সাক্ষাৎকার

সবাই আমাকে বিশ্বাস করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে

Thumbnail Image

আকস্মিকভাবে অধিনায়কত্ব পেয়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। তাঁর নেতৃত্বে ১৫ বছর পর ক্যারিবিয়ানে টেস্ট জিতেছে বাংলাদেশ। কাল জ্যামাইকার কিংস্টন থেকে মিরাজ শুধু টেস্ট জয় নয়, নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ-দর্শন, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ও টেস্টে নিজের পারফরম্যান্স ফিরে দেখেছেন। ফোনে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রানা আব্বাস

প্রশ্ন: জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে প্রথম জয়, সেটিও আবার বিদেশের মাঠে। পুরো জয়ের গল্পটা কীভাবে রচিত হলো, আপনার কাছ থেকে বিস্তারিত শুনতে চাই।

মেহেদী হাসান মিরাজ: আমার জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। আমাকে যখন এই সফরের আগে দায়িত্ব দেওয়া হয়, সেরকম প্রস্তুতি আমার ছিল না। শান্ত যখন চোটে পড়ল, হঠাৎ দায়িত্ব এল আমার কাঁধে। হুট করে দায়িত্ব নেওয়া সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং। এটা তো জানেনই, দলের প্রয়োজনে সব সময় নিজেকে উজাড় করে দিয়েছি। এর মধ্যে দলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েক ক্রিকেটার দলে ছিলেন না। তার আগে টানা চার টেস্টে হেরেছি। এই পরিস্থিতিতে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ এসেছে। সফরের প্রথম টেস্ট আবার হেরে গেছি। প্রথম টেস্টের হার থেকে শিখে পরের টেস্টে কাজে লাগিয়েছি। কিছু সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি তো একা সিদ্ধান্ত নিইনি, দলের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সবাই মিলে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটার মধ্যে একটা শক্তি থাকে। সবাই আমাকে সমর্থন করেছে, এটা ইতিবাচক দিক। দ্বিতীয় টেস্টে যখন ১৬৪ রানে অলআউট হয়ে গেলাম, দলের মনোবল যখন নিচে নেমে গেল; তখন একটা কথা বলেছি দলের সবাইকে, আমরা যদি ১৬৪ রানে অলআউট হই, যদি ৮১ রানে ৮ উইকেট পড়ে, তাহলে ওরাও সমস্যায় পড়বে। ওরা ১ উইকেটে ৭০ রান তুলে (দ্বিতীয়) দিন শেষ করেছিল। বলেছিলাম ১০০ রানের মধ্যে ওদের ৯ উইকেট ফেলে দিতে পারি। অধিনায়ক হিসেবে এ বিশ্বাস আমি একা করলে হবে না, দলের সবাইকে করতে হবে। অধিনায়ক হিসেবে আমার বিশ্বাস আছে ওদের ১৫০ রানের মধ্যে অলআউট করতে পারব, বিশ্বাস আছে ম্যাচটা জিততে পারব—এই বিশ্বাস দলের সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারলেই আমরা ভালো করতে পারব। মাঠে যখন বোলাররা ভালো করল, নাহিদ রানা দুর্দান্ত বোলিং করল, ওদের ১৫০ রানে গুটিয়ে দিলাম; তখনই বিশ্বাস এল, না আমরা পারি। আবার যখন দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামলাম, তখন সৌরভ ভাই (মুমিনুল হক) অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তিনি জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন দুই দিন। সে কারণেই তিনি আটে নেমেছিলেন দ্বিতীয় ইনিংসে। তখন প্রশ্ন এল, সৌরভ ভাইয়ের জায়গায় কে নামবে? সিদ্ধান্ত হলো দিপু (শাহাদাত হোসেন) খেলবে সৌরভ ভাইয়ের জায়গায় আর আমি নামব দিপুর জায়গায়। দিপুর জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল—এক বছর পর জাতীয় দলে ফিরেছে, সেটাও আবার এই কন্ডিশনে। ওকে সাহস দিলাম। বললাম, বাংলাদেশে ঘরোয়া ক্রিকেটে যেভাবে খেলো, এখানে সেভাবেই খেলো। যদি মনে হয় প্রথম বল থেকেই মারা দরকার, মারবা। প্রতিপক্ষের বোলার কে, দেখার দরকার নেই। বল দেখবা আর হিট করবা। যদি আউট হও কেউ কিছু বলবে না, আমি দায়িত্ব নিলাম। এরপর তো দেখেছেন সে কী আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করেছে, ওর ২৬ বলে ২৮ রানের ইনিংস আমাদের মোমেন্টাম বদলে দিয়েছে। আমিও আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করেছি। সাদমান ইসলাম আর আমি যখন ব্যাটিং করেছি, দ্বাদশ খেলোয়াড়কে দিয়ে ড্রেসিং রুমে বার্তা পাঠালাম, উইকেট ভালো আছে। এখন টেস্টের প্রথাগত রক্ষণাত্মক ব্যাটিং না করে ইতিবাচক মানসিকতায় আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করা জরুরি। যদি ওয়ানডে মেজাজে রান তুলে ফেলি, চতুর্থ ইনিংসে বল ঘুরবে। ওদের জন্য সমস্যা হবে। খেলোয়াড়রা আমার কথা গ্রহণ করল এবং সাড়াও দিল ভালোভাবে। আমি সাহসী সিদ্ধান্ত নিলাম, কিন্তু সবাই গ্রহণ করল না; তাহলে তো সফল হওয়া কঠিন। অধিনায়কের সিদ্ধান্ত মেনে সবাই যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে ওটা ভুল হলেও ভালো ফল আসার সম্ভাবনা থাকে। সবাই আমাকে বিশ্বাস করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, এ কারণে আমরা সফল হয়েছি।

প্রশ্ন: জ্যামাইকা টেস্টে দলের খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষা, মনোভাবও অন্যরকম দেখা গেছে।

মিরাজ: দলের খেলোয়াড়দের পুরো স্বাধীনতা দিয়েছি। বলেছি, মাঠে পুরোপুরি উপভোগ কর। মাঠে দলের ভালোর জন্য যা দরকার, সেটা নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা কর। আমি যেটা বলব, সেটাই শেষ কথা না। একেবারে তরুণ ক্রিকেটারের কাছ থেকেও ভালো সিদ্ধান্ত আসতে পারে। কাজে দিতে পারে। এভাবেই সবাই উজ্জীবিত হয়ে, সাহসী মনোভাবে খেলেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এবার আমাদের প্রথম তিন ইনিংস আর শেষ ইনিংসের পার্থক্য নিশ্চয়ই বুঝেছেন। অ্যাপ্রোচে কিন্তু অনেক পার্থক্য। সবাই দেখেছে আমরা মেরে খেলেছি, কিন্তু কেন মেরে খেলেছি? এর চেয়ে ভালো উইকেটে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু এবার সফল হলাম কেন? শুধুই মানসিকতায় পরিবর্তন এনেছি। একটাই চিন্তা করেছি, এবার শুধু অ্যাটাক। একটা লিড পাওয়ার পর মেরে খেলে যদি একটা ভালো স্কোর দাঁড় করাতে পারি, চতুর্থ ইনিংসে তো ওদের ব্যাটিং করতে হবে।

প্রশ্ন: একটু ঝুঁকিপূর্ণও কি ছিল না?

মিরাজ: ঝুঁকি না নিলে কি সফল হওয়া যায়? সফল তো সে-ই হয়, যে সাহস আর ঝুঁকি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। ব্যর্থতার ভয়ে ঝুঁকি না নিলে সফল হওয়া যায় না। আমরা ইতিবাচক চিন্তায় ঝুঁকি নিয়েছি বলেই সফল হয়েছি।

প্রশ্ন: এ বছর বাংলাদেশ বিদেশে ৩ টেস্ট জয়ের বিপরীতে দেশে কোনো জয় নেই। দলের সাফল্যে এই অদ্ভুত বৈপরীত্য কীভাবে ঘটেছে?

মিরাজ: এটার ইতিবাচক দিক আছে। মানুষ অন্তত বিশ্বাস করতে শুরু করছে, বাংলাদেশ দেশের বাইরেও টেস্ট জিততে পারে। আমাকে নিয়েও কথা হয়েছে একসময়, আমি নাকি দেশের বাইরে উইকেট পাই না! টেস্টে আমার অর্ধেক উইকেটই দেশের বাইরে।

প্রশ্ন: পেসারদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণেই কি বিদেশে বাংলাদেশের জয়ের হার বেড়েছে?

মিরাজ: ঠিক, কোনো দলে যদি ভালো মানের পেস আক্রমণ থাকে, তাহলে দেশের বাইরেও জিততে পারবেন। বিদেশে স্পিন আক্রমণ দিয়ে খুব একটা জেতা যায় না। স্পিনারদের খেলা টেস্টের চতুর্থ ও পঞ্চম দিনে। প্রথম তিন দিন ব্যাটার আর পেসারদের খেলা। কিন্তু আপনাকে তো টেস্ট চার কিংবা পাঁচ দিনে নিতে হবে। আমরা তৃতীয় দিনেই হেরে যাই, প্রথম ইনিংসেই হেরে যাই। এখন আমাদের দলে দুর্দান্ত সব পেসার এসেছে। তাসকিন আহমেদ, হাসান মাহমুদ, নাহিদ রানা, শরীফুল ইসলাম, খালেদ আহমেদ, ইবাদত হোসেন...আগে উইকেট শিকারি পেসার আমাদের কম ছিল। এখন আমাদের একজন পেসার যেকোনো ব্যাটিং লাইনআপ ধসিয়ে দিতে পারে। আপনার দলে যদি ঘণ্টায় ১৫০ কি.মি. গতিতে বল করার ফাস্ট বোলার থাকে, বিদেশে প্রতিপক্ষ আমাদের সবুজ উইকেট দিতে অনেক ভাববে। আমরা এখন দেশের বাইরে খেললে প্রতিপক্ষ ভাবে, ওদেরও তো তিন-চারটা ভালো মানের ফাস্ট বোলার আছে।

প্রশ্ন: যে তিনটি টেস্ট জিতেছে বাংলাদেশ, ব্যাটাররা মোটামুটি একটা রান করে দিতে পারলেই বোলাররা বাকি কাজ করে দিয়েছেন।

মিরাজ: ব্যাটাররা যেদিন বড় রান করেছি, ওইদিন বোলারদের কাজ সহজ হয়ে গেছে, ম্যাচ জিতিয়ে দিয়েছে। খুব কমই আছে বড় স্কোর করার পরও বোলাররা ম্যাচ হারিয়েছে। পাকিস্তানে ৫০০+ রান হয়েছে, বোলাররা কিন্তু কোনো না কোনো ইনিংসে ধসিয়ে দিয়েছে। এখানেও (জ্যামাইকাতে) ওদের ১৫০ রানের মধ্যে অলআউট করে দিয়েছি।

প্রশ্ন: নাহিদ রানার বোলিং অনেক প্রশংসিত হচ্ছে।

মিরাজ: আল্লাহর রহমতে ও (রানা) আমাদের দেশের একটা সম্পদ। আমাদের সবার উচিত ওর ভালোভাবে পরিচর্যা করা। দলের প্রত্যেক পেসার, প্রত্যেক খেলোয়াড়কেই যত্ন করতে হবে। আপনি যত যত্ন করবেন, তত আপনাকে ফল দেবে। যত পানি দেবেন, ততই আপনাকে ফল দেবে। আপনার গাছ তো খাওয়ার দরকার নেই, ফল খেতে হবে।

প্রশ্ন: এই বছর টেস্টে আপনি বাংলাদেশের সেরা পারফরমার...।

মিরাজ: টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের এই চক্রে এখন পর্যন্ত অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে মনে হয় আমার ওপরে কেউ নেই। এই চক্রে ১২ টেস্টে ৭০৭ রান আর ৩৯ উইকেট নিয়েছি।

প্রশ্ন: সব মিলিয়ে নিজের পারফরম্যান্সে কতটা তৃপ্ত?

মিরাজ: আলহামদুলিল্লাহ। খুব ভালো লাগছে। এই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ খুব ভালো গেছে আমার। রান করতে পারছি, সবার যে আস্থা আছে, সেটার প্রতিদান দিতে পারছি। এটাকে আরও অনেক দূরে নিয়ে যেতে হবে। এখন আমার কাছ থেকে অনেক আশা করে দল।

প্রশ্ন: কোচ ফিল সিমন্সকে কেমন লাগছে?

মিরাজ: ভালো লাগছে। অনেক ইতিবাচক মানসিকতার মানুষ। সবাই খুব উপভোগ করছে ওর সঙ্গে কাজ করে।

প্রশ্ন: জাতীয় দলে তিনটি ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছেন। এখন কি মনে হয় লম্বা সময়ের জন্য অধিনায়কত্ব করতে আপনি প্রস্তুত?

মিরাজ: যে পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব দিয়েছি গত তিন ম্যাচে, এটা অনেক চ্যালেঞ্জিং। হুট করে একটা দলকে পরিবর্তন করে দেওয়া যায় না। এটা সময়ের ব্যাপার। ক্রিকেট বোর্ড যদি মনে করে, ভালো কিছু করতে পারব, লম্বা সময়ের জন্য চিন্তা করে; তাহলে অনেক কিছু পরিবর্তন করা সম্ভব, ভালো কিছু করা সম্ভব। তবে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য কোনো কিছু...শুধু আমি না; কোনো খেলোয়াড়, কোনো অধিনায়কই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ভালো করতে পারবে না। সময় দিলে সে ভালো করতে পারবে। যেটা জানতে চাইলেন, আমি প্রস্তুত কি না? ৫১টি টেস্ট খেলে ফেলেছি, ৮ বছর ধরে জাতীয় দলে খেলি। কী মনে হয়, আমি এখনো প্রস্তুত কি না? প্রস্তুত আছি, সব সময় প্রস্তুত আছি। তবে রেজাল্ট পেতে গেলে সময় দিতে হয়। হুটহাট রেজাল্ট আসে না। আমাকে যদি ওই সময়টা দেওয়া হয়, আশা করি অধিনায়ক হিসেবে ভালো করব।

প্রশ্ন: এবার সাদা বলের চ্যালেঞ্জ, ওয়ানডে সিরিজ জিততে কতটা আশাবাদী?

মিরাজ: ইনশাআল্লাহ...অবশ্যই সিরিজ জিতব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত