সাহিদুল ইসলাম চৌধুরী
প্রশ্ন: পদ্মা নদীর কী কী বৈশিষ্ট্য সেতু নির্মাণের সময় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল?
বসুনিয়া: প্রথম বিবেচনায় ছিল নদী যেখানে অতিক্রম করতে চাই, সেখানে রাস্তাঘাট আগে থেকেই আছে কি না। থাকলে পুরোপুরি নতুন অ্যালাইনমেন্টে
যেতে হয় না। খরচও কম পড়ে। এ ছাড়া, নদীর বৈশিষ্ট্য কেমন। ভাঙে কেমন।
গতিপথ বদলায় কি না। সেতু যে স্থানে হবে, সেখানকার মাটি কেমন। ভূমিকম্পের প্রবণতা কেমন। এসব করতে করতে শুরুতে দুটি স্থান ঠিক করা হয়েছিল। তবে মাওয়া প্রান্তে বর্তমান স্থানে মাটি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল হওয়ায় এখানেই সেতু নির্মিত হলো।
প্রশ্ন: প্রকৌশলগত দিক থেকে পদ্মা সেতুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য কী কী?
বসুনিয়া: পদ্মা খুবই খরস্রোতা নদী। বেশ গভীর। নদীর তলদেশ ও গভীরে মাটির অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সেতুতে স্প্যান লম্বা দিতে হয়। স্প্যান ছোট দিলে ‘পিয়ার’ (কলাম, যা সাধারণভাবে পিলার হিসেবে পরিচিত) কাছাকাছি দিতে হয়। এতে পানির ঘূর্ণনে নিচে মাটি সরে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। এসব বিবেচনায় প্রতিটি স্প্যান ১৫০ মিটার করা হয়েছে, যা ৫০০ ফুটের বেশি। সেতুতে এ রকম ৪১টি স্প্যান আছে। সব মিলিয়ে সেতুটি ৬ হাজার ১৫০ মিটার দীর্ঘ।
সাধারণ সেতুতে প্রি-স্ট্রেসড কংক্রিট স্প্যান দেওয়া হয়। যমুনার ওপর বঙ্গবন্ধু সেতুর স্প্যান প্রি-স্ট্রেসড বক্স গার্ডার করে করে নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু পদ্মার বর্তমান স্থানে ১৫০ মিটার দীর্ঘ একই ধরনের স্প্যান দিলে ঝামেলা হতো। শুরু থেকেই রেলের ব্যবস্থা এবং মাঝখানে মিডিয়ানসহ চার লেনের প্রশস্ত সেতু নির্মাণের বিষয়টি বিবেচনায় ছিল। শেষ পর্যন্ত সেতুটি ওপরের অংশে ৭২ ফুট চওড়া হয়ে গেছে। এ ছাড়া এখানে দুই ধরনের স্টিল, রিইনফোর্সড কংক্রিট ও প্রি-স্ট্রেসড কংক্রিটের সমন্বয়ে স্প্যানগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সেতুর ভিত্তি মজবুত করার জন্য নদীর তলদেশে কমপক্ষে ১২০ মিটার গভীর পাইল করতে হয়েছে। পাইলের অনেক স্থানে বাঁকা করে করতে হয়েছে, যা বেশ ঝামেলার ছিল।
প্রশ্ন: যমুনার ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে পদ্মা সেতু কীভাবে আলাদা?
বসুনিয়া: বঙ্গবন্ধু সেতু শুরুতে শুধু সড়ক সেতু হিসেবে নির্মাণ আরম্ভ হয়। পরে একপাশে রেললাইন যুক্ত হয়; কিছুটা ঝুলন্ত অবস্থায়। এটা নিরাপদ। কিন্তু সড়কের পাশাপাশি রেল বসাতে গিয়ে লেনগুলো ছোট হয়ে গেছে। বাস যখন যায়, মনে হয় গায়ে গায়ে লেগে যাচ্ছে। পাঁচ কিলোমিটার লম্বা একটি সেতুতে এটা মানানসই ব্যবস্থা নয়। পদ্মা সেতুতে তা হবে না। এটি যথেষ্ট প্রশস্ত সেতু।
প্রশ্ন: পদ্মা সেতুতে কিছু কি নতুন করা হয়েছে, যা পৃথিবীর খুব কম সেতুতেই আছে বা আদৌ নেই?
বসুনিয়া: পদ্মা সেতুর মতো এত গভীরতায় আর কোনো সেতুতে পাইল দেওয়া হয়নি। প্রতিটি পিয়ারের নিচে ছয়টি করে পাইল আছে। সবগুলো পাইল আড়াই ইঞ্চি পুরু স্টিল দিয়ে ১০ ফুট ব্যাসে তৈরি এবং বাঁকা। এর মধ্যে কয়েকটি পিয়ারের নিচে পাইল করার সময় গভীরে কাদামাটি পাওয়া গেল। সেখানে মাটির মান উন্নত করতে তীব্র চাপে রাসায়নিক পদার্থ প্রবেশ করানো হলো। পরে লোড পরীক্ষা করে দেখা গেছে পাইল অনেক শক্তিশালী হয় গেছে।
প্রশ্ন: সেতু কি দেখতে ইংরেজি ‘এস’ আকৃতির?
বসুনিয়া: ঠিক ‘এস’ নয়। সেতুটি বাঁকানো রেখার মতো। দীর্ঘ সেতু সাধারণত সোজা করে নির্মিত হয় না। যমুনার ওপর বঙ্গবন্ধু সেতুও একটু বাঁকা। এর একটি কারণ হলো, কলামের ওপর যেসব বিয়ারিং সেতুর ওজন বহন করে, তার ছয়-সাতটি মিলে একেকটি মডিউল হয়। একেকটি মডিউল শেষে যেখানে নতুন মডিউল শুরু হয়েছে, সেখানেই বাঁক দিতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘ সেতুর একটি মনস্তাত্ত্বিক সমীক্ষা থাকে। সেই সমীক্ষায় বলা হয়, সেতু যদি সোজা হয়, তাহলে গাড়িচালকের একঘেয়েমি আসে। সেতুতে বাঁক থাকলে চালকেরা সতর্ক থাকে। এ ছাড়া, সেতু সোজা থাকলে উল্টো দিকের হেডলাইট থেকে আসা আলোয় চালকের বেশ অসুবিধা হয়। চতুর্থ কারণ হলো, বাঁকা সেতুতে আলো জ্বালানো হলে নান্দনিকতা বেড়ে যায়।
প্রশ্ন: কেন সেতুটি দ্বিতল করতে হলো?
বসুনিয়া: নিচে রেল আর ওপরে গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করতে গিয়ে সেতুটি দ্বিতল করতে হয়েছে। পাশাপাশি উভয় সুবিধা নিতে গেলে আরও চওড়া করতে হতো সেতুটি।
প্রশ্ন: সেতু নির্মাণে কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে?
বসুনিয়া: প্রথম চ্যালেঞ্জ এল বিশ্বব্যাংকের তরফ থেকে। তারা অর্থায়ন বন্ধ করল; একই সঙ্গে অন্য বিদেশিরাও। শেষ পর্যন্ত নির্মাণকাজ তত্ত্বাবধানের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল, নিজস্ব অর্থায়নে সেতু করতে গেলে ডলারের সংস্থান। মোট ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের মধ্যে যেটুকু কেনাকাটা স্থানীয়ভাবে হয়েছে, তা টাকায় পরিশোধ করা হয়েছে। আর যা বিদেশ থেকে আনতে হয়েছে, তা ডলারে পরিশোধ করা হয়েছে। সরকার তো আর ডলার ছাপায় না। তাই বিদেশ থেকে শ্রমিকের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাবদ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় যে ডলার আসে, তা খরচ করার ওপর সরকার নিয়ন্ত্রণ আরোপ করল। সেতুর জন্য প্রয়োজনীয় ডলার এসব ব্যাংক থেকে নেওয়া হলো। বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকে ঋণ পাওয়া গেলে সুদ দিতে হতো হয়তো ১ শতাংশ। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দিতে হয়েছে কয়েক গুণ বেশি।
প্রশ্ন: ২৬ জুন যানবাহন চালুর পর রেললাইন পাতার ক্ষেত্রে কি কোনো সমস্যা হতে পারে?
বসুনিয়া: মূল সেতু নির্মাণের সময়ই উভয় পাশে রেলসেতুর জন্য প্রয়োজনীয় ঢালসহ ৭০ ফুট পর্যন্ত উঁচু ভায়াডাক্ট এবং মূল সেতুর নিচের অংশে স্টিলের কাজ করে দেওয়া হয়েছে। এখন রেলের স্লিপার যাতে সমানভাবে বসে, সে জন্য কংক্রিটের আড়াই ইঞ্চি ঢালাই দিয়ে কমপেনসেটিং স্ল্যাব করে নিতে হবে। এর ওপর স্লিপার বসিয়ে তার ওপর রেললাইন পাতা হবে। কমপেনসেটিং স্ল্যাব ঢালাইয়ের সময় গাড়ি চললে কিছু ঝামেলা হতে পারে। তবে সেতুর লোড নেওয়ার যে ব্যবস্থা আছে, তাতে খুব বেশি কম্পন হওয়ার কথা নয়। তার পরও দরকার হলে রাতে সেতুতে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে ঢালাই দেওয়া যেতে পারে।
প্রশ্ন: এই সেতু নির্মাণ থেকে এখানকার তরুণ প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিকর্মীরা কি কিছু শিখলেন?
বসুনিয়া: পদ্মা সেতুর কাজের বিভিন্ন পর্যায়ে মান নিয়ন্ত্রণে এখানে ও চীনে বাংলাদেশের অনেক প্রকৌশলী যুক্ত ছিলেন। অনেক ডিপ্লোমা প্রকৌশলী কাজ করেছেন। যেমন কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত ঝালাই করা এবং ঠিকমতো ঝালাই হলো কি না, তা এক্স-রে দিয়ে পরীক্ষা করা এবং নদীশাসনের কাজ, সবই তো বাঙালিরাই করেছে। তাঁদের অনেকেই বেশ অভিজ্ঞ হয়ে গেছেন। বিশ্বের বহু নির্মাণ সংস্থায় একই ধরনের কাজে তাঁদের অনেকেই সুযোগ পাবেন।
প্রশ্ন: সেতু চালুর পর কী কী বিষয়ে নজর রাখা দরকার হতে পারে?
বসুনিয়া: পদ্মা নদীর তীব্র স্রোত ফেরি ও লঞ্চ চলাচলের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। দুটি পিয়ারের (কলাম) মাঝখানে ৪৫০ ফুট জায়গা আছে। ফেরিগুলো মাত্র ৫০ ফুট চওড়া। সেতু অতিক্রম করে ভাটির দিকে যাওয়ার সময় সাবধানে চললে সেতুতে লাগার কোনো কারণ নেই। দুর্ঘটনা এড়াতে নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষকে কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু সম্পর্কে সবশেষ খবর পেতে - এখানে ক্লিক করুন
প্রশ্ন: পদ্মা সেতুতে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। সেতুর বিদ্যমান বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে ব্যয় কি এর চেয়ে কমানো যেত?
বসুনিয়া: বাংলাদেশে নির্মাণ ব্যয় শুরু ও শেষের হিসাবে পার্থক্য হয়ে যায়, কারণ শুরুতে ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রফর্মা) ঠিকমতো করা হয় না। জমি অধিগ্রহণে ব্যয়ও এখানে বেশি। এর বাইরে পদ্মা সেতুতে খরচ বেশি হওয়ার বড় কারণ নদীর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নির্মাণকাজ করা। তীব্র স্রোত এবং নদীর তলদেশ ও গভীরে মাটির অবস্থা বিবেচনায় সেতুর ভিত্তি মজবুত করার জন্য কমপক্ষে ১২০ মিটার গভীর পাইল করতে হয়েছে। পাইলের অনেক স্থানে বাঁকা করে করতে হয়েছে, যা বেশ ঝামেলার ছিল। সেতুতে স্থাপন করা একেকটি স্প্যানের ওজন ৩ হাজার ১৫০ টন। চীনে নির্মিত এসব স্প্যান আনতে এবং তীব্র স্রোতের নদীতে স্থির থেকে কলামের ওপর স্থাপনে যথাক্রমে শক্তিশালী জাহাজ ও ক্রেন ব্যবহার করতে হলো। এ ধরনের জটিল কাজে অনুমানের বাইরেও বহু ঘটনা ঘটে। যত গভীরে যাবে, কাজে যত অনিশ্চয়তা ও জটিলতা থাকবে, খরচ তত বাড়বে।
পদ্মা সেতু সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
প্রশ্ন: পদ্মা নদীর কী কী বৈশিষ্ট্য সেতু নির্মাণের সময় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল?
বসুনিয়া: প্রথম বিবেচনায় ছিল নদী যেখানে অতিক্রম করতে চাই, সেখানে রাস্তাঘাট আগে থেকেই আছে কি না। থাকলে পুরোপুরি নতুন অ্যালাইনমেন্টে
যেতে হয় না। খরচও কম পড়ে। এ ছাড়া, নদীর বৈশিষ্ট্য কেমন। ভাঙে কেমন।
গতিপথ বদলায় কি না। সেতু যে স্থানে হবে, সেখানকার মাটি কেমন। ভূমিকম্পের প্রবণতা কেমন। এসব করতে করতে শুরুতে দুটি স্থান ঠিক করা হয়েছিল। তবে মাওয়া প্রান্তে বর্তমান স্থানে মাটি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল হওয়ায় এখানেই সেতু নির্মিত হলো।
প্রশ্ন: প্রকৌশলগত দিক থেকে পদ্মা সেতুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য কী কী?
বসুনিয়া: পদ্মা খুবই খরস্রোতা নদী। বেশ গভীর। নদীর তলদেশ ও গভীরে মাটির অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সেতুতে স্প্যান লম্বা দিতে হয়। স্প্যান ছোট দিলে ‘পিয়ার’ (কলাম, যা সাধারণভাবে পিলার হিসেবে পরিচিত) কাছাকাছি দিতে হয়। এতে পানির ঘূর্ণনে নিচে মাটি সরে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। এসব বিবেচনায় প্রতিটি স্প্যান ১৫০ মিটার করা হয়েছে, যা ৫০০ ফুটের বেশি। সেতুতে এ রকম ৪১টি স্প্যান আছে। সব মিলিয়ে সেতুটি ৬ হাজার ১৫০ মিটার দীর্ঘ।
সাধারণ সেতুতে প্রি-স্ট্রেসড কংক্রিট স্প্যান দেওয়া হয়। যমুনার ওপর বঙ্গবন্ধু সেতুর স্প্যান প্রি-স্ট্রেসড বক্স গার্ডার করে করে নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু পদ্মার বর্তমান স্থানে ১৫০ মিটার দীর্ঘ একই ধরনের স্প্যান দিলে ঝামেলা হতো। শুরু থেকেই রেলের ব্যবস্থা এবং মাঝখানে মিডিয়ানসহ চার লেনের প্রশস্ত সেতু নির্মাণের বিষয়টি বিবেচনায় ছিল। শেষ পর্যন্ত সেতুটি ওপরের অংশে ৭২ ফুট চওড়া হয়ে গেছে। এ ছাড়া এখানে দুই ধরনের স্টিল, রিইনফোর্সড কংক্রিট ও প্রি-স্ট্রেসড কংক্রিটের সমন্বয়ে স্প্যানগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সেতুর ভিত্তি মজবুত করার জন্য নদীর তলদেশে কমপক্ষে ১২০ মিটার গভীর পাইল করতে হয়েছে। পাইলের অনেক স্থানে বাঁকা করে করতে হয়েছে, যা বেশ ঝামেলার ছিল।
প্রশ্ন: যমুনার ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে পদ্মা সেতু কীভাবে আলাদা?
বসুনিয়া: বঙ্গবন্ধু সেতু শুরুতে শুধু সড়ক সেতু হিসেবে নির্মাণ আরম্ভ হয়। পরে একপাশে রেললাইন যুক্ত হয়; কিছুটা ঝুলন্ত অবস্থায়। এটা নিরাপদ। কিন্তু সড়কের পাশাপাশি রেল বসাতে গিয়ে লেনগুলো ছোট হয়ে গেছে। বাস যখন যায়, মনে হয় গায়ে গায়ে লেগে যাচ্ছে। পাঁচ কিলোমিটার লম্বা একটি সেতুতে এটা মানানসই ব্যবস্থা নয়। পদ্মা সেতুতে তা হবে না। এটি যথেষ্ট প্রশস্ত সেতু।
প্রশ্ন: পদ্মা সেতুতে কিছু কি নতুন করা হয়েছে, যা পৃথিবীর খুব কম সেতুতেই আছে বা আদৌ নেই?
বসুনিয়া: পদ্মা সেতুর মতো এত গভীরতায় আর কোনো সেতুতে পাইল দেওয়া হয়নি। প্রতিটি পিয়ারের নিচে ছয়টি করে পাইল আছে। সবগুলো পাইল আড়াই ইঞ্চি পুরু স্টিল দিয়ে ১০ ফুট ব্যাসে তৈরি এবং বাঁকা। এর মধ্যে কয়েকটি পিয়ারের নিচে পাইল করার সময় গভীরে কাদামাটি পাওয়া গেল। সেখানে মাটির মান উন্নত করতে তীব্র চাপে রাসায়নিক পদার্থ প্রবেশ করানো হলো। পরে লোড পরীক্ষা করে দেখা গেছে পাইল অনেক শক্তিশালী হয় গেছে।
প্রশ্ন: সেতু কি দেখতে ইংরেজি ‘এস’ আকৃতির?
বসুনিয়া: ঠিক ‘এস’ নয়। সেতুটি বাঁকানো রেখার মতো। দীর্ঘ সেতু সাধারণত সোজা করে নির্মিত হয় না। যমুনার ওপর বঙ্গবন্ধু সেতুও একটু বাঁকা। এর একটি কারণ হলো, কলামের ওপর যেসব বিয়ারিং সেতুর ওজন বহন করে, তার ছয়-সাতটি মিলে একেকটি মডিউল হয়। একেকটি মডিউল শেষে যেখানে নতুন মডিউল শুরু হয়েছে, সেখানেই বাঁক দিতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘ সেতুর একটি মনস্তাত্ত্বিক সমীক্ষা থাকে। সেই সমীক্ষায় বলা হয়, সেতু যদি সোজা হয়, তাহলে গাড়িচালকের একঘেয়েমি আসে। সেতুতে বাঁক থাকলে চালকেরা সতর্ক থাকে। এ ছাড়া, সেতু সোজা থাকলে উল্টো দিকের হেডলাইট থেকে আসা আলোয় চালকের বেশ অসুবিধা হয়। চতুর্থ কারণ হলো, বাঁকা সেতুতে আলো জ্বালানো হলে নান্দনিকতা বেড়ে যায়।
প্রশ্ন: কেন সেতুটি দ্বিতল করতে হলো?
বসুনিয়া: নিচে রেল আর ওপরে গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করতে গিয়ে সেতুটি দ্বিতল করতে হয়েছে। পাশাপাশি উভয় সুবিধা নিতে গেলে আরও চওড়া করতে হতো সেতুটি।
প্রশ্ন: সেতু নির্মাণে কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে?
বসুনিয়া: প্রথম চ্যালেঞ্জ এল বিশ্বব্যাংকের তরফ থেকে। তারা অর্থায়ন বন্ধ করল; একই সঙ্গে অন্য বিদেশিরাও। শেষ পর্যন্ত নির্মাণকাজ তত্ত্বাবধানের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল, নিজস্ব অর্থায়নে সেতু করতে গেলে ডলারের সংস্থান। মোট ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের মধ্যে যেটুকু কেনাকাটা স্থানীয়ভাবে হয়েছে, তা টাকায় পরিশোধ করা হয়েছে। আর যা বিদেশ থেকে আনতে হয়েছে, তা ডলারে পরিশোধ করা হয়েছে। সরকার তো আর ডলার ছাপায় না। তাই বিদেশ থেকে শ্রমিকের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাবদ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় যে ডলার আসে, তা খরচ করার ওপর সরকার নিয়ন্ত্রণ আরোপ করল। সেতুর জন্য প্রয়োজনীয় ডলার এসব ব্যাংক থেকে নেওয়া হলো। বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকে ঋণ পাওয়া গেলে সুদ দিতে হতো হয়তো ১ শতাংশ। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দিতে হয়েছে কয়েক গুণ বেশি।
প্রশ্ন: ২৬ জুন যানবাহন চালুর পর রেললাইন পাতার ক্ষেত্রে কি কোনো সমস্যা হতে পারে?
বসুনিয়া: মূল সেতু নির্মাণের সময়ই উভয় পাশে রেলসেতুর জন্য প্রয়োজনীয় ঢালসহ ৭০ ফুট পর্যন্ত উঁচু ভায়াডাক্ট এবং মূল সেতুর নিচের অংশে স্টিলের কাজ করে দেওয়া হয়েছে। এখন রেলের স্লিপার যাতে সমানভাবে বসে, সে জন্য কংক্রিটের আড়াই ইঞ্চি ঢালাই দিয়ে কমপেনসেটিং স্ল্যাব করে নিতে হবে। এর ওপর স্লিপার বসিয়ে তার ওপর রেললাইন পাতা হবে। কমপেনসেটিং স্ল্যাব ঢালাইয়ের সময় গাড়ি চললে কিছু ঝামেলা হতে পারে। তবে সেতুর লোড নেওয়ার যে ব্যবস্থা আছে, তাতে খুব বেশি কম্পন হওয়ার কথা নয়। তার পরও দরকার হলে রাতে সেতুতে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে ঢালাই দেওয়া যেতে পারে।
প্রশ্ন: এই সেতু নির্মাণ থেকে এখানকার তরুণ প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিকর্মীরা কি কিছু শিখলেন?
বসুনিয়া: পদ্মা সেতুর কাজের বিভিন্ন পর্যায়ে মান নিয়ন্ত্রণে এখানে ও চীনে বাংলাদেশের অনেক প্রকৌশলী যুক্ত ছিলেন। অনেক ডিপ্লোমা প্রকৌশলী কাজ করেছেন। যেমন কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত ঝালাই করা এবং ঠিকমতো ঝালাই হলো কি না, তা এক্স-রে দিয়ে পরীক্ষা করা এবং নদীশাসনের কাজ, সবই তো বাঙালিরাই করেছে। তাঁদের অনেকেই বেশ অভিজ্ঞ হয়ে গেছেন। বিশ্বের বহু নির্মাণ সংস্থায় একই ধরনের কাজে তাঁদের অনেকেই সুযোগ পাবেন।
প্রশ্ন: সেতু চালুর পর কী কী বিষয়ে নজর রাখা দরকার হতে পারে?
বসুনিয়া: পদ্মা নদীর তীব্র স্রোত ফেরি ও লঞ্চ চলাচলের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। দুটি পিয়ারের (কলাম) মাঝখানে ৪৫০ ফুট জায়গা আছে। ফেরিগুলো মাত্র ৫০ ফুট চওড়া। সেতু অতিক্রম করে ভাটির দিকে যাওয়ার সময় সাবধানে চললে সেতুতে লাগার কোনো কারণ নেই। দুর্ঘটনা এড়াতে নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষকে কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু সম্পর্কে সবশেষ খবর পেতে - এখানে ক্লিক করুন
প্রশ্ন: পদ্মা সেতুতে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। সেতুর বিদ্যমান বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে ব্যয় কি এর চেয়ে কমানো যেত?
বসুনিয়া: বাংলাদেশে নির্মাণ ব্যয় শুরু ও শেষের হিসাবে পার্থক্য হয়ে যায়, কারণ শুরুতে ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রফর্মা) ঠিকমতো করা হয় না। জমি অধিগ্রহণে ব্যয়ও এখানে বেশি। এর বাইরে পদ্মা সেতুতে খরচ বেশি হওয়ার বড় কারণ নদীর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নির্মাণকাজ করা। তীব্র স্রোত এবং নদীর তলদেশ ও গভীরে মাটির অবস্থা বিবেচনায় সেতুর ভিত্তি মজবুত করার জন্য কমপক্ষে ১২০ মিটার গভীর পাইল করতে হয়েছে। পাইলের অনেক স্থানে বাঁকা করে করতে হয়েছে, যা বেশ ঝামেলার ছিল। সেতুতে স্থাপন করা একেকটি স্প্যানের ওজন ৩ হাজার ১৫০ টন। চীনে নির্মিত এসব স্প্যান আনতে এবং তীব্র স্রোতের নদীতে স্থির থেকে কলামের ওপর স্থাপনে যথাক্রমে শক্তিশালী জাহাজ ও ক্রেন ব্যবহার করতে হলো। এ ধরনের জটিল কাজে অনুমানের বাইরেও বহু ঘটনা ঘটে। যত গভীরে যাবে, কাজে যত অনিশ্চয়তা ও জটিলতা থাকবে, খরচ তত বাড়বে।
পদ্মা সেতু সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। রোববার (২৪ নভেম্বর) আইন মন্ত্রণালয় থেকে এই সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়
২ ঘণ্টা আগেগণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর দায়িত্ব নিয়ে তড়িঘড়ি করে বেশির ভাগ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন ডিসিদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে এখন নানা রকম অভিযোগ আসছে। এই অবস্থায় নতুন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ডিসি নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
২ ঘণ্টা আগেসংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশন চলতি নভেম্বর মাসের মধ্যে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা শেষ করবে বলে জানিয়েছেন কমিশনটির প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেছেন, ‘যদি কোনো ধরনের অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় তাহলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সুপারিশের খসড়া প্রকাশ করা সম্ভব হবে। সুপারিশ চূড়ান্ত করে সরকারের কাছে দে
৩ ঘণ্টা আগেজাপান বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি জানান, জাপান অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সহায়তা করতে প্রস্তুত এবং দুই দেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
৩ ঘণ্টা আগে