দেবাশীষ দত্ত,কুষ্টিয়া
উপজেলা নেতা থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পর্যন্ত হয়েছেন মাহবুব উল আলম হানিফ। আর আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুযোগে দলের এই পদই ছিল তাঁর পুঁজি। নিজ জেলা কুষ্টিয়া ছাড়াও ঢাকা, গাজীপুরসহ একাধিক জেলায় তাঁর সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এমনকি কানাডায়ও হানিফের সম্পদ ও ব্যবসা আছে বলেও জানিয়েছে একাধিক সূত্র। কেননা, তাঁর স্ত্রী-সন্তান সেখানেই থাকেন। এই সম্পদ গড়ার ক্ষেত্রে কমিশন-বাণিজ্যই বড় নিয়ামক ছিল বলে জানিয়েছেন তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার, ভুক্তভোগী ঠিকাদার ও প্রকৌশলীরা।
আর কুষ্টিয়ার রাজনীতিতে হানিফই ছিল শেষ কথা। দলের প্রতিপক্ষ এবং বিরোধীদের দমনে তিনি সব অস্ত্রই প্রয়োগ করতেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী নেতারা। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে হানিফ আত্মগোপনে।
হানিফের উত্থান যেভাবে
দলীয় সূত্রে জানা যায়, মাহবুব উল আলম হানিফ শেখ পরিবারের আত্মীয়। মূলত তাঁর বড় ভাই সাবেক সচিব রাশিদুল আলম আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই হাসানাত আবদুল্লাহর বোনজামাই। সেই সূত্র ধরে হানিফ কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন তিনি। ১৯৯৬ সালে কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) আসন থেকে মনোনয়ন পান হানিফ। তবে পরাজিত হন। ২০০১ সালেও মনোনয়ন নিয়ে বিজয়ী হতে পারেননি। এরপর ২০০৮ সালে মহাজোট গঠনের পর হানিফ মনোনয়নবঞ্চিত হন। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী করা হয়। পরে ২০১৪ সাল থেকে কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনে তিনবার এমপি নির্বাচিত হন হানিফ। আর দলের কাউন্সিলে পেয়ে যান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ। এরপর বাড়তে থাকে তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি। একাধিকবার একই পদ পেয়ে তা আরও পাকাপোক্ত হয়।
ঘোষিত সম্পদই ২৪ কোটি
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে দাখিল করা হলফনামায় উল্লেখ করা হয়, তখন হানিফের সম্পদ ছিল ৮ কোটি ৫০ লাখ ৭৬ হাজার ৯০৪ টাকা। আর ২০২৪ সালের নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী, বর্তমানে তাঁর সম্পদ ২৪ কোটি ৯৯ লাখ ৬৭ হাজার ১১ টাকা।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে একটি সাধারণ মানের গাড়ি থাকলেও বর্তমানে একাধিক দামি গাড়ির মালিক হানিফ। প্রতিটির দাম কোটি টাকার ওপরে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
নামে-বেনামে সম্পদ
হানিফের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম কোয়েস্ট ইন্টারন্যাশনাল। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে তাঁর ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক অফিস। নির্বাচনী হলফনামায় আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবসার কথা উল্লেখ করেন তিনি। স্ত্রীর নামে কুষ্টিয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইসেন্স নেন। লালন কলা বিশ্ববিদ্যালয় নামে কার্যক্রম শুরু করেছিলেন জেলা পরিষদের নতুন ভবনে।
জেলা পরিষদ সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সপ্তম ও অষ্টমতলা মাসে ৩ লাখ টাকায় ভাড়া নেন হানিফ। আর এককালীন দিয়েছিলেন প্রায় ৫০ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠান সাজাতে বিনিয়োগ করেছিলেন কয়েক কোটি টাকা। শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা শেষ হলেও পটপরিবর্তনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রয়েছে।
দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে গত ১৫ বছরে কয়েক শ কোটি টাকা বানিয়েছেন হানিফ। দেশে কয়েকটি বড় কোম্পানির সঙ্গে বেনামে হানিফের ব্যবসা আছে। এ ছাড়া গাজীপুরে পার্টনারে রিসোর্ট, কক্সবাজারে জমিসহ সম্পদ রয়েছে।
কুষ্টিয়ায় হানিফের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতার যে মার্কেট, দোকান ও শপিং মল আছে, সেগুলো দুজন মিলেই কিনেছেন বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে জেলা পরিষদ অফিস সূত্র জানিয়েছে, তাঁদের নতুন দুটি দোকান নেওয়া আছে কোটি টাকায়।
এ ছাড়া তমিজ উদ্দিন মার্কেট কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক আজকের পত্রিকাকে জানান, খেলার মাঠের পাশে দোতলা নতুন যে মার্কেট হয়েছে, সেখানে ৮টি দোকান আছে হানিফ-আতার নামে। দোকানের ভাড়াটেরা জানান, প্রতি মাসে হানিফের ভাই আতা টাকা তুলতেন।
জেলা পরিষদের বটতৈল এলাকায় হানিফ পরিবারের ১২টি দোকানের খোঁজ পাওয়া গেছে। প্রতিটি দোকান ভাড়া দেওয়া আছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিন বলেন, মার্কেট নির্মাণ করার পর এখানে হানিফ তাঁর ভাইয়ের নামে ১২টি দোকান নেন। এসব দোকান থেকে মাসে লাখ টাকার বেশি ভাড়া ওঠে।
শহরের বহুতল বিপণিবিতান পরিমল টাওয়ারেও একাধিক দোকান আছে হানিফ ও আতার নামে। মার্কেট কমিটি জানায়, দুটি দোকানের দাম কোটি টাকার ওপরে। ভাড়া দেওয়া আছে দোকান দুটি। ভাড়া ওঠে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া সমবায় মার্কেটের নিচ ও দোতলায় একাধিক দোকান আছে। সেখানে ব্যবসা আছে হানিফ-আতার।
এদিকে শহরের হাউজিংয়ে ৫ কাঠার প্লটের ওপর ১০ তলা বাড়ি নির্মাণ করা হয় কয়েক বছর আগে। প্রতি তলায় ৪টি করে ফ্ল্যাট আছে। হাউজিং এলাকার বাসিন্দা আনিসুর রহমান বলেন, হাউজিংয়ের জমির সঙ্গে স্থানীয় একজনের জমি দখল করে এ বাড়ি নির্মাণ করা হয়।
আতার নামে হলেও পেছনে ছিলেন হানিফ। আর পিটিআই রোডে ৪ কাঠা জমির ওপর তিনতলা বাড়ি নির্মাণ করেন হানিফ। তবে কাগজ-কলমে তা ভাই আতা ও তাঁর স্ত্রীর নামে। প্রথম দিকে লালন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড এ বাড়িতে লাগানো হয়। আতার সম্পদ নিয়ে দুদক অনুসন্ধান করার পর সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
দল ও অন্য কয়েকটি সূত্র জানায়, কুষ্টিয়ার শীর্ষ ব্যবসায়ী অজয় সুরেকারের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যবসায় কয়েক কোটি টাকা লগ্নি আছে হানিফের। এসব কারণে অজয় সুরেকাকে জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অজয় সুরেকার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘জোর করে দলীয় পদ দেওয়া ছাড়া হানিফের সাথে অন্য কোনো সম্পর্ক নেই।’
কমিশন-বাণিজ্য
ঠিকাদার ও ব্যবসায়িক অংশীদার সূত্রে জানা গেছে, দলের প্রভাব কাজে লাগিয়ে নদী খননের বড় বড় কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন হানিফ। তাঁর নিজের একাধিক ড্রেজার আছে। সর্বশেষ গড়াই খননের একটি কাজ বাগিয়ে নেন তিনি। সরকারি খরচের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি খরচে তিনি কাজ করেন। এতে তাঁর নিজের ৩টি ড্রেজার কাজে লাগান। প্রতিটি ড্রেজারের দাম ৩০ কোটি টাকার বেশি বলে সূত্র জানিয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশের বিতর্কিত একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গে বেনামে যৌথ ব্যবসা আছে হানিফের। নদী খনন ও শাসনের কাজ করতেন তাঁরা দুজন। ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কাজের নামে কয়েক কোটি টাকা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদার জানান, সর্বশেষ কুষ্টিয়ার মিরপুর ও ভেড়ামারায় পদ্মা নদী শাসনের জন্য ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস হয়। কাজ ভাগাভাগি হয় হানিফের ঢাকা অফিসে বসে। সেখানে হানিফ একাই ৫০০ কোটি টাকার কাজ নিজের কবজায় নিয়ে নেন। এসব কাজ পরে কমিশনে বিক্রি করে দেন।
হানিফের সময়ে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্প, কুষ্টিয়া শহর ফোর লেন সড়ক প্রশস্তকরণ, কুষ্টিয়া বাইপাস সড়ক নির্মাণ, শেখ রাসেল কুষ্টিয়া-হরিপুর সেতু নির্মাণ প্রকল্প, মুজিবনগর সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পসহ বড় বড় অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রতিটি প্রকল্প থেকে তিনি কমিশন নিয়েছেন বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া নিয়োগ-বাণিজ্য, বালুঘাটের কমিশনসহ অন্যান্য কাজ থেকে যে টাকা আদায় হতো, তা আতার মাধ্যমে সংগ্রহ করতেন তিনি। সেই টাকা আতা নিজে হানিফের কাছে পৌঁছে দিতেন বলে জানান দলের নেতারা। সর্বশেষ কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে হানিফের পছন্দের প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি।
কুষ্টিয়া শহরের ফোর লেন সড়ক নির্মাণকাজের একটি প্যাকেজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হানিফের পার্টনারশিপ থাকা স্প্রেকটা লিমিটেড। এ লাইসেন্সে হানিফ নিজেই কাজ করেন।
এ ছাড়া মুজিবনগর সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পে গত ৪ বছরে কয়েক শ কোটি টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকৌশলী ও ঠিকাদারেরা। সব কাজ ভাভাভাগি করেছেন হানিফ ও তাঁর ভাই আতাসহ আওয়ামী লীগের নেতারা। মুজিবনগর সমন্বিত প্রকল্পের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রকৌশলী জানান, টেন্ডারে বেশির ভাগ কাজ নিতেন আতা। হানিফের নির্দেশে তাঁকে বড় বড় কাজ দিতে হয়েছে।
প্রতিপক্ষের নেতা-কর্মীদের নির্যাতন
হানিফের অত্যাচার-নির্যাতন থেকে বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি বাদ যাননি দলের নেতা-কর্মীরাও। জেলা যুবদল নেতা আল আমিন কানাই বলেন, ‘গত নির্বাচনের আগে একজন কাউন্সিলর আমার বাসায় গিয়ে জানান, হানিফের ভাই আতাউর রহমান আতা সাহেব চা খাবেন। আমি বলি, এত বড় নেতার সাথে চা খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এরপর থেকে তারা আমার বাড়িতে মাস্তান পাঠিয়ে হেনস্তা করে, আমার নামে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে।’ স্ট্রোকে এখন অসুস্থ আমিন কানাই বলেন, ‘তারা আমাকেসহ দলের বহু নেতাকে গত ১৬ বছরে শেষ করে দিয়েছে।’
কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ডা. আমিনুল হক রতন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘হানিফ-আতা এই দুই ভাইয়ের কারণে কুষ্টিয়ার রাজনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। একক আধিপত্য বিস্তার করে আওয়ামী লীগের আদর্শ থেকে তাঁরা বিচ্যুতি হয়েছিলেন।’
উপজেলা নেতা থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পর্যন্ত হয়েছেন মাহবুব উল আলম হানিফ। আর আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুযোগে দলের এই পদই ছিল তাঁর পুঁজি। নিজ জেলা কুষ্টিয়া ছাড়াও ঢাকা, গাজীপুরসহ একাধিক জেলায় তাঁর সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এমনকি কানাডায়ও হানিফের সম্পদ ও ব্যবসা আছে বলেও জানিয়েছে একাধিক সূত্র। কেননা, তাঁর স্ত্রী-সন্তান সেখানেই থাকেন। এই সম্পদ গড়ার ক্ষেত্রে কমিশন-বাণিজ্যই বড় নিয়ামক ছিল বলে জানিয়েছেন তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার, ভুক্তভোগী ঠিকাদার ও প্রকৌশলীরা।
আর কুষ্টিয়ার রাজনীতিতে হানিফই ছিল শেষ কথা। দলের প্রতিপক্ষ এবং বিরোধীদের দমনে তিনি সব অস্ত্রই প্রয়োগ করতেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী নেতারা। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে হানিফ আত্মগোপনে।
হানিফের উত্থান যেভাবে
দলীয় সূত্রে জানা যায়, মাহবুব উল আলম হানিফ শেখ পরিবারের আত্মীয়। মূলত তাঁর বড় ভাই সাবেক সচিব রাশিদুল আলম আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই হাসানাত আবদুল্লাহর বোনজামাই। সেই সূত্র ধরে হানিফ কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন তিনি। ১৯৯৬ সালে কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) আসন থেকে মনোনয়ন পান হানিফ। তবে পরাজিত হন। ২০০১ সালেও মনোনয়ন নিয়ে বিজয়ী হতে পারেননি। এরপর ২০০৮ সালে মহাজোট গঠনের পর হানিফ মনোনয়নবঞ্চিত হন। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী করা হয়। পরে ২০১৪ সাল থেকে কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনে তিনবার এমপি নির্বাচিত হন হানিফ। আর দলের কাউন্সিলে পেয়ে যান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ। এরপর বাড়তে থাকে তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি। একাধিকবার একই পদ পেয়ে তা আরও পাকাপোক্ত হয়।
ঘোষিত সম্পদই ২৪ কোটি
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে দাখিল করা হলফনামায় উল্লেখ করা হয়, তখন হানিফের সম্পদ ছিল ৮ কোটি ৫০ লাখ ৭৬ হাজার ৯০৪ টাকা। আর ২০২৪ সালের নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী, বর্তমানে তাঁর সম্পদ ২৪ কোটি ৯৯ লাখ ৬৭ হাজার ১১ টাকা।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে একটি সাধারণ মানের গাড়ি থাকলেও বর্তমানে একাধিক দামি গাড়ির মালিক হানিফ। প্রতিটির দাম কোটি টাকার ওপরে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
নামে-বেনামে সম্পদ
হানিফের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম কোয়েস্ট ইন্টারন্যাশনাল। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে তাঁর ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক অফিস। নির্বাচনী হলফনামায় আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবসার কথা উল্লেখ করেন তিনি। স্ত্রীর নামে কুষ্টিয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইসেন্স নেন। লালন কলা বিশ্ববিদ্যালয় নামে কার্যক্রম শুরু করেছিলেন জেলা পরিষদের নতুন ভবনে।
জেলা পরিষদ সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সপ্তম ও অষ্টমতলা মাসে ৩ লাখ টাকায় ভাড়া নেন হানিফ। আর এককালীন দিয়েছিলেন প্রায় ৫০ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠান সাজাতে বিনিয়োগ করেছিলেন কয়েক কোটি টাকা। শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা শেষ হলেও পটপরিবর্তনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রয়েছে।
দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে গত ১৫ বছরে কয়েক শ কোটি টাকা বানিয়েছেন হানিফ। দেশে কয়েকটি বড় কোম্পানির সঙ্গে বেনামে হানিফের ব্যবসা আছে। এ ছাড়া গাজীপুরে পার্টনারে রিসোর্ট, কক্সবাজারে জমিসহ সম্পদ রয়েছে।
কুষ্টিয়ায় হানিফের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতার যে মার্কেট, দোকান ও শপিং মল আছে, সেগুলো দুজন মিলেই কিনেছেন বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে জেলা পরিষদ অফিস সূত্র জানিয়েছে, তাঁদের নতুন দুটি দোকান নেওয়া আছে কোটি টাকায়।
এ ছাড়া তমিজ উদ্দিন মার্কেট কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক আজকের পত্রিকাকে জানান, খেলার মাঠের পাশে দোতলা নতুন যে মার্কেট হয়েছে, সেখানে ৮টি দোকান আছে হানিফ-আতার নামে। দোকানের ভাড়াটেরা জানান, প্রতি মাসে হানিফের ভাই আতা টাকা তুলতেন।
জেলা পরিষদের বটতৈল এলাকায় হানিফ পরিবারের ১২টি দোকানের খোঁজ পাওয়া গেছে। প্রতিটি দোকান ভাড়া দেওয়া আছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিন বলেন, মার্কেট নির্মাণ করার পর এখানে হানিফ তাঁর ভাইয়ের নামে ১২টি দোকান নেন। এসব দোকান থেকে মাসে লাখ টাকার বেশি ভাড়া ওঠে।
শহরের বহুতল বিপণিবিতান পরিমল টাওয়ারেও একাধিক দোকান আছে হানিফ ও আতার নামে। মার্কেট কমিটি জানায়, দুটি দোকানের দাম কোটি টাকার ওপরে। ভাড়া দেওয়া আছে দোকান দুটি। ভাড়া ওঠে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া সমবায় মার্কেটের নিচ ও দোতলায় একাধিক দোকান আছে। সেখানে ব্যবসা আছে হানিফ-আতার।
এদিকে শহরের হাউজিংয়ে ৫ কাঠার প্লটের ওপর ১০ তলা বাড়ি নির্মাণ করা হয় কয়েক বছর আগে। প্রতি তলায় ৪টি করে ফ্ল্যাট আছে। হাউজিং এলাকার বাসিন্দা আনিসুর রহমান বলেন, হাউজিংয়ের জমির সঙ্গে স্থানীয় একজনের জমি দখল করে এ বাড়ি নির্মাণ করা হয়।
আতার নামে হলেও পেছনে ছিলেন হানিফ। আর পিটিআই রোডে ৪ কাঠা জমির ওপর তিনতলা বাড়ি নির্মাণ করেন হানিফ। তবে কাগজ-কলমে তা ভাই আতা ও তাঁর স্ত্রীর নামে। প্রথম দিকে লালন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড এ বাড়িতে লাগানো হয়। আতার সম্পদ নিয়ে দুদক অনুসন্ধান করার পর সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
দল ও অন্য কয়েকটি সূত্র জানায়, কুষ্টিয়ার শীর্ষ ব্যবসায়ী অজয় সুরেকারের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যবসায় কয়েক কোটি টাকা লগ্নি আছে হানিফের। এসব কারণে অজয় সুরেকাকে জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অজয় সুরেকার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘জোর করে দলীয় পদ দেওয়া ছাড়া হানিফের সাথে অন্য কোনো সম্পর্ক নেই।’
কমিশন-বাণিজ্য
ঠিকাদার ও ব্যবসায়িক অংশীদার সূত্রে জানা গেছে, দলের প্রভাব কাজে লাগিয়ে নদী খননের বড় বড় কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন হানিফ। তাঁর নিজের একাধিক ড্রেজার আছে। সর্বশেষ গড়াই খননের একটি কাজ বাগিয়ে নেন তিনি। সরকারি খরচের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি খরচে তিনি কাজ করেন। এতে তাঁর নিজের ৩টি ড্রেজার কাজে লাগান। প্রতিটি ড্রেজারের দাম ৩০ কোটি টাকার বেশি বলে সূত্র জানিয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশের বিতর্কিত একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গে বেনামে যৌথ ব্যবসা আছে হানিফের। নদী খনন ও শাসনের কাজ করতেন তাঁরা দুজন। ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কাজের নামে কয়েক কোটি টাকা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদার জানান, সর্বশেষ কুষ্টিয়ার মিরপুর ও ভেড়ামারায় পদ্মা নদী শাসনের জন্য ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস হয়। কাজ ভাগাভাগি হয় হানিফের ঢাকা অফিসে বসে। সেখানে হানিফ একাই ৫০০ কোটি টাকার কাজ নিজের কবজায় নিয়ে নেন। এসব কাজ পরে কমিশনে বিক্রি করে দেন।
হানিফের সময়ে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্প, কুষ্টিয়া শহর ফোর লেন সড়ক প্রশস্তকরণ, কুষ্টিয়া বাইপাস সড়ক নির্মাণ, শেখ রাসেল কুষ্টিয়া-হরিপুর সেতু নির্মাণ প্রকল্প, মুজিবনগর সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পসহ বড় বড় অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রতিটি প্রকল্প থেকে তিনি কমিশন নিয়েছেন বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া নিয়োগ-বাণিজ্য, বালুঘাটের কমিশনসহ অন্যান্য কাজ থেকে যে টাকা আদায় হতো, তা আতার মাধ্যমে সংগ্রহ করতেন তিনি। সেই টাকা আতা নিজে হানিফের কাছে পৌঁছে দিতেন বলে জানান দলের নেতারা। সর্বশেষ কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে হানিফের পছন্দের প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি।
কুষ্টিয়া শহরের ফোর লেন সড়ক নির্মাণকাজের একটি প্যাকেজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হানিফের পার্টনারশিপ থাকা স্প্রেকটা লিমিটেড। এ লাইসেন্সে হানিফ নিজেই কাজ করেন।
এ ছাড়া মুজিবনগর সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পে গত ৪ বছরে কয়েক শ কোটি টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকৌশলী ও ঠিকাদারেরা। সব কাজ ভাভাভাগি করেছেন হানিফ ও তাঁর ভাই আতাসহ আওয়ামী লীগের নেতারা। মুজিবনগর সমন্বিত প্রকল্পের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রকৌশলী জানান, টেন্ডারে বেশির ভাগ কাজ নিতেন আতা। হানিফের নির্দেশে তাঁকে বড় বড় কাজ দিতে হয়েছে।
প্রতিপক্ষের নেতা-কর্মীদের নির্যাতন
হানিফের অত্যাচার-নির্যাতন থেকে বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি বাদ যাননি দলের নেতা-কর্মীরাও। জেলা যুবদল নেতা আল আমিন কানাই বলেন, ‘গত নির্বাচনের আগে একজন কাউন্সিলর আমার বাসায় গিয়ে জানান, হানিফের ভাই আতাউর রহমান আতা সাহেব চা খাবেন। আমি বলি, এত বড় নেতার সাথে চা খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এরপর থেকে তারা আমার বাড়িতে মাস্তান পাঠিয়ে হেনস্তা করে, আমার নামে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে।’ স্ট্রোকে এখন অসুস্থ আমিন কানাই বলেন, ‘তারা আমাকেসহ দলের বহু নেতাকে গত ১৬ বছরে শেষ করে দিয়েছে।’
কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ডা. আমিনুল হক রতন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘হানিফ-আতা এই দুই ভাইয়ের কারণে কুষ্টিয়ার রাজনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। একক আধিপত্য বিস্তার করে আওয়ামী লীগের আদর্শ থেকে তাঁরা বিচ্যুতি হয়েছিলেন।’
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসায়িক অংশীদারিত্বের উপর জোর দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। মার্কিন সাময়িকী টাইমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছে, তিনি ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ম
৫ ঘণ্টা আগে‘আওয়ামী লীগও অন্য যে কোনো দলের মতো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। আমরা তাঁদের রাজনৈতিক ময়দানে প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত। তবে এর আগে তাদের আচরণ এবং অতীতে সংঘটিত অপরাধের জন্য দায় মেনে নিতে হবে। একবার তাঁরা আইনি বাধাগুলো কাটিয়ে উঠলে নির্বাচনে তাদের স্বাগত জানানো হবে।’
৭ ঘণ্টা আগেমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের ক্লাসের অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী তথ্যপ্রাপ্তির আবেদন করতে দিলে এই আইন সম্পর্কে ধারণা ও বাস্তবায়ন বাড়বে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান।
৭ ঘণ্টা আগেপুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে ৫৪ জন কর্মকর্তাকে বদলি ও নতুন কর্মস্থলে পদায়ন করা হয়েছে। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে ৩১ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং ২৩ জন সহকারী পুলিশ সুপার রয়েছেন। গতকাল বুধবার (২০ নভেম্বর) প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেছেন বিদায়ী পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম।
৯ ঘণ্টা আগে