বিস্ময়কর গোলাপি হ্রদ আছে অস্ট্রেলিয়ায়

ইশতিয়াক হাসান
প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৩, ১১: ২৩
আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২৩, ১২: ৪০

একটি হ্রদের পানির রং কেমন হতে পারে? আর যাই হোক, নিশ্চয় গোলাপি আশা করবেন না। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও অস্ট্রেলিয়ার লেক হিলিয়ারের জলের রং গোলাপি।

পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার রিচার্চি দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে বড় দ্বীপ মিডল। এখানেই লেক হিলিয়ারের অবস্থান। বিশেষ করে ওপর থেকে দেখলে হ্রদটির গোলাপি রংটা সবচেয়ে সুন্দরভাবে ধরা দেয়। অবশ্য লেকের কাছাকাছি পর্যটকের এমনিতেও যাওয়া বারণ। আশ্চর্য সুন্দর গোলাপি জলের হ্রদটি তাঁদের দেখতে হয় হেলিকপ্টারে চড়ে বা উড়োজাহাজ থেকেই।

হ্রদটি দৈর্ঘ্যে ৬০০ মিটার বা ২০০০ হাজার ফুটের কাছাকাছি। চওড়ায় ২৫০ মিটার বা ৮০০ ফুটের মতো। এতে লবণের মাত্রা অত্যধিক। সাগরে সাধারণত যে পরিমাণ লবণ থাকে তার আট গুণ আছে এর জলে। হ্রদের পাড়ে বালুকাবেলা, তারপর আবার ইউকেলিপ্টাস আর পেপারবেক গাছের জঙ্গল। এই জঙ্গল আর বালিয়াড়ি হ্রদটিকে দক্ষিণ মহাসাগরের উত্তর প্রান্ত থেকে আলাদা করে রেখেছে।

মজার ঘটনা, একসময় অনেকের ধারণা ছিল লেক হিলিয়ারের গোলাপি জলের রহস্যে হয়তো আলোর কোনো প্রভাব আছে। কিন্তু পরে এর জল বড় পাত্র বা কন্টেইনারে নিয়ে দেখা গেছে সেটা গোলাপিই আছে।

লেকের গোলাপি জল মুগ্ধ করে পর্যটকদেরহিলিয়ারের জলের এই আশ্চর্য গোলাপি রঙের কারণ কী তা নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। এ সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্যও ছিল না। তবে পরে কিছু গবেষণা থেকে ধারণা করা হয়, ডানালিয়েল্লা সেলাইনা ও হ্যালো বেকটেরিয়ার সৃষ্টি করা রঙের কারণে এই হ্রদের জল গোলাপি। অবশ্য আরও একটি তত্ত্ব আছে। সেটি অনুযায়ী, হিলিয়ারের জলের লবণের আবরণের মধ্যে লাল হেলোফিলিক ব্যাকটেরিয়া এই গোলাপি রঙের কারণ।

লেক হিলিয়ারের জলে লবণের মাত্রা অত্যধিক।তবে সাম্প্রতিক সময়ে, মানে ২০২২ সালে বড় ধরনের একটি গবেষণা হয়েছে হিলিয়ারের জল নিয়ে। এতে দেখা যায় বর্ণিল ব্যাকটেরিয়া আর শৈবাল মিলেমিশে লেকের জলের এমন রং সৃষ্টি করেছে। এই গবেষণার মূলে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ভারমন্টের গবেষক স্কট টিঘে। প্রথম একটি টিভি অনুষ্ঠানে হ্রদের অবাক করা গোলাপি জল দেখে উৎসাহী হয়ে ওঠেন তিনি। ‘এক্সট্রিম মাইক্রোবায়োম’ প্রকল্পের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্কট টিঘে। পৃথিবীর চরমভাবাপন্ন জলবায়ুর এলাকাগুলোতে রহস্যজনক, বিস্ময়কর সব অণুজীবের খোঁজে অনুসন্ধান চালায় প্রতিষ্ঠানটি। অণুজীব নিয়ে কাজ করা অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনের কোম্পানি ‘মাইক্রোবা’র কেন ম্যাকগ্রাথের সঙ্গে জোড় বাঁধেন তিনি।

হ্রদটি থেকে পানি ও পলি সংগ্রহ করা হয়। টিঘে, ম্যাকগ্রাথসহ তাঁদের সহকর্মীরা গবেষণায় মেতে উঠলেন নমুনাগুলো নিয়ে। এতেই জানা গেলে, প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে এমন শ পাঁচেক অণুজীব আছে হ্রদটিতে। আছে নানা জাতের ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, শৈবাল। এদের বেশির ভাগ হেলোফিল জাতীয়, যাদের উচ্চমাত্রার লবণে টিকে থাকতে কোনো সমস্যা হয় না। এগুলোর কোনো কোনোটি খুব বর্ণিল। যেমন বেগুনি সালফার ব্যাকটেরিয়া, লাল-কমলা সেলাইনি বেকটার ও লাল রঙের শৈবাল ডানালিয়েল্লা সেলিনা। এসব অণুজীবের মিশ্রণ, সেই সঙ্গে আরও কিছু মিলিয়ে এই গোলাপি রঙের জন্ম।

জঙ্গল আর বালিয়াড়ি দক্ষিণ মহাসাগর থেকে হ্রদটিকে আলাদা করে রেখেছেমিডল দ্বীপের এই লাল হ্রদের ব্যাপারে প্রথম লিখিত বিবরণ মেলে ব্রিটিশ অভিযাত্রী ও জল নিয়ে গবেষণা করা ম্যাথু ফ্লিন্ডারসের জার্নালে, ১৮০২ সালে। ম্যাথু মিডল দ্বীপের সর্বোচ্চ চূড়ায় (এখন পরিচিত ফিন্ডারস পিক নামে) ওঠেন আশপাশের জলাধারগুলো দেখতে, তখনই তাঁর চোখে প্রথম ধরা পড়ে এখানকার আশ্চর্য গোলাপি জলের হ্রদ। বলা চলে, তারপর থেকেই হ্রদটির প্রতি মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়।

বিংশ শতকের গোড়ার দিকে কয়েকটি বছর এই এলাকা থেকে লবণ আহরণ করা হয়। ওই সময়টা মিডল্যান্ড দ্বীপ ও হিলিয়ার হ্রদ বেশ বিপদগ্রস্ত ছিল। তারপর থেকে অবশ্য এর পরিবেশ রক্ষায় মনোযোগ দেওয়া হয়। হ্রদসহ গোটা দ্বীপ এলাকাটিতে গবেষক ছাড়া সাধারণের প্রবেশ সংরক্ষিত। অবশ্য কেউ যদি লেকের কাছে যাওয়ার বিশেষ অনুমতির ব্যবস্থা করতেও পারেন, দুর্গম এলাকায় হওয়ায় সেখানে পৌঁছা সহজ নয় মোটেই।

পর্যটকদের পাখির চোখেই দেখতে হয় গোলাপি লেকতবে এখন পর্যন্ত এই গোলাপি জল মানুষের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি। অবশ্য পর্যটকেরা যেহেতু কাছে যেতে পারেন না, তাই এতে সাঁতারেরও সুযোগ নেই।

তাহলে কি সাধারণ পর্যটক অদ্ভুত সুন্দর এই গোলাপি জলের হ্রদ দেখার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হন? তা কেন হবে? এর সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ পান পর্যটকেরা হেলিকপ্টার ভ্রমণের মাধ্যমে, পাখির চোখে। অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত নিয়ম করে হেলিকপ্টার রাইডের ব্যবস্থা আছে তাঁদের জন্য। বছরের বাকি সময় লেকের সৌন্দর্য পাখির চোখে দেখতে হলে গোটা হেলিকপ্টার ভাড়া করতে হবে।

সূত্র: অ্যামিউজিং প্ল্যানেট, নিউ সায়েন্টিস্ট কম

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত