Ajker Patrika

সেই থেকে ঝুলে আছে মেয়েটা

মিজানুর রহমান নাসিম
Thumbnail image

ফেলানী হত্যাকাণ্ডের দিনটি ছিল ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি। ওই দিনই তার বিয়ে হতো লালমনিরহাটের বাসিন্দা খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে। এর কিছু সময় আগে, শেষরাতের কুয়াশাচ্ছন্ন আবছা অন্ধকারে ফেলানী খাতুন দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিএসএফ কর্তৃক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার অনন্তপুর বর্ডারে। তখন তার বয়স ছিল ১৪ বছর। লিকলিকে অপুষ্ট শরীর, নিম্নবর্গীয় পোশাক অথচ কী কসরত করেই না কাঁটাতারে উল্টো ঝুলে ছিল পলকা শরীরটা! ঠিক শিকারির গুলিতে মরে গাছে ঝুলে থাকা বেওয়ারিশ শামুকখোল পাখির মতো। রক্তের ধারা চুঁইয়ে সীমানা বেড়া ও বিভাজিত প্রান্তের ভূমি রঞ্জিত করেছিল। ‘সেই থেকে ঝুলে আছে মেয়েটা...’ সম্প্রতি একজন গবেষক পরাবাস্তব ভাষায় দৃশ্যটি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন তাঁর সীমান্তবিষয়ক গবেষণায়।

ফেলানীর মৃত্যুর এক যুগ পরে গত বছর ফেব্রুয়ারির এক দুপুরে তাঁদের বাড়িতে হাজির হই। এখন কি এ বাড়িটিকে ‘ফেলানীদের বাড়ি’ বলা যায়? যা-ই হোক, বাড়ির এক চিলতে উঠানে খড়ের আগুনে মোটা ধান সেদ্ধ করছিলেন ফেলানীর মা জাহানারা বেগম। কেনা ধান, তাতে চাল কেনার চেয়ে পড়তা পড়ে। তাঁর পরনের কম দামি প্রিন্ট শাড়িটির লাল ছোপ যেন মেয়ে ফেলানীর রক্তভেজা মৃতদেহের প্রতীক। স্মৃতি এমনি করেই বারবার ঘুরেফিরে আসে!

ফেলানীর পৈতৃক বাড়ি উত্তরের সীমান্তবর্তী রামখানা ইউনিয়নের কলোনিটারি গ্রামে। যদিও অভাবের তাড়নায় তার জন্মের আগেই পরিবারের সবাই অভিবাসী জীবন বেছে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন আসামের নিউ বঙ্গাইগাঁও। সেখান থেকে বিয়ে উপলক্ষে দেশে ফেরার পথে সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে ঘটেছিল সেই করুণ ও আলোচিত মৃত্যুর ঘটনা। ভারতীয় সীমান্ত জওয়ান অমিয় ঘোষের ছোড়া গুলিতে কিশোরী ফেলানী হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি পুরো পৃথিবী তোলপাড় করেছিল। অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন, অবৈধ পারাপারের কারণে আইনগত বিচারের আওতায় না নিয়ে ছোট্ট মেয়েটিকে গুলিতে ঝাঁজরা করে দেওয়া হলো কেন? কেন মইয়ে ওঠার আগে দেখেও না দেখার ভান করে থাকা হলো?

এক যুগ পেরিয়ে গেলেও ফেলানী হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। বিএসএফ আদালত অভিযুক্ত অমিয়কে খালাস করে দিলেও ভারতের মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) নিহতের পরিবারের পক্ষে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করে। দফায় দফায় পেছানো হচ্ছে ওই মামলার শুনানির তারিখ। মাস ছয়েক আগে ওই সংগঠনের সেক্রেটারি কিরীটি রায়ের সঙ্গে ফোনালাপে প্রসঙ্গটির আলাপ তুলতেই তিনি মামলার অগ্রগতি না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। দুই বছর আগে বিবিসি বাংলার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘দীর্ঘ ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও ওই হত্যাকাণ্ডের কাঙ্ক্ষিত বিচার পায়নি নিহতের পরিবার...’। ফেলানী হত্যার ১৩ বছর পরে আজও সেই কথাই বলতে হচ্ছে, বিচারের বাণী এখনো নিভৃতে কাঁদছে। 

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে উত্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে ৩৩২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে সীমান্তে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার সংস্থা ‘মাসুম’-এর হিসাবে সেই সংখ্যা ১ হাজার ২৩৬। সংগঠনটির মতে, প্রতিবছর প্রায় ১৫০ জন করে মানুষ মারা যাচ্ছে (৭ জানুয়ারি, ২০২১, বিবিসি বাংলায় সানজানা চৌধুরীর প্রতিবেদন)। 

সাতচল্লিশের দেশভাগের পর থেকে সীমান্ত একটি স্পর্শকাতর ও নিষিদ্ধ এলাকা। সীমান্ত লজ্জাবতীর মতো মুড়ে যায় না; বরং হন্তারকের 
মূর্তি ধারণ করে নিমেষেই। এককালে অভিন্ন ভূখণ্ডে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে দেশভাগ যে পার্থক্যের সূচনা ঘটিয়েছে, তার ভয়ানক দৃষ্টান্ত কাঁটাতার। কিন্তু ভৌগোলিক সীমানা আলাদা করে, প্রতিবন্ধকতার দেয়াল তুলে, এমনকি শক্তিপ্রদর্শন করে কি শত শত বছরের পারস্পরিক নির্ভরশীল জীবনযাপনকে থামিয়ে দেওয়া যায়?

ফেলানীর মা-বাবা। ছবি: আজকের পত্রিকাসীমান্ত দেশভাগের নির্মম উত্তরাধিকার বহন করছে। আর তার নীরব অভিঘাত নেমে এসেছে জনজীবনে; বিশেষ করে নারীদের জীবনের কথা বলব। তারা মরে, পাচারের শিকার হয়, ধর্ষিত হয় এবং জীবন বাঁচানোর তাগিদে চোরাইপণ্যের কারবারে জড়িয়ে ভিনদেশের কারাগারেও পচে মরে। এর কোনো কিছুই যখন ঘটে না, তখনো সীমান্ত ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে হাজির হয়। ভূরুঙ্গামারীর শালজোড় গ্রামের রেহানা খাতুন, ফুলবাড়ীর নাওডাঙ্গা গ্রামের আলেকজান, কুরুশাফুরুশা গ্রামের আলীমন বেওয়া, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের অমরখানা গ্রামের হাসিনা বানু, লালমনিরহাটের আঙ্গরপোতা ছিটমহলের ছালেহা আক্তার, নাজমুন নাহার, মিনু বেগম, আয়শা খাতুন ও বুড়িমারীর অবরুদ্ধপ্রায় ঝালঙ্গি গ্রামের নারীদের বয়ানের সারসংক্ষেপ হিসেবে এটাই লেখা উচিত।

বাড়ির পেছনে ফেলানীর বাঁধানো কবরটির কালো টাইলস চকচক করছিল। শোকের কালোরঙা টাইলস দিয়ে বাঁধানো কবরটি এক যুগ থেকে দর্শনার্থীদের মনোযোগ কাড়ছে। এপিটাফের পেছনে ফুলগাছ লাগানো হয়েছে। পেছনে দিগন্তজোড়া ধানখেত, দৃশ্যপটটি চমৎকার!
যদিও ফেলানীর কবরের এমন কালচে স্মৃতিচিহ্ন আমাদের শঙ্কিত, ক্ষুব্ধ ও বেদনার্ত করে। তবু আমরা কৃতজ্ঞ, আর কিছু না হোক, রাষ্ট্র অন্তত কবরটি বাঁধিয়ে দিয়েছে!

লেখক: ষাণ্মাসিক ‘মনন রেখা’র সম্পাদক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নারী সহকর্মীর সঙ্গে রাতযাপন: হাইটেক পার্কের ডিডি আতিক বরখাস্ত

বাংলাদেশসহ ৩ দেশে উন্নয়ন সহায়তা বন্ধের সিদ্ধান্ত সুইজারল্যান্ডের

বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিনের পদত্যাগ

পদ্মা সেতু ও ড. ইউনূসকে নিয়ে ভারত থেকে শেখ হাসিনার ভাষণ! ভাইরাল ভিডিওর পেছনের ঘটনা জানুন

২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ফেসবুক প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন কর্মসূচি শুরু

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত