Ajker Patrika

কিশোরী কন্যাদের ওপর মায়েরা এত বিরক্ত কেন

আপডেট : ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৭: ২৬
কিশোরী কন্যাদের ওপর মায়েরা এত বিরক্ত কেন

কৈশোর মানেই বয়ঃসন্ধিকাল। এই বয়সে লিঙ্গনির্বিশেষে বাল্যকালের মধুর কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। পরিবর্তন আসে আচরণে। না শিশু, না প্রাপ্তবয়স্ক— কোনো দলেই আর জায়গা হয় না। আদরের শিশুর হঠাৎ এই পরিবর্তনে অভিভাবকেরাও সহজবোধ করেন না। আর হঠাৎ আদরে ভাটা পড়ে যাওয়া কিশোর-কিশোরী চারপাশের পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতেও হিমশিম খায়। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন, ‘তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই!’

কৈশোরের এই জটিল সন্ধিক্ষণ কখনো কখনো পারিবারিক সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব ফেলে। সম্পর্কে দূরত্বের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি করে চোখে পড়ে মা-মেয়ের মধ্যে। এই সময়টাতে কিশোরীর প্রাইভেসি অর্থাৎ ব্যক্তিগত গোপনীয়তা-জ্ঞান টনটনে হয়।

সম্পর্কের ব্যবধান শুরু হয় কিশোরী মেয়ের হুট করেই দূরত্ব বজায় রেখে চলার প্রবণতার মাধ্যমে। কিশোর বয়সে পরিবারকে সময় দেওয়ার চেয়ে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে, একা নিজের ঘরে বা হাল আমলে স্মার্টফোনে সময় কাটাতেই বেশি পছন্দ করে কিশোরী। মায়েরা যতই শাসনের দণ্ড শক্ত করে ধরেন, মেয়েরা আরও বেশি দূরে সরে যায়। তারা আরও স্বাধীনতা চায়, স্বাতন্ত্র্য চায়। পান থেকে চুন খসলেই অভিমান করে। আচরণের এ বৈপরীত্য দুজনের সম্পর্ক রেষারেষিতে রূপ নেয়। 

কৈশোরের কয়েকটি বছর মা-মেয়ের মধ্যে শোনা যায় শত অভিযোগ অনুযোগের ফিরিস্তি। মায়েরা কিশোরী কন্যার ঘন ঘন মেজাজ পরিবর্তন, অযৌক্তিক আচরণ, অকারণে বিরক্তি প্রকাশ এবং কষ্ট দিয়ে কথা বলা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে থাকেন। কিশোরীরা মায়ের শাসনে বিরক্ত হয়। শুধু ভাবে, মা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছেন, মা তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে চান না, দুজনের বোঝাপড়ার ঘাটতি, ওজর-আবদার শুনতে মায়ের অনিচ্ছা, কথা না শুনলেই চিৎকার-চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তোলেন—মায়ের বিরুদ্ধে এমন একগাদা অভিযোগ নিয়ে বসে থাকা তারা।

মায়ের প্রতি কিশোরীদের বিরূপ আচরণের কারণ
মায়েরা আশা করে বসে থাকেন, এ সময়টাতে মেয়ে তাঁর সঙ্গে আরও খোলাখুলি কথা বলবে, মাকে সময় দেবে। তাঁরা আশা করেন, মায়ের সঙ্গে এ সময়টাতে তাঁদের যেমন সম্পর্ক ছিল, মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আরও মধুর হবে। কিন্তু বাস্তবে তা সাধারণত হয় না। কাঙ্ক্ষিত বাস্তবতার দেখা না পেয়ে মায়েরা হতাশ হন, মেয়েকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান। 

খেয়াল রাখতে হবে, কিশোরীর আচরণ ও মেজাজ যদিও হুট করেই উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়, তাহলে এটি শুধু হরমোনের প্রভাবের কারণে নয়; বরং বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থা বা বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তার মতো মানসিক স্বাস্থ্যজনিত কোনো সমস্যা। এ ক্ষেত্রে কোনো পেশাদার চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। 

যেসব কারণে কিশোরীদের বিরূপ আচরণ দেখা দিতে পারে—

স্বাধীন হওয়ার ইচ্ছা
বয়ঃসন্ধিকাল হলো এমন একটা সময়, যখন মেয়েদের মধ্যে ‘ব্যক্তিত্ব’ বা ‘অহং’ সম্পর্কে ধারণা গড়ে ওঠে। তারা এ সময় বেশ কয়েকটি ব্যক্তিত্ব ও পরিচয় নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায়। নিজেকে বোঝার চেষ্টা করে যে কোন ব্যক্তিত্ব তাকে মানায়। ব্যক্তিত্বের এ ঘন ঘন পরিবর্তনকে অনেক মা-বাবা বেয়াড়া আচরণ বলে ধরে নেন। 

এ ধরনের আচরণের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে হবে যে, এটা তার নিজেকে প্রকাশেরই ধরন কি না। তাকে তার পোশাক, কাজকর্ম ও নিজেকে প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে।

বয়ঃসন্ধিকাল ও মস্তিষ্কের বিকাশ
কৈশোরের সময়টাতে অনেকেই নানা রকম হরমোন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। মেয়েদের মধ্যে এর প্রভাব বেশি দেখা যায়। এ সময় তাদের মেজাজের ঘন ঘন পরিবর্তন দেখা যায়, তারা আবেগপ্রবণও হয় বেশি। এ কারণে তাদের মুহূর্তেই হাসতে দেখা যায়, আবার পরক্ষণেই কাঁদতে দেখা যায়। আবেগ-অনুভূতির এ পরিবর্তনের কারণে তারা অন্যের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে সহজে। 

তাই এ সময় তাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা না করে এই আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে মানিয়ে চলা শেখাতে হবে। 

আধুনিক হয়ে ওঠার তাড়না
কৈশোরের সময়টাতে হাল ফ্যাশনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার একটা প্রবণতা থাকে। সব কিশোরীর মনেই একটি তাড়না থাকে, তাকে যেন অন্যদের চেয়ে আলাদা এবং অবশ্যই সেরা দেখা যায়। হাল ফ্যাশনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পারলে সে হীনম্মন্যতায় ভুগতে থাকে। হীনম্মন্যতা ক্রমে বিষণ্নতায়, উদ্বিগ্নতায় ও আত্মহননের চিন্তায় পর্যবসিত হয়। 

এ প্রতিযোগিতা শুধু ফ্যাশনের ক্ষেত্রেই নয়, পড়ালেখায়, সামাজিক অবস্থানে, বন্ধুবান্ধবের কাছে গুরুত্ব পাওয়ার মতো নানা বিষয়ে। ফলে ঘরের বাইরে নানা দিক থেকেই মানসিক চাপ বোধ করে তারা। এ সময়টাতে ব্যর্থতার শঙ্কা তাকে আতঙ্কগ্রস্ত করে রাখে।

কিশোরীর মা-বাবা হিসেবে এ ধরনের চাপ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে এবং তাদের এ সময়ের সঙ্গে মানিয়ে চলা শেখাতে হবে। মায়েরা এসব ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারেন। তাঁরা কিশোরীকে নিজের যত্ন নেওয়া, আত্মবিশ্বাস তৈরি ও নিজেকে মূল্যায়ন করার উপায় দেখিয়ে দিতে পারেন। 

আর কিছু না হলেও, কখনো শুধু মনোযোগ দিয়ে তার কথা শোনার মাধ্যমেও তাকে সহযোগিতা করা যায়। কিশোরীর দৃষ্টিভঙ্গি ও সমস্যা মায়েদের কাছে নগণ্য মনে হতে পারে। কিন্তু এ সময় তাদের আবেগ থাকে বেশি। তাই সমাধান না করতে পারলেও তার কথা শোনা এবং সহমর্মী হওয়া প্রয়োজন। 

অন্যদের সঙ্গে তাল মেলানোর প্রবণতা
বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরীরা পরিবারের চেয়ে বন্ধুবান্ধবকে সময় দিতে বেশি পছন্দ করে। তাই বন্ধুদের সঙ্গে মানানসই পোশাক, জুতা, মোবাইল ফোন ইত্যাদি চাহিদা তৈরি হয় কিশোরীদের মধ্যে। এ তাল মিলিয়ে চলার প্রবণতার কারণে তারা ধীরে ধীরে মা-বাবার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। কখনো কখনো চাহিদা পূরণ না হলে অবাধ্য হয়ে উঠতে পারে। অনেক কিশোরীই পরিবারের আর্থিক অবস্থাকে গ্রাহ্য করতে চায় না বা পরিস্থিতির গুরুত্ব অনেক সময় তারা অনুধাবন করতে পারে না। 

বন্ধুদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার প্রবণতা কিশোরীদের মধ্যে সাধারণ একটি বৈশিষ্ট্য। এতে ব্যর্থ হলে তাদের আচরণে অসহিষ্ণুতা দেখা দিতে পারে।

কিশোরীদের এসব আচরণ ব্যক্তিগতভাবে না নেওয়াটা জরুরি। একসময় তারা বাবা-মায়ের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। কিছু কিশোরীর এ অনুধাবন জলদি হয়, কারও ক্ষেত্রে দেরিতে। 

যোগাযোগ
কিশোরীদের যোগাযোগদক্ষতা কিশোরদের তুলনায় দ্রুত বিকশিত হয়। তবে অনেকে তা কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে না। কিশোরীদের বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে দেখা যায়, তারা এককথায় এবং প্রায় একই ধরনের যেমন: হুম, জানি তো, যাহোক—ইত্যাদি উত্তর দেয়। এটি প্রায়ই মায়েদের কাছে বিরক্তির কারণ হয়। মেয়েদেরও মায়ের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ থাকে। এভাবে সম্পর্কের মধ্যে টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়। তর্ক, ঝগড়া ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। 

কিশোরীরা তাদের আবেগ, অনুভূতি, চাহিদা ব্যক্ত করতে তেমন পটু হয় না। তারা যোগাযোগকে অনেক সময় অন্যকে নিয়ন্ত্রণের উপায় হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। এ কারণে তারা অপরপক্ষের আগ্রহ বুঝতে পারলে সম্পূর্ণ তথ্য দিতে চায় না।

এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে মায়েরা যা করতে পারেন তা হলো, বিষয়টি নিয়ে আর কথা না বাড়ানো। এটা মনে হওয়াটা স্বাভাবিক যে এই বয়সী মেয়েদের অনেক কিছু শেখার আছে, তার অনেক কিছু শুধরে দেওয়ার আছে। কিন্তু এটিও মাথায় রাখতে হবে যে এই সময়টাতে কিশোরীর জীবনে প্রতিটা দিন অনেক কিছু ঘটছে এবং বহু পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে সে যাচ্ছে। কখনো কখনো সমস্ত খ্যাপাটে স্বভাবের প্রশ্রয় চায়। তারা তাদের স্বভাবের বিপরীতে কোনো মন্তব্য শুনতে প্রস্তুত থাকে না। কেবল নিজের কথা বলতে চায়। 

তাই তাদের বলতে দেওয়া উচিত। যোগাযোগের ধরন যেমনই হোক, তা একেবারে বিচ্ছিন্ন করা উচিত নয়।

নিয়ম ও সীমা নির্ধারণ
কিশোরীরা ভাবে, তারা সব জানে। কিন্তু তারা অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সচেতন থাকে না। এদিকে মায়েরা তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে সচেতন করতে চান এবং সব বিষয়েই আতঙ্কিত থাকেন। দুজনের এ বৈপরীত্য মতবিরোধে রূপ নিতে পারে। 

কিশোরীরা মনে করে, ঘরের নিয়মশৃঙ্খলা তাদের জীবন উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত করছে। তবে এসব সীমা নির্ধারণ ও নিয়মশৃঙ্খলা কিশোরীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, দায়িত্ববোধ ও কর্মের পরিণতি জ্ঞান তৈরি করার জন্য আবশ্যক। এতে তাদের মধ্যে জবাবদিহি তৈরি হয়। 

তবে নিয়মশৃঙ্খলা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশি কঠোরতা অবলম্বন করলে কিশোরীদের মধ্যে বিপ্লবী ভাব দেখা দিতে পারে। তাই সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে নমনীয় হতে হবে। 

ব্যক্তিগত সমস্যা
কিশোর বয়সে মেয়েদের ‘ব্যক্তিগত জীবনের’ শুরু হয়, যা সম্পর্কে অনেক মা-ই সচেতন থাকেন না। বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক, বাইরে কোনো অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা, অন্যদের সঙ্গে তাল মেলানোর প্রতিযোগিতা বা অন্য কোনো চাপ—অনেক কিছুই তার মানসিক অবস্থায় প্রভাব ফেলতে পারে। 

ঘরের বাইরেও যে তার একটি পৃথিবী গড়ে উঠছে, সে সম্পর্কে মায়েদের সহানুভূতিশীল হতে হবে। বাইরের পৃথিবীর নতুন নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য তার যে পরামর্শ প্রয়োজন, তা সবচেয়ে বেশি মায়ের কাছেই পাওয়া সম্ভব। কিশোরীদেরও অন্য সব প্রাপ্তবয়স্কের মতোই বাইরের চ্যালেঞ্জ, উৎকণ্ঠা, চাপ ইত্যাদি মোকাবিলা করতে হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মানুষের জীবনযাপনের ধরনের সঙ্গে এতটাই জড়িয়ে গেছে যে এর উল্লেখ ছাড়া কোনো আলোচনাই সম্পূর্ণ হয় না। বেশির ভাগ মায়েরই দাবি, তাঁরা সন্তানের অনলাইন কার্যকলাপ জানেন। তবে গবেষণা বলছে, ৭০ শতাংশ কিশোরই তাদের অনলাইন ব্যক্তিত্বকে পরিবারের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে। 

কিশোরীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হয় বেশি। নানা ধরনের ট্রেন্ডের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে তারা খাবারে অনীহা, নিজের ক্ষতি ও নিজেকে নিখুঁত হিসেবে উপস্থাপন করার প্রবণতার ফাঁদে পড়ে।

এ ছাড়া কিশোরীদের মধ্যে মোবাইল ফোনের প্রতি তীব্র আসক্তি দেখা দেয়। এটি তাদের ঘুম, খাওয়া, মেজাজ ও সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব ফেলে। 

কিশোরীদের সঙ্গে সম্পর্কে উন্নতি করতে চাইলে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে—এর দায়িত্বের গুরু ভাগ মায়েদেরই। নিজের অভিজ্ঞতা ও বর্তমান পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে। মনে রাখতে হবে, মেয়ের সব ভুলের দায় যেমন মায়েদের নয়, তেমন তাদের সব অর্জনের কৃতিত্বও মায়েদের নয়। 

সর্বোপরি যেকোনো পরিস্থিতিতে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না। একে অপরের কথা, অভিযোগ, অনুযোগ শোনার জন্য মনকে সব সময়কে উদার রাখতে হবে। বাঁধন ছিঁড়ে মুক্ত হওয়ার প্রবণতা মেয়ের; আর মায়ের দায়িত্ব হলো, তার জন্য অপেক্ষা করা, তার ফিরে আসার পথ খোলা রাখা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নেপালের মহাপরিকল্পনায় এভারেস্ট রক্ষা পাবে তো?

ফিচার ডেস্ক, ঢাকা 
আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯: ১৪
এভারেস্ট ধীরে ধীরে ‘বিশ্বের উচ্চতম ডাস্টবিনে’ পরিণত হচ্ছে, এই আন্তর্জাতিক সমালোচনা বন্ধ করতে নেপাল সরকার নিয়েছে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ। ছবি: ফ্রিপিক
এভারেস্ট ধীরে ধীরে ‘বিশ্বের উচ্চতম ডাস্টবিনে’ পরিণত হচ্ছে, এই আন্তর্জাতিক সমালোচনা বন্ধ করতে নেপাল সরকার নিয়েছে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ। ছবি: ফ্রিপিক

সাগরপৃষ্ঠ থেকে ৮ হাজার ৮৪৮ দশমিক ৮৬ মিটার উঁচু মাউন্ট এভারেস্ট শৃঙ্গটি মানুষের অদম্য সাহসের শেষ সীমানা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এসব তকমা ও শ্বেতশুভ্র সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক করুণ চিত্র। ২০০০ সালে জাপানি পর্বতারোহী কেন নগুচি যখন এভারেস্টে প্রথম সংগঠিত পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করেন, তখন তিনি যা দেখেছিলেন, তা ছিল রীতিমতো মর্মান্তিক। নগুচি বলেছিলেন, ‘টিভিতে এভারেস্টের যে সুন্দর ছবি দেখতাম, ভেবেছিলাম পাহাড়টি তেমনই হবে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি চারদিকে শুধু আবর্জনা।’ সেই শুরু; নগুচি ২০০০ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে প্রায় ৯০ টন বর্জ্য সরিয়েছিলেন। কিন্তু আজ এখন সমস্যাটি আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

সম্প্রতি নেপাল সরকার প্রথমবারের মতো একটি ব্যাপক নীতিমালাসহ এভারেস্ট ক্লিনিং অ্যাকশন প্ল্যান (২০২৫-২০২৯) ঘোষণা করেছে। এভারেস্ট যে ধীরে ধীরে ‘বিশ্বের উচ্চতম ডাস্টবিনে’ পরিণত হচ্ছে, সেই আন্তর্জাতিক সমালোচনা বন্ধ করতেই এই দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ।

ক্রমবর্ধমান অভিযাত্রীর চাপে নাজুক হয়ে পড়েছে এভারেস্টের পরিবেশ। ছবি: ফ্রিপিক
ক্রমবর্ধমান অভিযাত্রীর চাপে নাজুক হয়ে পড়েছে এভারেস্টের পরিবেশ। ছবি: ফ্রিপিক

সংকটের নেপথ্যে: প্লাস্টিক ও জলবায়ু পরিবর্তন

দশকের পর দশক ধরে আরোহী, গাইড এবং শেরপাদের ফেলে আসা অক্সিজেন সিলিন্ডার, প্লাস্টিকের বোতল, নাইলনের দড়ি এবং মানুষের মলমূত্রে পাহাড়ের ঢালগুলো বিষিয়ে উঠেছে; বিশেষ করে প্লাস্টিক এখন মূর্তিমান আতঙ্ক; একটি প্লাস্টিক ব্যাগ প্রকৃতিতে মিশে যেতে প্রায় ৫০০ বছর সময় নেয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বরফ গলে বেরিয়ে আসছে পুরোনো আবর্জনা এবং দীর্ঘদিনের চাপা পড়া মৃতদেহ, যা নিচের জনপদগুলোর পানীয় জলের উৎসকে দূষিত করছে।

নতুন পরিকল্পনা: একনজরে সরকারের রোডম্যাপ

খুম্বু হিমবাহের ওপর অবস্থিত বর্তমান বেস ক্যাম্পটি তাপমাত্রা ও আবর্জনার চাপে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ায় সেটি সরিয়ে নেওয়ার চিন্তা করছে নেপাল সরকার। ছবি: ফ্রিপিক
খুম্বু হিমবাহের ওপর অবস্থিত বর্তমান বেস ক্যাম্পটি তাপমাত্রা ও আবর্জনার চাপে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ায় সেটি সরিয়ে নেওয়ার চিন্তা করছে নেপাল সরকার। ছবি: ফ্রিপিক

নেপাল সরকারের সংস্কৃতি, পর্যটন ও বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় ঘোষিত পাঁচ বছর মেয়াদি এই পরিকল্পনায় বেশ কিছু বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো,

বেস ক্যাম্প স্থানান্তর: খুম্বু হিমবাহের ওপর অবস্থিত বর্তমান বেস ক্যাম্পটি ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা ও আবর্জনার চাপে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে। তাই এটি অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়া যায় কি না, তার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হবে।

বর্জ্য ফেরাতে কড়া নজরদারি: আরোহীদের ব্যবহৃত প্রতিটি সরঞ্জাম, মই ও দড়ির তালিকা এন্ট্রি পয়েন্টে জমা দিতে হবে এবং নামার সময় তা মিলিয়ে দেখা হবে। প্রত্যেক আরোহী দলকে তাদের ব্যবহৃত সব সরঞ্জাম এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ পুরোনো আবর্জনা পাহাড় থেকে নামিয়ে আনতে হবে।

ক্যাম্প-২-এ বর্জ্য সংগ্রহ কেন্দ্র: সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬ হাজার ৭৫০ মিটার উঁচুতে ক্যাম্প-২-এ বর্জ্য সংগ্রহের জন্য একটি অস্থায়ী কেন্দ্র করা হবে। এটি চেকপয়েন্ট হিসেবে কাজ করবে, যাতে উচ্চতর ক্যাম্পগুলোতে কেউ আবর্জনা ফেলে আসতে না পারে।

মাউন্টেন রেঞ্জার ও ড্রোন: পাহাড়ের ওপর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তদারক করতে প্রশিক্ষিত আরোহীদের নিয়ে একটি মাউন্টেইন রেঞ্জার দল গঠন করা হবে। এমনকি দুর্গম এলাকা থেকে আবর্জনা সংগ্রহে ড্রোনের ব্যবহারও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

আর্থিক নীতিমালা ও রয়্যালটি: বর্তমানে আরোহীদের ৪ হাজার ডলারের যে ডিপোজিট দিতে হয়, সেটিকে একটি অফেরতযোগ্য ফিতে রূপান্তরের প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনায়, যা সরাসরি পাহাড়ের কল্যাণে ব্যয় হবে। এ ছাড়া ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এভারেস্টের রয়্যালটি ১১ হাজার ডলার থেকে বাড়িয়ে ১৫ হাজার ডলার করা হয়েছে।

আদালতের আদেশ ও সচেতনতা

এই মহাপরিকল্পনা মূলত গত বছর দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের একটি আদেশের ফল। আদালত সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল পাহাড়ের ধারণক্ষমতা মেপে আরোহীদের পারমিট সংখ্যা নির্ধারণ করতে। এ ছাড়া ২০২৪ সাল থেকে বেস ক্যাম্পের ওপর ‘পুপ ব্যাগ’ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সরকার এখন পরিবেশ-সচেতনতাকে জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে অন্তর্ভুক্তির পরিকল্পনা করছে।

একটি বিশাল কর্মযজ্ঞের শুরু

২০২৪ সালের বসন্ত মৌসুমে এভারেস্ট থেকে প্রায় ৮৫ টন বর্জ্য এবং ২৮ টন মানুষের মলমূত্র সরানো হয়েছে। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ শেষ করতে বড় অঙ্কের বাজেট প্রয়োজন, যা ১০০ কোটি রুপি ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এভারেস্টের চূড়ায় আরোহীদের দীর্ঘ সারি আর যত্রতত্র আবর্জনার স্তূপ এখন বিশ্ববাসীর নজরে। এই পাঁচ বছরের মহাপরিকল্পনা কি পারবে বিশ্বের ছাদকে আবার তার আদি অকৃত্রিম রূপ ফিরিয়ে দিতে? সেটি সময় বলবে, তবে নেপাল সরকারের এই কাঠামোগত উদ্যোগ হিমালয়প্রেমীদের মনে আশার আলো জাগাচ্ছে।

সূত্র: দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

গম্বুজ তলে শব্দের মেলা, পাঁচ পাঠাগারের কাব্যিক অভিযাত্রা

ফিচার ডেস্ক
আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ১৭
তিয়ানজিন বিনহাই লাইব্রেরির বইয়ের তাকগুলো ঢেউয়ের মতো খেলে গেছে পুরো দেয়াল জুড়ে। ছবি: আজর ম্যাগাজিন
তিয়ানজিন বিনহাই লাইব্রেরির বইয়ের তাকগুলো ঢেউয়ের মতো খেলে গেছে পুরো দেয়াল জুড়ে। ছবি: আজর ম্যাগাজিন

বইয়ের পাতার মৃদু মর্মর আর শতাব্দীর প্রাচীন প্রতিধ্বনি। এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে এই সুর যেন একই সুতোয় গাঁথা। মেলবোর্ন থেকে রিও, বিশ্বের এই পাঁচটি অনন্য গ্রন্থাগার একটি বিশেষ দর্শনকে ধারণ করে আছে। পড়া মানে কেবল তথ্যের আহরণ নয়, বরং একটি বিশেষ স্থাপত্যের আবহে নিজেকে সঁপে দেওয়া। মঠের নিস্তব্ধতা থেকে শুরু করে প্রজাতন্ত্রী উদ্যোগ কিংবা ভবিষ্যতের কোনো স্বপ্নদর্শী প্রকল্প। এই সবকটি স্থাপনা আজ বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নগর সভ্যতার মাইলফলক। তাদের মূল সার্থকতা এখানেই যে, তারা বইকে কেবল তাকে সাজিয়ে রাখেনি বরং বইকে রূপান্তরিত করেছে এক একটি জীবন্ত পরিসরে। বইপ্রেমীদের জন্য পৃথিবীর সেরা সেই পাঁচটি লাইব্রেরি যেন পাঠ-স্বর্গের গল্প বলে। এই পাঁচটি লাইব্রেরি কেবল পড়ার জায়গা নয় বরং প্রতিটি বইপ্রেমীর জন্য একবার হলেও ঘুরে আসার মতো তীর্থস্থান।

স্টেট লাইব্রেরি অফ ভিক্টোরিয়া (মেলবোর্ন)

অস্ট্রেলিয়ার সাংস্কৃতিক রাজধানীর হৃদপিণ্ডে অবস্থিত এই গ্রন্থাগারটি জ্ঞানের এক বিশাল বাতিঘর। ১৮৫৬ সাল থেকে সবার জন্য উন্মুক্ত এই প্রতিষ্ঠানটি সংস্কৃতির অবাধ অধিকারের এক মূর্ত প্রতীক। এর মূল আকর্ষণ হলো ১৯১৩ সালে নির্মিত ’ট্রোব রিডিং রুম’। এক বিশাল ৩৫ মিটারের অষ্টভুজাকার গম্বুজের নিচে দাঁড়িয়ে মনে হবে আপনি কোনো এক আধুনিক উপাসনালয়ে আছেন। সরু সিঁড়ি দিয়ে যুক্ত এর উঁচু গ্যালারিগুলো কক্ষটির গম্ভীরতাকে এক অনন্য উচ্চতা দান করেছে। এডওয়ার্ডিয়ান স্থাপত্যের এই শ্রেষ্ঠ নিদর্শনটি গত এক শতাব্দী ধরে জ্ঞান বিনিময়ের এক জীবন্ত সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

১৮৫৬ সাল থেকে সবার জন্য উন্মুক্ত অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের স্টেট লাইব্রেরি অফ ভিক্টোরিয়া। ছবি: উইকিপিডিয়া
১৮৫৬ সাল থেকে সবার জন্য উন্মুক্ত অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের স্টেট লাইব্রেরি অফ ভিক্টোরিয়া। ছবি: উইকিপিডিয়া

তিয়ানজিন বিনহাই লাইব্রেরি (তিয়ানজিন)

দৃষ্টিভ্রম নাকি কোনো মায়াবী জগত? ২০১৭ সালে চীনে নির্মিত এই লাইব্রেরিটি পড়ার ঘরের চিরাচরিত ধারণা পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। এখানে সবকিছুই শুভ্র। এর বইয়ের তাকগুলো ঢেউয়ের মতো খেলে গেছে পুরো দেয়াল জুড়ে, যা কখনও সিঁড়ি আবার কখনও বসার আসনে পরিণত হয়েছে। তাকিয়ে থাকলে মনে হবে তাকগুলো বুঝি মিশে গেছে ছাদের কোনো অলীক শিল্পকর্মে। স্থাপত্যের ঠিক মাঝখানে রয়েছে এক বিশাল স্বচ্ছ গোলক, যার নাম দেওয়া হয়েছে ’দ্য আই’ বা ’চক্ষু’। ৩৩ হাজার বর্গমিটারের এই রেট্রো-ফিউচারিস্টিক প্রাঙ্গণে ১০ লক্ষেরও বেশি বই রয়েছে। ডাচ সংস্থা MVRDV-এর তৈরি এই স্থাপত্যটি নির্মাণ করতে সময় লেগেছে মাত্র তিন বছর।

লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস (ওয়াশিংটন)

আমেরিকার সবচেয়ে গম্ভীর এবং আভিজাত্যপূর্ণ স্থান হলো এর জেফারসন উইং। মার্বেল পাথরের কারুকাজ আর সোনালি রঙের ছটায় এখানে তৈরি হয়েছে এক রাজকীয় পরিবেশ। ঐতিহাসিক চরিত্রদের আবক্ষ মূর্তি আর মোজাইকের পথ ধরে যখন আপনি অষ্টভুজাকার রিডিং রুমে প্রবেশ করবেন, তখন চারপাশের বিশালাকার গম্বুজ আর নরম আলো আপনাকে এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে ফেলে দেবে। ১৭ কোটি ৫০ লক্ষ নথি ও বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে এটি বিশ্বের বৃহত্তম গ্রন্থাগার। বিরল পাণ্ডুলিপি থেকে শুরু করে কমিক বই কিংবা বিজ্ঞানের জটিল কাজ—সবই এখানে সাজানো আছে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত তাকে। পাথরের গায়ে এখানে খোদাই করা আছে আমেরিকার উচ্চাভিলাষের গল্প।

মার্বেল পাথরের কারুকাজ আর সোনালি রঙের ছটায় এখানে তৈরি হয়েছে লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস। ছবি: উইকিপিডিয়া
মার্বেল পাথরের কারুকাজ আর সোনালি রঙের ছটায় এখানে তৈরি হয়েছে লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস। ছবি: উইকিপিডিয়া

অ্যাডমন্ট মনাস্ট্রি লাইব্রেরি (অ্যাডমন্ট)

অস্ট্রিয়ার স্টাইরিয়া অঞ্চলের পাহাড়ি জনপদে ১৭৭৬ সাল থেকে টিকে আছে এই বারোক স্থাপত্যের বিস্ময়। সাতটি বিশাল গম্বুজের নিচে শিল্পী বার্তোলোমিও আলতোমন্তের আঁকা ফ্রেস্কো বা দেয়ালচিত্রগুলো লাইব্রেরিটিকে এক স্বর্গীয় রূপ দিয়েছে। ৪৮টি জানালা দিয়ে আসা আলো যখন বাঁকানো তাকগুলোতে সাজানো লুথারের বাইবেলসহ প্রায় ৭০ হাজার বইয়ের ওপর পড়ে, তখন এক অপার্থিব পরিবেশ তৈরি হয়। শিল্পী জোসেফ স্টামেলের খোদাই করা মূর্তি আর সাদা-কালো মার্বেলের মেঝে জ্ঞান আর শিল্পের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন ঘটিয়েছে এখানে।

বিবলিওটেকা ন্যাসিওনাল (রিও ডি জেনিরো)

এই গ্রন্থাগারের জন্ম হয়েছিল নির্বাসনের ইতিহাস থেকে। ১৮১০ সালে পর্তুগিজ রাজদরবার যখন লিসবন থেকে পালিয়ে রিওতে আশ্রয় নেয়, তখন তারা সাথে করে নিয়ে আসে বিশাল বইয়ের ভাণ্ডার। সেই সংগ্রহের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে নতুন বিশ্বের প্রথম বড় এই গ্রন্থাগার। বর্তমানে এখানে নথির সংখ্যা প্রায় ৯০ লক্ষ। ১৯১০ সালে রিও ব্রাঙ্কো অ্যাভিনিউতে নির্মিত হয় এর বিশাল নিওক্লাসিক্যাল ভবনটি। এর ভেতরে লোহার কারুকার্যময় ব্যালকনি, বিশালাকার থামের সারি আর সুউচ্চ অলিন্দগুলো আপনাকে মনে করিয়ে দেবে সেই রাজকীয় ঐতিহ্যের কথা।

সূত্র: ইএনভোলস

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

উত্তরের হিম রাজ্যে তুষারবিলাসের রোমাঞ্চ, হিমাঙ্কের নিচে তপ্ত রাত

ফিচার ডেস্ক
আইস হোটেল ৩৬ এর এবারের সবচেয়ে বড় চমক হলো বরফ দিয়ে খোদাই করা একটি পূর্ণাঙ্গ গ্র্যান্ড পিয়ানো। ছবি: আইসহোটেল ডটকম
আইস হোটেল ৩৬ এর এবারের সবচেয়ে বড় চমক হলো বরফ দিয়ে খোদাই করা একটি পূর্ণাঙ্গ গ্র্যান্ড পিয়ানো। ছবি: আইসহোটেল ডটকম

প্রকৃতি যখন শুভ্র তুষারের চাদরে নিজেকে ঢেকে নেয়, উত্তর গোলার্ধের হিমশীতল তন্দ্রা তখন জেগে ওঠে এক ক্ষণস্থায়ী বিস্ময়ে। যার নাম আইস হোটেল। বসন্তের আগমনে যারা নিভৃতে গলে মিশে যায় নদীর পানিতে, সেই বরফ প্রাসাদগুলোই এখন বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের কাছে শীতকালীন অভিযানের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। বসন্তের প্রথম ছোঁয়া লাগলেই এই তুষার প্রাসাদগুলো নিভৃতে গলে যায়। তখন তারা ফিরে যায় আপন উৎস, নদীর বুকে। আপনি কি কখনো হিমাঙ্কের নিচে এমন বরফের বিছানায় রাত কাটানোর অদম্য রোমাঞ্চ অনুভব করতে চেয়েছেন?

অনেকে ভাবেন, বরফের ঘরে ঘুমানো মানেই জমে যাওয়া। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। রুমের তাপমাত্রা থাকে প্রায় ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে পর্যটকদের দেওয়া হয় বিশেষ থার্মাল স্লিপিং ব্যাগ এবং রেইনডিয়ারের চামড়া, যা শরীরের স্বাভাবিক উষ্ণতা ধরে রাখে। বাথরুম বা পোশাক পরিবর্তনের জন্য পাশেই থাকে উত্তপ্ত আধুনিক ভবন। ২০২৫ সালের এই হাড়কাঁপানো মৌসুমেও সুইডেন, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড আর কানাডায় ফিরে এসেছে এই অনন্য ‘বরফবিলাস’।

ফিনল্যান্ডের আপুক্কা রিসোর্টের দেখামেলে কাঁচের ছাদের ইগলু থেকে শুরু করে তুষারাবৃত বনের মধ্য দিয়ে রেইনডিয়ারের যাত্রা। ছবি: আপুক্কা রিসোর্ট ডটকম
ফিনল্যান্ডের আপুক্কা রিসোর্টের দেখামেলে কাঁচের ছাদের ইগলু থেকে শুরু করে তুষারাবৃত বনের মধ্য দিয়ে রেইনডিয়ারের যাত্রা। ছবি: আপুক্কা রিসোর্ট ডটকম

আইস হোটেল ৩৬

বিশ্বের বিখ্যাত বরফ হোটেল আইস হোটেল ৩৬। প্রতিবছর এটি নতুন করে তৈরি করা হয় এবং এর প্রধান আকর্ষণ হলো বরফের ভাস্কর্য, বরফের ঘর, বরফের বার এবং আর্কটিক কার্যকলাপ; যেমন ডগ স্লেডিং ও নর্দান লাইট দেখা। সুইডিশ ল্যাপল্যান্ডের জুকাসজারভি ভিলেজে এ বছর উদ্বোধন করা হয়েছে আইস হোটেল ৩৬। নামের সংখ্যাটিই বলে দেয়, এটি তাদের ৩৬তম সংস্করণ। এবার এখানে ১২টি আর্ট স্যুট, আইস রুম, একটি প্রধান হল এবং সেরিমনি হল থাকবে। প্রতিবছর টোর্নে নদী থেকে বরফ সংগ্রহ করে হোটেলটি তৈরি করা হয়। বসন্তে এটি গলে নদীতে ফিরে যায়। এ বছরের সবচেয়ে বড় চমক হলো বরফ দিয়ে খোদাই করা একটি পূর্ণাঙ্গ গ্র্যান্ড পিয়ানো। অদ্ভুত শোনালেও সত্যি, এটি শুধু প্রদর্শনের জন্য নয়, রীতিমতো বাজানোর যোগ্য। ১২টি দেশের ৩৩ জন তুখোড় শিল্পী তাঁদের তুলির বদলে ছেনি-হাতুড়ির কারুকার্যে ফুটিয়ে তুলেছেন একেকটি কক্ষ বা আর্ট স্যুট। কোথাও দেয়ালে খোদাই করা হিমায়িত লাইব্রেরি, আবার কোথাও গোলকগুলো মাথার ওপর ভেসে থাকার বিভ্রম তৈরি করছে। জেনে রাখুন, এই হোটেলে দুজনের জন্য এক রাত কাটানোর খরচ পড়বে প্রায় ৬০০ ইউরো।

আল্পস পর্বতমালার ২,৭০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত সুইজারল্যান্ডের ইগলু-ডর্ফ জেরম্যাট। ছবি: ইগলু-ডর্ফ জেরম্যাট ডটকম
আল্পস পর্বতমালার ২,৭০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত সুইজারল্যান্ডের ইগলু-ডর্ফ জেরম্যাট। ছবি: ইগলু-ডর্ফ জেরম্যাট ডটকম

উত্তর মেরুর অন্যান্য বরফস্বর্গ

সুইডেনের বাইরেও ফিনল্যান্ড থেকে কানাডা পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে এই হিমাঙ্ক-বিজয়ীদের আস্তানা।

ফিনল্যান্ডের আপুক্কা রিসোর্ট: ল্যাপল্যান্ডের রোভানিয়েনিতে কাচের তৈরি ইগলুতে শুয়ে আকাশের ‘নর্দান লাইটস’ বা মেরুজ্যোতি দেখা এক স্বর্গীয় অনুভূতি। কাচের ছাদের ইগলু থেকে শুরু করে তুষারাবৃত বনের মধ্য দিয়ে রেইনডিয়ারের যাত্রা পর্যন্ত, আপুক্কা রিসোর্ট আপনার আর্কটিক স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়। আগস্ট থেকে এপ্রিল পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম চলবে। এখানে খরচ শুরু হয় ৪০০ ইউরো থেকে।

সুইজারল্যান্ডের ইগলু-ডর্ফ জেরম্যাট: আল্পস পর্বতমালার ২ হাজার ৭০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই ইগলু ভিলেজ। এই ইগলু গ্রামের অবস্থান এতটাই চমৎকার যে আপনি যখন এর রোদ-ঝলমলে বারান্দায় বসে কফি খাবেন কিংবা খোলা আকাশের নিচে উষ্ণ পানিতে হট টব বা ঘূর্ণি জলধারায় গা এলিয়ে দিতে পারবেন। আর আপনার ঠিক চোখের সামনে ধরা দেবে সুইজারল্যান্ডের সব থেকে আইকনিক পাহাড় ‘ম্যাটারহর্ন’। এখানে রাত কাটাতে লাগবে ৪৫০ ইউরো।

কানাডার হোটেল ডি গ্লেস: উত্তর আমেরিকার একমাত্র বরফ হোটেল এটি। এখানে কেবল থাকার ঘর নয়, রয়েছে বরফ-বার, হট টব এবং শরীর চাঙা করার সাউনা। পশমি চাদর, মেরুজ্যোতির আভা আর স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ নিস্তব্ধতার মাঝে হাতে খোদাই করা একটি স্যুটে রাত কাটানোর রোমাঞ্চই আলাদা। এখানে থাকার খরচ শুরু হয় ৫০০ ইউরো থেকে।

উত্তর আমেরিকার একমাত্র বরফ হোটেল কানাডার হোটেল ডি গ্লেস। ছবি: হোটেল ডি গ্লেস
উত্তর আমেরিকার একমাত্র বরফ হোটেল কানাডার হোটেল ডি গ্লেস। ছবি: হোটেল ডি গ্লেস

যেভাবে গড়া হয় তুষার প্রাসাদ

একটি আইস হোটেল তৈরি করা আর এক মহাকাব্য রচনা করা প্রায় একই কথা। এর প্রস্তুতি শুরু হয় সাত-আট মাস আগে থেকে। প্রথমে বরফ সংগ্রহের পালা। বসন্তের শেষে যখন বরফ সবচেয়ে স্বচ্ছ ও পুরু থাকে, তখন টর্ন রিভারের মতো নদীগুলো থেকে বিশাল বিশাল বরফের চাঁই কেটে নেওয়া হয়। এরপর সেগুলো সোলার পাওয়ারড হ্যাঙ্গারে যত্ন করে রাখা হয় পরবর্তী শীত পর্যন্ত। এরপর শুরু হয় নির্মাণযজ্ঞ। নভেম্বর মাসে যখন তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে স্থির হয়, তখন প্রায় ৯০ জন শিল্পী, ইঞ্জিনিয়ার ও শ্রমিকের এক অমানুষিক পরিশ্রমে মাত্র ৬ সপ্তাহে গড়ে ওঠে এই স্থাপত্য। নির্মাণের গোপন উপাদান ‘সনিস’। এটি তৈরিতে শত শত টন স্বচ্ছ বরফের পাশাপাশি ব্যবহৃত হয় এই বিশেষ উপাদান। এটি তুষার ও বরফের এমন এক বিশেষ মিশ্রণ, যা দেয়াল ও ছাদকে পাথরের মতো মজবুত করে।

সূত্র: আফ্রিকা নিউজ, আপুক্কা রিসোর্ট ডটকম, ইগলু-ডর্ফ জেরম্যাট ডটকম, হোটেল ডি গ্লেস ডটকম

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আজকের রাশিফল: অহেতুক তর্কে মৌনতাই শ্রেয়, ঘর গোছাতে গিয়ে মাথা অগোছালো হবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ০৩
আজকের রাশিফল: অহেতুক তর্কে মৌনতাই শ্রেয়, ঘর গোছাতে গিয়ে মাথা অগোছালো হবে

মেষ

আজ নিজেকে সুপারম্যান মনে করতে পারেন। অফিসে বা ঘরে সবাইকে হুকুম দেওয়ার ইচ্ছা জাগবে। তবে সাবধান! মঙ্গল আপনার রাশিতে একটু বেশিই গরম, তাই গরম চা খেতে গিয়ে জিব পুড়িয়ে বা কারোর সঙ্গে অযথা তর্কে জড়িয়ে ফিউজ ওড়াবেন না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রশংসা করুন, কিন্তু অন্যের সামনে নয়।

বৃষ

আজকের মূল মনোযোগ থাকবে পেটের দিকে। বিদেশের কোনো কাজ বা দূরে ভ্রমণের সুযোগ আসতে পারে, কিন্তু মন পড়ে থাকবে বিরিয়ানির হাঁড়িতে। আর্থিক দিক থেকে দিনটি ভালো, তবে খরচ কমাতে আজ বন্ধুর পকেটের দিকে নজর রাখুন! মনে রাখবেন, বাজেট মানে শুধুই ডায়েরির পাতা নয়, মানিব্যাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা।

মিথুন

আজ মনে হবে আপনি একই সঙ্গে পঞ্চগড় আর লালপুরে আছেন। পরস্পরবিরোধী আবেগ আপনাকে ভোগাবে। একদিকে মনে হবে খুব কাজ করি, অন্যদিকে লেপ ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করবে না। বিবাহিতদের জন্য দিনটি ‘জি হুজুর’ বলে কাটানোই নিরাপদ। সাতটি বিষাদ ও বিচ্ছেদের গান শুনুন, আর না হলে অন্তত সাতবার দীর্ঘশ্বাস ফেলুন।

কর্কট

আজ আপনার আবেগ সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়বে। তুচ্ছ কারণে চোখে পানি আসতে পারে। ব্যবসায় বড় বিনিয়োগের প্ল্যান আজ ড্রয়ারেই থাক। কারণ, আপনার বিচারবুদ্ধি আজ আবেগের বন্যায় ভাসছে। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান, কিন্তু ঝগড়া করবেন না। ফেসবুক বা ইনস্টায় ইমোশনাল স্ট্যাটাস দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।

সিংহ

আজ যেখানেই যাবেন, লাইমলাইট আপনার ওপর থাকবে। গ্রহ বলছে আপনি প্রচুর আত্মবিশ্বাসী। তবে অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার সময় একটু ‘ভলিউম’ কমিয়ে রাখুন, নতুবা তারা আপনার রাজকীয় গর্জনে ভয় পেয়ে ছুটি নিয়ে নিতে পারে! বড়দের সম্মান দিন, আর ছোটদের চকলেট খাইয়ে শান্ত রাখুন।

কন্যা

পারিপার্শ্বিক অস্থিরতা আপনাকে আজ একটু খিটখিটে করে তুলতে পারে। চাইবেন সবকিছু একদম নিখুঁত হোক, কিন্তু পৃথিবীটা তো আপনার নোটবই নয়! সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরুন, সঙ্গীর ভুল ধরাটা আজকের মতো অফ রাখুন। ঘর গোছাতে গিয়ে নিজের মাথাটা বেশি অগোছালো করবেন না।

তুলা

শরীর আজ বেশ চনমনে থাকবে। অনেক দিন ধরে আটকে থাকা কাজ ঝটপট শেষ করে ফেলবেন। তবে সাবধান, সংসারের বিবাদ আজ আপনার শান্তির রাজ্যে হানা দিতে পারে। টাকাপয়সার যোগ ভালো হলেও পকেটে ফুটো যেন না হয় খেয়াল রাখুন। অহেতুক তর্কে ‘মৌনতাই শ্রেয়’।

বৃশ্চিক

আজ আপনি চার মাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে কনফিউজড বোধ করবেন—ডানে যাব না বাঁয়ে? রিয়েল এস্টেট বা জমি-সংক্রান্ত কাজে লাভের মুখ দেখতে পারেন। প্রেমে আজ রসপিঠার মতো মিষ্টি সম্পর্ক থাকবে, যদি না আপনি পুরোনো কোনো ঝগড়া টেনে আনেন। মনের কথা শুনুন, কিন্তু গুগল ম্যাপকেও একটু বিশ্বাস করুন।

ধনু

আজ আপনার রাশিতে গ্রহের মেলা বসেছে! আজ গোল্ডেন টাইম এনজয় করবেন। সৃজনশীল কাজে ফাটিয়ে দেবেন। টাকাপয়সা আসার প্রবল যোগ, কিন্তু সেই খুশিতে সবাইকে অকাতরে খাওয়াতে গিয়ে যেন নিজেকে উপোস করতে না হয়! মাজারে একটু শিরনি দিয়ে আসুন, মাথা ঠান্ডা থাকবে।

মকর

আজ আপনাকে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হতে পারে। তবে ফল হবে মিষ্টি। টাকা একদিকে পকেটে ঢুকবে, অন্যদিকে বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে যাবে। বিদেশি কোম্পানি বা দূরপাল্লার যোগাযোগ থেকে লাভের খবর আসতে পারে। উপার্জনের খাতাটা একটু আড়াল করে রাখুন।

কুম্ভ

আজ নতুন লোকজনের সঙ্গে আলাপ হবে, যা জীবনের মানে বদলে দিতে পারে। সাধারণ কাজও আপনি অসাধারণভাবে করবেন। তবে অতিরিক্ত উৎসাহে যেন কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি না হতে হয়, সেদিকে খেয়াল রাখুন। সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাসটা অন্তত আজকের জন্য ট্রাই করুন।

মীন

মীন রাশির জাতকেরা আজ কল্পনার জগতে ভাসবেন। ক্যারিয়ারে বড় কিছু করার সুযোগ আসবে। তবে বাস্তবে পা রাখাটা জরুরি। আর্থিক হিসাব মেলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে পারেন। বন্ধুর সাহায্য নিলে কাজ সহজ হবে। আকাশকুসুম চিন্তা না করে হাতের কাজটা আগে শেষ করুন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত