মসজিদে মুমিনের ১৫ কর্তব্য

ড. এ এন এম মাসউদুর রহমান
প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৩, ১০: ০০

মুসলিম সমাজের অন্যতম নিদর্শন মসজিদ। পৃথিবীর বুকে মসজিদ আল্লাহর ঘর, যাতে তাঁর প্রতি সম্মান ও ভক্তি প্রদর্শনের জন্য মাথা নত করে সিজদা করা হয়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান মসজিদ এবং সর্বনিকৃষ্ট স্থান বাজার।’ (তিরমিজি) মসজিদে মুমিনের কী কী দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে, তা লিখেছেন ড. এ এন এম মাসউদুর রহমান

মসজিদ আবাদ করা
প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব হলো, ইবাদতের মাধ্যমে মসজিদ আবাদ করা, প্রাণবন্ত ও চালু রাখা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘একমাত্র তারাই আল্লাহর মসজিদগুলো আবাদ করবে, যারা আল্লাহ ও কিয়ামতের দিনের প্রতি ইমান রাখে, নামাজ কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না।’ 
(সুরা তাওবা: ১৮)

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা
আল্লাহর ঘর এবং ইবাদতের উত্তম স্থান হিসেবে মসজিদ পরিষ্কার রাখা মুমিনের দায়িত্ব। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম যে তোমরা তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকুকারী-সিজদাকারীদের জন্য আমার ঘর পবিত্র করো।’ (সুরা বাকারা: ১২৫)। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মসজিদের আবর্জনা পরিষ্কার করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে ঘর তৈরি করেন।’ (ইবনে মাজাহ) 

উত্তম পোশাক পরা
নামাজ আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনকারী ইবাদত। তাই এই সময় সুন্দর পোশাক ও মার্জিত সাজসজ্জা করা জরুরি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে বনি আদম, তোমরা প্রতিটি নামাজে সাজসজ্জা (সুন্দর পোশাক) গ্রহণ করো।’ (সুরা আরাফ: ৩১)। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ নামাজে দাঁড়াবে, তবে সে যেন সুন্দর পোশাক পরে।’ (তাবারানি)

দুর্গন্ধযুক্ত খাবার পরিহার করা
যেসব খাবার খেলে মুখে গন্ধ হয়, সেগুলো খেয়ে মসজিদে যাওয়া যাবে না। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি পেঁয়াজ-রসুন বা এ-জাতীয় সবজি খাবে, সে যেন আমাদের মসজিদের কাছেও না আসে। কেননা মানুষ যেসব কারণে কষ্ট পায়, ফেরেশতারাও একই কারণে কষ্ট পায়।’ (মুসলিম) অবশ্য পেঁয়াজ-রসুন বা এ-জাতীয় গন্ধযুক্ত কিছু খেয়ে ভালোভাবে মুখ পরিষ্কার করে দুর্গন্ধমুক্ত হয়ে এলে কোনো অসুবিধা নেই।

মসজিদে ঢোকা ও বের হওয়ার শিষ্টাচার মান্য করা
মসজিদে ডান পায়ে প্রবেশ করা এবং বাঁ পায়ে বের হওয়া সুন্নত। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যখন তুমি মসজিদে প্রবেশ করবে, তখন ডান পায়ে শুরু করা এবং যখন মসজিদ থেকে বের হবে, তখন বাম পায়ে শুরু করা তোমার জন্য সুন্নত।’ (মুস্তাদরাক আল-হাকিম)। প্রবেশকালে পড়তে হয় ‘আল্লাহুম্মাফতাহলি আবওয়াবা রাহমাতিকা’ এবং বের হওয়ার সময় পড়তে হয় ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা মিন ফাদলিকা।’

ধীরস্থিরভাবে মসজিদে যাওয়া
মসজিদে যাওয়ার সময় তাড়াহুড়ো না করে ধীরস্থিরভাবে যাওয়া উত্তম। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যখন তোমরা ইকামত শুনবে, তখন নামাজের দিকে চলতে থাকবে। তোমাদের উচিত, স্থিরতা ও গাম্ভীর্য অবলম্বন করা। তাড়াহুড়ো করবে না।’ (বুখারি)

তাহিয়্যাতুল মসজিদ আদায় করা
যেকোনো মসজিদই হোক তাতে প্রবেশের পর মসজিদের সম্মানার্থে দুই রাকাত নফল সালাত পড়া উত্তম। একে ইসলামের পরিভাষায় তাহিয়্যাতুল মসজিদ বলা হয়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে দুই রাকাত নামাজ আদায় না করে বসবে না।’ (বুখারি) 

ইতিকাফের নিয়তে অবস্থান করা
মসজিদে যতক্ষণ অবস্থান করা হয়, ততক্ষণ ইতিকাফের নিয়তে অবস্থান করা সুন্নত। এই অবস্থানের মুহূর্তটি নামাজের মধ্যে গণ্য হয়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কারও মসজিদে অপেক্ষা করাটা নামাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। কারণ সে নামাজের জন্যই বসে আছে।’ (বুখারি) 

ইমামের অনুসরণ করা
নামাজে মুসল্লিরা সব সময় ইমামকে অনুসরণ করবেন। কোনোভাবেই নামাজের কোনো কাজ ইমামের আগে করতে যাবেন না। মহানবী (সা.) বলেন, ‘নামাজ পরিপূর্ণ করার জন্য ইমাম নিযুক্ত করা হয়েছে। তিনি যখন রুকু করবেন, তখন তোমরাও রুকু করবে। তিনি যখন রুকু থেকে উঠবেন, তখন তোমরাও উঠবে। তিনি যখন নামাজে বসেন, তখন তোমরাও বসে নামাজ আদায় করবে।’ (বুখারি) 

আজানের পর মসজিদ ত্যাগ না করা
আজান হওয়ার পর বৈধ কারণ ছাড়া মসজিদ ত্যাগ করা জায়েজ নেই। মহানবী (সা.) বলেন, ‘আমার এই মসজিদে আজান শোনার পর প্রয়োজন ছাড়া কোনো লোক বাইরে গিয়ে ফিরে না এলে সে মুনাফিক।’ (তাবারানি)

মুসল্লিদের সামনে দিয়ে চলাচল না করা
নামাজরত মুসল্লিদের সামনে দিয়ে চলাচল করা নিষিদ্ধ। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যদি মুসল্লির সামনে দিয়ে চলাচলকারী ব্যক্তি জানত যে তার ওপর কী পরিমাণ বোঝা চেপেছে, তবে ‘‘চল্লিশ’’ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকাকেও সে প্রাধান্য দিত।’ বর্ণনাকারী বলেন, ‘আমি জানি না, তিনি চল্লিশ দিন নাকি চল্লিশ বছর বলেছেন।’ (বুখারি)

মসজিদকে চলার পথ হিসেবে ব্যবহার না করা
ইবাদত-বন্দেগি, জিকির-আসকার ছাড়া মসজিদকে অন্য কাজে ব্যবহার করা অনুচিত; বিশেষ করে মসজিদকে চলাচলের রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই। মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা মসজিদকে রাস্তা হিসেবে গ্রহণ কোরো না। কেননা সেটা জিকির ও নামাজের জন্য।’ (তাবারানি) 

হারানো বস্তু না খোঁজা এবং বেচাকেনা না করা
মসজিদে হারানো বস্তুর ঘোষণা দেওয়া অথবা বেচাকেনা করা জায়েজ নেই। মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা মসজিদে কোনো লোককে বেচাকেনা করতে দেখলে বলবে, আল্লাহ যেন তোমার ব্যবসায় লাভ না দেন। আর মসজিদে কোনো বস্তু হারানোর ঘোষণা শুনলে তোমরা বলবে, আল্লাহ তা যেন ফিরিয়ে না দেন।’ (তিরমিজি) 

অপবিত্র অবস্থায় মসজিদে অবস্থান না করা
যার জন্য গোসল ফরজ হয়ে গেছে, তার পবিত্র হওয়া ছাড়া মসজিদে অবস্থান করা জায়েজ নেই। মহানবী (সা.) বলেন, ‘ঋতুস্রাবযুক্ত নারী এবং অপবিত্র ব্যক্তির জন্য মসজিদে অবস্থান করা আমি বৈধ মনে করি না।’ (আবু দাউদ) 

অহেতুক কথাবার্তা না বলা
অন্যের ইবাদত ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোনো অনর্থক ও দুনিয়াবি কথা মসজিদে বলা জায়েজ নয়। মসজিদে চুপচাপ থাকাও ইবাদত। মহানবী (সা.) বলেন, ‘এমন এক সময় আসবে, যখন মানুষ মসজিদে দুনিয়াবি কথা বলবে, তখন তোমরা তাদের সঙ্গে বোসো না।’ (বুখারি)
একইভাবে বর্তমানে মোবাইল ফোন বন্ধ রাখাও মুসল্লির অন্যতম কর্তব্য। কারণ মসজিদে মোবাইল ফোন বাজলে তা ইবাদতের পরিবেশ নষ্ট করে। তাই মসজিদে প্রবেশের আগে বা যখনই খেয়াল হয়, তখনই মোবাইল বন্ধ করা জরুরি। 

লেখক: অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত