গদাইলস্কর গদাধর

রজত কান্তি রায়
Thumbnail image

গদাইলস্কর গদাধর গজরাজের মতো গজরাইতে লাগিল। কারণ, আসন্ন শীতের প্রাক্কালে কোথাও হইতে কোকিলের কুহুতান শোনা যাইতেছে না। আর শোনা যাইতেছে না বলিয়া তাহার মেজাজ সপ্তমে উঠিতেছে। তাই এদিক-সেদিক শো ডাউন করিয়া বেড়াইতে লাগিল গদাধর। কাঁধে তাহার গদা। দুষ্টু লোকে কহিতে লাগিল, গদাধর কাঁধে গদা লইবার পূর্বে শিবের পূজা করিয়াছিল। সেই হেতু তাহার চক্ষু রক্তবর্ণ। 

কহিলাম, ‘তুমি বাপু মিছেই হয়রান হইতেছ।’
গদাধর কহিল, ‘মিছেই?’
কহিলাম, ‘যুক্তি যে নাই, তাহা বুঝিতেছি।’

গদাধর এইবার ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল। ভূতল কাঁপিতে লাগিল। সবুজ শষ্যরাজি দুলিয়া উঠিল। আম্র বৃক্ষ, কাঁঠাল বৃক্ষ, তাল বৃক্ষ, আমার আর গদাধরের চারিপাশে যত বৃক্ষরাজি ছিল, সকলি মৃদু দুলিয়া উঠিল। কিন্তু গদাধর শান্ত হইল না। 

কহিলাম, ‘বাপু হে, ক্ষিপ্ত না হইয়া আমার মস্তকে গদাঘাত কর।’

আমি আভূমি আনত হইয়া মস্তক সবুজ দুর্বাদলের ওপর স্থাপন করিলাম আর ক্ষণ গুনিতে লাগিলাম। পল অণুপল করিয়া ক্ষণ বহিয়া যাইতে লাগিল। আমি নিশ্বাস প্রায় বন্ধ করিয়া মস্তকোপরি গদার আঘাত পাইবার জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। কিন্তু গদাধর আগাইয়া আসিয়া আমার মস্তকে আঘাত করিল না। কহিলাম, ‘গদাধর, আঘাত কর।’

গদাধর ক্ষীণ কণ্ঠে কহিল, ‘আমার হিসু পাইয়াছে।’

বিক্ষিপ্ত হৃদয় লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম। গদাধরকে কোথাও দেখিতে পাইলাম না। কিয়ৎক্ষণ পর বংশবীথি হইতে গদাধর বাহির হইয়া আসিল। কহিলাম, ‘শান্ত হইয়াছ বৎস?’

গদাধর কিছু কহিতে পারিল না। বয়সে আমার কিছু ছোটই হইবে সে। সম্ভবত সেই কারণে বংশবীথিতে মুত্রবিসর্জন করিবার বিষয়টি ভাবিয়া বয়োজ্যেষ্ঠ আমার সামনে লজ্জা পাইতেছে।

কহিলাম, ‘গদাধর, এখন হেমন্ত কাল চলিতেছে। দেখ মাঠে মাঠে ধান পুরুষ্ট হইতেছে। হেমন্ত কালের পরেই আসিবে শীতকাল। তখন চরাচর এক ভিন্ন রঙে সাজিবে। তাহার পর আসিবে ঋতুরাজ বসন্ত। তখন কোকিল কুহুতানে গান করিবে। ডালে ডালে ফিঙে নাচিবে। তুমি কেন হেমন্তকালে কোকিলের কুহুতান শুনিতে চাহিতেছে?’

গদাধর কিছু কহিতে পারিল না বটে। কিন্তু বুঝিলাম, হৃদায়াভ্যন্তরে তাহার গজরাজের মতোই গর্জন চলিতেছে।

আমার পূর্বপুরুষ পূর্ণচন্দ্র খাচুয়া তাঁর হাতে ধরা জীর্ণ ভূর্জপত্রের ধূসর পাণ্ডুলিপিখানা বন্ধ করলেন। তাঁর চোখ ছল ছল করিয়া উঠিল। আমি ব্যাকুল হয়ে বলিলাম, ‘আরে, কী আশ্চর্য! আপনি কাঁদিতেছেন কেন?’

তিনি বলিলেন, ‘বঙ্কিমচন্দ্রের এই অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি আমি আবিষ্কার করিয়াছি সমতট অঞ্চল থেকে। কিন্তু দেখ, শেষ পাতাখানা নাই। ছাগলে খেয়ে ফেলেছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত