Ajker Patrika

বলার আগে একটু ভাবুন

ডা. ফারজানা রহমান
বলার আগে একটু ভাবুন

বছরের পর বছর কিছু বিষয় আমাদের জীবনে স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকে। ফলে বোঝা যায় না, সেগুলো থেকেও মানসিক সমস্যা তৈরি হতে পারে। এ জন্য এর কোনো প্রতিকার করাও সম্ভব হয় না। ফলে একসময় মানুষ ‘ভালো লাগে না’ রোগে ভুগতে শুরু করে। দিন দিন তা বেড়ে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আর এসব আপাত ‘স্বাভাবিক’ ব্যাপারের বেশির ভাগ ঘটে নারীদের সঙ্গে। 

ঘর থেকে শুরু  
নিশা পেশায় চিকিৎসক। বিসিএস ক্যাডার। ইচ্ছা আছে উচ্চ ডিগ্রি নেওয়ার। কিন্তু তাঁর শাশুড়ি সেসবে রাজি নন। রুমা একজন ব্যাংকার। তাঁর স্বামী তাঁকে চাকরি করতে দিতে চান না। আফরোজা পেশায় একজন নার্স। পরিবার তাঁকে রাতে দায়িত্ব পালন করতে দিতে চায় না। মিলি তাঁর দ্বিতীয় কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছেন। পুত্রসন্তান না হলে স্বামী তাঁকে গ্রহণ করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। 

শুধু যে সমাজ পেশাজীবী নারী কিংবা গৃহিণীদের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তা নয়। বিষয়টির শুরু অনেক ক্ষেত্রে পরিবার থেকে। নিশা, রুমা কিংবা আফরোজার মতো প্রচুর উদাহরণ আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। 

অফিস ও বাসা–সব সামলে নারীদের ঘুমোতে যেতে হয়। তাদের ওপর শারীরিক পরিশ্রমের পাশাপাশি মানসিক যন্ত্রণার আলাদা ভার থাকে। মিলির মতো গৃহিণীকেও সারা দিনের সব কাজ সামলে রাতে বিছানায় ছটফট করতে হয়। হয়তো দিনের কোনো এক সময় পরিবারেরই কেউ একজন তাঁকে বলেছেন, এত মেয়ে দিয়ে কী করবে? বুড়ো বয়সে তো একটা ছেলেই তোমাদের পাশে থাকত। এ কথার মানসিক আঘাত সামলাতে সামলাতেই হয়তো ভোরের আলো ফোটে মিলির জীবনে। ফলে মিলির মতো নারীদের শারীরিক ও মানসিক কষ্ট কম নয়। 

মন্তব্য করার আগে ভাবুন
একজন পাস করা চিকিৎসক নারীকে ঘরে বসিয়ে রাখলে তাঁর জীবনে কতটা মানসিক যন্ত্রণা নেমে আসতে পারে, সে বিষয়ে আমাদের ভাবনা খুব সীমিত। একজন অনার্স অথবা কোনো বিষয়ে স্নাতক পাস করা মেয়েকে পাওয়া চাকরি করতে না দেওয়ার ঘটনাও একই রকম মনঃকষ্টের কারণ হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, সরকারি চাকরি পেয়েও দূরে পোস্টিংয়ের জন্য একজন মেয়েকে চাকরি করতে দেওয়া হয় না। বিবাহিত হলে এটি শুধু যে মেয়েটির শ্বশুরবাড়ির সিদ্ধান্তে হয়, এমনও নয়। অনেক সময় মেয়েটির বাবার পরিবারও বিষয়টি বুঝতে চায় না। সন্তান ছেলে হবে নাকি মেয়ে, এ বিষয়টি যে একা মেয়েদের হাতে নয়, সেটি এখনো বুঝতে আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপারগ। ফলে সন্তান মেয়ে হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীদের ওপর প্রথম ধাক্কাটা আসে পরিবার থেকে। এতে নতুন মা যে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, সে বিষয়ে আমাদের এখনো তেমন ধারণা নেই।

সব শ্রেণির নারীই ভুক্তভোগী
যৌন নির্যাতন, যৌতুকের জন্য নীরব ও সরব চাপ, দৈহিক নির্যাতন, মাদকাসক্তি, স্বামীর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়ানোসহ মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রতিদিন অনেক নারী আমাদের কাছে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসেন। শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত—কোনো নারীই এর বাইরে নন। পরিবারের জন্য, সন্তানের জন্য, সমাজের জন্য, লোকলজ্জার ভয়ে অথবা স্রেফ সিদ্ধান্তহীনতার জন্য অনেকে নিজেদের নাজুক অবস্থার কথা মেনে নেন। এমনকি নির্যাতিত হলে বিচার চাওয়া তো দূরের কথা, প্রতিবাদ পর্যন্ত করেন না। এতে সেই নারীর মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি পরিবারটিতে বেড়ে ওঠা শিশুদের মনোদৈহিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়।

যেকোনো ধরনের নেতিবাচক কথা, আচরণ, ব্যবহার বা ইশারা, অন্যের সঙ্গে তুলনা, শ্লেষাত্মক কথা, ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, কটাক্ষই যথেষ্ট কাউকে মানসিকভাবে নির্যাতন করার জন্য। আমাদের পরিবার বা সমাজে নারীদের ক্ষেত্রে যা প্রায় নিয়মিত ঘটনা। আমরা নারীর ক্ষমতায়ন ও স্বাধীনচেতা মনোভাবকে সম্মান করতে জানি না। ফলে কখনো কখনো নারীরা নিজ পরিবারে সবচেয়ে বেশি বাধার সম্মুখীন হয়। 

পরিবার থেকে ওঠা আপত্তিতে নারীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। আর এ থেকে তারা পিছিয়ে পড়ে জীবনের বহু ক্ষেত্রে। ফলে একটি
সুস্থ সমাজ, জাতি বা প্রজন্ম চাইতে হলে নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে ভাবতে হবে পরিবার থেকেই। 

[ লেখাটিতে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।]

লেখক: ডা. ফারজানা রহমান, সহযোগী অধ্যাপক জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হলেন ক্যালিফোর্নিয়ার পরিবহন বিশেষজ্ঞ

‘তল্লাশির’ জন্য উসকানি দিয়েছে গুলশানের ওই বাসার সাবেক কেয়ারটেকার: প্রেস উইং

প্রধান উপদেষ্টার আরও দুই বিশেষ সহকারী নিয়োগ

খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা মাসুদ আহমেদের সব পদ স্থগিত

টিআইএন নেওয়ার পরে কিন্তু ঘুমাইতে পারবেন না: এনবিআর চেয়ারম্যান

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত