বিজয়নগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি
গভীর রাতের আদুরে ঘুমে আচ্ছন্ন রাজধানীর মানুষ। শুধু অভিজাত পাড়ার একটি ক্লাবে জেগে আছে শ-দুয়েক তরুণ-তরুণী। ক্লাবের ড্যান্স ফ্লোরে রঙিন আলোর নিচে কানফাটা মিউজিকের তালে চলছে উদ্দাম নাচ। সবাই মত্ত সেই ভিনদেশি নাচের তালে। মিউজিক থামিয়ে হঠাৎ ঘোষণা: ‘দ্রুত হল ত্যাগ করুন।’ বিপদ বুঝে যে যার মতো বেরিয়ে এলেন। নিচে নেমে দেখেন, লিফটের পাশে কাতরাচ্ছেন গুলিবিদ্ধ এক যুবক। একটু পরে কাতরানিও থেমে গেল। নিভে গেল যুবকের জীবনপ্রদীপ। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত দুটোর ঘর পেরিয়ে গেছে। তারিখ: ১৮ ডিসেম্বর ১৯৯৮।
কী হলো, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেশের ইতিহাসে একটি আলোচিত খুন হয়ে গেল চোখের নিমেষে। মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা নিহত যুবককে পাশ ফেরাতেই পরিচয় বেরিয়ে এল। তিনি আর কেউ নন, শিল্পপতির পুত্র, ব্যবসায়ী চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী। খবরের কাগজগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আলোচনায় উঠে এল উচ্চবিত্তদের বিনোদনকেন্দ্রের নাম ‘ক্লাব ট্রাম্পস’।
ঢাকায় তখন ‘নাইট ক্লাব’ কালচার সীমাবদ্ধ ছিল শুধু পাঁচতারকা হোটেলে। দুটি পাঁচতারকা হোটেলে সপ্তাহের এক দিন ডিসকো হতো। এর বাইরে মতিঝিল এলাকার একটি তিনতারকা হোটেলেও শুরু হয় ডিসকো নাচ। মদপানের সঙ্গে চড়া মিউজিকের তালে নাচানাচি। বিত্তশালী পরিবারের কমবয়সী তরুণেরা সেখানে ভিড় করতে শুরু করেন। তাই দেখে অভিজাত পাড়া বনানীর আবেদিন টাওয়ারের সাততলার বিশাল ফ্লোরজুড়ে শুরু হয় ক্লাব ট্রাম্পসের যাত্রা।
ক্লাবটির নাম কেন ট্রাম্পস, সে রহস্য ভেদ হয়নি। তবে এটা জানা যায়, আবেদিন টাওয়ারের মালিকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল যোগ ও শরীরচর্চাকেন্দ্র তৈরির কথা বলে। সেই মতো ফ্লোর সাজানো এবং মিউজিক সিস্টেম বসানো হয়। এরপর শুরু হয় অবৈধ পন্থায় মদ কেনাবেচা। উঠতি তরুণেরা ভিড় করতে শুরু করেন সেখানে। চলচ্চিত্র জগতের অনেকেই সেখানে নিয়মিত আসতেন। প্রয়াত চিত্রনায়ক সালমান শাহও ছিলেন এই তালিকায়। তবে সবচেয়ে বেশি শোনা যেত অভিনেতা নাদের চৌধুরীর নাম।
ক্লাব ট্রাম্পসের মূল আয়োজক ছিলেন অধুনালুপ্ত ইংরেজি দৈনিক মর্নিং সানের মালিক ববি ইসলামের ছোট ভাই আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম। তিনি ছিলেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বন্ধু। তাঁর বড় ভাই ববি ইসলামের মেয়ে নওরিনকে বিয়ে করেছিলেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। সেই সুবাদে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের চাচাশ্বশুর বান্টি ইসলাম। বান্টি তখন ডিশ ব্যবসাও চালাতেন।
ক্লাব ট্রাম্পস জমে ওঠার পরপরই নানা ধরনের উটকো ঝামেলা শুরু হয়। বিশেষ করে বনানীর বাসিন্দারা ক্লাব নিয়ে আপত্তি তোলেন। সংবাদপত্রে লেখালেখি হতে থাকে। একপর্যায়ে বান্টিকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। তিনি তাঁর সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক কাজে লাগান। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কয়েকজন ক্লাবে নিয়মিত আসতে শুরু করেন। সেই তালিকায় ছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন ও লেদার লিটন।
ক্লাব ট্রাম্পসে যেদিন গুলি হয়, সেই রাতে রাজধানীর আর সব আমজনতার মতো আমিও ঘুমিয়ে ছিলাম। ভোর হতে না হতেই সাংবাদিক-বন্ধুদের ফোন। বড় খুন হয়েছে—ছুটতে হবে। গেলাম বনানীর আবেদিন টাওয়ারে। থানা আর গোয়েন্দা পুলিশের কড়া পাহারা। পুরো ভবনে চলছে চিরুনি তল্লাশি।
ক্লাবের সামনের রাস্তায় রক্তের দাগ। সেই দাগ দেখে মনে হচ্ছিল, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সোহেল চৌধুরী বনানীর কাঁচাবাজারের সামনের মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন। এই মসজিদের সামনের বাড়িটিই তাঁদের। এ বাড়িতেই তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পুরোনো বাড়িটি এখনো সে রকমই আছে।
সোহেলের বড় ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা। তিনি বললেন, ১৯৬২ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ভারতের সমর্থন আদায়ের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দুই সহযোগীকে নিয়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের চোখ এড়িয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের ত্রিপুরায় গিয়েছিলেন। সেই সফরে তাঁর সঙ্গী ছিলেন দুজন। যাঁদের একজনের নাম তারেক আহমেদ চৌধুরী। ত্রিপুরার সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যের লেখা ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা’ বইয়ে তার বিশদ বিবরণ রয়েছে। বইটি প্রকাশ করেছে মফিদুল হকের প্রতিষ্ঠান সাহিত্য প্রকাশ। বঙ্গবন্ধুর সেই সফরসঙ্গী তারেক আহমেদ চৌধুরীই হলেন চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীর বাবা।
সোহেলের ছোটবেলার গল্প বললেন তিনি। সোহেলের ডাক নাম ছিল সুলু। আসল নাম সোলাইমান চৌধুরী। ছোটবেলায় বেশি খেতেন বলে এই নাম দিয়েছিলেন মা। তাঁর চলচ্চিত্রের নাম সোহেল চৌধুরী। দুই ভাইয়ের মধ্যে সোহেলই ছোট।
সোহেলদের দাদার বাড়ি চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে। পরে ঢাকার বনানীতে থিতু হন। দাদা ছিলেন এফডিসির তৎকালীন পরিচালক। তিনি ছেলেকে বিদেশে লেখাপড়া করান। দেশে ফিরে তারেক আহমেদ চৌধুরী ব্যবসায় মনোযোগ দেন।
সোহেল ও তাঁর ভাই পড়তেন শাহিন স্কুলে। এসএসসি পাসের পর ভর্তি হন তিতুমীর কলেজে। কলেজে ওঠার আগে থেকেই সোহেল ভারতের জনপ্রিয় অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনকে অনুসরণ করতেন। তাঁর মতো চুলও কাটতেন। কলেজের মেয়েরা তাঁকে ডাকতেন অমিতাভ বলে।
কলেজে পড়ার সময় লেখাপড়া বাদ দিয়ে টেকনোভিশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে ডিশ ব্যবসা শুরু করেন সোহেল। এরপর শুরু করেন দেশি বাংলা সিনেমা কিনে ভিডিও ক্যাসেটে রূপান্তরের কাজ। এই ব্যবসায় শত শত বাংলা সিনেমা সস্তায় কিনে বিদেশ থেকে ভিডিও ক্যাসেট করেন। ব্যবসাটা অল্প দিনে বড় হয়ে যায়। লন্ডনে কোম্পানির অফিস খোলেন।
১৯৮৪ সালে ‘নতুন মুখের সন্ধান’ নামে অভিনেতা-অভিনেত্রীর খোঁজ করে চলচ্চিত্র মহল। সোহেল চৌধুরী মনোনীত হন। ১৯৮৬ সালে তাঁর প্রথম ছবি মুক্তি পায়। ছবির পরিচালক এফ কবির চৌধুরী। সিনেমায় এসেই নায়িকা দিতির প্রেমে পড়েন সোহেল। সে বছরই তাঁকে বিয়ে করেন। পরের বছর জন্ম হয় তাঁদের প্রথম সন্তান লামিয়া চৌধুরীর। কানাডায় পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় ফিরে এসে ব্যবসা করছেন লামিয়া। ১৯৮৯ সালে তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান সাফায়েত আহমেদ চৌধুরীর জন্ম। সাফায়েত এখন নেদারল্যান্ডসে মিউজিক নিয়ে ব্যবসা করেন। তবে সোহেল-দিতির সুখের সংসার খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। দিতি এরপর চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনকে বিয়ে করেন। সে সংসারও টেকেনি। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ মারা যান দিতি। তবে দিতির সঙ্গে বিচ্ছেদের পরই একা হয়ে যান সোহেল। মূলত বিচ্ছেদের পর দিতির ক্যারিয়ার গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হলেও সোহেল আর এগোতে পারেননি। এতে বিষণ্ন সোহেলের গোছানো জীবন এলোমেলো হয়ে যায়।
ক্লাব ট্রাম্পস ওঠানো নিয়ে বনানীর বাসিন্দারা তখন এককাট্টা। সোহেলও তাঁদের সঙ্গে। এ নিয়ে বান্টির সঙ্গে তাঁর ঝগড়া হয়। সোহেলের পরিবারের কাছে অভিযোগও করেন বান্টি। ক্লাব ট্রাম্পসের ভেতর একদিন মদ্যপ অবস্থায় আজিজ মোহাম্মদ ভাইের গায়ে হাত তোলেন সোহেল। এতে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। এর পর থেকেই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আনাগোনা বেড়ে যায় ক্লাব ট্রাম্পসে।
ঘটনার দিন রাত দুটোর দিকে চার বন্ধুকে নিয়ে ক্লাব ট্রাম্পসে আসেন সোহেল। ক্লাবের নিচেই কলাপসিবল গেটের কাছে দুই যুবক তাঁদের গতি রোধ করেন। এক যুবক বাগ্বিতণ্ডায় জড়ান। এক যুবক কোমরে বাঁধা হোলস্টার থেকে রিভলবার তুলে গুলি চালান। মাত্র একটি গুলি লাগে সোহেলের বুকে। লুটিয়ে পড়েন তিনি। হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। ততক্ষণে সব শেষ। চিকিৎসক জানিয়ে দেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। পুলিশ এরপর ক্লাবের ১১ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে। সোহেলের বড় ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলা আসে ডিবিতে। সেই মামলায় ১৯৯৯ সালের ৩ জানুয়ারি গুলশান থেকে বান্টি ইসলামকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। এর তিন দিন পর ৬ জানুয়ারি গুলশান লেডিস পার্কের সামনে থেকে আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে গ্রেপ্তার করে এসবি। আসামিদের একজন আদনান সিদ্দিকি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। তাতে উল্লেখ করেন, হত্যাকাণ্ডের আগে এক শিল্পপতির ফোন পেয়ে ঢাকা ক্লাব থেকে ঘটনাস্থলে যান তিনি।
১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই ডিবি পুলিশের সহকারী কমিশনার আবুল কাশেম ব্যাপারী নয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। এতে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ছাড়াও তারিক সাঈদ মামুন, সেলিম খান, হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন, ফারুক আব্বাসী, আশীষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনকে অভিযুক্ত করা হয়।
২০০১ সালের ৩০ অক্টোবর মামলাটির অভিযোগ গঠিত হয়। বিচারের জন্য পাঠানো হয় দুই নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। এর মধ্যে তারিক সাঈদ মামুন হাইকোর্টে রিট করেন। এরপর হাইকোর্টের বেঞ্চ ২০০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি একটি আদেশ দেন। এতে বলা হয়, রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলার নিম্ন আদালতের কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। এরপর থেকে সেভাবেই পড়ে আছে মামলাটি। রাষ্ট্রপক্ষ আর খোঁজ করেনি একসময়ের জনপ্রিয় এই নায়ক খুনের কী হলো। সোহেলের বড় ভাই সেই আক্ষেপই করলেন।
আরও পড়ুন:
গভীর রাতের আদুরে ঘুমে আচ্ছন্ন রাজধানীর মানুষ। শুধু অভিজাত পাড়ার একটি ক্লাবে জেগে আছে শ-দুয়েক তরুণ-তরুণী। ক্লাবের ড্যান্স ফ্লোরে রঙিন আলোর নিচে কানফাটা মিউজিকের তালে চলছে উদ্দাম নাচ। সবাই মত্ত সেই ভিনদেশি নাচের তালে। মিউজিক থামিয়ে হঠাৎ ঘোষণা: ‘দ্রুত হল ত্যাগ করুন।’ বিপদ বুঝে যে যার মতো বেরিয়ে এলেন। নিচে নেমে দেখেন, লিফটের পাশে কাতরাচ্ছেন গুলিবিদ্ধ এক যুবক। একটু পরে কাতরানিও থেমে গেল। নিভে গেল যুবকের জীবনপ্রদীপ। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত দুটোর ঘর পেরিয়ে গেছে। তারিখ: ১৮ ডিসেম্বর ১৯৯৮।
কী হলো, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেশের ইতিহাসে একটি আলোচিত খুন হয়ে গেল চোখের নিমেষে। মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা নিহত যুবককে পাশ ফেরাতেই পরিচয় বেরিয়ে এল। তিনি আর কেউ নন, শিল্পপতির পুত্র, ব্যবসায়ী চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী। খবরের কাগজগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আলোচনায় উঠে এল উচ্চবিত্তদের বিনোদনকেন্দ্রের নাম ‘ক্লাব ট্রাম্পস’।
ঢাকায় তখন ‘নাইট ক্লাব’ কালচার সীমাবদ্ধ ছিল শুধু পাঁচতারকা হোটেলে। দুটি পাঁচতারকা হোটেলে সপ্তাহের এক দিন ডিসকো হতো। এর বাইরে মতিঝিল এলাকার একটি তিনতারকা হোটেলেও শুরু হয় ডিসকো নাচ। মদপানের সঙ্গে চড়া মিউজিকের তালে নাচানাচি। বিত্তশালী পরিবারের কমবয়সী তরুণেরা সেখানে ভিড় করতে শুরু করেন। তাই দেখে অভিজাত পাড়া বনানীর আবেদিন টাওয়ারের সাততলার বিশাল ফ্লোরজুড়ে শুরু হয় ক্লাব ট্রাম্পসের যাত্রা।
ক্লাবটির নাম কেন ট্রাম্পস, সে রহস্য ভেদ হয়নি। তবে এটা জানা যায়, আবেদিন টাওয়ারের মালিকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল যোগ ও শরীরচর্চাকেন্দ্র তৈরির কথা বলে। সেই মতো ফ্লোর সাজানো এবং মিউজিক সিস্টেম বসানো হয়। এরপর শুরু হয় অবৈধ পন্থায় মদ কেনাবেচা। উঠতি তরুণেরা ভিড় করতে শুরু করেন সেখানে। চলচ্চিত্র জগতের অনেকেই সেখানে নিয়মিত আসতেন। প্রয়াত চিত্রনায়ক সালমান শাহও ছিলেন এই তালিকায়। তবে সবচেয়ে বেশি শোনা যেত অভিনেতা নাদের চৌধুরীর নাম।
ক্লাব ট্রাম্পসের মূল আয়োজক ছিলেন অধুনালুপ্ত ইংরেজি দৈনিক মর্নিং সানের মালিক ববি ইসলামের ছোট ভাই আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম। তিনি ছিলেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বন্ধু। তাঁর বড় ভাই ববি ইসলামের মেয়ে নওরিনকে বিয়ে করেছিলেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। সেই সুবাদে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের চাচাশ্বশুর বান্টি ইসলাম। বান্টি তখন ডিশ ব্যবসাও চালাতেন।
ক্লাব ট্রাম্পস জমে ওঠার পরপরই নানা ধরনের উটকো ঝামেলা শুরু হয়। বিশেষ করে বনানীর বাসিন্দারা ক্লাব নিয়ে আপত্তি তোলেন। সংবাদপত্রে লেখালেখি হতে থাকে। একপর্যায়ে বান্টিকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। তিনি তাঁর সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক কাজে লাগান। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কয়েকজন ক্লাবে নিয়মিত আসতে শুরু করেন। সেই তালিকায় ছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন ও লেদার লিটন।
ক্লাব ট্রাম্পসে যেদিন গুলি হয়, সেই রাতে রাজধানীর আর সব আমজনতার মতো আমিও ঘুমিয়ে ছিলাম। ভোর হতে না হতেই সাংবাদিক-বন্ধুদের ফোন। বড় খুন হয়েছে—ছুটতে হবে। গেলাম বনানীর আবেদিন টাওয়ারে। থানা আর গোয়েন্দা পুলিশের কড়া পাহারা। পুরো ভবনে চলছে চিরুনি তল্লাশি।
ক্লাবের সামনের রাস্তায় রক্তের দাগ। সেই দাগ দেখে মনে হচ্ছিল, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সোহেল চৌধুরী বনানীর কাঁচাবাজারের সামনের মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন। এই মসজিদের সামনের বাড়িটিই তাঁদের। এ বাড়িতেই তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পুরোনো বাড়িটি এখনো সে রকমই আছে।
সোহেলের বড় ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা। তিনি বললেন, ১৯৬২ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ভারতের সমর্থন আদায়ের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দুই সহযোগীকে নিয়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের চোখ এড়িয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের ত্রিপুরায় গিয়েছিলেন। সেই সফরে তাঁর সঙ্গী ছিলেন দুজন। যাঁদের একজনের নাম তারেক আহমেদ চৌধুরী। ত্রিপুরার সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যের লেখা ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা’ বইয়ে তার বিশদ বিবরণ রয়েছে। বইটি প্রকাশ করেছে মফিদুল হকের প্রতিষ্ঠান সাহিত্য প্রকাশ। বঙ্গবন্ধুর সেই সফরসঙ্গী তারেক আহমেদ চৌধুরীই হলেন চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীর বাবা।
সোহেলের ছোটবেলার গল্প বললেন তিনি। সোহেলের ডাক নাম ছিল সুলু। আসল নাম সোলাইমান চৌধুরী। ছোটবেলায় বেশি খেতেন বলে এই নাম দিয়েছিলেন মা। তাঁর চলচ্চিত্রের নাম সোহেল চৌধুরী। দুই ভাইয়ের মধ্যে সোহেলই ছোট।
সোহেলদের দাদার বাড়ি চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে। পরে ঢাকার বনানীতে থিতু হন। দাদা ছিলেন এফডিসির তৎকালীন পরিচালক। তিনি ছেলেকে বিদেশে লেখাপড়া করান। দেশে ফিরে তারেক আহমেদ চৌধুরী ব্যবসায় মনোযোগ দেন।
সোহেল ও তাঁর ভাই পড়তেন শাহিন স্কুলে। এসএসসি পাসের পর ভর্তি হন তিতুমীর কলেজে। কলেজে ওঠার আগে থেকেই সোহেল ভারতের জনপ্রিয় অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনকে অনুসরণ করতেন। তাঁর মতো চুলও কাটতেন। কলেজের মেয়েরা তাঁকে ডাকতেন অমিতাভ বলে।
কলেজে পড়ার সময় লেখাপড়া বাদ দিয়ে টেকনোভিশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে ডিশ ব্যবসা শুরু করেন সোহেল। এরপর শুরু করেন দেশি বাংলা সিনেমা কিনে ভিডিও ক্যাসেটে রূপান্তরের কাজ। এই ব্যবসায় শত শত বাংলা সিনেমা সস্তায় কিনে বিদেশ থেকে ভিডিও ক্যাসেট করেন। ব্যবসাটা অল্প দিনে বড় হয়ে যায়। লন্ডনে কোম্পানির অফিস খোলেন।
১৯৮৪ সালে ‘নতুন মুখের সন্ধান’ নামে অভিনেতা-অভিনেত্রীর খোঁজ করে চলচ্চিত্র মহল। সোহেল চৌধুরী মনোনীত হন। ১৯৮৬ সালে তাঁর প্রথম ছবি মুক্তি পায়। ছবির পরিচালক এফ কবির চৌধুরী। সিনেমায় এসেই নায়িকা দিতির প্রেমে পড়েন সোহেল। সে বছরই তাঁকে বিয়ে করেন। পরের বছর জন্ম হয় তাঁদের প্রথম সন্তান লামিয়া চৌধুরীর। কানাডায় পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় ফিরে এসে ব্যবসা করছেন লামিয়া। ১৯৮৯ সালে তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান সাফায়েত আহমেদ চৌধুরীর জন্ম। সাফায়েত এখন নেদারল্যান্ডসে মিউজিক নিয়ে ব্যবসা করেন। তবে সোহেল-দিতির সুখের সংসার খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। দিতি এরপর চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনকে বিয়ে করেন। সে সংসারও টেকেনি। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ মারা যান দিতি। তবে দিতির সঙ্গে বিচ্ছেদের পরই একা হয়ে যান সোহেল। মূলত বিচ্ছেদের পর দিতির ক্যারিয়ার গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হলেও সোহেল আর এগোতে পারেননি। এতে বিষণ্ন সোহেলের গোছানো জীবন এলোমেলো হয়ে যায়।
ক্লাব ট্রাম্পস ওঠানো নিয়ে বনানীর বাসিন্দারা তখন এককাট্টা। সোহেলও তাঁদের সঙ্গে। এ নিয়ে বান্টির সঙ্গে তাঁর ঝগড়া হয়। সোহেলের পরিবারের কাছে অভিযোগও করেন বান্টি। ক্লাব ট্রাম্পসের ভেতর একদিন মদ্যপ অবস্থায় আজিজ মোহাম্মদ ভাইের গায়ে হাত তোলেন সোহেল। এতে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। এর পর থেকেই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আনাগোনা বেড়ে যায় ক্লাব ট্রাম্পসে।
ঘটনার দিন রাত দুটোর দিকে চার বন্ধুকে নিয়ে ক্লাব ট্রাম্পসে আসেন সোহেল। ক্লাবের নিচেই কলাপসিবল গেটের কাছে দুই যুবক তাঁদের গতি রোধ করেন। এক যুবক বাগ্বিতণ্ডায় জড়ান। এক যুবক কোমরে বাঁধা হোলস্টার থেকে রিভলবার তুলে গুলি চালান। মাত্র একটি গুলি লাগে সোহেলের বুকে। লুটিয়ে পড়েন তিনি। হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। ততক্ষণে সব শেষ। চিকিৎসক জানিয়ে দেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। পুলিশ এরপর ক্লাবের ১১ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে। সোহেলের বড় ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলা আসে ডিবিতে। সেই মামলায় ১৯৯৯ সালের ৩ জানুয়ারি গুলশান থেকে বান্টি ইসলামকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। এর তিন দিন পর ৬ জানুয়ারি গুলশান লেডিস পার্কের সামনে থেকে আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে গ্রেপ্তার করে এসবি। আসামিদের একজন আদনান সিদ্দিকি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। তাতে উল্লেখ করেন, হত্যাকাণ্ডের আগে এক শিল্পপতির ফোন পেয়ে ঢাকা ক্লাব থেকে ঘটনাস্থলে যান তিনি।
১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই ডিবি পুলিশের সহকারী কমিশনার আবুল কাশেম ব্যাপারী নয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। এতে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ছাড়াও তারিক সাঈদ মামুন, সেলিম খান, হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন, ফারুক আব্বাসী, আশীষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনকে অভিযুক্ত করা হয়।
২০০১ সালের ৩০ অক্টোবর মামলাটির অভিযোগ গঠিত হয়। বিচারের জন্য পাঠানো হয় দুই নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। এর মধ্যে তারিক সাঈদ মামুন হাইকোর্টে রিট করেন। এরপর হাইকোর্টের বেঞ্চ ২০০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি একটি আদেশ দেন। এতে বলা হয়, রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলার নিম্ন আদালতের কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। এরপর থেকে সেভাবেই পড়ে আছে মামলাটি। রাষ্ট্রপক্ষ আর খোঁজ করেনি একসময়ের জনপ্রিয় এই নায়ক খুনের কী হলো। সোহেলের বড় ভাই সেই আক্ষেপই করলেন।
আরও পড়ুন:
ভারতের কলকাতায় ডেপুটি হাইকমিশনের বাইরে বিক্ষোভে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কুশপুত্তলিকা পোড়ানোর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
২১ মিনিট আগেবাংলাদেশে সহিংসতা ও উসকানির ঘটনা বাড়ছে এবং এটাকে মিডিয়ার বাড়াবাড়ি হিসেবে উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে মন্তব্য করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আজ শুক্রবার দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল নয়াদিল্লিতে সাপ্তাহিক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এমন মন্তব্য করেছেন।
১ ঘণ্টা আগেনির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে যৌক্তিক সময় দেওয়া উচিত বলে মনে করেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন কবে হবে, তা নিয়ে ভবিষ্যৎ বাণী করা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। তবে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অন্যান্য জরুরি সংস্কারের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে এবং সংস্কারের জন্য...
২ ঘণ্টা আগেভারতের গণমাধ্যম আনন্দবাজারসহ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের পক্ষে ইসকন একটি সমর্থনমূলক বিবৃতি দিয়েছে। তবে ইসকনের পক্ষ থেকে এ দাবি পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়েছে। ইসকন স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, তারা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের পক্ষে...
২ ঘণ্টা আগে