জাহীদ রেজা নূর
নিউইয়র্ক সেন্ট্রাল পার্ক প্রথম দেখেছিলাম ‘হোম অ্যালোন’ ছবিতে। পরিবারের সঙ্গে বের হয়েও ভুল প্লেনে চড়ে নিউইয়র্কে চলে এসেছিল কেভিন। বাবার ক্রেডিট কার্ড হাতে থাকায় বিশাল পাঁচতারা হোটেলে এসে উঠতে পেরেছিল সে। সে হোটেলের পাশেই সেন্ট্রাল পার্ক। সেখানে এক ডাইনি বুড়ির মতো নারীকে দেখেছিল কেভিন, যার কাঁধে বসে থাকে কবুতর! সিনেমার শেষে দেখা যায়, এই রহস্যময় নারীই রক্ষা করে কেভিনকে।
নিউইয়র্কে দেখার মতো যে স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, তার একটি হলো প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর। এই জাদুঘর ঘুরে দেখে প্রথমবারের মতো গিয়েছিলাম সেন্ট্রাল পার্কে। সেটা ২০১৮ সাল। বিশাল সে পার্কে কত ধরনের নতুন বিষয় যে ছিল! যেমন, খুবই অবাক হয়েছিলাম রিকশা দেখে। পার্কেরই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় রিকশায় করে যাওয়া যায়। তবে বিনা পয়সায় নয়। ফেলো কড়ি, মাখো তেল। নিউইয়র্ক তো পর্যটকদের তীর্থ স্থান। কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকেরা এই শহর দেখতে আসে।
গত বছর করোনা যখন সারা পৃথিবীতেই কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ, তখন কিছুদিনের জন্য এসেছিলাম নিউইয়র্কে। সে সময় রাস্তাঘাটে চলাচলকারী প্রত্যেকের মনেই ভয়। সেই ভয়ের মধ্যেই বসন্তের একটা দিন বেছে নিয়ে আমরা চলে গিয়েছিলাম সেন্ট্রাল পার্কে। ফুলে আর রঙিন পাতায় সেজেছিল পার্কটি। তার কিছু ছবি করোনাকালের স্মৃতি হয়ে থাকবে। সে সময় মেট্রোর বগিতে দূরত্ব নিয়ে বসতে হতো। সে এক সময় গেছে।
এই মে মাসে নিউইয়র্কবাসীর জন্য সুখবর আছে। দুই ডোজ ভ্যাকসিন যারা নিয়েছেন, তাঁদের উদ্দেশে নিউইয়র্কের গভর্নর কুমো বলেছেন, এখন থেকে ভ্যাকসিন নেওয়া নাগরিকেরা মাস্ক ছাড়াই চলাচল করতে পারবেন। তবে ১৫০ জনের বেশি মানুষ একসঙ্গে জমায়েত না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে। নিউইয়র্কে করোনায় মৃত্যুর হার কমে গেছে। কিন্তু মানুষ এখনো সতর্ক। চলতি পথে গত শুক্রবার ২০৪ নম্বর স্ট্রিট আর হিলসাইড অ্যাভিনিউয়ের মোড়টায় ডানকিন ডোনাটের কাছে এক বৃদ্ধাকে দেখলাম মাস্কবিহীন চলছেন। ওই একজনকেই দেখলাম। আর কাউকে মাস্ক ছাড়া দেখিনি এই সাত দিনে।
কুইন্স ভিলেজ এলাকায় নানা বর্ণের মানুষের বাস। মিশ্র সংস্কৃতি জায়গাটিকে বিশেষায়িত করেছে। যদিও এশিয়ান ও আফ্রিকান মানুষের সংখ্যা বেশি, তারপরও লাতিন বংশোদ্ভূত মানুষ অলক্ষ্যণীয় নয়। এ কথা সবাই জানেন, গোটা নিউইয়র্কে শ্বেতাঙ্গ মানুষের সংখ্যা ৪০ শতাংশেরও কম। তাদের একটা বড় অংশ থাকেন স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে। কোথায় লাতিন মানুষ বেশি থাকে, কোথায় আফ্রিকান, কোথায় এশিয়ান—সে কথা ধীরে ধীরে বলব। আর চীনা মানুষদের বসবাসের ইতিহাসও জানাব। নিউইয়র্ক এক বিশাল শহর। এক এক জায়গার এক এক গল্প। তারই মধ্যে ম্যানহাটন জাদু–বাস্তবতার জন্ম দেয়।
বলে রাখা ভালো, সবাই সিনেমায় চাকচিক্যময় যে শহরটি দেখে, সেটি কিন্তু নিউইয়র্কের পূর্ণ পরিচয় নয়। নিউইয়র্ক বাস করে প্রতিটি মোড়ের ভাঁজে ভাঁজে। পর্যটক থেকে যখন কেউ স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায় এই শহরের, তখন সে ভুলে যায়, এই তো কিছুদিন আগে অকারণেই বিনয়ী কোনো নাগরিক তাকে ‘স্যরি’ বলেছিল। ‘স্যরি’ বললে যে কেউ ছোট হয় না, কিংবা শব্দটি উচ্চারণ করে যে আনন্দ পায়, সে কথা ধীরে ধীরে ভুলে যেতে থাকে মার্কিন নাগরিকত্বের ছাপ পড়ে যাওয়া মানুষ। তারা বুঝতে শেখে—এটাই নিয়ম।
বাঙালিপাড়ার মধ্যে জ্যাকসন হাইটসের কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। সেটা নিয়ে আলাদাভাবে লিখব। এখানে শুধু বলে রাখি, জ্যাকসন হাইটসের অনেক দোকানেই ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষায় লেখা আছে দোকানের নাম। দোকানের মালিক, ম্যানেজার থেকে শুরু করে সেলসম্যানেরাও বাঙালি। এখানে ইংরেজির অনুপ্রবেশ প্রায় নিষিদ্ধ। কালেভদ্রে বাংলা না জানা কেউ যদি ঢুকে পড়ে এসব দোকানে, তখন ইংরেজি বলার দরকার পড়ে। অবশ্য সে জন্য ‘ইয়েস–নো–ভেরি গুড’ পর্যন্ত বিদ্যা থাকলেই হয়। এ কথা অনায়াসেই এখন বলতে পারি, এমন অনেক বাঙালি আছেন নিউইয়র্কে, যারা বাংলাতেই তাদের বাতচিৎ সারেন। অন্য কোনো ভাষার সাহায্য তাকে নিতে হয় না।
কী করে তা সম্ভব—এই প্রশ্ন করতেই পারেন আপনি।
উত্তর দিচ্ছি।
একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রাথমিকভাবে কী কী লাগে?
থাকার একটা জায়গা, রান্নাবান্না, কেনাকাটা, চিকিৎসা। বাড়ি থাকলে রান্নার জায়গাও থাকবে। তাই এ জন্য আর কারও ওপর নির্ভর করার প্রয়োজন নেই। কেনাকাটার জন্য রয়েছে বাঙালির দোকান, এক বর্ণ ইংরেজি না জেনে কেনাকাটা করা যাচ্ছে। চিকিৎসক বেছে নেওয়ার সুবিধা আছে। দেশি ডাক্তারের কাছে যেতে পারেন তিনি। এর পর চলাচল। যারা এ ধরনের জীবনে অভ্যস্ত, তারা নিজ বাড়ি আর কর্মক্ষেত্র ছাড়া আর কোথাও খুব একটা যান না। গেলেও কোনো বাঙালি ভাইবোনের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন, মেট্রো বা সাবওয়ের কোন স্টপেজে নামবেন। দু–একবার যাওয়ার পর তা মুখস্থ হয়ে যায়।
বললাম এ কারণে যে, যদি কেউ নিউইয়র্কে এসে ইংরেজি না জেনেও সারা জীবন থাকতে চান, তবে তিনি অনায়াসে থাকতে পারবেন। অবশ্য এখানকার মূলধারায় ঢুকে যাওয়া বাঙালিও দুর্লক্ষ্য নয়। সে কথা আরেকদিন।
নিউইয়র্কে এক টুকরো রাশিয়া
রাশিয়ায় ছিলাম দশ বছর। তাই যেকোনোভাবে সে দেশটির সঙ্গে যোগাযোগে এক ধরনের তৃপ্তি পাই। এখানেও কিছু কিছু জায়গা আছে রুশ অধ্যুষিত। যেমন ব্রাইটন বিচ এলাকা। কোনো পর্যটক একবার এখানে এসে পড়লে সংশয়ে পড়ে যেতে পারে—এটা সত্যিই আমেরিকা তো? নাকি রাশিয়া? এখানকার শতকরা ৯০ জন মানুষ রুশ অভিবাসী।
এখানকার ফরেস্ট হিলস এলাকায়ও রুশ দেশ থেকে আসা মানুষের বসবাস। ফরেস্ট হিলসে যারা থাকে, তারা বেশ বড়লোক। বাড়িগুলো দেখেই বোঝা যায়, চাকচিক্যের মধ্যে থাকতেই পছন্দ করে এরা। আর রুশ খাবার–দাবারের যে দোকানগুলো রয়েছে, তা দেখে মনে হয়, যারা অভিবাসী হয়েছে, তাদের অন্তত খাবার–দাবারের ব্যাপারে নস্টালজিয়ায় ভুগতে হবে না।
ফরেস্ট হিলস নিয়েই আজ থাকি। কেউ নিউইয়র্কে এলে এবং এই এলাকায় গেলে বাড়তি কিছু সব সময়ই পাবেন। ১৯৮০ সালের দিকে ফরেস্ট হিলসের জনসংখ্যায় দেখা গেল রাশানদের কর্তৃত্ব। এখানে বাড়তে থাকে রুশদের সংখ্যা। আমরা বলেছি, নিউইয়র্কের ব্রাইটন বিচে সবচেয়ে বেশি রুশ ভাষাভাষীর বসবাস। আকারের দিক থেকে ফরেস্ট হিলস রুশ ভাষাভাষীদের দ্বিতীয় আশ্রয়।
ব্রাইটন বিচে মূলত এসেছে ওদেসা ও রাশিয়া আর ইউক্রেনের ছোট শহরগুলো থেকে মানুষ। তারা এসেছে বৈচিত্র্য ও আনন্দময় জীবনের সন্ধানে। এসেছে নানা ধরনের মুখরোচক সসেজ খাওয়ার জন্য। অন্যদিকে ফরেস্ট হিলে মূলত এসে আবাস গড়েছে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। এর পর যারা এসেছে, তারা আত্মীয়–স্বজন যেখানে আছে, সেখানেই করেছে বসতবাড়ি।
এ রকম সময় একটা ঘটনা ঘটল। ব্রাইটন বিচ আর ফরেস্ট হিলসের রুশরা আলাদা হয়ে যেতে শুরু করল। ব্রাইটন বিচে বসবাসকারী রুশেরা সমুদ্রপাড়ের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগল, সেখানে গড়ে উঠতে লাগল রাশান দোকানপাট। রেস্তোরাঁ, মদ্যপানের আসরগুলো বসতে লাগল রাশিয়ার মতোই। অর্থাৎ, জীবনযাপনে তারা রয়ে গেল রুশ সংস্কৃতির অধীনেই। অন্যদিকে ফরেস্ট হিলসের রুশ অভিবাসীরা নিউইয়র্কের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগল। সে সময় এ এলাকার বাসিন্দাদের অর্ধেকই ছিল ইহুদি। আর অর্ধেক ছিল ইতালীয়, লাতিন আমেরিকান, এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে আসা মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বহুসংখ্যক ইহুদি জার্মানি থেকে পাড়ি জমিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। তাদের বড় একটা অংশ থিতু হয়েছিলেন নিউইয়র্কের ফরেস্ট হিলসে। এরা ইংরেজিটা বলত খুব ভালো। এর পর রুশ দেশ থেকে আসা মানুষেরা ঠাঁই করে নিলেন ১০৮ নম্বর স্ট্রিটে।
জমির দাম বাড়তে থাকায় ফরেস্ট হিলসের স্থবির জীবনে দেখা দিল চঞ্চলতা। অভিবাসীরা মওকা পেয়ে গেলেন আরও একটু ভালো থাকার। নিজেদের বাড়ি ভালো দামে বিক্রি করে এই শহরের অন্যত্র কিংবা এই স্টেটের অন্য কোনো শহরে পাড়ি জমালেন। কেউ কেউ চলে গেলেন লং আইল্যান্ডে, অনেকে বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ায় চলে গেলেন সন্তানদের কাছে। কেউ কেউ চলে গেলেন দুনিয়া ছেড়ে। চলে যাওয়া এই মানুষদের জায়গা যারা দখল করল, তাদের বলা হয় বুখারার ইহুদি। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে তাজিকিস্তান আর উজবেকিস্তানে যখন রাজনৈতিক সংকট বাড়তে শুরু করল, তখন বুখারার ইহুদি নামে খ্যাত এই মানুষেরা এলেন এখানে। ইহুদি ও মধ্য এশিয়া—উভয় সংস্কৃতির ধারক–বাহক এরা। ইসরায়েলের বাইরে এটাই ইহুদি সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় বসতি। বুখারার ইহুদিরা এই এলাকায় আসার পর থেকে ধীরে ধীরে এলাকাটি বদলে যেতে শুরু করে। এখন নিউইয়র্কের ধনী এলাকার একটি হচ্ছে ফরেস্ট হিল। এবং ফরেস্ট হিলের ১০৮ নম্বর রাস্তা কথা বলে রুশ ভাষায়।
নিউইয়র্ক সেন্ট্রাল পার্ক প্রথম দেখেছিলাম ‘হোম অ্যালোন’ ছবিতে। পরিবারের সঙ্গে বের হয়েও ভুল প্লেনে চড়ে নিউইয়র্কে চলে এসেছিল কেভিন। বাবার ক্রেডিট কার্ড হাতে থাকায় বিশাল পাঁচতারা হোটেলে এসে উঠতে পেরেছিল সে। সে হোটেলের পাশেই সেন্ট্রাল পার্ক। সেখানে এক ডাইনি বুড়ির মতো নারীকে দেখেছিল কেভিন, যার কাঁধে বসে থাকে কবুতর! সিনেমার শেষে দেখা যায়, এই রহস্যময় নারীই রক্ষা করে কেভিনকে।
নিউইয়র্কে দেখার মতো যে স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, তার একটি হলো প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর। এই জাদুঘর ঘুরে দেখে প্রথমবারের মতো গিয়েছিলাম সেন্ট্রাল পার্কে। সেটা ২০১৮ সাল। বিশাল সে পার্কে কত ধরনের নতুন বিষয় যে ছিল! যেমন, খুবই অবাক হয়েছিলাম রিকশা দেখে। পার্কেরই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় রিকশায় করে যাওয়া যায়। তবে বিনা পয়সায় নয়। ফেলো কড়ি, মাখো তেল। নিউইয়র্ক তো পর্যটকদের তীর্থ স্থান। কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকেরা এই শহর দেখতে আসে।
গত বছর করোনা যখন সারা পৃথিবীতেই কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ, তখন কিছুদিনের জন্য এসেছিলাম নিউইয়র্কে। সে সময় রাস্তাঘাটে চলাচলকারী প্রত্যেকের মনেই ভয়। সেই ভয়ের মধ্যেই বসন্তের একটা দিন বেছে নিয়ে আমরা চলে গিয়েছিলাম সেন্ট্রাল পার্কে। ফুলে আর রঙিন পাতায় সেজেছিল পার্কটি। তার কিছু ছবি করোনাকালের স্মৃতি হয়ে থাকবে। সে সময় মেট্রোর বগিতে দূরত্ব নিয়ে বসতে হতো। সে এক সময় গেছে।
এই মে মাসে নিউইয়র্কবাসীর জন্য সুখবর আছে। দুই ডোজ ভ্যাকসিন যারা নিয়েছেন, তাঁদের উদ্দেশে নিউইয়র্কের গভর্নর কুমো বলেছেন, এখন থেকে ভ্যাকসিন নেওয়া নাগরিকেরা মাস্ক ছাড়াই চলাচল করতে পারবেন। তবে ১৫০ জনের বেশি মানুষ একসঙ্গে জমায়েত না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে। নিউইয়র্কে করোনায় মৃত্যুর হার কমে গেছে। কিন্তু মানুষ এখনো সতর্ক। চলতি পথে গত শুক্রবার ২০৪ নম্বর স্ট্রিট আর হিলসাইড অ্যাভিনিউয়ের মোড়টায় ডানকিন ডোনাটের কাছে এক বৃদ্ধাকে দেখলাম মাস্কবিহীন চলছেন। ওই একজনকেই দেখলাম। আর কাউকে মাস্ক ছাড়া দেখিনি এই সাত দিনে।
কুইন্স ভিলেজ এলাকায় নানা বর্ণের মানুষের বাস। মিশ্র সংস্কৃতি জায়গাটিকে বিশেষায়িত করেছে। যদিও এশিয়ান ও আফ্রিকান মানুষের সংখ্যা বেশি, তারপরও লাতিন বংশোদ্ভূত মানুষ অলক্ষ্যণীয় নয়। এ কথা সবাই জানেন, গোটা নিউইয়র্কে শ্বেতাঙ্গ মানুষের সংখ্যা ৪০ শতাংশেরও কম। তাদের একটা বড় অংশ থাকেন স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে। কোথায় লাতিন মানুষ বেশি থাকে, কোথায় আফ্রিকান, কোথায় এশিয়ান—সে কথা ধীরে ধীরে বলব। আর চীনা মানুষদের বসবাসের ইতিহাসও জানাব। নিউইয়র্ক এক বিশাল শহর। এক এক জায়গার এক এক গল্প। তারই মধ্যে ম্যানহাটন জাদু–বাস্তবতার জন্ম দেয়।
বলে রাখা ভালো, সবাই সিনেমায় চাকচিক্যময় যে শহরটি দেখে, সেটি কিন্তু নিউইয়র্কের পূর্ণ পরিচয় নয়। নিউইয়র্ক বাস করে প্রতিটি মোড়ের ভাঁজে ভাঁজে। পর্যটক থেকে যখন কেউ স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায় এই শহরের, তখন সে ভুলে যায়, এই তো কিছুদিন আগে অকারণেই বিনয়ী কোনো নাগরিক তাকে ‘স্যরি’ বলেছিল। ‘স্যরি’ বললে যে কেউ ছোট হয় না, কিংবা শব্দটি উচ্চারণ করে যে আনন্দ পায়, সে কথা ধীরে ধীরে ভুলে যেতে থাকে মার্কিন নাগরিকত্বের ছাপ পড়ে যাওয়া মানুষ। তারা বুঝতে শেখে—এটাই নিয়ম।
বাঙালিপাড়ার মধ্যে জ্যাকসন হাইটসের কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। সেটা নিয়ে আলাদাভাবে লিখব। এখানে শুধু বলে রাখি, জ্যাকসন হাইটসের অনেক দোকানেই ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষায় লেখা আছে দোকানের নাম। দোকানের মালিক, ম্যানেজার থেকে শুরু করে সেলসম্যানেরাও বাঙালি। এখানে ইংরেজির অনুপ্রবেশ প্রায় নিষিদ্ধ। কালেভদ্রে বাংলা না জানা কেউ যদি ঢুকে পড়ে এসব দোকানে, তখন ইংরেজি বলার দরকার পড়ে। অবশ্য সে জন্য ‘ইয়েস–নো–ভেরি গুড’ পর্যন্ত বিদ্যা থাকলেই হয়। এ কথা অনায়াসেই এখন বলতে পারি, এমন অনেক বাঙালি আছেন নিউইয়র্কে, যারা বাংলাতেই তাদের বাতচিৎ সারেন। অন্য কোনো ভাষার সাহায্য তাকে নিতে হয় না।
কী করে তা সম্ভব—এই প্রশ্ন করতেই পারেন আপনি।
উত্তর দিচ্ছি।
একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রাথমিকভাবে কী কী লাগে?
থাকার একটা জায়গা, রান্নাবান্না, কেনাকাটা, চিকিৎসা। বাড়ি থাকলে রান্নার জায়গাও থাকবে। তাই এ জন্য আর কারও ওপর নির্ভর করার প্রয়োজন নেই। কেনাকাটার জন্য রয়েছে বাঙালির দোকান, এক বর্ণ ইংরেজি না জেনে কেনাকাটা করা যাচ্ছে। চিকিৎসক বেছে নেওয়ার সুবিধা আছে। দেশি ডাক্তারের কাছে যেতে পারেন তিনি। এর পর চলাচল। যারা এ ধরনের জীবনে অভ্যস্ত, তারা নিজ বাড়ি আর কর্মক্ষেত্র ছাড়া আর কোথাও খুব একটা যান না। গেলেও কোনো বাঙালি ভাইবোনের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন, মেট্রো বা সাবওয়ের কোন স্টপেজে নামবেন। দু–একবার যাওয়ার পর তা মুখস্থ হয়ে যায়।
বললাম এ কারণে যে, যদি কেউ নিউইয়র্কে এসে ইংরেজি না জেনেও সারা জীবন থাকতে চান, তবে তিনি অনায়াসে থাকতে পারবেন। অবশ্য এখানকার মূলধারায় ঢুকে যাওয়া বাঙালিও দুর্লক্ষ্য নয়। সে কথা আরেকদিন।
নিউইয়র্কে এক টুকরো রাশিয়া
রাশিয়ায় ছিলাম দশ বছর। তাই যেকোনোভাবে সে দেশটির সঙ্গে যোগাযোগে এক ধরনের তৃপ্তি পাই। এখানেও কিছু কিছু জায়গা আছে রুশ অধ্যুষিত। যেমন ব্রাইটন বিচ এলাকা। কোনো পর্যটক একবার এখানে এসে পড়লে সংশয়ে পড়ে যেতে পারে—এটা সত্যিই আমেরিকা তো? নাকি রাশিয়া? এখানকার শতকরা ৯০ জন মানুষ রুশ অভিবাসী।
এখানকার ফরেস্ট হিলস এলাকায়ও রুশ দেশ থেকে আসা মানুষের বসবাস। ফরেস্ট হিলসে যারা থাকে, তারা বেশ বড়লোক। বাড়িগুলো দেখেই বোঝা যায়, চাকচিক্যের মধ্যে থাকতেই পছন্দ করে এরা। আর রুশ খাবার–দাবারের যে দোকানগুলো রয়েছে, তা দেখে মনে হয়, যারা অভিবাসী হয়েছে, তাদের অন্তত খাবার–দাবারের ব্যাপারে নস্টালজিয়ায় ভুগতে হবে না।
ফরেস্ট হিলস নিয়েই আজ থাকি। কেউ নিউইয়র্কে এলে এবং এই এলাকায় গেলে বাড়তি কিছু সব সময়ই পাবেন। ১৯৮০ সালের দিকে ফরেস্ট হিলসের জনসংখ্যায় দেখা গেল রাশানদের কর্তৃত্ব। এখানে বাড়তে থাকে রুশদের সংখ্যা। আমরা বলেছি, নিউইয়র্কের ব্রাইটন বিচে সবচেয়ে বেশি রুশ ভাষাভাষীর বসবাস। আকারের দিক থেকে ফরেস্ট হিলস রুশ ভাষাভাষীদের দ্বিতীয় আশ্রয়।
ব্রাইটন বিচে মূলত এসেছে ওদেসা ও রাশিয়া আর ইউক্রেনের ছোট শহরগুলো থেকে মানুষ। তারা এসেছে বৈচিত্র্য ও আনন্দময় জীবনের সন্ধানে। এসেছে নানা ধরনের মুখরোচক সসেজ খাওয়ার জন্য। অন্যদিকে ফরেস্ট হিলে মূলত এসে আবাস গড়েছে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। এর পর যারা এসেছে, তারা আত্মীয়–স্বজন যেখানে আছে, সেখানেই করেছে বসতবাড়ি।
এ রকম সময় একটা ঘটনা ঘটল। ব্রাইটন বিচ আর ফরেস্ট হিলসের রুশরা আলাদা হয়ে যেতে শুরু করল। ব্রাইটন বিচে বসবাসকারী রুশেরা সমুদ্রপাড়ের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগল, সেখানে গড়ে উঠতে লাগল রাশান দোকানপাট। রেস্তোরাঁ, মদ্যপানের আসরগুলো বসতে লাগল রাশিয়ার মতোই। অর্থাৎ, জীবনযাপনে তারা রয়ে গেল রুশ সংস্কৃতির অধীনেই। অন্যদিকে ফরেস্ট হিলসের রুশ অভিবাসীরা নিউইয়র্কের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগল। সে সময় এ এলাকার বাসিন্দাদের অর্ধেকই ছিল ইহুদি। আর অর্ধেক ছিল ইতালীয়, লাতিন আমেরিকান, এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে আসা মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বহুসংখ্যক ইহুদি জার্মানি থেকে পাড়ি জমিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। তাদের বড় একটা অংশ থিতু হয়েছিলেন নিউইয়র্কের ফরেস্ট হিলসে। এরা ইংরেজিটা বলত খুব ভালো। এর পর রুশ দেশ থেকে আসা মানুষেরা ঠাঁই করে নিলেন ১০৮ নম্বর স্ট্রিটে।
জমির দাম বাড়তে থাকায় ফরেস্ট হিলসের স্থবির জীবনে দেখা দিল চঞ্চলতা। অভিবাসীরা মওকা পেয়ে গেলেন আরও একটু ভালো থাকার। নিজেদের বাড়ি ভালো দামে বিক্রি করে এই শহরের অন্যত্র কিংবা এই স্টেটের অন্য কোনো শহরে পাড়ি জমালেন। কেউ কেউ চলে গেলেন লং আইল্যান্ডে, অনেকে বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ায় চলে গেলেন সন্তানদের কাছে। কেউ কেউ চলে গেলেন দুনিয়া ছেড়ে। চলে যাওয়া এই মানুষদের জায়গা যারা দখল করল, তাদের বলা হয় বুখারার ইহুদি। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে তাজিকিস্তান আর উজবেকিস্তানে যখন রাজনৈতিক সংকট বাড়তে শুরু করল, তখন বুখারার ইহুদি নামে খ্যাত এই মানুষেরা এলেন এখানে। ইহুদি ও মধ্য এশিয়া—উভয় সংস্কৃতির ধারক–বাহক এরা। ইসরায়েলের বাইরে এটাই ইহুদি সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় বসতি। বুখারার ইহুদিরা এই এলাকায় আসার পর থেকে ধীরে ধীরে এলাকাটি বদলে যেতে শুরু করে। এখন নিউইয়র্কের ধনী এলাকার একটি হচ্ছে ফরেস্ট হিল। এবং ফরেস্ট হিলের ১০৮ নম্বর রাস্তা কথা বলে রুশ ভাষায়।
১৯৫১ সাল। ইরানের রাজা রেজা শাহ পাহলভি এলেন পৃথিমপাশা জমিদারবাড়িতে। সে এক হুলুস্থুল ব্যাপার! এ বাড়ির পূর্বপুরুষেরা ইরান থেকে এসেছিলেন বলে জানা যায়।
২ দিন আগেশীতে কাপড় ভালো রাখতে সেগুলোকে যেমন রোদে মেলে দিতে হয়, সম্পর্ক উন্নয়নে মাঝেমধ্যে তেমনি ভ্রমণেও যেতে হয়। শীত চলে এসেছে। ভ্রমণপ্রেমীরা হয়ে উঠেছেন সরব।
২ দিন আগেপর্যটন বন্ধে কারফিউ! হ্যাঁ, তেমনটিই ঘটেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। গ্রামের নাম বুকচন হ্যানোক। দক্ষিণ কোরিয়ার জংনো জেলায় এর অবস্থান। বুকচন হ্যানোক দেশটির ‘মাস্ট ভিজিট’ পর্যটন গন্তব্য।
২ দিন আগেভ্রমণের স্বাদ একবার রক্তে ঢুকলে, তা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। এক অদৃশ্য তাড়না কাজ করতে থাকে ভেতরে-ভেতরে।
২ দিন আগে