আনিকা জীনাত, ঢাকা
ছাড়া ছাড়াভাবে অনেক কথাই ঘুরেফিরে কানে আসছিল। মাঘের শেষ দিনের ঠান্ডা বাতাস আর বৃষ্টির মধ্যে তাঁর কথায় তেমন মনযোগ ছিল না। বসুন্ধরা গেট থেকে ভাড়া ঠিক করে ওঠার পর থেকেই ২৪-২৫ বছর বয়সী তরুণ রিকশাচালক কিছু একটা নিয়ে কথা বলে যাচ্ছিলেন। বুঝতে না পারায় প্রশ্ন করলাম, ‘কী বলছেন?’ রিকশাচালক পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘চিটার চেনেন? চিটার?’
বললাম, ‘হ্যাঁ, কী হয়েছে?’
‘দিনের প্রথম খ্যাপ এটা। সারা দিন কিছু খাই নাই। ভাতের কষ্ট বোঝেন আপা? বুঝবেন না কেন? আপনিও তো মানুষ!’
এমনিতে মানুষের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে তোলায় আমি একেবারেই অদক্ষ। নিজেই কেমন জড়ভরত হয়ে যাই। একবার এক আট বছর বয়সী মাস্ক বিক্রেতা শিশুর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। তার কুঁচকানো ভ্রু দেখে আর কথা বাড়াইনি। বড়দের সঙ্গে কথা বলতে আরও বেশি জড়তা কাজ করে। কিন্তু ইনি নিজেই সবকিছু বলে যাচ্ছেন। যাক, কিছু জিজ্ঞেস করলে অন্তত ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করবেন না। কথা বললে নাকি গল্প পাওয়া যায়। আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা উল্টে গেল। গল্প থেকেই কথার শুরু হলো। কথা মানে প্রশ্ন। প্রশ্নকর্তা আমিই। বললাম—আপনার নাম কী?
উত্তরও এল, ‘ইমন, ইমন ইসলাম।’ বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এবার আবার শুনতে চাই তাঁর কথাগুলো।
‘কী হয়েছে আবার বলেন।’
‘আমি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এক লোকরে নিয়ে ঘুরসি। সে জায়গায় জায়গায় থেমে বাসা দেখসে। পরে যমুনা ফিউচার পার্কের পেছন গেটে এসে ১ হাজার টাকা দেখায় বলে ভাংতি নাই। ভাংতি করে আনি। কয়েক ঘণ্টায় ভাড়া হইসিল ৫০০ টাকা। এর পর অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও সে আসে নাই।’
একটু থামেন ইমন। একটু যেন জিরিয়ে নিলেন। ক্ষণিকের বিরতি। তার পর আবার বলতে থাকেন—
‘হাজার টাকা বা ৫০০ টাকাটা বড় না। আমার সাথে বাটপারিটা কেন করল? এর পর ওরে দেখলে মাইরাই ফেলব। সারা দিন কোনো আয় হয়নি। ভাতও খাইতে পারি নাই। পরিবারে বলতে আমার কেউ নাই। শুধু এক ভাগনা থাকে আমার সঙ্গে। তার জন্যও কিছু নিয়ে যাইতে পারি নাই।’
কথাগুলো বলতে বলতেই হয়তো তাঁর খেয়াল হলো, কার সঙ্গে বলছেন তিনি এ কথা। হয়তো ভাবলেন—যার সম্পর্কে বলছেন, তাঁর মতো আমিও তো তাঁর যাত্রী। আমি কি বিশ্বাস করব? তাঁর কথাগুলো কি বিশ্বাসযোগ্য লাগছে আমার কাছে? এসব ভেবেই হয়তো আবার বললেন—
‘আমার কথাগুলা সত্যি না মিথ্যা আপনি জানেন না। কিন্তু আল্লাহ তো জানে। সে-ই বিচার করবে।’
আমিও বিচারের ভার সৃষ্টিকর্তার ওপর ছেড়ে দিয়ে তাঁকে দ্বিগুণ ভাড়া দিলাম। হয়তো তাঁর পুরো গল্প নিছকই ভাড়া বাড়িয়ে নেওয়ার ধান্দা। আবার এমনও হতে পারে, আসলেই সারা দিন তিনি কিছু খাননি। কোনটা সাদা, আর কোনটা কালো, তা বিচার করার চেয়ে ধূসর রঙের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়া ভালো।
আজ সকালেই দেখলাম, সারি সারি রিকশার সামনে শিকল বাঁধা। প্রথমে চোখে পড়েনি বলে একজন চালককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘যাবেন নাকি?’ পাল্টা উত্তর এল, ‘যাইতাম তো! দেখেন না মামা, রেকারে দিয়া রাখসে।’ তাকিয়ে দেখলাম মোটা শিকলে তাঁদের সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আচ্ছা, নিয়ম যদি তাঁরা ভেঙে থাকেন, তবে জরিমানা করা যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁদের বসিয়ে রেখে আয়ের অঙ্কটা কমিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে কী? রিকশা চালিয়েই তো খেতে হয় তাঁদের, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের। কে জানে তাঁদের ঘরে কেউ অসুস্থ আছে কি-না, সন্তানেরা পথ চেয়ে বসে আছে কি-না অবুঝ বায়না প্রাপ্তির আশায়। কিংবা আরও আরও জটিল সমীকরণ থাকতে পারে তাঁদের জীবনে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না কেউ।
ছাড়া ছাড়াভাবে অনেক কথাই ঘুরেফিরে কানে আসছিল। মাঘের শেষ দিনের ঠান্ডা বাতাস আর বৃষ্টির মধ্যে তাঁর কথায় তেমন মনযোগ ছিল না। বসুন্ধরা গেট থেকে ভাড়া ঠিক করে ওঠার পর থেকেই ২৪-২৫ বছর বয়সী তরুণ রিকশাচালক কিছু একটা নিয়ে কথা বলে যাচ্ছিলেন। বুঝতে না পারায় প্রশ্ন করলাম, ‘কী বলছেন?’ রিকশাচালক পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘চিটার চেনেন? চিটার?’
বললাম, ‘হ্যাঁ, কী হয়েছে?’
‘দিনের প্রথম খ্যাপ এটা। সারা দিন কিছু খাই নাই। ভাতের কষ্ট বোঝেন আপা? বুঝবেন না কেন? আপনিও তো মানুষ!’
এমনিতে মানুষের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে তোলায় আমি একেবারেই অদক্ষ। নিজেই কেমন জড়ভরত হয়ে যাই। একবার এক আট বছর বয়সী মাস্ক বিক্রেতা শিশুর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। তার কুঁচকানো ভ্রু দেখে আর কথা বাড়াইনি। বড়দের সঙ্গে কথা বলতে আরও বেশি জড়তা কাজ করে। কিন্তু ইনি নিজেই সবকিছু বলে যাচ্ছেন। যাক, কিছু জিজ্ঞেস করলে অন্তত ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করবেন না। কথা বললে নাকি গল্প পাওয়া যায়। আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা উল্টে গেল। গল্প থেকেই কথার শুরু হলো। কথা মানে প্রশ্ন। প্রশ্নকর্তা আমিই। বললাম—আপনার নাম কী?
উত্তরও এল, ‘ইমন, ইমন ইসলাম।’ বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এবার আবার শুনতে চাই তাঁর কথাগুলো।
‘কী হয়েছে আবার বলেন।’
‘আমি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এক লোকরে নিয়ে ঘুরসি। সে জায়গায় জায়গায় থেমে বাসা দেখসে। পরে যমুনা ফিউচার পার্কের পেছন গেটে এসে ১ হাজার টাকা দেখায় বলে ভাংতি নাই। ভাংতি করে আনি। কয়েক ঘণ্টায় ভাড়া হইসিল ৫০০ টাকা। এর পর অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও সে আসে নাই।’
একটু থামেন ইমন। একটু যেন জিরিয়ে নিলেন। ক্ষণিকের বিরতি। তার পর আবার বলতে থাকেন—
‘হাজার টাকা বা ৫০০ টাকাটা বড় না। আমার সাথে বাটপারিটা কেন করল? এর পর ওরে দেখলে মাইরাই ফেলব। সারা দিন কোনো আয় হয়নি। ভাতও খাইতে পারি নাই। পরিবারে বলতে আমার কেউ নাই। শুধু এক ভাগনা থাকে আমার সঙ্গে। তার জন্যও কিছু নিয়ে যাইতে পারি নাই।’
কথাগুলো বলতে বলতেই হয়তো তাঁর খেয়াল হলো, কার সঙ্গে বলছেন তিনি এ কথা। হয়তো ভাবলেন—যার সম্পর্কে বলছেন, তাঁর মতো আমিও তো তাঁর যাত্রী। আমি কি বিশ্বাস করব? তাঁর কথাগুলো কি বিশ্বাসযোগ্য লাগছে আমার কাছে? এসব ভেবেই হয়তো আবার বললেন—
‘আমার কথাগুলা সত্যি না মিথ্যা আপনি জানেন না। কিন্তু আল্লাহ তো জানে। সে-ই বিচার করবে।’
আমিও বিচারের ভার সৃষ্টিকর্তার ওপর ছেড়ে দিয়ে তাঁকে দ্বিগুণ ভাড়া দিলাম। হয়তো তাঁর পুরো গল্প নিছকই ভাড়া বাড়িয়ে নেওয়ার ধান্দা। আবার এমনও হতে পারে, আসলেই সারা দিন তিনি কিছু খাননি। কোনটা সাদা, আর কোনটা কালো, তা বিচার করার চেয়ে ধূসর রঙের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়া ভালো।
আজ সকালেই দেখলাম, সারি সারি রিকশার সামনে শিকল বাঁধা। প্রথমে চোখে পড়েনি বলে একজন চালককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘যাবেন নাকি?’ পাল্টা উত্তর এল, ‘যাইতাম তো! দেখেন না মামা, রেকারে দিয়া রাখসে।’ তাকিয়ে দেখলাম মোটা শিকলে তাঁদের সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আচ্ছা, নিয়ম যদি তাঁরা ভেঙে থাকেন, তবে জরিমানা করা যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁদের বসিয়ে রেখে আয়ের অঙ্কটা কমিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে কী? রিকশা চালিয়েই তো খেতে হয় তাঁদের, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের। কে জানে তাঁদের ঘরে কেউ অসুস্থ আছে কি-না, সন্তানেরা পথ চেয়ে বসে আছে কি-না অবুঝ বায়না প্রাপ্তির আশায়। কিংবা আরও আরও জটিল সমীকরণ থাকতে পারে তাঁদের জীবনে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না কেউ।
ভোরের আলো ফোটার আগেই রাজধানীর আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন শ্রমজীবীদের হাটে জড়ো হন শত শত শ্রমজীবী মানুষ। বিভিন্ন বয়সের পুরুষ ও নারী শ্রমিকেরা এই হাটে প্রতিদিন ভিড় করেন একটু কাজ পাওয়ার আশায়। তবে দিন যত যাচ্ছে, তাঁদের জীবনের লড়াই ততই কঠিন হয়ে উঠছে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি তাঁদের জীবনকে দুর্বিষ
২৬ অক্টোবর ২০২৪ফেলুদার দার্জিলিং জমজমাট বইয়ে প্রথম পরিচয় দার্জিলিংয়ের সঙ্গে। তারপর অঞ্জন দত্তের গানসহ আরও নানাভাবে হিল স্টেশনটির প্রতি এক ভালোবাসা তৈরি হয়। তাই প্রথমবার ভারত সফরে ওটি, শিমলা, মসুরির মতো লোভনীয় হিল স্টেশনগুলোকে বাদ দিয়ে দার্জিলিংকেই বেছে নেই। অবশ্য আজকের গল্প পুরো দার্জিলিং ভ্রমণের নয়, বরং তখন পরিচয়
২৩ অক্টোবর ২০২৪কথায় আছে না—‘ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরেমেঘ দেখলেই ডরায়’! আমার হইছে এই অবস্থা। বাড়িতে এখন বাড়িআলী, বয়স্ক বাপ-মা আর ছোট মেয়ে। সকাল থেকে চার-পাঁচবার কতা বলিচি। সংসার গোচাচ্ছে। আইজকা সন্ধ্যার দিকে ঝড় আসপি শুনতিছি। চিন্তায় রাতে ভালো ঘুমাতে পারিনি...
২৬ মে ২০২৪প্রতিদিন ভোরে ট্রেনের হুইসেলে ঘুম ভাঙে রাকিব হাসানের। একটু একটু করে গড়ে ওঠা রেলপথ নির্মাণকাজ তাঁর চোখে দেখা। এরপর রেলপথে ট্রেন ছুটে চলা, ট্রেন ছুঁয়ে দেখা—সবই হলো; কিন্তু এখনো হয়নি চড়া। রাকিবের মুখে তাই ভারতীয় সংগীতশিল্পী হৈমন্তী শুক্লার বিখ্যাত গান। ‘আমার বলার কিছু ছিল না, চেয়ে চেয়ে দেখলাম, তুমি চলে
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪