‘অপারেশন ত্রিশালের’ পর ফের জঙ্গি ছিনতাই, উপেক্ষিতই ২০১৪ সালের সুপারিশ

রাশেদ নিজাম, ঢাকা
প্রকাশ : ২০ নভেম্বর ২০২২, ১৯: ৩৭
আপডেট : ০৮ এপ্রিল ২০২৩, ১৮: ৫৯

২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ এর ২০ নভেম্বরের পার্থক্য প্রায় নয় বছর। জঙ্গিরা তাদের অপারেশন ধরন পাল্টে ঢাকার আদালতের ফটক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে সহযোগীদের। কিন্তু পাল্টায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্বে থাকা কারাগার ও পুলিশ প্রশাসনের মনোভাব। 

গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহের আদালতে নেওয়ার পথে ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল ও ভালুকার মাঝামাঝি সাইনবোর্ড এলাকায় পুলিশের প্রিজন ভ্যানে ঝটিকা আক্রমণ চালায় জঙ্গিরা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে জঙ্গিদের গোলাগুলি হয়। গুলি ও বোমার আঘাতে আতিকুল ইসলাম (৩০) নামে পুলিশের এক কনস্টেবল নিহত হন। আহত হন আরও দুজন। 

সালাহউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি (৩৮), জাহিদুল ইসলাম মিজান ওরফে বোমা মিজান (৩৫) ও হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব হাসান (৩৫) নামের জেএমবির তিন শীর্ষ নেতাকে ছিনিয়ে নেয় জঙ্গিরা। তিনজনের মধ্যে সালাহউদ্দিন ও রাকিব মৃত্যুদণ্ড ও বোমা মিজান যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। 

প্রকাশ্যে জঙ্গি আসামি ছিনতাইয়ের পর বাড়ানো হয়েছে আদালত চত্বরের নিরাপত্তাওই দিনই বিকেলে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের তক্তারচালা এলাকা থেকে ছিনিয়ে নেওয়া জঙ্গি হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব হাসানকে আরও এক সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রাতেই পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন তিনি। বাকি দুজনকে ধরিয়ে দিতে ৫ লাখ করে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ। 

গোয়েন্দারা তখন জানিয়েছিলেন, জঙ্গিরা ওই অভিযানের নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন ত্রিশাল’। প্রিজন ভ্যান থেকে ছিনতাইয়ের এই ঘটনা বাংলাদেশজুড়ে তোলপাড় তোলে। ঘটনার পরপরই সালেহীন ও মিজান ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে জানান পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্তারা। 

ভারতের বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে বোমা বিস্ফোরণ মামলার আসামি বোমা মিজান বেঙ্গালুরুতে দেশটির জাতীয় তদন্ত সংস্থার (এনআইএ) অভিযানে ধরা পড়েন। কিন্তু এখনো সালেহীনের সন্ধান মেলেনি দুই দেশের কোনো সূত্র থেকেই। 

ওই ঘটনার তদন্তে গঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাটি ছিল সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত। পুরো ঘটনায় পুলিশ ও কারাগারের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে। 

তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব (পুলিশ) নাজিম উদ্দীন চৌধুরীর পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়—কারাগারে ‘জ্যামার’ নষ্ট থাকার অজুহাতে দুর্ধর্ষ আসামিরা মোবাইলে নিয়মিত কথা বলছেন। ওই ঘটনার আগে জঙ্গিরা কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে সে বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ আসামি আদালতে আনা-নেওয়ার জন্য আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা ব্যবহারের জন্য সুপারিশ করে কমিটি। 

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির নেতাদের আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে জুতসই নিরাপত্তা ছিল না, যা মোটেও কাম্য নয়। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না থাকায় আদালতে আসামি নেওয়ার বিষয়ে অপারগতা প্রকাশের সুযোগ ছিল কারা কর্তৃপক্ষের। তাঁরা প্রিজন ভ্যানের সামনে-পেছনে প্রহরা রাখার জন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের কাছে আবেদন করতে পারত। তা না করে এ ধরনের ভয়ংকর জঙ্গিদের অল্পসংখ্যক পুলিশ পাহারায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। 

ত্রিশালের প্রায় নয় বছরের মাথায় আজ রোববার ঢাকার আদালত এলাকা থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। তাঁরা হলেন—মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান ও আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব। এরা দুজনই জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। আবু সিদ্দিক ব্লগার অভিজিৎ হত্যা মামলারও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। ছিনিয়ে নেওয়া ওই আসামিরা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য। 

সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে অন্য একটি মামলার শুনানি শেষে তাদের হাজত খানায় নিয়ে যাওয়ার সময় এই ঘটনা ঘটে। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আদালত ভবন থেকে হাজতখানায় আসামিদের নেওয়ার সময় সিজেএম আদালতের প্রধান ফটকের কাছে পৌঁছালে জঙ্গি আসামিরাও পুলিশ সদস্যদের ঘুষি মারে। এ সময় কনস্টেবল আজাদের নাক মুখ ফেটে যায়। আরও দুজন কনস্টেবল অন্য আসামিদের নিয়ে হাজতখানায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে দায়িত্বে থাকা এএসআই মহিউদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রথমে আসামিরাই এ কে আজাদকে ঘুষি মারতে থাকেন। একপর্যায়ে বহিরাগত সন্ত্রাসীরা কনস্টেবলদের চোখে স্প্রে করে।’ 

ত্রিশালের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দুর্ধর্ষ আসামিদের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা। কিন্তু তা যে মানা হয়নি তার উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিদের যেভাবে নিরাপত্তার মাধ্যমে আদালত বা ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয় আজ রোববার সেরকম কোনো নিরাপত্তা ছিল না। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, চারজন জঙ্গিকে একজন পুলিশ কনস্টেবল নিয়ে ট্রাইব্যুনালে যান। আবার ট্রাইব্যুনাল থেকে হাজতখানায় ফেরানোর সময় একই ভাবে নেওয়া হয়। সাধারণত দুজন আসামিকে একটি হাতকড়া পরিয়ে আদালতে নেওয়া হয়। কিন্তু আজ দুই আসামিকে পৃথক ভাবে হাতকড়া পরানো ছিল। 

বিষয়টি স্বীকার করে ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের পিপি আব্দুল্লাহ আবু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দুর্ধর্ষ আসামিদের বিশেষ করে জঙ্গিদের যেভাবে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা সেরকম নিরাপত্তা ছিল না। অন্তত ওখানে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা থাকা উচিত ছিল।’ 

আসামি ছিনতাই নিয়ে উপকমিশনার (ডিসি) প্রসিকিউশন জসিম উদ্দিন কোনো কথা বলতে রাজি হননি। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এরই মধ্যে জানিয়েছেন, আদালত চত্বর থেকে জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় বাহিনীর কেউ দায়ী থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই রেড অ্যালার্ট চলছে। সীমান্তেও সতর্কতা দেওয়া হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে। 

এই সম্পর্কিত আরও পড়ুন:

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত