সংস্কারের আগে নির্বাচন দিলে ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না: নুর

রংপুর প্রতিনিধি
Thumbnail image
রংপুর জিলা স্কুল মাঠে রংপুর বিভাগীয় সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। ছবি: আজকের পত্রিকা

রাষ্ট্র সংস্কারের আগে নির্বাচন দিলে জনগণের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না বলে মন্তব্য করেছেন গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর।

আজ শুক্রবার বিকেলে রংপুর জিলা স্কুল মাঠে রংপুর বিভাগীয় সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। গণ অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের স্মরণে এবং বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে গণ অধিকার পরিষদের রংপুর মহানগর ও জেলা কমিটি এ সমাবেশের আয়োজন করে।

নুরুল হক নুর বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান থাকবে এই গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে জনআকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, আপনারা সেই জনআকাঙ্ক্ষা প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্র সংস্কার এবং নির্বাচন নিয়ে একই সঙ্গে ভাবতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কারের আগে নির্বাচন দিলে জনগণের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না। রাজনৈতিক দলগুলো ৫৩ বছর ক্ষমতায় ছিল। আজকে যে ভোটের অধিকার, ন্যায় বিচার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, যে সরকার ক্ষমতায় থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন-নিপীড়ন, গণবিরোধী অবস্থান, সব সরকারের আমলে আমরা দেখেছি। আমরা চাই জনবান্ধব প্রশাসন, জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং যারা ক্ষমতায় থাকবে, তাঁরা ক্ষমতাকে ভোগের বিষয়বস্তু মনে করবে না। জনসেবাকে প্রাধান্য দিয়েই তাঁরা রাষ্ট্রনীতি ঠিক করবে এবং জনগণ ক্ষমতায় বসাবে, কারা জনপ্রতিনিধি হবে সেটা নির্ধারণ করবে।’

আবু সাঈদের আত্মত্যাগকে ধারণ করে যুবসমাজকে নতুন বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে মাঠে থাকার আহ্বান জানিয়ে সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, আবু সাঈদ আপনাদের বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের কৃতি সন্তান। আবু সাঈদের বীরত্বগাথা অবদানকে আপনারা ভুলতে দেবেন না। আবু সাঈদের নামে যেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হয়।

তিনি আরও বলেন, ‘যারা ধোঁকাবাজি করে জনগণের কাছে ভোট ভিক্ষা করে, গরিব-দুঃখী, মেহনতি মানুষের বন্ধু হওয়ার কথা বলে ভোট নিয়ে এমপি-মন্ত্রী হয়ে সিঙ্গাপুর চলে গেছে, যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-মালয়েশিয়াতে সেকেন্ড হোম বানিয়েছে, ছেলে-মেয়েদের উন্নত স্কুলে পড়িয়েছে কিন্তু অবহেলিত রংপুর অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করে নাই, এমন প্রতারক জনপ্রতিনিধিদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার সময় হয়েছে। আবু সাঈদের আত্মত্যাগের এবং তারুণ্যের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে দেশের প্রশ্নে আপসহীনভাবে একমাত্র কাজ করতে পারে তরুণেরাই। সেই তরুণদের নিয়েই আমরা আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে চাই।’

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে, এ জন্য তৃণমূল পর্যায় থেকে দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানান গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর।

তিনি বলেন, ‘আগামীতে রাজনৈতিক দলগুলো সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ এবং চার বছর মেয়াদি সংসদের সংস্কার প্রস্তাবনা দিচ্ছে। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের বিষয়টি হচ্ছে এই গণ অধিকার পরিষদ যদি সারা দেশ মিলিয়ে ৫০ শতাংশ ভোট পায় তাহলে গণ অধিকার পরিষদের দেড় শ এমপি থাকবে। কোনো দল যদি ১০ শতাংশ ভোট পায় ৩০ জন এমপি থাকবে। কোনো দল যদি এক শতাংশ ভোটও পায় তার ৩ জন এমপি থাকবে। এই সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনই একমাত্র রাজনীতিতে একটা ভারসাম্য আনতে পারে। আগামীতে স্বৈরাচারী হওয়া থেকে কোনো সরকারকে ঠেকাতে থাকে, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা যেন গড়ে না ওঠে, সে জন্য এখন থেকেই রাষ্ট্র এবং রাজনীতির ব্যবস্থা কী হবে, সেটি নিয়ে আলোচনা করতে হবে।’

নুর আরও বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি সারা বাংলাদেশে এখনো আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে যারা ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে, তাঁদের আস্ফালন থামে নাই। এই রংপুরের মাটিতেও গণ অধিকার পরিষদের নেতাদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা হয়েছে কটূক্তি করা হয়েছে। আজকের এই সমাবেশ থেকে আমরা তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। আমরা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, আবু সাঈদের রক্তে ভেজা রংপুরের মাটি, ছাত্র-জনতার রক্তে ভেজা সারা বাংলাদেশের মাটি, সেই রক্তের দাগ এখনো শুকিয়ে যায়নি। আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনে যারা চেষ্টা করবে ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে, তাঁদের সমুচিত জবাব দিতে হবে।’

জাতীয় পার্টিকে ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে ইঙ্গিত করে নুরুল হক নুর বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের কোনো জায়গা নেই। আমাদের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে আওয়ামী বাকশালিদের জায়গা নাই। আওয়ামী লীগের দোসর যারা ছিলেন, তাঁদের কোনো জায়গা হবে না। যারা আস্ফালন দেখাচ্ছেন, প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আমরা অনুরোধ করব অনতিবিলম্বে গণহত্যাকারী এবং গণহত্যাকারীর দোসরদের গ্রেপ্তার করে এই রংপুরসহ সারা বাংলাদেশে জনগণকে স্বস্তি প্রদান করুন। আপনারা (প্রশাসন) যদি আইনগত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হন, জনগণ কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নেবে। কিন্তু আমরা চাই না জনগণ সেটা করুক। ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত লড়াই সংগ্রাম, প্রাণ দানের মধ্য দিয়ে যে পরিবর্তন এসেছে, সেই পরিবর্তনকে স্থায়ী করার জন্য আমরা এই সরকারকে স্থিতিশীল করতে চাই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করতে চাই এবং আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে তারুণ্যের যে রাজনীতিক দল গণ অধিকার পরিষদের নেতৃত্বে গণজোয়ার তৈরি করতে চাই। আগামীতে গণ অধিকার পরিষদ ৩০০ আসনে নির্বাচন করবে। আমরা সাধারণ মানুষকে ক্ষমতায়ন করতে চাই, পিছিয়ে পড়া রংপুরকে আমরা এগিয়ে নিতে চাই।’

ডাকসুর সাবেক এই ভিপি বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫৩ বছরে তিস্তা নিয়ে এই অঞ্চলের মানুষের যে দুঃখ-ভোগান্তি সেটা নিয়ে কোনো সরকারই সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে নাই। রংপুর অঞ্চলে একটা ভালো চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান নেই। একটা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে পুরো রংপুর কাভার হয় না। এই পিছিয়ে পড়া রংপুরের ৪৭ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। অথচ বাংলাদেশের মধ্যে কৃষিতে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনায় জায়গা হচ্ছে রংপুর। কৃষিকে গুরুত্ব দিয়ে রংপুরকে কৃষির হাব তৈরি করার জন্য নতুন শিল্পনীতি প্রয়োজন, শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা প্রয়োজন। রংপুর অঞ্চলের মিষ্টি কুমড়া, হাড়িভাঙ্গা আম, আলুসহ ১০ টির বেশি কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়। রংপুরের যদি কৃষিনীতিকে গুরুত্ব দিয়ে এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়, তাহলে শুধু রংপুরই নয় গোটা বাংলাদেশ লাভবান হবে। আমাদের কেন পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচ ভারতে থেকে আনতে হবে? আমাদের দেশের কৃষকদের আমরা কেন গুরুত্ব দিচ্ছি না। এসব নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।’

সমাবেশে প্রধান বক্তা হিসেবে গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন বলেন, ‘রংপুরের মানুষ অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়, অত্যন্ত সহজ-সরল। কিন্তু শান্তিপ্রিয় মানুষ নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণে যে ভূমিকা রেখেছে, তা ইতিহাসে বিরল, স্মরণীয় ও গৌরবের। শহীদ আবু সাঈদ এই নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও কারিগর। আবু সাঈদরা আমাদের নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছে। জুলাই বিপ্লবে যারা রক্ত দিয়েছে জীবন দিয়েছে তাদের স্বপ্ন ছিল একটি নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আমরা সকলে মিলে সহযোগিতা করব। যাতে করে আবু সাঈদদের স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা যায়।’

রংপুরের মাটিতে জাতীয় পার্টির জায়গা হবে না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় বেইমান পার্টি মনে করে রংপুর তাঁদের ঘাঁটি। আমরা বলতে চাই রংপুরের মানুষ জাতীয় বেইমান পার্টিকে বয়কট করেছে। জাতীয় পার্টি বাংলাদেশে ফ্যাসিজম কায়েম করেছে সুতরাং রংপুরের মাটিতে জাতীয় পার্টির জায়গা হবে না। রংপুরের সাবেক অবৈধ ডামি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা একজন দুর্নীতিবাজ। তাঁর বিরুদ্ধে দুদকে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এই দুর্নীতিবাজরা আগামীতে রংপুর থেকে এমপি, মন্ত্রী, মেয়র হতে পারবে না। এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।’

সমাবেশে গণ অধিকার পরিষদ উচ্চতর পরিষদের সদস্য ও রংপুর বিভাগের সমন্বয়ক হানিফ খান সজীবের সভাপতিত্বে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন—সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান আল মামুন, সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুদ রানা মোন্নাফ, যুব অধিকার পরিষদের সভাপতি এরশাদুল হক, শ্রমিক অধিকার পরিষদের সভাপতি আব্দুর রহমান, ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা, পঞ্চগড় জেলার সদস্যসচিব হারুনুর রশিদ, যুগ্ম আহ্বায়ক মামুন মিয়া, রংপুর মহানগর গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান, রংপুর জেলার ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক শেরে খোদা আসাদুল্লাহ প্রমুখ। রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে গণ অধিকার পরিষদসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে জিলা স্কুল মাঠে সমবেত হন। প্রায় এক ঘণ্টার সমাবেশে কয়েক হাজার নেতা-কর্মীর মাঝে দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।

এর আগে বিকেল ৩টার দিকে নুরুল হক নুর ও রাশেদ খাঁনসহ গণ অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতারা রংপুরের পীরগঞ্জে আবু সাঈদের গ্রামের বাড়ি বাবনপুর জাফরপাড়ায় যান। সেখানে তাঁরা আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করার পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত