হুসাইন আহমদ
বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে বিশেষ নাম—সিরাজুল আলম খান। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ইতিহাসের পরিক্রমায় নিজের ভূমিকার জন্য ‘রহস্যপুরুষ’ আখ্যা পেয়েছেন এই রাজনীতিক। কর্মকাণ্ডে রহস্য থাকলেও রাজনৈতিক মহলে তাত্ত্বিক হিসেবে পরিচিত তিনি। যে গোপন সংগঠন স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্বের কেন্দ্রে ছিল, সেই ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের’ প্রবক্তা ও মূল সংগঠক তিনিই ছিলেন।
রাজনীতির এই ‘রহস্যপুরুষ’ দশকের পর দশক ধরে রহস্য বুকে পুষে নিয়েই চলে গেলেন। উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে সংক্রমণসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগে আজ শুক্রবার দুপুরে ৮২ বছর বয়সী ‘দাদাভাই’ রহস্যময় জীবন থেকে বিদায় নিলেন। রাজনৈতিক সহযোগী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা তাঁকে ‘দাদাভাই’ ডাকতেন।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বছরের বেশির ভাগ সময় যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদে ওপর গবেষণা করে ও বই লিখে সময় কাটাতেন। বাংলাদেশে এলে অধিকাংশ সময় কাটাতেন পাঁচতারা হোটেলে। রাজনৈতিক সহযোগী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ভুলে গেলেও সাম্যবাদী দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের আদলে লম্বা দাঁড়ি ও চুল তাঁর আমৃত্যু সঙ্গী হয়ে ছিল। অকৃতদার থেকে তিনি বিপ্লবী ঐতিহ্যের দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন।
জন্ম ও শৈশব
সিরাজুল আলম খান ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি নোয়াখালী জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন। খোরশেদ আলম খান ও সৈয়দা জাকিয়া খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান তিনি। তাঁরা পাঁচ ভাই ও তিন বোন। খোরশেদ আলম খান এডিনবরায় (স্কটল্যান্ড) পড়াশোনা শেষে স্কুল পরিদর্শক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় বিভিন্ন জায়গায় বদলি হয়ে যেতেন। তাই শৈশবের বেশির ভাগ সময় তিনি নোয়াখালী থেকে দূরে ছিলেন। সিরাজুল আলম খান বলতেন, শৈশব থেকেই বাবাই তাঁর পরামর্শদাতা ছিলেন।
তাঁর মা স্বল্প শিক্ষিত হলেও সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয়-সংস্কৃতির শিক্ষায় কড়া ছিলেন। শৈশব থেকেই তাঁর ভাইবোনদের সবাই তাঁদের পিতার কাছ থেকে আধুনিক এবং পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির পাঠ এবং মায়ের কাছ থেকে মধ্যপন্থী মুসলিম মূল্যবোধের পাঠ নেন।
শিক্ষা
১৯৫৬ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে অসামান্য কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিকুলেশন (এসএসসি) পাস করেন সিরাজুল আলম খান। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে বিজ্ঞান শাখায় উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন তিনি। এইচএসসি পাস করে ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। তিনি ফজলুল হক হলে থাকতেন।
‘কনভোকেশন মুভমেন্টে’ অংশগ্রহণ করার কারণে গণিতে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। প্রতিদিন রাত করে হলে ফিরতেন তিনি। ফলে হল থেকেও একবার বহিষ্কৃত হন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করায় তাঁর পক্ষে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া সম্ভব হয়নি।
রাজনীতি
কলেজে পাঠ্যক্রম-বহির্ভূত কার্যক্রম সিরাজুল আলম খানকে ভবিষ্যৎ নেতা হওয়ার পথ দেখায়; ঢাকা কলেজেই তাঁর রাজনীতির শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ছাত্রলীগের সদস্য হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে তিনি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৩-৬৪ ও ১৯৬৪-৬৫ দুই মেয়াদে দুই বছর তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বিকশিত করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে যে ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’ গড়ে উঠেছিল, তাঁর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। এই নিউক্লিয়াসের সদস্য ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এই নিউক্লিয়াসের মাধ্যমে ছাত্রলীগের সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হত।
ছয় দফার সমর্থনে জনমত গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন সিরাজুল আলম খান। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ও উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৬৯-৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে নিউক্লিয়াসের রাজনৈতিক শাখা হিসেবে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) এবং সশস্ত্র শাখা হিসেবে ‘জয় বাংলা বাহিনী’ গড়ে তোলা হয়।
এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণে সিরাজুল আলম খানের ভূমিকা ছিল মুখ্য। ১৯৬৯-৭০ সালে গণ-আন্দোলনের চাপে ভেঙে পড়া পাকিস্তানি শাসনের সমান্তরালে নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংগঠন করা হয় ছাত্র ব্রিগেড, যুব ব্রিগেড, শ্রমিক ব্রিগেড, নারী ব্রিগেড, কৃষক ব্রিগেড, সার্জেন্ট জহুর বাহিনী। এদের সদস্যরা এ ভেঙে পড়া পাকিস্তানি শাসনের পরিবর্তে যানবাহন চলাচল, ট্রেন-স্টিমার চালু রাখা, শিল্প-কারখানা উৎপাদন আব্যাহত রাখা এবং থানা পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের পতাকা তৈরি করে ২ মার্চ উত্তোলন করেছিল ‘নিউক্লিয়াস’। এর অধীনে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ প্রকাশিত হয়। ‘আমার সোনার বাংলা ...’—কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানকে জাতীয় সংগীত এবং স্বাধীনতার থিম হিসেবে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান বাছাই করে।
‘...এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’—বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণ প্রস্তুত করতে ‘নিউক্লিয়াস’ ও বিএলএফ নেতৃত্ব সহায়তা করেছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন ও সমান্তরাল বেসামরিক প্রশাসন চালু করায় মূল ভূমিকা রেখেছিল বিএলএফ। শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিও দিয়েছিল বিএলএফ নেতৃত্ব।
পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদকে নিয়ে বিএলএফ হাইকমান্ড পুনর্গঠন করা হয়। পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্তির জন্য ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের সময় ভারতে বিএলএফের নাম পাল্টে ‘মুজিব বাহিনী’ হয়।
আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘১৯৬৯-এ আমি ছিলাম তোতাপাখির মতো। সবকিছু করে দিয়েছেন আমার রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু সিরাজুল আলম খান, যিনি আমাকে হাতে-কলমে রাজনীতি শিখিয়েছেন।’
জাসদ পর্ব
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর আন্দোলন-সংগ্রামের রূপ ও চরিত্র বদলে যায়। ‘বিপ্লবী জাতীয় সরকার’ গঠন প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের মতভেদ দেখা দেয়। তাঁর সিদ্ধান্ত ও তৎপরতায় গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল ও একমাত্র বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। বাংলাদেশের ইতিহাসের বহুল বিতর্কিত অংশ কথিত ‘সিপাহী জনতার গণ-অভ্যুত্থান’। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানেরও নেপথ্য পরিকল্পনাকারী ছিলেন সিরাজুল আলম খান।
তাঁর সঙ্গে এই দুই ঘটনার আরও কুশীলব ছিলেন মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব ও কর্নেল আবু তাহের। জাসদের চিন্তাগুরু সিরাজুল আলম খান তাহেরকে মাঠে নামিয়ে দিয়ে চলে যান অজ্ঞাত স্থানে। যদিও সেখান থেকেই তিনি তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। কিন্তু মূল দৃশ্যপট থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন তিনি।
কিন্তু পরে ১৯৭৬ সালেই জিয়াউর রহমানের আমলে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৭৯ সালে মুক্তি পান। আরও দুবার তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৩ সালের শেষদিকে ‘কনভোকেশন মুভমেন্টের’ কারণে তিনি গ্রেপ্তার হন। সর্বশেষ ১৯৯২ সালে বিদেশ যাওয়া আগে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ২৪ মার্চ সিরাজুল আলম খানকে গ্রেপ্তার করা হলে চার মাস পর হাইকোর্টের রায়ে মুক্তি পান। ভিন্ন ভিন্ন তিন মেয়াদে প্রায় সাত বছর কারাভোগ করেন তিনি।
গবেষণা
দীর্ঘ কারাজীবনে তিনি দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশবিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, সংগীত, খেলাধুলা নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন। মেধাবী ছাত্র হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছিল।
স্বাধীনতার পরপরই রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে সিরাজুল আলম খান রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ‘তাত্ত্বিক’ উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত করেন। গণিত শাস্ত্রে পড়লেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ওপর গড়ে উঠে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ও দক্ষতা। সেই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওশকোশের ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের খণ্ডকালীন অধ্যাপক হন।
সিরাজুল আলম খানের বই ও ভাষণ থেকে তাঁর রাজনৈতিক-প্রশাসনিক রূপরেখা নিয়ে বেশ কিছু মূল ধারণা মিলেছে। এসব কিছুর মধ্যে তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আরেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক জিল্লুর রহমান খান। শেষ পর্যন্ত তাঁরা তাত্ত্বিক পর্যায়ে একসঙ্গে কাজ করেছেন।
নব্বই দশকের গোড়ার দিকে সিরাজুল আলম খান পরিবর্তিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৪ দফা প্রস্তাব পেশ করেন। সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অর্থায়নে উপজেলাভিত্তিক ‘শিল্পাঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেন।
বাংলাদেশের জনগণকে শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবী হিসেবে বিভক্ত করে ‘রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক’ মডেল হাজির করেছেন সিরাজুল আলম খান। চিরাচরিত পার্লামেন্টারি ধাঁচের ‘অঞ্চলভিত্তিক’ প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি শ্রম, কর্ম, পেশায় নিয়োজিত সমাজ শক্তিসমূহের ‘বিষয়ভিত্তিক’ প্রতিনিত্বের ব্যবস্থাসংবলিত ‘দুই কক্ষ’বিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠন, ফেডারেল সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন, বাংলাদেশকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন এবং প্রাদেশিক সরকার গঠন, উপজেলা পর্যায়ে স্বশাসিত স্থানীয় সরকার পদ্ধতি চালু করার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আইনব্যবস্থা ও শাসন কাঠামোর পরিবর্তে স্বাধীন দেশের উপযোগী শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার মডেল উত্থাপন করেন তিনি।
বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে বিশেষ নাম—সিরাজুল আলম খান। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ইতিহাসের পরিক্রমায় নিজের ভূমিকার জন্য ‘রহস্যপুরুষ’ আখ্যা পেয়েছেন এই রাজনীতিক। কর্মকাণ্ডে রহস্য থাকলেও রাজনৈতিক মহলে তাত্ত্বিক হিসেবে পরিচিত তিনি। যে গোপন সংগঠন স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্বের কেন্দ্রে ছিল, সেই ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের’ প্রবক্তা ও মূল সংগঠক তিনিই ছিলেন।
রাজনীতির এই ‘রহস্যপুরুষ’ দশকের পর দশক ধরে রহস্য বুকে পুষে নিয়েই চলে গেলেন। উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে সংক্রমণসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগে আজ শুক্রবার দুপুরে ৮২ বছর বয়সী ‘দাদাভাই’ রহস্যময় জীবন থেকে বিদায় নিলেন। রাজনৈতিক সহযোগী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা তাঁকে ‘দাদাভাই’ ডাকতেন।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বছরের বেশির ভাগ সময় যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদে ওপর গবেষণা করে ও বই লিখে সময় কাটাতেন। বাংলাদেশে এলে অধিকাংশ সময় কাটাতেন পাঁচতারা হোটেলে। রাজনৈতিক সহযোগী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ভুলে গেলেও সাম্যবাদী দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের আদলে লম্বা দাঁড়ি ও চুল তাঁর আমৃত্যু সঙ্গী হয়ে ছিল। অকৃতদার থেকে তিনি বিপ্লবী ঐতিহ্যের দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন।
জন্ম ও শৈশব
সিরাজুল আলম খান ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি নোয়াখালী জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন। খোরশেদ আলম খান ও সৈয়দা জাকিয়া খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান তিনি। তাঁরা পাঁচ ভাই ও তিন বোন। খোরশেদ আলম খান এডিনবরায় (স্কটল্যান্ড) পড়াশোনা শেষে স্কুল পরিদর্শক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় বিভিন্ন জায়গায় বদলি হয়ে যেতেন। তাই শৈশবের বেশির ভাগ সময় তিনি নোয়াখালী থেকে দূরে ছিলেন। সিরাজুল আলম খান বলতেন, শৈশব থেকেই বাবাই তাঁর পরামর্শদাতা ছিলেন।
তাঁর মা স্বল্প শিক্ষিত হলেও সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয়-সংস্কৃতির শিক্ষায় কড়া ছিলেন। শৈশব থেকেই তাঁর ভাইবোনদের সবাই তাঁদের পিতার কাছ থেকে আধুনিক এবং পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির পাঠ এবং মায়ের কাছ থেকে মধ্যপন্থী মুসলিম মূল্যবোধের পাঠ নেন।
শিক্ষা
১৯৫৬ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে অসামান্য কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিকুলেশন (এসএসসি) পাস করেন সিরাজুল আলম খান। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে বিজ্ঞান শাখায় উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন তিনি। এইচএসসি পাস করে ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। তিনি ফজলুল হক হলে থাকতেন।
‘কনভোকেশন মুভমেন্টে’ অংশগ্রহণ করার কারণে গণিতে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। প্রতিদিন রাত করে হলে ফিরতেন তিনি। ফলে হল থেকেও একবার বহিষ্কৃত হন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করায় তাঁর পক্ষে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া সম্ভব হয়নি।
রাজনীতি
কলেজে পাঠ্যক্রম-বহির্ভূত কার্যক্রম সিরাজুল আলম খানকে ভবিষ্যৎ নেতা হওয়ার পথ দেখায়; ঢাকা কলেজেই তাঁর রাজনীতির শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ছাত্রলীগের সদস্য হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে তিনি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৩-৬৪ ও ১৯৬৪-৬৫ দুই মেয়াদে দুই বছর তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বিকশিত করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে যে ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’ গড়ে উঠেছিল, তাঁর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। এই নিউক্লিয়াসের সদস্য ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এই নিউক্লিয়াসের মাধ্যমে ছাত্রলীগের সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হত।
ছয় দফার সমর্থনে জনমত গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন সিরাজুল আলম খান। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ও উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৬৯-৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে নিউক্লিয়াসের রাজনৈতিক শাখা হিসেবে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) এবং সশস্ত্র শাখা হিসেবে ‘জয় বাংলা বাহিনী’ গড়ে তোলা হয়।
এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণে সিরাজুল আলম খানের ভূমিকা ছিল মুখ্য। ১৯৬৯-৭০ সালে গণ-আন্দোলনের চাপে ভেঙে পড়া পাকিস্তানি শাসনের সমান্তরালে নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংগঠন করা হয় ছাত্র ব্রিগেড, যুব ব্রিগেড, শ্রমিক ব্রিগেড, নারী ব্রিগেড, কৃষক ব্রিগেড, সার্জেন্ট জহুর বাহিনী। এদের সদস্যরা এ ভেঙে পড়া পাকিস্তানি শাসনের পরিবর্তে যানবাহন চলাচল, ট্রেন-স্টিমার চালু রাখা, শিল্প-কারখানা উৎপাদন আব্যাহত রাখা এবং থানা পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের পতাকা তৈরি করে ২ মার্চ উত্তোলন করেছিল ‘নিউক্লিয়াস’। এর অধীনে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ প্রকাশিত হয়। ‘আমার সোনার বাংলা ...’—কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানকে জাতীয় সংগীত এবং স্বাধীনতার থিম হিসেবে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান বাছাই করে।
‘...এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’—বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণ প্রস্তুত করতে ‘নিউক্লিয়াস’ ও বিএলএফ নেতৃত্ব সহায়তা করেছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন ও সমান্তরাল বেসামরিক প্রশাসন চালু করায় মূল ভূমিকা রেখেছিল বিএলএফ। শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিও দিয়েছিল বিএলএফ নেতৃত্ব।
পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদকে নিয়ে বিএলএফ হাইকমান্ড পুনর্গঠন করা হয়। পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্তির জন্য ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের সময় ভারতে বিএলএফের নাম পাল্টে ‘মুজিব বাহিনী’ হয়।
আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘১৯৬৯-এ আমি ছিলাম তোতাপাখির মতো। সবকিছু করে দিয়েছেন আমার রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু সিরাজুল আলম খান, যিনি আমাকে হাতে-কলমে রাজনীতি শিখিয়েছেন।’
জাসদ পর্ব
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর আন্দোলন-সংগ্রামের রূপ ও চরিত্র বদলে যায়। ‘বিপ্লবী জাতীয় সরকার’ গঠন প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের মতভেদ দেখা দেয়। তাঁর সিদ্ধান্ত ও তৎপরতায় গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল ও একমাত্র বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। বাংলাদেশের ইতিহাসের বহুল বিতর্কিত অংশ কথিত ‘সিপাহী জনতার গণ-অভ্যুত্থান’। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানেরও নেপথ্য পরিকল্পনাকারী ছিলেন সিরাজুল আলম খান।
তাঁর সঙ্গে এই দুই ঘটনার আরও কুশীলব ছিলেন মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব ও কর্নেল আবু তাহের। জাসদের চিন্তাগুরু সিরাজুল আলম খান তাহেরকে মাঠে নামিয়ে দিয়ে চলে যান অজ্ঞাত স্থানে। যদিও সেখান থেকেই তিনি তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। কিন্তু মূল দৃশ্যপট থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন তিনি।
কিন্তু পরে ১৯৭৬ সালেই জিয়াউর রহমানের আমলে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৭৯ সালে মুক্তি পান। আরও দুবার তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৩ সালের শেষদিকে ‘কনভোকেশন মুভমেন্টের’ কারণে তিনি গ্রেপ্তার হন। সর্বশেষ ১৯৯২ সালে বিদেশ যাওয়া আগে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ২৪ মার্চ সিরাজুল আলম খানকে গ্রেপ্তার করা হলে চার মাস পর হাইকোর্টের রায়ে মুক্তি পান। ভিন্ন ভিন্ন তিন মেয়াদে প্রায় সাত বছর কারাভোগ করেন তিনি।
গবেষণা
দীর্ঘ কারাজীবনে তিনি দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশবিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, সংগীত, খেলাধুলা নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন। মেধাবী ছাত্র হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছিল।
স্বাধীনতার পরপরই রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে সিরাজুল আলম খান রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ‘তাত্ত্বিক’ উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত করেন। গণিত শাস্ত্রে পড়লেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ওপর গড়ে উঠে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ও দক্ষতা। সেই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওশকোশের ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের খণ্ডকালীন অধ্যাপক হন।
সিরাজুল আলম খানের বই ও ভাষণ থেকে তাঁর রাজনৈতিক-প্রশাসনিক রূপরেখা নিয়ে বেশ কিছু মূল ধারণা মিলেছে। এসব কিছুর মধ্যে তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আরেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক জিল্লুর রহমান খান। শেষ পর্যন্ত তাঁরা তাত্ত্বিক পর্যায়ে একসঙ্গে কাজ করেছেন।
নব্বই দশকের গোড়ার দিকে সিরাজুল আলম খান পরিবর্তিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৪ দফা প্রস্তাব পেশ করেন। সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অর্থায়নে উপজেলাভিত্তিক ‘শিল্পাঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেন।
বাংলাদেশের জনগণকে শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবী হিসেবে বিভক্ত করে ‘রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক’ মডেল হাজির করেছেন সিরাজুল আলম খান। চিরাচরিত পার্লামেন্টারি ধাঁচের ‘অঞ্চলভিত্তিক’ প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি শ্রম, কর্ম, পেশায় নিয়োজিত সমাজ শক্তিসমূহের ‘বিষয়ভিত্তিক’ প্রতিনিত্বের ব্যবস্থাসংবলিত ‘দুই কক্ষ’বিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠন, ফেডারেল সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন, বাংলাদেশকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন এবং প্রাদেশিক সরকার গঠন, উপজেলা পর্যায়ে স্বশাসিত স্থানীয় সরকার পদ্ধতি চালু করার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আইনব্যবস্থা ও শাসন কাঠামোর পরিবর্তে স্বাধীন দেশের উপযোগী শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার মডেল উত্থাপন করেন তিনি।
মানবমুক্তির মহান সংগ্রামে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কমরেড হেনা দাস অবিচল ছিলেন বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক কমরেড রুহিন হোসেন প্রিন্স। তিনি বলেন, ‘বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে কমরেড হেনা দাস ছিলেন অগ্রসৈনিক।’
৩ ঘণ্টা আগেসবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়—নীতি অনুসরণ করে ভারতসহ প্রতিবেশী সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায় বলে জানিয়েছেন দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান। আজ শুক্রবার (২২ নভেম্বর) ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
৬ ঘণ্টা আগেকঠিন সময়ে দলের প্রতি নেতা–কর্মীদের একাগ্রতা ও ত্যাগ আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় থাকুন, আমাদের পেজ থেকে প্রকাশিত প্রতিটি বার্তা ছড়িয়ে দিন। সে জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
৭ ঘণ্টা আগেসশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার, বীর সিপাহসালার মেজর এম এ জলিলকে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলক, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব...
৯ ঘণ্টা আগে