Ajker Patrika

কম্বোডিয়ার বাঁশের ট্রেন

ইশতিয়াক হাসান
আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ১০: ১৩
কম্বোডিয়ার বাঁশের ট্রেন

রেললাইন ধরে ছুটে চলা জিনিসটা দেখলেই চমকে উঠবেন এলাকায় নতুন যে কেউ। ছোট্ট একটা বাঁশের কাঠামোর ওপর বসে আছে ১০-১২ জন। ৪০-৫০ কিলোমিটার বেগে অবলীলায় চলে যাচ্ছে অদ্ভুত এই যান। হ্যাঁ, এটিই কম্বোডিয়ার বিখ্যাত বাঁশের ট্রেন বা নরি।

নরির কথা যখন প্রথম পড়ি, অবাক হয়েছিলাম। এমনিতেও ট্রেনে চড়তে ভারি আনন্দ হয়। আর এমন বাঁশের ট্রেনে চেপে বসতে পারলে না জানি কেমন আনন্দ হবে, ভাবছিলাম! এখন পর্যন্ত অবশ্য কম্বোডিয়া যাওয়া হয়নি, তাই নরিতেও চড়া হয়নি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশের অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থার এলাকাগুলোয় বহু বছর ধরে প্রয়োজনীয় এক বাহন হিসেবে সেবা দিয়ে এসেছে নরি। তবে একে কিন্তু গোটা কম্বোডিয়ায় পাবেন না, নরির দেখা পেতে হলে আপনাকে যেতে হবে দেশটির বেটামবাং প্রদেশে।

চলার পথে কোনো কারণে থেমেছে কয়েকটি বাঁশের ট্রেন। দেখতে কেমন
নরির মূল কাঠামোয় আছে একটা বাঁশের পাটাতন। অবশ্য এটাকে শক্ত করার জন্য ধাতব একটা পাতও ব্যবহার করা হয়। চাকাগুলো ইস্পাতের। আর থাকে একে চালানোর জন্য ছোট্ট একটি মোটর। নরির চাকা ও এক্সেল পুরোনো পরিত্যক্ত ট্যাংক ও লরি থেকে সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত ব্যবহার করা হয় মোটরসাইকেল কিংবা ট্রাক্টরের পুরোনো ইঞ্জিন। মূল কাঠামো বা বসার জায়গাটি বাঁশের হওয়ায় এটি স্থানীয় নাম নরির পাশাপাশি বেম্বো ট্রেন বা বাঁশের ট্রেন নামেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

রেললাইনের পাশে ফেলে রাখা কয়েকটি নরি। কীভাবে এলো নরি
১৯৭০-এর দশকে গৃহযুদ্ধ ও খেমাররুজের শাসনের সময় কম্বোডিয়ার জাতীয় রেলরোড পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৮০-এর দশকে আবার ট্রেন চলাচল শুরু হলেও চলতে থাকা গেরিলাযুদ্ধে দেশের বিভিন্ন অবকাঠামোর বারোটা বেজে যায়। রাস্তাগুলোর অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। ট্রেন চলাচল কমতে কমতে একসময় আবার বন্ধ হয়ে যায়। এতে মানুষের পক্ষে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যাওয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। আর এই সমস্যার সহজ এক সমাধান বের করেন স্থানীয়রা, সেটিই বেম্বু ট্রেন বা বাঁশের ট্রেন। 

একটি নরিকে জায়গা দিতে লাইন থেকে সরানো হচ্ছে আরেকটি নরি। যোগাযোগে বড় ভরসা
বেটামবাংয়ের পরিত্যক্ত লাইনগুলোর ওপর চলা এই আজব ট্রেন অচিরেই প্রদেশের ছোট ছোট গ্রামগুলোর মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করা আরম্ভ করে। মানুষ তো বটেই, নানা মালামাল, এমনকি গবাদিপশুও পরিবহন করে। বিশেষ করে রোগী, বৃদ্ধ ও শিশুদের যাতায়াতে দারুণ সুবিধা হয় নতুন এই যানের উদ্ভবে। লাইন একটাই, দুই দিক থেকে আসে নরি। যখন দুটি নরির দেখা হয়ে যায়, তখন থামতে হয় একটাকে। তার পরই এক মজার কাণ্ড ঘটে। হালকা নরিটার মালামাল খালাস করে ওটাকে লাইনের পাশে নিয়ে আসা হয়। এতে অন্য নরিটা চলে যেতে পারে। তারপর আবার এটাকে লাইনে তুলে মালামাল ও যাত্রী তুলে স্টার্ট দেওয়া হয়। পুরো ঘটনায় সময় লাগে কয়েক মিনিট। একটা সময় বড় বড় শহরের বাইরের এলাকাগুলোয় যেখানে রেললাইন আছে, সেখানেই চলত নরি। মোটামুটি বড় একটা দূরত্ব বাঁশের এই ট্রেন দিয়েই পাড়ি দেওয়া সম্ভব ছিল।

একের পর এক সারবেঁধে চলেছে কয়েকটি ট্রেন।ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা
কিন্তু বিগত বছরগুলোয় কম্বোডিয়ার বেশির ভাগ রেললাইন সংস্কার করা হয়েছে যাত্রীবাহী ও মালগাড়ি চলাচলের জন্য। এতে বাঁশের ট্রেনের ভবিষ্যৎ ধোঁয়াশার মধ্যে পড়ে যায়। অনেক দিন ধরে বাঁশের এই ট্রেন বন্ধ করে দেওয়ার গুজবও শোনা যাচ্ছিল। কারণ বিশালাকার ইস্পাতের ট্রেনের পাশাপাশি তো আর নরির চলার সুযোগ নেই। ক্রমেই চলার এলাকা কমতে কমতে ২০১৭ সালে এসে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায় নরির কার্যক্রম।

এর মধ্যে আরেকটি কাণ্ড হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বেটামবাংয়ের ফনম বেনান পর্বতের পাদদেশ থেকে শুধু নরির জন্য একটা লাইন স্থাপন করা হয়েছে। মূল শহর থেকে একটু দূরে নতুন এই নরি অবশ্য পর্যটকদের কথা ভেবেই করা হয়েছে। পুরোনো নরির যাত্রী ছিল স্থানীয় কম্বোডিয়ান অধিবাসী, কুকুর, মুরগি ও পর্যটকেরা। তবে এই নরি কেবল পর্যটকদের কথা ভেবেই বানানো।

বাঁশের ট্রেনে চড়া ভারি মজা।তবে সৌভাগ্যক্রমে কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর সীমিত পরিসরে হলেও আবার শুরু হয় পুরোনো নরির চলাচল। এমনিতে নরি বা বাঁশের ট্রেন ভ্রমণে দুপাশের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলা, কখনো শরীরে গাছের কাঁটার খোঁচা খাওয়া, আচমকা সামনে এসে পড়া বড় কোনো ডালের আঘাত থেকে বাঁচতে মাথা নিচু করা—এই সবকিছু মিলিয়ে দারুণ রোমাঞ্চকর ছিল যাত্রা। একটি নড়বড়ে বাঁশের সেতু্ও পার হতে হতো। তবে এখন এই ভ্রমণে আগের মতো রোমাঞ্চ হয়তো মিলবে না। কারণ দুপাশের জঙ্গল অনেকটাই ছেঁটে ফেলা হয়েছে। বাঁশের সেতুর জায়গা নিয়েছে কংক্রিটের সেতু। বেটামবাং শহরের পাশেই ও ডামবং এবং ও শ্রা লাভের মাঝখানের এলাকায় চলে পুরোনো এই বাঁশের ট্রেন।

নতুন বাঁশের ট্রেনে চড়লে মন্দির, গুহাসহ কম্বোডিয়ার বিখ্যাত কিছু পর্যটন স্পট সহজে দেখতে পারবেন। অন্যদিকে পুরোনো নরিতে চড়া পর্যটকদের দাবি, বাঁশের ট্রেনে ভ্রমণের মূল আমেজ পেতে চাইলে এখনো পুরোনো বাঁশের ট্রেনই ভরসা। এখন কম্বোডিয়ায় গেলে কোনটায় ভ্রমণ করবেন সেটা আপনার সিদ্ধান্ত। যেটাতেই ভ্রমণ করুন না কেন, ভাড়া পড়বে পাঁচ ডলার বা আমাদের হিসেবে ৫০০ টাকার কিছু বেশি।

বিবিসি, সিয়েম রিপার.কম, ব্যাকপেকারস ওয়ন্ডারলাস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত