সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহে অনীহা, পাচ্ছে বেসরকারি

  • সরকারি কেন্দ্র রূপসায় গ্যাস দিতে রাজি নয় মন্ত্রণালয়
  • রূপসা ৩ বছরের মধ্যে চালু না হলে যন্ত্রপাতি নষ্ট হবে
  • সামিট, ইউনিক, রিলায়েন্সের কেন্দ্রে গ্যাস দিতে বেশি আগ্রহী সরকার
আরিফুজ্জামান তুহিন, ঢাকা
প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯: ৪১
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০: ২৫
ফাইল ছবি

খুলনার রূপসায় নিউজপ্রিন্ট মিলের জায়গায় ৪০০ মেগাওয়াটের দুই ইউনিটে ৮০০ মেগাওয়াটের একটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে বেশ কিছুদিন আগে। প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত কেন্দ্রটি আগামী তিন বছরের মধ্যে চালু না হলে যন্ত্রপাতি নষ্ট হতে থাকবে। এ কারণে কেন্দ্রটিতে জরুরি ভিত্তিতে গ্যাস দিতে চায় পেট্রোবাংলা। কিন্তু বাদ সেধেছে সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। তারা এই কেন্দ্রে গ্যাস দেবে না। অথচ এই কেন্দ্রের পরে অনুমতি পাওয়া মেঘনাঘাটে সামিট গ্রুপের ৫৮৩ মেগাওয়াট এবং আওয়ামী লীগ আমলের আরেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের ৫৮৪ মেগাওয়াট কেন্দ্রে গ্যাস দিচ্ছে সরকার। এমনকি একই স্থানে ভারতের রিলায়েন্সের ৭১৮ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটিতেও গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে।

বেসরকারি ও বিদেশি কোম্পানির কেন্দ্রে গ্যাস দিলেও সরকারি কেন্দ্র রূপসায় গ্যাস দিতে রাজি নয় মন্ত্রণালয়। শুধু তা-ই নয়, সরকারি কেন্দ্রে গ্যাস দেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে বক্তব্য উত্থাপন করায় এক যুগ্ম সচিবকে রাতারাতি বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে সরিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে বলে জানা গেছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ ও জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হলে সেটির জ্বালানির নিশ্চয়তা নিতে হয় জ্বালানি বিভাগের প্রতিষ্ঠান থেকে। যদি গ্যাস হয়, তাহলে সেটির নিশ্চয়তা দিতে হয় পেট্রোবাংলাকে। এই নিশ্চয়তা পাওয়ার পর ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটি পৃথক চুক্তি করে। খুলনার রূপসা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালনাকারী শতভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠান নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড। ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পেট্রোবাংলা এই প্রকল্পে ২০২০ সাল নাগাদ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা দেয়। এরপর ২০১৮ সালের ২২ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রের প্রকল্পটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) পাস হয়। ওই বছরের ২ আগস্ট কেন্দ্রটির জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৫০ কেটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে। গ্যাস সরবরাহকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির সঙ্গে গত ২৮ মার্চ প্রকল্পের গ্যাস সরবরাহ চুক্তি সই হয়। কারণ, জরুরিভিত্তিক কেন্দ্রে পেট্রোবাংলা গ্যাস সরবরাহে একটি বিকল্প উপায় বের করে। এর অনেক পরে সামিট, চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের ইউনিকের কেন্দ্রের সঙ্গে গ্যাস সরবরাহ চুক্তি হয়েছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রকৌশলীরা বলছেন, রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রে দুটি উৎস থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছিল। এর একটি হলো ভারত থেকে এইচএস এনার্জি পাইপলাইনের মাধ্যমে এলএনজি সরবরাহ করবে। অন্যটি হলো পটুয়াখালীর পায়রার এলএনজি টার্মিনাল থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে এই কেন্দ্রে গ্যাস আনা হবে। পটুয়াখালীর পায়রাতে সরকারি প্রতিষ্ঠান নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে যৌথভাবে জার্মানির সিমেন্সের সঙ্গে যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানি গঠনে চুক্তিও সই হয়। বলা হয়, সেখানে তারা একটি ৩৬০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে। সেই কেন্দ্রের জন্য একটি এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করবে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাকসিলারেট এনার্জি। কিন্তু এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সামিট গ্রুপ। কারণ, সরকারের ওপর প্রভাব বাড়িয়ে সামিট কাজটি পেতে চায়। এরপর ঠিক হয়, পায়রাতে দুটি এলএনজি টার্মিনাল করা হবে; একটি পাবে সামিট, অন্যটি করবে অ্যাকসিলারেট; যার গ্যাস ৩৬০০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রে ব্যবহার হবে। আর এই দুই টার্মিনালের বাকি গ্যাস যাবে খুলনার শিল্পাঞ্চলে। এ ছাড়া সরকার ভারতের এইচএস এনার্জির সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখে, তবে এইচএস এনার্জির সঙ্গে তৎকালীন জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর ঘনিষ্ঠতা থাকায় এই আলোচনাটি একটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের মধ্যে আটকে যায়। এতে আটকা পড়ে যায় খুলনার রূপসা বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাস প্রাপ্যতার বিষয়টি।

জানা গেছে, রূপসা কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ নিয়ে মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হয়েছিল। সেখানে পেট্রোবাংলার এই প্রস্তাব দেওয়ার পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির বলেন, পাইপলাইনে গ্যাস দিলে তা অন্য কলকারখানা টেনে নেবে। তখন তাঁকে যুগ্ম সচিব মনোয়ার হোসেন জানান, এই পাইপলাইনে কোনো সংযোগ দেওয়া হয়নি। আর যদি অনুমতি না মেলে, তাহলে কেউ কোনো জাতীয় গ্রিড থেকে গ্যাস নিতে পারবে না। তখন উপদেষ্টা সাফ জানিয়ে দেন, রূপসা কেন্দ্রে গ্যাস যাবে না। আর বৈঠকে উপদেষ্টাকে যুক্তি দেওয়ায় বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে মুহূর্তে সরিয়ে দেওয়া হয় যুগ্ম সচিব মনোয়ার হোসেনকে।

দেশে বর্তমানে মোট উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ৪৮১ মেগাওয়াটের মধ্যে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদনক্ষমতা ১০ হাজার ৭১২ মেগাওয়াট। এসব কেন্দ্র চালাতে দৈনিক প্রায় ২০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস দরকার হয়। দেশে সর্বোচ্চ ৩৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করতে পারে পেট্রোবাংলা, যার মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে দিতে পারে ১০০ কোটি ঘনফুট। বর্তমান গ্যাস-সংকটে পেট্রোবাংলার মোট সরবরাহ ২৫০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাত পাচ্ছে মাত্র ৭০ কোটি ঘনফুট। সরকারি মালিকানাধীন কেন্দ্রগুলোয় গ্যাস না দিয়ে গত সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট সামিট, চৌধুরী নাফিজ সরাফাত, ভারতের রিলায়েন্সের মতো কেন্দ্রে গ্যাস দিতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে সরকার।

এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, সামিট, রিলায়েন্স, নাফিজ সরাফাতের কোম্পানিগুলোর সব চুক্তি খতিয়ে দেখতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে গ্যাস না দেওয়াটা দুঃখজনক। জনগণের রক্তের ওপর দাঁড়ানো সরকার যদি ভারতপন্থী হয়ে যায়, তাহলে তো দুঃখের সীমা থাকে না।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ইসরায়েলের ‘হৃৎপিণ্ড’ তেল আবিবে হুতিদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

সাগরে নিম্নচাপ, কত দিন বৃষ্টি হতে পারে জানাল আবহাওয়া দপ্তর

শেখ মুজিব ও জিয়াউর রহমান যার যার স্থানে শ্রেষ্ঠ: গয়েশ্বর

র‌্যাব বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি: নূর খান লিটন

হাসিনার আমলে রাশিয়ার সঙ্গে ১০০ কোটি ডলারের অস্ত্র চুক্তি, জড়াল টিউলিপের নামও

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত