্থনৈতিক গুরুত্ব নির্বিশেষে অন্যদের তুলনায় কোনো কিছুতে দক্ষ করে তুলবে।
(বোঝার সুবিধার্থে আমরা এখানে Excellent Education বলতে প্রায়োগিক শিক্ষা এবং Superior Education বলতে উন্নত শিক্ষা বলব।)
এখন এমন এক সমাজের কথা ভাবুন, যেখানে বিস্তৃত পরিসরে প্রায়োগিক শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে সমাজের জন্য দরকারি সব কাজে মানুষকে প্রশিক্ষিত করতে ভালো বিনিয়োগ রয়েছে, যেখানে সমাজের জন্য দরকারি সব কাজে দক্ষদেরই নিযুক্ত করা হয়। সেই সমাজ হবে একধরনের মেধাতান্ত্রিক সমাজ, যেখানে শিক্ষা ও কাজকে এমনভাবে কাঠামোবদ্ধ করা হয়, যেখানে দক্ষ ও একটু বেশি দক্ষের মধ্যে তেমন পার্থক্য করার সুযোগ থাকে না।
এমন সমাজের বাস্তব নজির হতে পারে জার্মানি। কিন্তু আমাদের (মার্কিন) সমাজ জোর দেয় উন্নত শিক্ষার ওপর। এই ব্যবস্থা এমন ব্যক্তিদের ব্যাপক সুবিধা দেয়, যারা কিছু লোক বা অধিকাংশ লোক থেকে এমন সব বিষয়ে এগিয়ে, যার কোনো অর্থনৈতিক গুরুত্ব নেই। এটা অনেকটা হাইটেক ফাইন্যান্সে পণ্ডিত হওয়ার মতো, যার কোনো সামাজিক মূল্য নেই বলে মনে করেন অধিকাংশ অর্থনীতিবিদই।
অথচ এ বিষয়ে ভালো হলে একজন বছরে মিলিয়ন ডলার কামাতে পারে। আর এতে একেবারে দক্ষ হয়ে উঠলে সব ধরনের জটিল কাজে দক্ষ হওয়া তো বটেই, বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব ধরনের ডিগ্রিই হাতের মুঠোয় চলে আসবে। অথচ মূল্যহীন। আর আমরা এমনই এক সমাজে আজ বাস করছি।
এবার আমি একটু আপনার পেছনের বক্তব্যর দিকে যেতে চাই। আপনি বলছিলেন, সুবিধাপ্রাপ্তদের জন্যও মেধাতন্ত্র ভালো কিছু নয়। যেহেতু বিষয়টি সাধারণ জ্ঞানের বিপরীত। এই কথাটা অনেক পাঠকের মনেই দাগ কাটবে। আপনি বিষয়টি কি আরেকটু বিশ্লেষণ করবেন?
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: আমরা মেতে উঠেছি বিজয়ী হওয়ার খেলায়। কিন্তু জয়ী হতে হলে প্রতিযোগিতা করতে হয়। আর সেই বিজয়কে টিকিয়ে রাখতে গেলে দরকার পড়ে কল্পনাতীত প্রতিযোগিতার। আমি বলতে চাইছি, অভিজাত বিদ্যালয়গুলো গত ২০-৫০ বছরের চেয়ে অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক হয়েছে। আর অভিজাত পেশাগুলো হয়ে পড়েছে আরও তীব্র প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র। আর এর একটা মাশুল আছে। আমি মনে করি, সুখী মানুষ হতে সবচেয়ে বড় বাধা এখন এই অসম প্রতিযোগিতা।
মেধাতান্ত্রিকেরা ভীষণ এক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের। এসব পরীক্ষায় পাস করতে প্রতিনিয়ত নিজেদের নবায়ন করতে হয়। তারা যেন নিজেকে বেচতে বের হওয়া এক ব্যবস্থাপক, যার সম্পদের তালিকায় শুধু তারা নিজেরাই আছে। নিজের জীবন থেকেই তারা যেন বিতাড়িত।
আপনি ইয়েলে পড়ান। আপনার আশপাশে অভিজাতদের আনাগোনা রয়েছে বেশ। আপনার চোখে কি এমন অভিজাত (অন্তত একজন) পড়েছে, যিনি বা যাঁরা তাঁদের সুযোগ-সুবিধার জন্য মানসিক চাপে রয়েছেন? কারণ, আমি মনে করি, সমাজটাকে পুনর্বিন্যাস করলে যাঁদের হারানোর রয়েছে সবচেয়ে বেশি, তাঁরা সমাজটা যেমন আছে তেমনই থাকতে দেওয়ার পক্ষপাতী। তার পরও আপনার বইটিতে আমরা যখন দেখি, এই অভিজাতরাই মধ্যবিত্তদের সঙ্গে নিয়ে নেমে পড়বেন সমাজকে পুনর্বিন্যাস করতে, তখন বিষয়টি আমার কাছে কিছুটা ইউটোপিয়ান মনে হয়েছে।
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: এটা শুনতে কেমন লাগে তাই না? নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা তবে বলি। দু-এক বছর আগে ইয়েল ল স্কুলে মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে একটি জরিপ হয়েছিল। সেখানে অংশ নেওয়াদের ৭০ শতাংশই বলেছিল, তারা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে। একই ধরনের ফল পাওয়া গিয়েছিল অন্য অভিজাত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেও। অর্থাৎ, অভিজাত শিক্ষার্থীরা আসলে সুখে নেই, তারা ভালো নেই।
বিশ বছর আগে আমি যখন এখানে পড়ানো শুরু করি, তখন শিক্ষার্থীরা অনেক আত্মবিশ্বাসী ছিল। তাদের দেখে মনে হতো, যেন তারা সোনার টিকিট পেয়ে গেছে। এখনকার শিক্ষার্থীদের দেখে কিন্তু তেমন মনে হয় না। এখনকার শিক্ষার্থীদের দেখলে মনে হয়, তাদের এখানে আসার পথে কঠিন সামরিক শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। এবং তারা এটাও জানে যে, পড়া শেষে তারা কর্মক্ষেত্রে যখন যাবে, সেখানেও একই শাস্তি অপেক্ষা করছে। এসব তারা কখনই চায় না।
এখনকার শিক্ষার্থীরা এটাও ভালোভাবে জানছে যে, তাদের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কারণে অন্যরা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিষয়টি তাদের নৈতিক পীড়ার কারণ। এসব তাদের জন্য আসলেই ভালো কিছু নয়। এখান থেকে পাস করে কেউ হয়তো ভালো ক্যারিয়ার পাবে। কিন্তু তার জীবনের বাকি অনুষঙ্গগুলো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। আমি মনে করি আমার ছাত্ররা বিষয়টি এখন বোঝে।
এই মেধাতন্ত্রের জন্য অনভিজাতদের কী মূল্য দিতে হচ্ছে? মেধাতন্ত্রই-বা কীভাবে তাদের প্রান্তিক করে তুলেছে?
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: আমি মনে করি এখানে তিন ধরনের মূল্য দিতে হয় অনভিজাতদের। প্রথমত, অনভিজাতরা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে না, এমনকি তাদের সন্তানেরাও নয়। একটা অভিজাত পরিবারের তুলনায় একটি দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবার সন্তানের শিক্ষার পেছনে কী এমন ব্যয় করতে পারে?
দ্বিতীয়ত, অভিজাতরা শ্রমবাজারেও সর্বনাশ করছে। চাকরির বাজার পুনর্বিন্যাস করছে অভিজাতরা। আগে মধ্যবিত্তরা যেসব চাকরি করত, উচ্চ বেতনের সেসব চাকরি এখন তাদের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। যাদের ওই শ্রেণিতে যোগাযোগ নেই, তারা বাদ পড়ছে। কোডাক কোম্পানির কথাই ভাবুন, যেখানে ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ কর্মরত ছিল। আজকের বাজারে একই অর্থমূল্যর কোম্পানি ইনস্টাগ্রাম চলে ১৩ জন কর্মী দিয়ে (যখন ফেসবুক ১ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ইনস্টা কিনেছিল)। এই ১৩ জন হলো অতি দক্ষ অভিজাত কর্মী, যারা মধ্যবিত্তদের সংখ্যাকে সংকুচিত করেছে।
তৃতীয়ত, মেধাতান্ত্রিক সমাজে মানুষ যে কাঠামোগতভাবেই সুষম-সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং ঝরে পড়ছে, সে বিষয়টিকে ব্যক্তিগত ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানকে বলা হচ্ছে, তুমি যদি ভালো চাকরি না পাও, তা তোমার অযোগ্যতা। তুমি হার্ভার্ডে পড়তে পারোনি? তাও তোমার অযোগ্যতা। এসব আসলে ফালতু কথা। আর এসব ফালতু কথাই আজকের এই মতবাদ প্রতিনিয়ত বলছে।
আপনার কথাগুলো বেশ যুক্তিসংগত। তবু এই ব্যবস্থা থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে আমি চিন্তিত। আমরা কি সম্পূর্ণ এক রাজনৈতিক-অর্থনীতি ও নৈতিকতা নিয়ে আলাপ করছি না?
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: ভুল বলেননি হয়তো। মেধাতন্ত্রের শিকড়ের দিকে তাকালে আপনি দেখবেন ১৮৩৩ সালের দিকে ইংরেজি ভাষাভাষীদের দুনিয়ায় এই ব্যবস্থার সূচনা। ওই সময় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে প্রবেশ ও পদোন্নতির বিষয়টি ব্যক্তির সামাজিক বা বংশগত পরিচয়ের বদলে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে কার্যকর করা শুরু হয়।
আর সেই ১৮৩৩ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ১৫০ বছর লেগেছে মানুষের গোটা সমাজ ও অর্থনীতিকে ঢেলে সাজাতে। এই করতে গিয়ে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান, প্রযুক্তি, সরকারব্যবস্থা, নীতিসহ সব পরিসরে বদল আনতে হয়েছে। তাই এই ব্যবস্থা থেকে বের হওয়াটা রাতারাতি হবে না। কয়েক প্রজন্ম লাগতে পারে শুধু কল্পনায় এই ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতেই, যেই পরিবর্তন আমাদের সামগ্রিক সত্তাকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাবে।
আমি জানি, আমার কথাগুলো শুনে আপনার মনে হতে পারে, যা কখনো পাওয়া সম্ভব না, তাই নিয়ে বকবক করছি। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থাটি দিনে দিনে আরও বেশি অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এতে খুব দ্রুতই মৌলিক পরিবর্তন আসবে মানুষের চিন্তায়, আকাঙ্ক্ষায়, উৎপাদনব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠান, ভোগসহ সামগ্রিক জীবনযাপনে। আর এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে প্রতিনিয়ত নিজেদের বর্তমান ব্যবস্থার সমালোচনার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ ব্যবস্থা কী হতে পারে, তা নিয়ে কথা বলতে হবে।
যে পরিবর্তনের কথা আপনি বলছেন, সেটা বর্ণনার জন্য উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। তবে এটি ব্যক্তির চেতনায় একটা বিপ্লব দাবি করে। সর্বোপরি মানুষের প্রয়োজন, আকাঙ্ক্ষা ও ভীতির ধরন বদলে যাবে।
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: মানুষের এখনই বোঝা উচিত যে, আজকাল তারা যা কিছু চায়, তা আসলে তাদের জন্য ভালো কিছু নয়। তাদের অতৃপ্তির পেছনের কারণ কী, তাঁদের সন্তানদের অতৃপ্তির পেছনের কারণ কী, তা আগে খুঁজে বের করতে হবে। তার পরই শুধু তারা বিকল্প খুঁজে পাবে।
তাই আমাদের নীতিনির্ধারকদের কাজ হলো কিছু বিকল্প পদ্ধতি তৈরি করা, যা সুবিধাবঞ্চিতদের স্বপ্নপূরণে সহায়তা করবে। এ জন্য অভিজাত বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনভিজাতদের সন্তানদের ব্যাপকভাবে পড়াশোনার সুযোগ করে দিতে হবে, যাতে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই প্রথম সুষম-সুযোগের বীথিকা হয়ে ওঠে।
সাক্ষাৎকার শেষ করার আগে একটি অপ্রিয় প্রশ্ন করতে চাই। আমরা যদি এই মেধাতন্ত্রকে উপড়ে না ফেলি, সমাজ যেই সুরে গান গাইছে, তাতেই তাল দিতে থাকি, আর অসাম্যকেই সহ্য করে যাই, তবে কী হতে পারে?
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না। তবে যে সমাজে কিছু মানুষ প্রচুর সুযোগ-সুবিধা আর সম্পদ পেয়ে বসে থাকে, সেই সমাজ অন্য দেশের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত না হলে বা অভ্যন্তরীণ বিপ্লব ছাড়া মৌলিক পরিবর্তনের মুখ দেখে না। আর এমন কিছুই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি জানি না কখন বা কীভাবে এসব ঘটবে। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে আপনাকে বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
এই সাক্ষাৎকার আমেরিকান সংবাদমাধ্যম ভক্সে প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর।
মেধাতন্ত্র আসলে কী? আমরা কি আসলেই মেধাতান্ত্রিক সমাজে বাস করছি?
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: মেধাতন্ত্র এমন এক সমাজব্যবস্থার ধারণা, যেখানে ব্যক্তি নিজের যোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে যায়। আর সেই যোগ্যতা অর্জনে তার বাবা-মায়ের আর্থসামাজিক অবস্থা কোনো প্রভাব রাখে না। মেধাতন্ত্র একই সঙ্গে আমাদের মধ্যে এক নৈতিক বোধের সৃষ্টি করে। এই ব্যবস্থা এক অভিজাত শ্রেণির জন্ম দেয়, যারা সমাজের বাকি মানুষদের সফল হওয়ার সুষম সুযোগ দেয়।
প্রশ্ন হলো, আমরা কি আসলেই মেধাতান্ত্রিক সমাজে বাস করছি? এর উত্তর হতে পারে আমরা একটি ত্রুটিপূর্ণ মেধাতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য আছি। এর মূল সমস্যা হলো, অভিজাতরা পুরো ব্যবস্থাকে নিজেদের অনুকূলে নিতে প্রতারণা বা ভাঁওতার আশ্রয় নেয়। পুরো ব্যবস্থাকে তারা এমনভাবে সাজিয়ে নেয়, যাতে তারাই এগিয়ে যেতে পারে।
আরেকটু খোলাসা করলে বলতে হয়, আমরা এমন এক সমাজে বাস করি, যা দেখতে অনেকটা মেধাতন্ত্রের মতো। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, কিছু মানুষ আসলেই তাদের ‘নিজেদের যোগ্যতায়’ (পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা যেখানে প্রভাব রাখে না) এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, মেধাতন্ত্রের পেছনে যে নৈতিক বোধ ক্রিয়াশীল বলে ধরে নেওয়া হয়, তা আদৌ বাস্তবায়ন হয়নি। এই সমাজব্যবস্থা সবার জন্য সমান ও ন্যায্য সুযোগের ব্যবস্থা করতে পারেনি এবং পুরো সমাজের জন্য সার্বিকভাবে এটি ইতিবাচক হয়ে ওঠেনি। এমনকি এটি অভিজাতদের জন্যও ভালো কিছু নয়।
আমরা আপনার ‘সুষম সুযোগ’ প্রসঙ্গে আবার আসব। তার আগে মাত্রই আপনার করা মন্তব্যের প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাই। মেধাতন্ত্র নিয়ে খুব সাধারণ সমালোচনা হচ্ছে—অভিজাতরা আদতে অভিজাত নন, তাঁরা ত্রুটিপূর্ণ একটি ব্যবস্থার সুবিধাপ্রাপ্ত অংশ কেবল। এই মতের বিরোধিতা আপনি করবেন বলে মনে হয় না। বরং আপনি আরও কিছুটা এগিয়ে আরও গভীর একটি দাবি করেছেন। বলছেন, আমরা এমন এক সমাজ গড়ে তুলেছি, যেখানে এমন কিছু যোগ্যতা দিয়ে মেধাতন্ত্র গড়ে তোলা হচ্ছে, যা অর্জনে আবার সমাজই তাকে সহায়তা করছে। অর্থাৎ, বিশেষ সুবিধা দিয়ে মেধাতন্ত্র গড়ে তুলে তাকেই আবার সাফল্যের সিঁড়িতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি কি আরেকটু বুঝিয়ে বলবেন?
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: বিষয়টি দুই ভাগে করা যেতে পারে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে যে কেলেঙ্কারি হলো, তা এটি ব্যাখ্যায় সহায়তা করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের সন্তানকে ভর্তির জন্য কিছু খ্যাতিমান ও ধনী লোক ঘুষ দিয়েছিলেন। আমি বলছি না যে এটি কেলেঙ্কারি হওয়ার মতো কোনো ঘটনা নয়। বরং এটি বেশ বড় কেলেঙ্কারিই। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, বিশেষত অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এত এত ধনীর দুলাল থাকার মূল কারণ আসলে এটি নয়।
ধনীরা শুধু ঘুষ দেন বলেই তাঁদের সন্তানেরা ভালো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে পারছে, বিষয়টি এমন নয়। বরং তাঁরা তাঁদের সন্তানদের শিক্ষার পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন বলেই তারা ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুযোগ পাচ্ছে। তাঁরা তাঁদের সন্তানদের বেশ ভালো ভালো কিন্ডারগার্টেন, হাইস্কুলে পড়ান, তাদের জন্য আলাদা করে কোচ রাখেন, শিক্ষক রাখেন, সংগীতের পাঠ দেন। এসবের মধ্য দিয়েই ধনীদের সন্তানেরা অন্যদের চেয়ে বেশি মেধাতান্ত্রিক হয়ে বেড়ে ওঠে।
এখানে তাই মূল সমস্যা এটা নয় যে অভিজাতরা অসদুপায় অবলম্বন করছেন। বরং মেধাতন্ত্রই ধনীদের পক্ষ হয়ে কাজ করছে। যদিও সবাই একই নিয়মের মধ্যে আছে।
সুতরাং আপনি বলতে চাইছেন, আমরা যেই মেধাতান্ত্রিক দুনিয়ায় বাস করছি, তা সংজ্ঞার দিক থেকেই একটি বাজে দুনিয়া, যেখানে গোটা বিশ্ব কারচুপিতে ভরা এবং প্রতিনিয়ত অসাম্য পুনরুৎপাদন করে।
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: হ্যাঁ, এই ব্যবস্থা অসাম্যকে পুনরুৎপাদন করে একে আরও বাড়িয়ে তোলে। এতে পুরো ব্যবস্থা আরও নাজুক হতে থাকে। কারণ, অভিজাতরা তাদের সন্তানদের শিক্ষার পেছনে যেভাবে অর্থ ব্যয় করতে পারে, অন্যরা তা কখনোই পারে না। আর এসব শেষে আপনি যখন সবার মেধা যাচাই করতে যাবেন, তখন দেখবেন অভিজাতদের সন্তানেরা এগিয়ে আছে। এটাই স্বাভাবিক।
তাহলে কি মেধাতন্ত্রই ন্যায্য সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা, যে সমাজে সবার জন্য সমান সুযোগ একটি বাস্তব ধারণা?
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: সমসুযোগের সমাজ গঠনে বর্ণবাদ, নাকি মেধাতন্ত্র—কোনটি বড় বাধা, তা নিয়ে আমি তর্ক করব না। শুধু বলতে চাই, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে স্কলাস্টিক অ্যাসেসমেন্ট টেস্ট (এসএটি) ও কলেজ বোর্ডের রিপোর্টে দেখা যায়, যারা এসএটি পরীক্ষায় ৭৫০ বা এর বেশি স্কোর করেছে, তাদের অধিকাংশের বাবা-মা কমপক্ষে স্নাতক পাস। (যুক্তরাষ্ট্রের অভিজাত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হতে একজন শিক্ষার্থীর গড়ে ৭৫০ এসএটি স্কোর করতে হয়। অভিজাত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একসঙ্গে আইভি লিগ হিসেবে পরিচিত।) সে বছর এসএটি পরীক্ষায় ৭৫০ বা তার বেশি স্কোর করা শিক্ষার্থীদের দেড় হাজারেরই বাবা-মা ছিলেন স্নাতক পাস।
আপনি আরও দেখতে পাবেন, হাইস্কুল পাস করেননি এমন মা-বাবার সন্তানদের মধ্যে এসএটি পরীক্ষায় ৭৫০ বা তার বেশি স্কোর করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশ নগণ্য ও হতাশাজনক। এই সংখ্যা এতই কম যে সেখানে পরিসংখ্যানের কৌশলগুলোও খুব একটা খাটে না। কিন্তু শুধু সংখ্যার দিকে তাকালে আপনি দেখবেন, সে বছর এমন শিক্ষার্থী ছিল মাত্র ৩২ জন।
তাহলে এখানে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে আপনার মা-বাবা বা অভিভাবকের শিক্ষাগত যোগ্যতা আপনার এসএটি স্কোর ঠিক করে দিচ্ছে। এটিই নির্ধারণ করে দিচ্ছে যে আপনি আইভি লিগ কলেজে পড়তে পারবেন কি না। এ-ও তো মেধাতন্ত্রই। একই সঙ্গে এটি সমসুযোগের পথে এক অবিশ্বাস্য বাধাও।
একটি প্রতিযোগিতামূলক সমাজ গঠন কি সম্ভব, যেখানে এমন সুযোগের প্রাপ্যতা বাধাগ্রস্ত হবে না?
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: আমি মনে করি সম্ভব। এখানেই আমি শিক্ষাকে Excellent Education ও Superior Education—এ দুই ধারায় বিভাজনের কথা বলি। Excellent Education হলো এমন এক শিক্ষা, যা একজন মানুষকে এমন কিছুতে দক্ষ করে তুলবে, যার অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে। অন্যদিকে Superior Education হবে এমন এক শিক্ষা, যা একজন ব্যক্তিকে অর্থনৈতিক গুরুত্ব নির্বিশেষে অন্যদের তুলনায় কোনো কিছুতে দক্ষ করে তুলবে।
(বোঝার সুবিধার্থে আমরা এখানে Excellent Education বলতে প্রায়োগিক শিক্ষা এবং Superior Education বলতে উন্নত শিক্ষা বলব।)
এখন এমন এক সমাজের কথা ভাবুন, যেখানে বিস্তৃত পরিসরে প্রায়োগিক শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে সমাজের জন্য দরকারি সব কাজে মানুষকে প্রশিক্ষিত করতে ভালো বিনিয়োগ রয়েছে, যেখানে সমাজের জন্য দরকারি সব কাজে দক্ষদেরই নিযুক্ত করা হয়। সেই সমাজ হবে একধরনের মেধাতান্ত্রিক সমাজ, যেখানে শিক্ষা ও কাজকে এমনভাবে কাঠামোবদ্ধ করা হয়, যেখানে দক্ষ ও একটু বেশি দক্ষের মধ্যে তেমন পার্থক্য করার সুযোগ থাকে না।
এমন সমাজের বাস্তব নজির হতে পারে জার্মানি। কিন্তু আমাদের (মার্কিন) সমাজ জোর দেয় উন্নত শিক্ষার ওপর। এই ব্যবস্থা এমন ব্যক্তিদের ব্যাপক সুবিধা দেয়, যারা কিছু লোক বা অধিকাংশ লোক থেকে এমন সব বিষয়ে এগিয়ে, যার কোনো অর্থনৈতিক গুরুত্ব নেই। এটা অনেকটা হাইটেক ফাইন্যান্সে পণ্ডিত হওয়ার মতো, যার কোনো সামাজিক মূল্য নেই বলে মনে করেন অধিকাংশ অর্থনীতিবিদই।
অথচ এ বিষয়ে ভালো হলে একজন বছরে মিলিয়ন ডলার কামাতে পারে। আর এতে একেবারে দক্ষ হয়ে উঠলে সব ধরনের জটিল কাজে দক্ষ হওয়া তো বটেই, বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব ধরনের ডিগ্রিই হাতের মুঠোয় চলে আসবে। অথচ মূল্যহীন। আর আমরা এমনই এক সমাজে আজ বাস করছি।
এবার আমি একটু আপনার পেছনের বক্তব্যর দিকে যেতে চাই। আপনি বলছিলেন, সুবিধাপ্রাপ্তদের জন্যও মেধাতন্ত্র ভালো কিছু নয়। যেহেতু বিষয়টি সাধারণ জ্ঞানের বিপরীত। এই কথাটা অনেক পাঠকের মনেই দাগ কাটবে। আপনি বিষয়টি কি আরেকটু বিশ্লেষণ করবেন?
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: আমরা মেতে উঠেছি বিজয়ী হওয়ার খেলায়। কিন্তু জয়ী হতে হলে প্রতিযোগিতা করতে হয়। আর সেই বিজয়কে টিকিয়ে রাখতে গেলে দরকার পড়ে কল্পনাতীত প্রতিযোগিতার। আমি বলতে চাইছি, অভিজাত বিদ্যালয়গুলো গত ২০-৫০ বছরের চেয়ে অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক হয়েছে। আর অভিজাত পেশাগুলো হয়ে পড়েছে আরও তীব্র প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র। আর এর একটা মাশুল আছে। আমি মনে করি, সুখী মানুষ হতে সবচেয়ে বড় বাধা এখন এই অসম প্রতিযোগিতা।
মেধাতান্ত্রিকেরা ভীষণ এক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের। এসব পরীক্ষায় পাস করতে প্রতিনিয়ত নিজেদের নবায়ন করতে হয়। তারা যেন নিজেকে বেচতে বের হওয়া এক ব্যবস্থাপক, যার সম্পদের তালিকায় শুধু তারা নিজেরাই আছে। নিজের জীবন থেকেই তারা যেন বিতাড়িত।
আপনি ইয়েলে পড়ান। আপনার আশপাশে অভিজাতদের আনাগোনা রয়েছে বেশ। আপনার চোখে কি এমন অভিজাত (অন্তত একজন) পড়েছে, যিনি বা যাঁরা তাঁদের সুযোগ-সুবিধার জন্য মানসিক চাপে রয়েছেন? কারণ, আমি মনে করি, সমাজটাকে পুনর্বিন্যাস করলে যাঁদের হারানোর রয়েছে সবচেয়ে বেশি, তাঁরা সমাজটা যেমন আছে তেমনই থাকতে দেওয়ার পক্ষপাতী। তার পরও আপনার বইটিতে আমরা যখন দেখি, এই অভিজাতরাই মধ্যবিত্তদের সঙ্গে নিয়ে নেমে পড়বেন সমাজকে পুনর্বিন্যাস করতে, তখন বিষয়টি আমার কাছে কিছুটা ইউটোপিয়ান মনে হয়েছে।
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: এটা শুনতে কেমন লাগে তাই না? নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা তবে বলি। দু-এক বছর আগে ইয়েল ল স্কুলে মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে একটি জরিপ হয়েছিল। সেখানে অংশ নেওয়াদের ৭০ শতাংশই বলেছিল, তারা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে। একই ধরনের ফল পাওয়া গিয়েছিল অন্য অভিজাত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেও। অর্থাৎ, অভিজাত শিক্ষার্থীরা আসলে সুখে নেই, তারা ভালো নেই।
বিশ বছর আগে আমি যখন এখানে পড়ানো শুরু করি, তখন শিক্ষার্থীরা অনেক আত্মবিশ্বাসী ছিল। তাদের দেখে মনে হতো, যেন তারা সোনার টিকিট পেয়ে গেছে। এখনকার শিক্ষার্থীদের দেখে কিন্তু তেমন মনে হয় না। এখনকার শিক্ষার্থীদের দেখলে মনে হয়, তাদের এখানে আসার পথে কঠিন সামরিক শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। এবং তারা এটাও জানে যে, পড়া শেষে তারা কর্মক্ষেত্রে যখন যাবে, সেখানেও একই শাস্তি অপেক্ষা করছে। এসব তারা কখনই চায় না।
এখনকার শিক্ষার্থীরা এটাও ভালোভাবে জানছে যে, তাদের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কারণে অন্যরা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিষয়টি তাদের নৈতিক পীড়ার কারণ। এসব তাদের জন্য আসলেই ভালো কিছু নয়। এখান থেকে পাস করে কেউ হয়তো ভালো ক্যারিয়ার পাবে। কিন্তু তার জীবনের বাকি অনুষঙ্গগুলো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। আমি মনে করি আমার ছাত্ররা বিষয়টি এখন বোঝে।
এই মেধাতন্ত্রের জন্য অনভিজাতদের কী মূল্য দিতে হচ্ছে? মেধাতন্ত্রই-বা কীভাবে তাদের প্রান্তিক করে তুলেছে?
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: আমি মনে করি এখানে তিন ধরনের মূল্য দিতে হয় অনভিজাতদের। প্রথমত, অনভিজাতরা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে না, এমনকি তাদের সন্তানেরাও নয়। একটা অভিজাত পরিবারের তুলনায় একটি দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবার সন্তানের শিক্ষার পেছনে কী এমন ব্যয় করতে পারে?
দ্বিতীয়ত, অভিজাতরা শ্রমবাজারেও সর্বনাশ করছে। চাকরির বাজার পুনর্বিন্যাস করছে অভিজাতরা। আগে মধ্যবিত্তরা যেসব চাকরি করত, উচ্চ বেতনের সেসব চাকরি এখন তাদের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। যাদের ওই শ্রেণিতে যোগাযোগ নেই, তারা বাদ পড়ছে। কোডাক কোম্পানির কথাই ভাবুন, যেখানে ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ কর্মরত ছিল। আজকের বাজারে একই অর্থমূল্যর কোম্পানি ইনস্টাগ্রাম চলে ১৩ জন কর্মী দিয়ে (যখন ফেসবুক ১ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ইনস্টা কিনেছিল)। এই ১৩ জন হলো অতি দক্ষ অভিজাত কর্মী, যারা মধ্যবিত্তদের সংখ্যাকে সংকুচিত করেছে।
তৃতীয়ত, মেধাতান্ত্রিক সমাজে মানুষ যে কাঠামোগতভাবেই সুষম-সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং ঝরে পড়ছে, সে বিষয়টিকে ব্যক্তিগত ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানকে বলা হচ্ছে, তুমি যদি ভালো চাকরি না পাও, তা তোমার অযোগ্যতা। তুমি হার্ভার্ডে পড়তে পারোনি? তাও তোমার অযোগ্যতা। এসব আসলে ফালতু কথা। আর এসব ফালতু কথাই আজকের এই মতবাদ প্রতিনিয়ত বলছে।
আপনার কথাগুলো বেশ যুক্তিসংগত। তবু এই ব্যবস্থা থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে আমি চিন্তিত। আমরা কি সম্পূর্ণ এক রাজনৈতিক-অর্থনীতি ও নৈতিকতা নিয়ে আলাপ করছি না?
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: ভুল বলেননি হয়তো। মেধাতন্ত্রের শিকড়ের দিকে তাকালে আপনি দেখবেন ১৮৩৩ সালের দিকে ইংরেজি ভাষাভাষীদের দুনিয়ায় এই ব্যবস্থার সূচনা। ওই সময় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে প্রবেশ ও পদোন্নতির বিষয়টি ব্যক্তির সামাজিক বা বংশগত পরিচয়ের বদলে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে কার্যকর করা শুরু হয়।
আর সেই ১৮৩৩ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ১৫০ বছর লেগেছে মানুষের গোটা সমাজ ও অর্থনীতিকে ঢেলে সাজাতে। এই করতে গিয়ে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান, প্রযুক্তি, সরকারব্যবস্থা, নীতিসহ সব পরিসরে বদল আনতে হয়েছে। তাই এই ব্যবস্থা থেকে বের হওয়াটা রাতারাতি হবে না। কয়েক প্রজন্ম লাগতে পারে শুধু কল্পনায় এই ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতেই, যেই পরিবর্তন আমাদের সামগ্রিক সত্তাকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাবে।
আমি জানি, আমার কথাগুলো শুনে আপনার মনে হতে পারে, যা কখনো পাওয়া সম্ভব না, তাই নিয়ে বকবক করছি। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থাটি দিনে দিনে আরও বেশি অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এতে খুব দ্রুতই মৌলিক পরিবর্তন আসবে মানুষের চিন্তায়, আকাঙ্ক্ষায়, উৎপাদনব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠান, ভোগসহ সামগ্রিক জীবনযাপনে। আর এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে প্রতিনিয়ত নিজেদের বর্তমান ব্যবস্থার সমালোচনার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ ব্যবস্থা কী হতে পারে, তা নিয়ে কথা বলতে হবে।
যে পরিবর্তনের কথা আপনি বলছেন, সেটা বর্ণনার জন্য উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। তবে এটি ব্যক্তির চেতনায় একটা বিপ্লব দাবি করে। সর্বোপরি মানুষের প্রয়োজন, আকাঙ্ক্ষা ও ভীতির ধরন বদলে যাবে।
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: মানুষের এখনই বোঝা উচিত যে, আজকাল তারা যা কিছু চায়, তা আসলে তাদের জন্য ভালো কিছু নয়। তাদের অতৃপ্তির পেছনের কারণ কী, তাঁদের সন্তানদের অতৃপ্তির পেছনের কারণ কী, তা আগে খুঁজে বের করতে হবে। তার পরই শুধু তারা বিকল্প খুঁজে পাবে।
তাই আমাদের নীতিনির্ধারকদের কাজ হলো কিছু বিকল্প পদ্ধতি তৈরি করা, যা সুবিধাবঞ্চিতদের স্বপ্নপূরণে সহায়তা করবে। এ জন্য অভিজাত বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনভিজাতদের সন্তানদের ব্যাপকভাবে পড়াশোনার সুযোগ করে দিতে হবে, যাতে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই প্রথম সুষম-সুযোগের বীথিকা হয়ে ওঠে।
সাক্ষাৎকার শেষ করার আগে একটি অপ্রিয় প্রশ্ন করতে চাই। আমরা যদি এই মেধাতন্ত্রকে উপড়ে না ফেলি, সমাজ যেই সুরে গান গাইছে, তাতেই তাল দিতে থাকি, আর অসাম্যকেই সহ্য করে যাই, তবে কী হতে পারে?
ডেনিয়েল মার্কোভিটস: আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না। তবে যে সমাজে কিছু মানুষ প্রচুর সুযোগ-সুবিধা আর সম্পদ পেয়ে বসে থাকে, সেই সমাজ অন্য দেশের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত না হলে বা অভ্যন্তরীণ বিপ্লব ছাড়া মৌলিক পরিবর্তনের মুখ দেখে না। আর এমন কিছুই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি জানি না কখন বা কীভাবে এসব ঘটবে। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে আপনাকে বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
এই সাক্ষাৎকার আমেরিকান সংবাদমাধ্যম ভক্সে প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর।
ইউনিক গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাখাওয়াত হোসেন। পর্যটনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি মনজুরুল ইসলাম।
০৩ অক্টোবর ২০২৪বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, সুফি এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কোনো বিভাজনমূলক এজেন্ডায় রাজনীতির দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত না হওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা দৃঢ়ভাবে কোনো সাম্প্রদায়িক ফাঁদে আটকা পড়তে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করি। কোনোভাবেই তা হতে দেওয়া যাবে না।
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪‘আমি এটাকে ঠিক রাজনৈতিক ভাবাদর্শ বলব না। আমি এটাকে বলব, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, সেটা আমার পারিবারিক শিক্ষা। আমাদের ঘরের ডাইনিং টেবিল থেকে শুরু করে যেকোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজনে পরিবারের বড়দের সাথে আমরা দ্বিমত পোষণ করতে পেরেছি। ছোট থেকে বড়, কারও কোনো কথা বা কাজ ভুল মনে হলে সেটাকে আমরা তার প্রতি স
৩১ আগস্ট ২০২৪একেক মানুষ বেছে নেন একেক পেশা। তাঁদের মধ্যে কারও কারও পেশা একটু ভিন্ন ধরনের। যেমন—মো. মুনসুর আলী ওরফে মন্টু খলিফা। বাপ-দাদার পেশাকে ভালোবেসে শিশুদের খতনা করানো বা হাজামের কাজ বেছে নিয়েছেন পেশা হিসেবে। জীবনে পার করেছেন প্রায় ৮৫ বছর। জানিয়েছেন গত ৬০ বছরে ২ লাখের বেশি শিশুর মুসলমানি বা সুন্নতে খতনা দিয়
৩০ মার্চ ২০২৪