Ajker Patrika

দারিদ্র্য মানুষের সহজাত নয়, বিদ্যমান ব্যবস্থার ত্রুটি: ড. ইউনূস

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ৩০ মার্চ ২০২৫, ১৭: ৪২
পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদানের পর বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: ফেসবুক
পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদানের পর বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: ফেসবুক

ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ও সামাজিক ব্যবস্থা দেশে দেশে দারিদ্র্য জিইয়ে রাখে। শিক্ষা সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণা মানুষকে স্বাধীন হওয়ার পথে বাধা তৈরি করে। এমন একটি ব্যবস্থার অংশ হওয়া এবং এর পরিবর্তন করতে না পারায় নিজে অপরাধবোধে ভোগেন বলে জানিয়েছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, মানুষের দক্ষতা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাবে দরিদ্র থাকে না; বরং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তাদের সমান সুযোগ না দেওয়ায় তারা দরিদ্র থাকে।

গতকাল শনিবার বেইজিংয়ের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য দেওয়ার সময় এ কথা বলেন অধ্যাপক ইউনূস। বিশ্ববিদ্যালয়টি তাঁকে এদিন সম্মানসূচক ডক্টরেট দিয়েছে।

পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য দেওয়ার সময় ড. ইউনূস এমন শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেন, যা ভুল ধারণাগুলো টিকিয়ে রাখে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, দারিদ্র্য মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য নয়, বরং আমরা যে ব্যবস্থা তৈরি করেছি, তার ত্রুটি। তাঁর মতে, ত্রুটিপূর্ণ চিন্তাভাবনাই অনেক সামাজিক সমস্যার মূল কারণ।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমি অপরাধবোধ করি, কারণ আমরা এখনো প্রচলিত মানসিকতা পরিবর্তন করতে পারিনি, যা ভোগান্তিই তৈরি করে চলেছে। তরুণদের শিক্ষিত করার জন্য আমরা যে ব্যবস্থা ব্যবহার করি, তার ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করা আমার কর্তব্য, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একই ভুল না করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান ব্যবস্থা ধনীদের জন্য তৈরি, দরিদ্রদের জন্য নয়। এই উপলব্ধি আমাকে একটি বিকল্প তৈরি করতে চালিত করে।’

লাখ লাখ তরুণের স্বপ্নপূরণের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের এই স্বীকৃতি আমাকে অগণিত যুবকের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সাহায্য করার আমার প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দেয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘গত বছর থেকে তারা (তরুণেরা) বাংলাদেশের রূপান্তরের চালিকাশক্তি। তাদের লক্ষ্য একটি নতুন বাংলাদেশ তৈরি করা—যা দারিদ্র্য ও ক্ষুধা থেকে মুক্ত। এই দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নের জন্য আমরা সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বেশ কিছু সংস্কার শুরু করেছি।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘অর্থনৈতিক নীতিগুলোকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে পুনর্গঠন করে আমরা সবার জন্য সমান সুযোগ প্রদান করতে চাই। এই সংস্কারগুলো আমাদের শীর্ষ অগ্রাধিকার, যার সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি কৌশল রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিনিয়োগ, শিক্ষা, প্রযুক্তি এবং শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশকে পুনরুজ্জীবিত করছি, উদ্যোক্তার মাধ্যমে অর্থনৈতিক রূপান্তরকে উৎসাহিত করছি।’

অধ্যাপক ইউনূস প্রচলিত চাকরি খোঁজার মানসিকতার সমালোচনা করে বলেন, ‘আমাদের যুবকেরা তাদের শিক্ষা শেষ করে এবং এরপর চাকরি খোঁজে। আমি সব সময় বলেছি, এটি একটি ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতি। মানুষ চাকরি খোঁজার জন্য জন্মগ্রহণ করে না। চাকরির ধারণাটি একটি ভুল ধারণা।’

তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ সহজাতভাবে সৃজনশীল এবং তারা সৃজনশীল কাজে নিযুক্ত হতে পছন্দ করে। চাকরি তাদের তত্ত্বাবধায়কদের নির্দেশ অনুসরণ করতে বাধ্য করে সৃজনশীলতাকে দমন করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘চাকরি হলো আধুনিক দাসত্বের একটি রূপ, কিন্তু মানুষ দাস হওয়ার জন্য নয়—তারা মুক্ত হওয়ার জন্য। আমাদের এই ধারণাটি ছড়িয়ে দিতে হবে যে, মানুষ কর্মচারী হওয়ার জন্য নয়, উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য জন্মগ্রহণ করে।’

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষার্থীদের চাকরিপ্রার্থী না করে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রস্তুত করার আহ্বান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের চাকরিপ্রার্থী হিসেবে নয়, সফল উদ্যোক্তা হিসেবে স্নাতক হওয়া উচিত। এই বিশ্বাস একটি সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পড়াতাম, তার কাছে আমি গ্রামীণ নারীদের ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের মাধ্যমে একটি ছোট উদ্যোগ শুরু করি।’

তিনি বলেন, ‘আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তাদের জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য তহবিল ব্যবহার করতে সাহায্য করা। সেই সময়ে, আমি নিশ্চিত ছিলাম না, এই উদ্যোগটি কাজ করবে কি না। তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয় এবং তারা তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যায়। অবশেষে, এই পদ্ধতি লাখ লাখ নারীর জীবন পরিবর্তন করেছে।’

তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, ‘এই উদাহরণ আমাকে আশ্বস্ত করেছে যে, সমস্ত মানুষ উদ্যোক্তা। পাঠ্যপুস্তকে আমাদের শেখানো হয় যে, শুধু কয়েকজন উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য জন্মগ্রহণ করে, বাকিদের তাদের অধীনে কাজ করতে হয়। আমি এই ধারণার সঙ্গে দৃঢ়ভাবে দ্বিমত পোষণ করি।’

বাংলাদেশের দৃষ্টান্ত টেনে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশের অত্যন্ত দরিদ্র, অশিক্ষিত নারীরা যদি ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হতে পারে, তবে যে কেউ পারবে। আমরা তাদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণ বা নির্দেশ প্রদান করি না—তারা নিজেরাই এটি বের করে।’

অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, ‘এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করে: শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? তাই আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষা একজন ব্যক্তির সৃজনশীল সম্ভাবনা উন্মোচন করবে এবং তাদের বিশ্ব পরিবর্তন করার ক্ষমতা দেবে।’

গতকাল শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় (পিকেইউ) প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সম্মানসূচক ডক্টরেট দেয়।

সম্মানসূচক ডক্টরেট গ্রহণের পর প্রধান উপদেষ্টা দর্শকদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন।

এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি, কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের একটি দল তাঁকে স্বাগত জানান।

প্রধান উপদেষ্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বের সঙ্গে একটি সংক্ষিপ্ত বৈঠকও করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বাংলাদেশকে ভেঙে ফেলার আহ্বান ত্রিপুরার রাজপরিবার প্রধানের

পরিবারের সামনে পুলিশ কর্মকর্তা লাঞ্ছিত, স্বেচ্ছাসেবক দলের ৩ নেতা-কর্মী আটক

বাংলাদেশে-ভারত সম্পর্কের অবনতিতে দায়ী মোদি সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা: কংগ্রেস

তখন অন্য একটা সংগঠন করতাম, এখন বলতে লজ্জা হয়: জামায়াতের আমির

গ্রেপ্তার আসামিকে ছিনিয়ে নিতে পুলিশের ওপর হামলা, বিএনপির ১৭ নেতা-কর্মী আটক

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত