Ajker Patrika

সরকারি দপ্তরের সেবায় অসন্তোষ: অনলাইনে অভিযোগ করলেই মিলছে প্রতিকার

আয়নাল হোসেন, ঢাকা
সরকারি দপ্তরের সেবায় অসন্তোষ: অনলাইনে অভিযোগ করলেই মিলছে প্রতিকার

ফুসফুসের সমস্যা থাকায় গত বছরের জুনে জিসান খানের নানিকে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। চিকিৎসকেরা এক্স–রে করাতে দেন। হাসপাতাল থেকে ২৫০ টাকায় পরীক্ষাটি করানোর পর চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগেই সেখানকার স্টাফরা বলেন, হাসপাতালের এক্স-রে ভালো না। ডাক্তারেরা দেখেন না। বাইরে থেকে করানোর পরামর্শ দেন। পরে ২ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয়ে বাইরে থেকে এক্স–রে করানো হয়। বিষয়টি নিয়ে জিসান খান গত বছরের ৫ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দেন। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবসহ (প্রশাসন) দুই জন কর্মকর্তা পরিদর্শন করে অভিযোগের সত্যতা পান। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বড় বিলবোর্ড টানিয়ে কী কী সেবা পাওয়া যাবে সেগুলোর মূল্য তালিকা টানানোর নির্দেশ দেয়। 

একই হাসপাতালের ভাসমান পরিচ্ছন্নতাকর্মীর অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য তাবাসুম নামে এক নারী অভিযোগ করেন। অভিযোগকারী জানান, তাঁর মা ভর্তি ছিলেন। কিন্তু হাসপাতালের ভাসমান পরিচ্ছন্নতা কর্মী রোগীদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেন। প্রতিকার পেতে মন্ত্রণালয়ের সেবা বিভাগে অভিযোগ দেন। পরে মন্ত্রণালয় থেকে দুই দফা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রতিকারের ব্যবস্থা করা হয়। পুনরায় কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে সংশ্লিষ্ট কর্মীকে চাকরিচ্যুত করার নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। 

দেশের সব সরকারি দপ্তরে সেবা বঞ্চিত হলে সংক্ষুব্ধ বা সুবিধা বঞ্চিত ব্যক্তি ‘অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থার (জিআরএস) মাধ্যমে অনলাইনে আবেদন করলেই বিচার পাবেন। এভাবে আবেদন করলে সেটি ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেটি নিষ্পত্তি না হলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জবাবদিহি করতে হয়। 

উল্লিখিত দুই ব্যক্তি জিআরএসের মাধ্যমে আবেদন করেই তাৎক্ষণিক প্রতিকার পেয়েছেন। 

কিন্তু সরকারি দপ্তরে কর্মরত কিছু ব্যক্তি ও সচেতন কতিপয় নাগরিক ছাড়া এ বিষয়টি অধিকাংশ মানুষেরই অজানা। অনেকে কাগজে দরখাস্ত লিখে অভিযোগ দিয়ে থাকেন। কিন্তু এই অভিযোগ নিষ্পত্তি না-ও হতে পারে। আর হলেও সেটি সময় সাপেক্ষ। কিন্তু অনলাইনে জিআরএসের ওয়েবসাইটে আবেদন করলেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিকার করার বিধান রয়েছে। 

জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, অভিযোগ ও প্রতিকারের ব্যবস্থা, সেবা প্রদানের প্রতিশ্রুতি, তথ্য অধিকার বাস্তবায়ন ও বার্ষিক কর্ম সম্পাদন চুক্তি যথাযথভাবে পালনের জন্য ২০১৪-২০১৫ অর্থবছর থেকে দেশের ৪৮টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বার্ষিক কর্ম সম্পাদন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে আসছে। অর্থাৎ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে দেশের সব মন্ত্রণালয় আগামী অর্থবছরে কী কী কাজ বাস্তবায়ন করবে, সেটির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। এই চুক্তির আওতায় প্রতিটি মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বিভাগ বা জেলা জবাবদিহির আওতায় থাকে। 

জানা গেছে, সরকারের পাঁচটি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য সব মন্ত্রণালয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে। এসব প্রতিশ্রুতি সার্বিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ৩০ নম্বর রয়েছে। আর ৭০ নম্বর নিজ নিজ মন্ত্রণালয় দিয়ে থাকে। এই চুক্তি অনুযায়ী কোনো মন্ত্রণালয় ভালো কাজ করলে তাদের পুরস্কৃতও করা হচ্ছে। এতে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে নম্বর রয়েছে। অসাধারণ ১০০, অতি উত্তম ৯০, উত্তম ৮০, চলতি মান ৭০ ও চলতি মানের নিচে ৬০ নম্বর ধার্য রয়েছে। ফলে মন্ত্রণালয় ও অধীনস্থ দপ্তর বা সংস্থার মধ্যে সেবা ও প্রতিকার দেওয়ার প্রতিযোগিতা কাজ করছে। 

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অনেকেই এখন জিআরএসের মাধ্যমে অভিযোগ করছেন। ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের চেয়ে ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে অভিযোগের সংখ্যাও অনেক বাড়ছে। শুধু সরকারি দপ্তরে সেবা বঞ্চিত হওয়াই নয়। 

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সব মন্ত্রণালয় বা বিভাগে অনলাইনের মাধ্যমে অভিযোগ আসে ৬ হাজার ৪৯১ টি। অভিযোগ নিষ্পত্তির হার ৩৪ দশমিক ১২ শতাংশ। আর ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অভিযোগ আসে ২৫ হাজার ৩৮ টি। নিষ্পত্তির হার ৭৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারি ও ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনলাইনে অভিযোগ আসে ৬ হাজার ৯৮১ টি। 

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সব মন্ত্রণালয় বা বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে অভিযোগ বেশি আসছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে। ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত অনলাইনে অভিযোগ আসে ৩৭৮ টি। এসব অভিযোগের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১৩৪ টি। 

তবে পণ্য বা সেবায় প্রতারিত হয়ে ভোক্তারা জিআরএস ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করছেন। এটি সরকারের নীতি কৌশলের সঙ্গে মিল নেই। যদিও সব অভিযোগেরই নিষ্পত্তি করেছে সংস্থাটি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এক বছরে এ মন্ত্রণালয় ও অধীনস্থ দপ্তরে অনলাইনে আবেদন পড়েছে ১৫৯ টি। 

এ ছাড়া ২০১৪ সালের সচিবালয় নির্দেশমালা অনুযায়ী, বাংলাদেশে অভিযোগ প্রতিকারের জন্য বর্তমানে বিভিন্ন দপ্তরে সীমিত পরিসরে স্বতন্ত্র ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ই-ফাইলের মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় এবং কোনো কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগে অনলাইনে অভিযোগ দাখিল বা প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ রয়েছে। 

সরকারি দপ্তরে সেবা পেতে ভোগান্তিতে পড়লে কিংবা দপ্তরের অনিয়মের বিষয়ে প্রতিকার পাওয়ার জন্য অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা (জিআরএস) রয়েছে। জিআরএস ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি দপ্তরে দেশের একজন নাগরিক যে কোনো সেবার বিরুদ্ধে তাঁর অসন্তোষ বা ক্ষোভ জানিয়ে অভিযোগ দিতে পারেন। অনলাইনে সরাসরি দেশ-বিদেশ থেকে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি অভিযোগ দাখিল করতে পারেন। 

এদিকে অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে জনসেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এরই মধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। ২০০০ সালের জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয়ভাবে অভিযোগ গ্রহণ ও প্রতিকার ব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করা হয়। ওই সুপারিশ অনুযায়ী, সচিবালয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে মানুষের অভিযোগ গ্রহণ কেন্দ্র চালু করে। অভিযোগগুলো প্রতিকারের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ২০০৭ সালে একটি পরিপত্র জারি করা হয়। ওই পরিপত্রের আলোকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগের অনেক কর্মকর্তার কাছে অভিযোগগুলো পাঠানো হয়। প্রাপ্ত অভিযোগের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ২০১৫ সাল থেকে অনলাইনে অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থাপনা চালু করে। 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব (সংস্কার ও সমন্বয়) মো. মাহমুদুল হোসাইন খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অভিযোগ প্রতিকার বিষয়ে জেলা পর্যায়ে ওয়ার্কশপে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়। জিআরএস বক্সে অভিযোগ ও প্রতিকার সম্পর্কে জেলা ও উপজেলা কর্মকর্তারা ইউনিয়ন পর্যায়ে জানাবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের বড় ভূমিকা অনেক বড়।’ 

জিআরএসের মাধ্যমে অভিযোগ দেওয়া হলে প্রতি উত্তর পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে কারও বিরুদ্ধে যাতে মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া না হয় সে বিষয়েও জনগণকে খেয়াল রাখতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হলেন ক্যালিফোর্নিয়ার পরিবহন বিশেষজ্ঞ

‘তল্লাশির’ জন্য উসকানি দিয়েছে গুলশানের ওই বাসার সাবেক কেয়ারটেকার: প্রেস উইং

প্রধান উপদেষ্টার আরও দুই বিশেষ সহকারী নিয়োগ

খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা মাসুদ আহমেদের সব পদ স্থগিত

টিআইএন নেওয়ার পরে কিন্তু ঘুমাইতে পারবেন না: এনবিআর চেয়ারম্যান

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত