অদরকারি প্রকল্প বাতিল শুরু হচ্ছে

  • বেশির ভাগই ‘শেখ’ পরিবারের নামে।
  • একনেকে আগে উঠছে তৃতীয় সাফারি পার্ক।
  • স্থগিত করা হয়েছে চার প্রকল্প।
  • সাশ্রয় হবে ২ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা।
মাহফুজুল ইসলাম, ঢাকা
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩: ১৪
Thumbnail image

পরিবেশের ক্ষতির কারণে চলমান মৌলভীবাজারের ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক’ প্রকল্প বাতিল করছে সরকার। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের আলোকে পরিকল্পনা কমিশন আগামী সপ্তাহেই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি বাতিলের প্রস্তাব করতে যাচ্ছে। বাতিলের প্রক্রিয়ায় থাকা আরও চারটি প্রকল্প স্থগিত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, বিভিন্ন কারণে প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হওয়ার আগেই বাতিল করায় রাষ্ট্রের প্রায় ২ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।

ফলে ২০২৩ সালে শেখ হাসিনা সরকারের সময় অনুমোদিত হওয়া প্রকল্পটি আগামী একনেক সভায় বাতিল হচ্ছে। একনেক সভা ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

মৌলভীবাজারের লাঠিটিলা বনের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক শীর্ষক প্রকল্পটি বাতিলের সিদ্ধান্তের পাশাপাশি যে চারটি প্রকল্প স্থগিত করা হয়েছে বা হচ্ছে, সেগুলো হলো শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোনা; শেখ জহুরুল হক পল্লি উন্নয়ন একাডেমি, যশোর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার, খুলনা এবং ‘ট্যুরিস্ট কোচ সংগ্রহ’। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে প্রথম তিনটি প্রকল্প বাতিল করার প্রস্তাব পেয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ অনুসন্ধান করে এগুলোর কার্যক্রম স্থগিত করেছে। ‘ট্যুরিস্ট কোচ সংগ্রহ’ শীর্ষক প্রকল্পটি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। ইতিমধ্যে প্রায় ৬৭৪ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে।

অর্থনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকে প্রকাশ্যে বা একান্তে বলে আসছিলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অনেক অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। এগুলোর বেশির ভাগই যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই না করে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাহিদার ভিত্তিতে অনুমোদন করা হয়েছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া অলাভজনক ও অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। যাচাই করে এখন ইতিমধ্যে অনুমোদিত এসব প্রকল্প বাতিল করা শুরু হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের সদস্য (সচিব) ইকবাল আব্দুল্লাহ হারুন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘২৩ ডিসেম্বর একনেকের সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সভায় একটি প্রকল্প বাতিলের প্রস্তাব করা হবে।’

কী কারণে প্রকল্পটি বাতিল করা হবে জানতে চাইলে অবশ্য ইকবাল আব্দুল্লাহ হারুন বলেন, ‘ঠিক কী কারণে বাতিলের প্রস্তাব করা হচ্ছে, তা আমার জানা নেই।’

একনেক সূত্রে জানা গেছে, মৌলভীবাজারের লাঠিটিলা বনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক শীর্ষক প্রকল্পটি গত বছরের নভেম্বরে একনেকে অনুমোদিত হয়। বনটি সংরক্ষিত হওয়ায় সেখানে সাফারি পার্ক স্থাপনের জোরালো বিরোধিতা করেছিলেন পরিবেশবাদীরা। কিন্তু তাঁদের আপত্তি উপেক্ষা করা হয়। পরিবেশবাদীদের দাবি ছিল, প্রাকৃতিক বনের মধ্যে এ ধরনের সাফারি পার্ক নির্মিত হলে তা হবে প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য আত্মঘাতী ও সর্বনাশা প্রকল্প। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন প্রভাব খাটিয়ে নিজের নির্বাচনী এলাকায় পাহাড় ও গাছ কেটে এ পার্ক তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকার প্রকল্পটির পরিবেশগত প্রভাব যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে কমিটি গঠন করে। সংরক্ষিত ওই অভয়ারণ্যে সাফারি পার্ক নির্মাণ বনাঞ্চলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে উল্লেখ করে প্রকল্পটি বাতিলের সুপারিশ করেছে যাচাই কমিটি। এ প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ প্রকল্পের অনুমোদন বাতিলের সুপারিশ করে পরিকল্পনা কমিশনের কাছে। এরই ধারাবাহিকতায় একনেক সভায় দেশের তৃতীয় সাফারি পার্ক স্থাপনের প্রকল্পটি বাতিলের প্রস্তাব উঠছে।

অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া বিভিন্ন অলাভজনক ও অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাতিলের পাশাপাশি কোনোটির কোনোটির অর্থায়ন স্থগিত অথবা ব্যয় কাটছাঁট করবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতিমধ্যে প্রায় ৪০টি প্রকল্প বাতিল অথবা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

গত ১৯ আগস্ট পরিকল্পনা কমিশনে এক বৈঠকে এ ধরনের প্রকল্পের তালিকা করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তারপর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রকল্পের তালিকা তৈরি শুরু হয়। প্রকল্পগুলোর কোনোটির কাজ মাত্রই শুরু হয়েছে, কোনোটি মাঝামাঝি পর্যায়ে, কোনোটির কাজ শুরুই হয়নি।

বাতিলের অপেক্ষায় থাকা অন্য প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে সুনামগঞ্জ জেলার সঙ্গে নেত্রকোনার সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে হাওরে উড়ালসড়ক নির্মাণের প্রকল্প। সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের আগ্রহে নেওয়া এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের বিবেচনায় পরিকল্পনা কমিশনের এক সভায় এটি বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন মন্ত্রী থাকার সময় নিজের নির্বাচনী এলাকায় ১৮০ কোটি টাকার টেপাখোলা পার্ক প্রকল্প নিয়েছিলেন। এটিও বাতিল হচ্ছে। প্রকল্পটির কাজ এখনো শুরু হয়নি। এর অর্থায়ন স্থগিত হচ্ছে। সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের উদ্যোগে মেহেরপুরের মেরিটাইম ইনস্টিটিউট নির্মাণের প্রকল্পটি বাতিল হচ্ছে।

ঢাকার অদূরে হেমায়েতপুর থেকে আফতাবনগর হয়ে দাশেরকান্দি পর্যন্ত মেট্রোরেলের লাইন-৫ আপাতত বাদ রাখছে সরকার। এর বদলে গাবতলী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত লাইন-২ নির্মাণে জোর দেওয়া হচ্ছে। সংসদ সদস্যদের পছন্দ অনুযায়ী গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণের প্রকল্পটিও বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

কাজে না লাগায় দুর্যোগকালে মানুষের আশ্রয়ের জন্য দেশের বিভিন্ন জেলায় ৫৫০টি ‘মুজিব কিল্লা’র (আশ্রয়কেন্দ্র) নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৩০টি সাইলো নির্মাণ, মাঠে বজ্রনিরোধক দণ্ড বসানো, ১২টি আধুনিক তথ্য কমপ্লেক্স, ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন, পল্লি সড়কে গুরুত্বপূর্ণ সেতু, ঢাকা বিভাগে উপজেলা ও ইউনিয়নের সড়ক, আমার গ্রাম-আমার শহর, রংপুর সিটি করপোরেশন উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পগুলো বাতিল হচ্ছে।

বাতিল অথবা বরাদ্দ কাটছাঁটের তালিকায় থাকা বাকি প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ফেনী, চাঁদপুর ও টাঙ্গাইল জেলায় কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট নির্মাণ, ১২ জেলায় হাইটেক পার্ক, ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন, মোবাইল গেম অ্যাপ্লিকেশন, শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার এবং প্রান্তিক পর্যায়ে উন্নয়ন প্রচার এবং শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক সাবেক সংসদ সদস্য সাজ্জাদুল হাসানের নির্বাচনী এলাকায় নেওয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নের দুটি প্রকল্প।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত