দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী: ধর্ম অবমাননা মামলায় গ্রেপ্তার, মানবতাবিরোধী অপরাধে সাজা নিয়ে মৃত্যু

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২৩, ২২: ৪৯
আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০২৩, ২৩: ৪৭

২০১০ সালে গ্রেপ্তারের পর আর কখনোই ছাড়া পাননি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। এক যুগের বেশি সময় কারাগারে থেকে আজ সোমবার (১৪ আগস্ট) আমৃত্যু যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তাঁর বিচারিক প্রক্রিয়ায় নানা জটিলতা ও ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল। 

গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায়
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগে একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন প্রথম গ্রেপ্তার করা হয়েছিল সাবেক সংসদ সদস্য ও জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে। পরে একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পিরোজপুরে সংঘটিত হত্যা, লুণ্ঠন, নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ২০১১ সালের ১৪ জুলাই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একই বছরের ৩ অক্টোবর সাঈদীর বিচার শুরু হয়। 

বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের দেড় বছর পর সাঈদীর বিরুদ্ধেই প্রথম আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়। 

মানবতাবিরোধী ২০ অভিযোগ
ট্রাইব্যুনালে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেদের জোর করে ধর্মান্তর করাসহ সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এসব অপরাধের বেশির ভাগই ১৯৭১ সালে পিরোজপুর এলাকায় সংঘটিত হয়েছিল বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তবে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। 

দীর্ঘ তদন্তের পর তদন্ত সংস্থা ২০১১ সালের জুলাই মাসে সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৫টি খণ্ডে ৪০৭৪ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদন জমা দেয়। 

প্রথমে ফাঁসির রায়
এই মামলায় দীর্ঘ শুনানির পর ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাঈদীকে ফাঁসির আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর জনাকীর্ণ আদালতে ওই রায় ঘোষণা করেন। 

ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, ১৯৭১ সালে সংঘটিত হত্যা, লুণ্ঠন, নির্যাতনসহ অন্তত ২০টি মানবতাবিরোধী অভিযোগের মধ্যে আটটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। 

প্রমাণিত অভিযোগের মধ্যে দুটি হত্যার অভিযোগে আদালত সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। যার মধ্যে রয়েছে পিরোজপুরে ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা এবং বিসা বালি হত্যা। এ ছাড়া অধিকাংশ অভিযোগই সাক্ষীর অভাবে প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি বলে দাবি করে রাষ্ট্রপক্ষ। 

রায়ের দিন এজলাসে আনার পর থেকেই সাঈদীকে বেশ নির্লিপ্ত এবং বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। রায়ের পুরো সময়টিতে তিনি কিছু বলেননি। তবে রায় শেষ হওয়ার পরপরই উঠে দাঁড়িয়ে তিনি আদালতকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনারা নিজেদের শপথের ওপর দায়বদ্ধ থেকে বিচার করতে পারেননি।’ এ সময় তিনি দাবি করেন, আদালত শাহবাগের আন্দোলনকারীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রায় দিয়েছেন। 

সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর ব্যাপক সহিংসতায় দেশে বহু মানুষ প্রাণ হারায়। 

সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড
ফাঁসির আদেশ হলেও সাঈদীর আইনজীবীরা এই রায়ের বিরুদ্ধ আপিল করেন। এই আপিলের ভিত্তিতে পরে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তাঁর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন সর্বোচ্চ আদালত। 

প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ওই রায় ঘোষণা করেন।

আপিলের রায়ে ১০, ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগে হত্যা, নিপীড়ন, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও ধর্মান্তরে বাধ্য করায় সাঈদীকে ‘যাবজ্জীবন’ কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সে সময় যাবজ্জীবন বলতে ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর সময় পর্যন্ত’ কারাবাস বোঝাবে বলে ব্যাখ্যা দেন প্রধান বিচারপতি। 

একাত্তরে ভূমিকার কারণে এই জামায়াত নেতার সাজা কমানোর রায়ে তাৎক্ষণিকভাবে আদালতের বাইরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল ও শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। 

কাশিমপুর কারাগারে মৃত্যুর ‘ডাক’
আমৃত্যু কারাদণ্ডের পর দীর্ঘ বছর গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারেই ছিলেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। গত রোববার (১৩ আগস্ট) কারাগারের ভেতর বুকে ব্যথা অনুভব করায় অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) পাঠানো হয়। 

গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা গণমাধ্যমকে জানান, ইসিজিসহ বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায়, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সুগার অনেক বেশি, প্রেশার নিয়ন্ত্রণে নেই। এ ছাড়া তিনি হৃদ্‌রোগে (হার্ট অ্যাটাক) আক্রান্ত হয়েছেন। এই কারণেই তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিএসএসএমইউতে পাঠানো হয়। 

আজ সোমবার (১৪ আগস্ট) রাত ৮টার দিকে হাসপাতালেই সাঈদীর মৃত্যু হয়েছে বলে চিকিৎসকেরা নিশ্চিত করেন। 

ব্যক্তিগত জীবন
১৯৪০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুর জেলার ইন্দুরকানী গ্রামে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ইউসুফ সাঈদী একজন আলেম ছিলেন। বাবার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন সাঈদী। পরে তিনি খুলনা আলিয়া মাদ্রাসায় কিছুদিন এবং পরে ১৯৬২ সালে ছারছিনা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কামিল পাস করেন। 

জামায়েতে ইসলামীর হয়ে ১৯৯৬ সালে ১২ জুন থেকে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই মেয়াদে সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত