Ajker Patrika

ট্রাম্পের শুল্কে বাংলাদেশের সর্বনাশ, ভারতসহ যাদের পৌষ মাস

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৭: ৫৪
সব আমদানি পণ্যে বিভিন্ন মাত্রায় শুল্ক আরোপ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত
সব আমদানি পণ্যে বিভিন্ন মাত্রায় শুল্ক আরোপ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত

ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিশানা ছিল চীন, তবে শিকার হলো প্রায় সবাই। তাঁর নতুন শুল্কনীতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের মতো অনেক ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক অংশীদার চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে। তবে ‘কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ’ প্রবাদটি যেন ফলছে এখানে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, কিছুটা চাপে পড়লেও এই শুল্কযুদ্ধ থেকে ফসল ঘরে তুলতে পারে ব্রাজিল, মিসর, মরক্কো, ভারত ও কেনিয়ার মতো কিছু দেশ। দেশগুলো একধরনের কৌশলগত সুবিধা পেতে পারে। তবে এ সুফল স্থায়ী হবে কি না, তা নির্ভর করবে ট্রাম্প প্রশাসনের পরবর্তী নীতিনির্ধারণী পদক্ষেপ আর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবেশের গতিপথের ওপর।

ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে এমনটি জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি মিত্র ও ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর ২০ শতাংশ বা তার বেশি হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ট্রাম্পের নতুন এই শুল্কনীতি ৯ এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। তবে এ-যাত্রায় ‘রক্ষা’ পাওয়া দেশগুলোর একটি হলো ব্রাজিল। দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মাত্র ১০ শতাংশ ‘পারস্পরিক’ আমদানি শুল্ক নিয়ে সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে ব্রাজিল নিট আমদানিকারক দেশ। চীন ও অন্যান্য বৃহৎ রপ্তানিকারকদের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের এই বাণিজ্যযুদ্ধ থেকে কিছু দেশ যে সুযোগ নিতে পারে, তা চোখে আঙুল দিয়েই দেখিয়েছে লাতিন আমেরিকার দেশটি।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতিতে থাকা মরক্কো, মিসর, তুরস্ক ও সিঙ্গাপুর এখন বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোর বিপর্যয় থেকে সুবিধা নিতে পারে। কারণ, এ দুটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রে বিশাল পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করে এবং ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের ওপর যথাক্রমে ৩৭ শতাংশ ও ৪৬ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। অন্যদিকে ব্রাজিল ও তার প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর মাত্র ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতির তুলনায় অনেকটাই নমনীয়।

মিসরের টেক্সটাইল কোম্পানি টি অ্যান্ড সি গার্মেন্টসের চেয়ারম্যান মাগদি তোলবা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র শুধু মিসরের ওপর শুল্ক আরোপ করেনি, অন্য অনেক দেশের ওপর আরও বেশি হারে শুল্ক বসিয়েছে। এটি মিসরের জন্য বড় সুযোগ এনে দিচ্ছে।

চীন, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামকে মিসরের প্রধান প্রতিযোগী হিসেবে উল্লেখ করে তোলবা বলেন, ‘সুযোগটা একেবারে চোখের সামনে। এখন আমাদের শুধু এটাকে কাজে লাগাতে হবে।’

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কে তুরস্কের লোহা, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম রপ্তানি আগেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন অন্য দেশগুলোর ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপের ফলে তুলনামূলকভাবে লাভবান হতে পারে। তুরস্কের বাণিজ্যমন্ত্রী ওমের বোলাত এই শুল্ক পরিস্থিতিকে ‘সবচেয়ে খারাপের মধ্যে সেরা’ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ, অন্য অনেক দেশের তুলনায় তুরস্কের ওপর শুল্কের হার অপেক্ষাকৃত কম।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মরক্কোর একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও এশিয়ার সাবেক শক্তিধর অর্থনৈতিক দেশগুলোর ক্ষতির মধ্যে আপাতভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে দেশটির। একজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ট্রাম্পের শুল্ক এখন মরক্কোর জন্য একটি সুযোগ হয়ে এসেছে। যেসব বৈদেশিক বিনিয়োগকারী যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করতে চান, তাঁদের জন্য ১০ শতাংশ শুল্ক তুলনামূলক আকর্ষণীয় হতে পারে।

তবে ওই কর্মকর্তা ও অন্যান্য বিশ্লেষক সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ঝুঁকি এখনো বিদ্যমান। সম্প্রতি চীনা কোম্পানি গোশন হাইটেক ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের একটি বড় বিনিয়োগ করছে মিসরে। এই টাকায় আফ্রিকার প্রথম গিগাফ্যাক্টরি নির্মাণ করা হবে। এটি ট্রাম্প ভালোভাবে না-ও নিতে পারেন।

মরক্কোর ইনস্টিটিউট ফর পলিসি অ্যানালাইসিসের অর্থনীতিবিদ রাশিদ আওররাজ বলেন, ‘মরক্কোর সিংহভাগ রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রে না হলেও শুল্কের সামগ্রিক ধাক্কা এবং মন্দার আশঙ্কা আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলতে পারে।’

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্তে থাকা কেনিয়ার ওপর তুলনামূলকভাবে কম শুল্ক আরোপ হলেও দেশটিতে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে; বিশেষ করে টেক্সটাইল উৎপাদকেরা আশাবাদী যে মোটা শুল্কে জর্জরিতদের তুলনায় তাঁরা একটু বেশি সুবিধা নিতে পারবেন।

একই ধরনের উদ্বেগ সিঙ্গাপুরেও দেখা যাচ্ছে। গতকাল সোমবার দেশটির শেয়ারবাজারে সূচক ৭ দশমিক ৫ শতাংশ পড়ে গেছে, যা ২০০৮ সালের পর সবচেয়ে বড় পতন। আজ মঙ্গলবারও এই পতন অব্যাহত ছিল।

ওসিবিসি ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ সেলেনা লিং বলেন, বিনিয়োগকারীরা বিকল্প হিসেবে সিঙ্গাপুরের মতো জায়গায় যেতে পারেন; কিন্তু এখানে এখনো স্থানীয় উৎপাদন ও কনটেন্ট-সম্পর্কিত কঠোর নীতিমালা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বা বৈশ্বিক অর্থনীতি বড় ধাক্কা খেলে আদতে কেউই জয়ী হবে না—সবই আপেক্ষিক।

মেব্যাঙ্কের অর্থনীতিবিদ চুয়া হাক বিন বলেন, সিঙ্গাপুর বিশ্ব বাণিজ্যযুদ্ধে জিততে পারবে না; কারণ, দেশটি বিশ্ব বাণিজ্যের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল।

এদিকে ভারত ২৬ শতাংশ শুল্কের মুখে পড়লেও এশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। রয়টার্সের হাতে আসা এক সরকারি মূল্যায়নে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে টেক্সটাইল, পোশাক ও পাদুকা খাতে অংশীদারত্ব বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে দেশটির।

শুল্ক ঘোষণার পরপরই ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বাণিজ্যনীতির কারণে সৃষ্ট সম্ভাব্য সুযোগগুলো বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তারা অ্যাপলের আইফোন উৎপাদনের আরও বড় অংশ চীন থেকে ভারতে সরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। কারণ, শুল্ক পার্থক্য সুবিধা এনে দিতে পারে। যদিও ২৬ শতাংশ শুল্কেও যুক্তরাষ্ট্রে আইফোনের দাম বেশ বাড়বে।

দক্ষিণ আমেরিকা এখনো রপ্তানির জন্য ও শস্য জাতীয় পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। সেখানেও আশাবাদ দেখা যাচ্ছে যে এই শুল্ক-সংকটের ফলে মার্কোসার ব্লক এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে বহুপ্রতীক্ষিত বাণিজ্য চুক্তি নতুন করে আলোচনায় আসতে পারে।

ব্রাজিল এই আলোচনায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে পারে। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে চীন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষকদের বাদ দিয়ে ব্রাজিল থেকে বেশি সয়াবিন ও ভুট্টা কিনেছিল—তেমনটি আবারও ঘটতে পারে।

লাতিন আমেরিকার আরেক দেশ মেক্সিকো অতীতে ট্রাম্পের রোষানলে পড়েছিল, এবার তুলনামূলক ভালোভাবেই রক্ষা পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো-কানাডা (ইউএসএমসিএ) চুক্তির কারণে তাদের বেশির ভাগ বাণিজ্যই সুরক্ষিত রয়েছে।

তবে আরবিসি ব্লুবের ইমার্জিং মার্কেট স্ট্র্যাটেজিস্ট গ্রাহাম স্টক বলেন, মেক্সিকান সম্পদগুলো এখন অন্যদের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ, দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। আর দিনশেষে ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি আসলে যুক্তরাষ্ট্রের নিজের অর্থনীতির বিরুদ্ধেই এক বড় আত্মঘাতী পদক্ষেপ।

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত