জাহীদ রেজা নূর
ভ. ফিলিপকে
ভাষা—মোটেই চরম সত্য নয়। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য একটা উপায়মাত্র।
পল অস্টার (একাকিত্ব আবিষ্কার)
জুনের এক রোববার, দুপুরের পরপরই আমার বাবা খুন করতে গিয়েছিল মাকে। বরাবরের মতো রোববারে আমি নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট পনেরো আগে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। ফেরার পথে ঢুকেছিলাম বেকারিতে, পেস্ট্রি কিনব বলে। বেকারিটা ছিল একটি বাণিজ্যিক ভবনে, যুদ্ধের পর থেকেই তা মেরামত করা হচ্ছিল, পুরো মেরামত করা এখনও হয়ে ওঠেনি। বাড়ি এসে আমি রোববারের বাইরের পোশাক ছাড়লাম, পরলাম বাড়িতে পরার জামা। দোকানের গ্রাহকরা বিদায় নিয়েছে, কাচের জানালাগুলো পর্দা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। আমরা পরিবারসুদ্ধ বসেছি টেবিল ঘিরে এবং অবধারিতভাবেই রেডিওতে বাজছে ‘বিচার’ নামে কৌতুকরসে সমৃদ্ধ একটি অনুষ্ঠান। ইয়ান দেন অভিনয় করছিলেন ইলেকট্রিশিয়ানের ভূমিকায়। তাঁর কিছু হাস্যকর কার্যকলাপের জন্য বিচারক তাঁর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে রায় দিচ্ছিলেন, সেই রায় শুনতে শুনতেও হাসিতে পেট ফেটে যাচ্ছিল।
মায়ের মেজাজ খারাপ ছিল। চেয়ারে বসেই বাবার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করল মা, কোনোভাবেই সে নিজেকে নিরস্ত করতে পারছিল না। টেবিল থেকে থালা-বাসন সরিয়ে, টেবিলক্লথটা পরিষ্কার করার পর অপরিসর রান্নাঘরে গিয়েও বাবাকে ঠেস দিয়ে কথা বলতে লাগল সে। এখান দিয়েই একটি সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে শোয়ার ঘরের দিকে।
প্রতিবার মা রেগে গেলে এ রকমই হতো। বাবা নীরবে বসে থাকত তার চেয়ারে, জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকত বাইরের দিকে। কিন্তু হঠাৎ করেই সেদিন বাবার নিশ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হয়ে এল। সে লাফিয়ে উঠল চেয়ার থেকে, তারপর মাকে ধরে টেনে নিয়ে গেল ক্যাফের দিকে এবং অচেনা এক ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে মাকে অভিশাপ দিতে লাগল।
আমি দৌড়ে চলে গেলাম ওপরতলায়, শুয়ে পড়লাম বিছানায়, বালিশ দিয়ে ঢেকে রাখলাম মাথা। তখনই শুনতে পেলাম মায়ের ক্রন্দনরত কণ্ঠ, ‘মেয়ে’! ক্যাফের পাশে মাটির নিচের সেলার থেকে উঠে আসছিল মায়ের কণ্ঠ। আমি দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম এবং চিৎকার করতে থাকলাম, ‘বাঁচাও, বাঁচাও!’ মাটির নিচের আলো-আঁধারির মধ্যে আমি দেখলাম, বাবা এক হাতে মাকে জাপটে ধরে আছে, কিন্তু ঘাড় না গলা চেপে ধরেছে, তা বোঝা যাচ্ছিল না। অন্য হাতে গাছের ডাল কাটার বড় একটা কাঁচি। আমার শুধু মনে পড়ছে চিৎকার আর মায়ের কান্নাকাটি। এরপর আমরা তিনজন মিলে আবার রান্নাঘরে। বাবা জানালার ধারে বসে, মা চুলোর পাশে দাঁড়িয়ে, আমি সিঁড়ির একেবারে নিচের ধাপে বসে আছি।
আমি কাঁদছিলাম। কিছুতেই কান্না থামাতে পারছিলাম না। বাবা তখনো নিজের মধ্যে ফিরে আসেনি। তার কণ্ঠ থেকে যে স্বর বের হচ্ছে, সেটা কাঁপা কাঁপা অচেনা অন্য মানুষের কণ্ঠ।
সে শুধু বলে চলেছিল, ‘তুই কাঁদছিস কেন, আমি তো তোকে কিছুই করিনি।’ আমার মনে আছে, কী উত্তর দিয়েছিলাম বাবাকে—‘তোমার কারণেই আমি সারা জীবনের জন্য উন্মাদ হয়ে যাব।’ মা বলেছিল, ‘আর না আর না, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।’ এরপর আমরা তিনজন সাইকেলে করে শহর ঘুরতে বের হলাম। যখন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলাম, তখন প্রতি রোববারের মতোই আমার মা-বাবা তাদের ক্যাফে খুলল। আমাদের তিনজনের কেউই আর কোনো দিন এই ব্যাপারটা নিয়ে মুখ খুলিনি।
১৯৫২ সালের ১৫ জুন এই ঘটনাটি ঘটেছিল। শৈশবের এই তারিখটিকেই সর্বপ্রথম আমি মনে জায়গা দিয়েছি। এর আগে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে কিংবা আমার খাতায় যা লিখেছি, তা কখনোই ধারাবাহিকভাবে কার পর কোনটা, তা মনে রাখিনি।
পরে, আমার কয়েকজন প্রেমিককে আমি বলেছি, ‘জানো, আমার বয়স যখন বারো, তখন আমার বাবা আমার মাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল।’ কেন এই কথা তাদের বলার তৃষ্ণা জাগল আমার মনে, তার কারণ হিসেবে আমি দেখেছি যে এই পুরুষগুলোকে আমি খুব ভালো বাসতাম। কিন্তু আমার জীবনের এই গোপন কথা তাদের কাছে ফাঁস করায় আমাকে কম ভুগতে হয়নি। এ কথা শোনার পরই তারা মৌন হয়ে যেত। আমি বুঝতে পেরেছি, কথাটা বলা আমার ভুলই হয়েছে, আমার প্রেমিকদের কেউই ঘটনাটি হজম করার জন্য প্রস্তুত ছিল না।
ঘটনাটা আমি এবারই প্রথম লিখলাম। আজকের দিনের আগ পর্যন্ত আমি ভেবেছিলাম, এই ঘটনা আমি কখনোই লিখতে পারব না, এমনকি নিজের ডায়েরিতেও নয়। ভয় পেয়েছি, কোনো গোপন নিষেধাজ্ঞা তাতে ভঙ্গ হবে বলে, হয়তো তাতে চিরতরে লেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারি। এখন হালকা লাগছে। দেখছি, তেমন ভয়ংকর কিছু ঘটেনি, আগে যেভাবে লিখতাম সেভাবেই লিখতে পারছি। যখন আমি কাগজে লিখে ফেলেছি ঘটনাটা, তখন বুঝতে পারছি এটা এমন কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়, একেবারেই সাধারণ পারিবারিক ঘটনা, এবং বলতে হয়, খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটা গল্প করতে করতে সেটা তার ব্যতিক্রমী আমেজটা হারিয়ে সাদামাটা ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
কিন্তু দৃশ্যটি আমার মনে ভয়ংকর ও বচনহীনভাবে পোক্ত হয়ে বসায়, আমি আমার প্রেমিকদের কাছে তা বর্ণনা করেছিলাম এমন সব শব্দ নির্মাণ করে, যা আমার কাছে অদ্ভুত বলে মনে হয়। এখন থেকে দৃশ্যটি শুধুই আমার নয়।
এতদিন আমার মনে হতো, ঘটনাটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমার মনে স্থায়ী আসন পেয়েছে। কিন্তু আসলে আমার স্মৃতিতে রয়েছে শুধু সেদিনের পরিবেশটার কথা আর কে কী ধরনের অঙ্গভঙ্গি করেছিল সে কথা আর সঙ্গে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন শব্দ। আমার মনে ছিল না, কী নিয়ে ঝগড়া হচ্ছিল বাবা-মায়ের মধ্যে, মায়ের শরীরে কি ক্যাফেতে কাজ করার সেই সাদা অ্যাপ্রোনটা ছিল, নাকি তিনি আগেই তা বিকেলে ঘুরতে বেরোবেন বলে খুলে রেখেছিলেন, তা আমার মনে নেই। সকালের নাশতা হিসেবে কী খেয়েছিলাম, সেটাও আমার মনে নেই।
যেকোনো রোববারের মতোই ছিল সেই রোববারটি; সেই প্রার্থনায় যাওয়া, পেস্ট্রিশপে যাওয়া—কিছুই মনে রাখার মতো নয়, কিন্তু মনে রাখা উচিত ছিল, কারণ কোনো এক দিন ঘটনাগুলো স্মরণ করতে হবে। মনে আছে শুধু, আমার পরনে ছিল সাদা ফুটকি দেওয়া নীল রঙের ফ্রক। এটা মনে আছে, কারণ পরপর দুই বছর গ্রীষ্মকালে আমি এই ফ্রক পরেছি এবং পরার সময় ভেবেছি, ‘এই তো সেই ফ্রক।' আরও মনে আছে, সে দিনটি ছিল হাওয়ার দিন, সূর্য সুযোগ পেলেই হারিয়ে যাচ্ছিল মেঘের মধ্যে।
এই রোববারের পর আমি যেন মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে বসবাস করছিলাম। আমি খেলতাম, পড়তাম, সবকিছুই করতাম; কিন্তু সাধারণত আমার চিন্তাভাবনা পড়ে থাকত অনেক অনেক দূরে। সবকিছুই আমার কাছে অবাস্তব বলে মনে হতো। আমি পড়াশোনায় অমনোযাগী হয়ে পড়লাম, যদিও গ্রীষ্মের ছুটিতে সবকিছুই ছিল আয়ত্তের মধ্যে। একজন মেধাবী কিন্তু অসতর্ক শিক্ষার্থী থেকে আমি পরিণত হয়েছিলাম এক অমনোযোগী শিক্ষার্থীতে। আমি কিছুতেই দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে পারছিলাম না। আমার বাবা, যে আমার মাকে খুন করতে চেয়েছিল, সে আমাকে খুব আদর করত, মা-ও আমাকে আদর করত। মা ছিল বাবার চেয়ে বেশি ধার্মিক, টাকা-পয়সার লেনদেন সে-ই বেশি করত, আমার শিক্ষকদের কাছে সে-ই মূলত যেত, এবং সে বাবার ওপর চিল্লাচিল্লিও করত, আমার ওপরও চিল্লাচিল্লি করত, তাতে আমার কিছু মনে হতো না। আমি এ থেকে কে ঠিক আর কে বেঠিক, সেটা ভাবতাম না। আমি শুধু মাকে খুন করার সময় বাবাকে বাধা দিয়েছি স্রেফ এ জন্য যে খুন করে যেন তাকে জেলে যেতে না হয়।
মনে আছে, এরপর মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আমি এ রকম আরেকটি দৃশ্যের অবতারণার আশঙ্কা মনে নিয়ে কীভাবে সময় কাটিয়েছি। যখন আমাদের ক্যাফেতে খদ্দের থাকত, তখন আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত থাকতাম, কিন্তু যখন রাতে আমরাই শুধু থাকতাম বাড়িতে, কিংবা রোববার দুপুরের পর আতঙ্ক এসে আমার ওপর ভর করত। বাবা-মা যে কেউ একজন গলা চড়িয়ে কথা বললে আমি চকিতে বাবার দিকে তাকাতাম, তার প্রতিটি পদক্ষেপের দিকে নজর রাখতাম। যদি সবকিছু শান্ত হয়ে যেত, তাহলেও কিছু একটা অকল্যাণের আশঙ্কায় আমি বিবর্ণ হয়ে পড়তাম। স্কুলে ক্লাস করার সময় আমি ভাবতাম বাড়ি ফেরার পর আমার জন্য না জানি কোন নাটক অপেক্ষা করছে!
যখন তাদের দুজনের মধ্যে ভালোবাসার পরশ দেখতে পেতাম, তখন তাদের প্রতিটি হাসি, রসিকতা আমি উপভোগ করতাম, মনে করতাম, সবকিছুই চলছে আগের মতো। আর ওই ভয়ংকর ঘটনাটা আসলে একটা দুঃস্বপ্ন। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরই বুঝতে পারতাম, যে পেলবতা দেখা যাচ্ছে, তা ভবিষ্যৎকে আশঙ্কামুক্ত রাখার গ্যারান্টি দিতে পারে না।
সেই বছরগুলোয় রেডিওতে একটা অদ্ভুত গান বাজত। একটি জায়গায় শান্ত নীরবতা, এ সময় কেউ ফিসফিস করে বলছে, ‘মাছি উড়ে গেলেও তার শব্দ শোনা যাবে।’ আর তখনই সশব্দ আর্তচিৎকার আর যুক্তিহীন কথাবার্তার ভিড়। এই গানটি সব সময় আমাকে বিষাদাক্রান্ত করত। একবার গোয়েন্দা গল্পভক্ত আমার এক চাচা হঠাৎ আমাকে বলেছিল, ‘তোর কী মনে হয়? যদি তোর বাবাকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয় এবং সে যদি খুনি না হয়, তাহলে কী হবে?’ আমি বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলাম। সব সময় আমার মনে এসে ধাক্কা দিচ্ছিল সেই ঘটনা।
এই দৃশ্যের অবতারণা আর কখনো হয়নি। এর পনের বছর পর বাবা মারা গিয়েছিল। সেটাও ছিল জুনের কোনো এক রোববার।
এখন আমি ভাবি, এমন তো হতে পারে, মা-বাবা ওই রোববারের ঘটনা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ করেছে। বাবার সেদিনকার আচরণ নিয়ে তারা কথা বলেছে এবং দুজনে মিলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ভুলে যাবে ঘটনাটি। এটা ঘটতে পারে ঠিক সেই রোববার রাতেই, বিছানায় শুয়ে শুয়ে। সেখানেই সঙ্গমের সময় তারা সবকিছু মিটিয়ে ফেলেছিল। এই ভাবনা এবং এরপর অনেক ভাবনা আমার মাথায় এসেছে অনেক অনেক পরে। আজ আর তার কিছুই আমি বদলাতে পারব না এবং সেই ভয়ংকর ঘটনা ভুলতে পারব না, যে ঘটনার জন্ম দিয়েছিল সেই রোববার।
দক্ষিণ ফ্রান্সে কোনো এক জনশূন্য রাস্তার ধারে কয়েকজন ইংরেজ একটা তাঁবু খাটিয়েছিল রাতে। পরদিন সকালে দেখা গেল, তারা সবাই খুনের শিকার হয়েছে। পরিবারের মাথা, বাবা স্যার জ্যাক ড্র্যামোন্ড, তার স্ত্রী লেডি আনা এবং মেয়ে এলিজাবেথ। দোমিনিচি পদবির একটি ইতালীয় পরিবার থাকত সে রাস্তার ধারে-কাছেই। সে পরিবারের ছেলে গুস্তাভ তিনটি খুনের দায়ে জেল খেটে এসেছে। দোমিনিচি পরিবারের লোকেরা ফরাসি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারত না। এমনকি ইংরেজ ড্র্যামোন্ড পরিবারের লোকেরাও হয়তো তাদের চেয়ে ভালো ফরাসি বলতে পারত। আমি শুধু ইংরেজি আর ইতালীয় ভাষায় লেখা ‘বাইরের দিকে ঝুঁকবেন না’ বুঝতে পেরেছিলাম। লেখাগুলো ছিল বড় ট্রাকের গায়ে লেখা। সবাই খুব অবাক হয়েছিল এই ভেবে যে, এই বড়লোক ইংরেজ পরিবারটি হোটেলে রুম ভাড়া না নিয়ে কেন রাস্তার ধারে খোলা আকাশের নিচে তাঁবুতে রাত কাটানোর কথা ভেবেছিল। আর আমি কল্পনা করেছি, রাস্তার ধারে খুন হয়ে পড়ে আছি আমি আর আমার মা-বাবা।
সেই বছরের দুটি ছবি আমার সংগ্রহে আছে। তার একটি নান্দনিক সাদা-কালো ছবি। সেটা ঢোকানো আছে কাগজের ফ্রেমে। অন্য পিঠে ফটোগ্রাফারের স্বাক্ষর রয়েছে।
ছবিটিতে একটি পরিষ্কার গোলমুখো বালিকা, যার উঁচু চোয়ালের হাড়, বড় বড় নাকের ফুটো। তার মুখের অর্ধেকটা জুড়েই চশমা। চোখ সরাসরি ক্যামেরার দিকে নিবদ্ধ। চোয়ালের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বাঁধা টুপির ফাঁক দিয়ে তার ঢেউখেলানো চুলগুলো বেরিয়ে আছে, ঠোঁটের কোণে তার সহজ হাসি লুকিয়ে আছে। এই ছোট্ট বালিকাটিকে বয়সের তুলনায় একটু বেশি বয়স্ক লাগছে বড় গোল চশমাটার কারণে।
ছবিটায় তারিখ দেওয়া ছিল ৫ জুন, ১৯৫২। ছবিটি ১৯৫১ সালে তোলা হয়নি, কিন্তু সে বছর ‘ব্রত পুনর্নবীকরণে’র সময় যে পোশাক পরেছিলাম, সে পোশাকটিই পরেছিলাম ছবিটায়।
দ্বিতীয় ছবিটায় ছিলাম আমি আর বাবা, ফুলভর্তি টবের পাশে। এ ছবি তোলা হয়েছিল বিয়ারিৎসে, ১৯৫২ সালের আগস্ট মাসে, সম্ভবত সমুদ্রসৈকতে (ছবিতে সে সৈকত নেই), লুর্দে আমরা যখন ভ্রমণে গিয়েছিলাম, সম্ভবত তখনকার ছবি। আমার উচ্চতা তখন এক মিটার ষাট সেন্টিমিটারের বেশি হবে না। আমার মাথাটা বাবার ঘাড়ের কাছাকাছি হয়েছে ততদিনে, বাবার উচ্চতা ছিল এক মিটার তিয়াত্তর সেন্টিমিটার। এই তিন মাসের মধ্যেই আমার চুল অনেক বড় হয়ে উঠেছিল, এবং তা চোয়ালে ফিতে বাঁধা ঢেউখেলানো টুপির মতো দেখাত। এই ছবিটি তোলা হয়েছিল পুরোনো বক্স ক্যামেরা দিয়ে, যুদ্ধের আগেই বাবা-মা মেলায় লটারিতে জিতেছিলেন সে ক্যামেরাটা। অবয়ব আর চশমাটা খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না, শুধু দেখা যাচ্ছিল, আমি হাসছি। আমার পরনে সাদা স্কার্ট আর ব্লাউজ, স্কুলড্রেস, যেটা খ্রিষ্টান স্কুলের উৎসবের সময় পরা হয়েছিল। আমার কাঁধের ওপর একটা জ্যাকেট। এই ছবিতে আমাকে খুব শীর্ণ ও চিকন-চাকন লাগছে স্কার্টের কারণে। এই পোশাকে আমাকে ছোট্ট একজন মহিলা বলে মনে হচ্ছে। বাবার পরনে গাঢ় রঙের কোট আর গাঢ় রঙের টাই, উজ্জ্বল রঙের শার্ট আর প্যান্ট। ছবিতে বাবা অতিকষ্টে হাসছে। ছবিতে সব সময়ই বাবা খুব শক্ত হয়ে থাকে। আমার হালও ছিল তেমনই, কারণ আমরা দুজনেই জানতাম, অন্যান্য বড়লোক পর্যটকের ভিড়ে আমাদের থাকতে হচ্ছে এবং তাদের মতো ভান করতে করতে। দুটো ছবিতে হাসলেও আমার দাঁত দেখা যাচ্ছে না, কারণ আমি জানতাম আমার দাঁতগুলো এবড়োখেবড়ো, পচা।
এ ছবিগুলো দেখার সময় আমার মাথা কাজ করে না, যেন মনে হয়, আমি সেই বালিকা যে বিয়ারিৎসে দাঁড়িয়ে আছে বাবার পাশে। কিন্তু যদি আমি এই ছবি জীবনে প্রথমবারের মতো দেখতাম, তাহলে নিজেকে একেবারেই চিনতে পারতাম না। (আমি নিশ্চিত ‘এই আমি’কে কখনোই নিজেকে চিনতে পারতাম না, বলতাম ‘না, এটা আমি নই’)।
ছবি দুটোর মধ্যে ব্যবধান মাত্র তিন মাসের। প্রথমটিতে তারিখ দেওয়া আছে জুনের শুরুর দিকের, দ্বিতীয়টায় আগস্টের শেষের দিকের। ছবি দুটো মানে ও গুণে একেবারেই আলাদা বলে ছবির সূত্র ধরে আমার চেহারা ও শরীরের পরিবর্তনগুলো চোখে পড়বে না। কিন্তু এই দুটো ছবি আমার চোখে দুই যুগের ব্যবধানে তোলা। প্রথম ছবিটি শুভ্র পোশাকে, যেন এটা শৈশব থেকে বিদায়ের ছবি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে সেই সময়ের ছবি, যখন থেকে আমি বেঁচে থাকছি লজ্জাকে সঙ্গী করে। হতে পারে, সেই গ্রীষ্মের মাসগুলোকে আমি ইতিহাসবিদের মতো কোনো নির্দিষ্ট সময় হিসেবে দেখতে চাইছি। (‘সেই গ্রীষ্মে বলে কিংবা ‘ঘটনাটি ঘটেছিল সেই গ্রীষ্মে, যখন আমার বয়স বারো বছর পূর্ণ হলো, আমি সময়টিকে রূপকথার রোমান্টিকতার মধ্যে নিয়ে যেতে চাই, কিন্তু আসলে সেই গ্রীষ্ম ১৯৯৫ সালের গ্রীষ্মের চেয়ে মোটেই বেশি রোমান্টিক ছিল না।)
[চলবে]
ভ. ফিলিপকে
ভাষা—মোটেই চরম সত্য নয়। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য একটা উপায়মাত্র।
পল অস্টার (একাকিত্ব আবিষ্কার)
জুনের এক রোববার, দুপুরের পরপরই আমার বাবা খুন করতে গিয়েছিল মাকে। বরাবরের মতো রোববারে আমি নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট পনেরো আগে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। ফেরার পথে ঢুকেছিলাম বেকারিতে, পেস্ট্রি কিনব বলে। বেকারিটা ছিল একটি বাণিজ্যিক ভবনে, যুদ্ধের পর থেকেই তা মেরামত করা হচ্ছিল, পুরো মেরামত করা এখনও হয়ে ওঠেনি। বাড়ি এসে আমি রোববারের বাইরের পোশাক ছাড়লাম, পরলাম বাড়িতে পরার জামা। দোকানের গ্রাহকরা বিদায় নিয়েছে, কাচের জানালাগুলো পর্দা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। আমরা পরিবারসুদ্ধ বসেছি টেবিল ঘিরে এবং অবধারিতভাবেই রেডিওতে বাজছে ‘বিচার’ নামে কৌতুকরসে সমৃদ্ধ একটি অনুষ্ঠান। ইয়ান দেন অভিনয় করছিলেন ইলেকট্রিশিয়ানের ভূমিকায়। তাঁর কিছু হাস্যকর কার্যকলাপের জন্য বিচারক তাঁর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে রায় দিচ্ছিলেন, সেই রায় শুনতে শুনতেও হাসিতে পেট ফেটে যাচ্ছিল।
মায়ের মেজাজ খারাপ ছিল। চেয়ারে বসেই বাবার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করল মা, কোনোভাবেই সে নিজেকে নিরস্ত করতে পারছিল না। টেবিল থেকে থালা-বাসন সরিয়ে, টেবিলক্লথটা পরিষ্কার করার পর অপরিসর রান্নাঘরে গিয়েও বাবাকে ঠেস দিয়ে কথা বলতে লাগল সে। এখান দিয়েই একটি সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে শোয়ার ঘরের দিকে।
প্রতিবার মা রেগে গেলে এ রকমই হতো। বাবা নীরবে বসে থাকত তার চেয়ারে, জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকত বাইরের দিকে। কিন্তু হঠাৎ করেই সেদিন বাবার নিশ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হয়ে এল। সে লাফিয়ে উঠল চেয়ার থেকে, তারপর মাকে ধরে টেনে নিয়ে গেল ক্যাফের দিকে এবং অচেনা এক ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে মাকে অভিশাপ দিতে লাগল।
আমি দৌড়ে চলে গেলাম ওপরতলায়, শুয়ে পড়লাম বিছানায়, বালিশ দিয়ে ঢেকে রাখলাম মাথা। তখনই শুনতে পেলাম মায়ের ক্রন্দনরত কণ্ঠ, ‘মেয়ে’! ক্যাফের পাশে মাটির নিচের সেলার থেকে উঠে আসছিল মায়ের কণ্ঠ। আমি দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম এবং চিৎকার করতে থাকলাম, ‘বাঁচাও, বাঁচাও!’ মাটির নিচের আলো-আঁধারির মধ্যে আমি দেখলাম, বাবা এক হাতে মাকে জাপটে ধরে আছে, কিন্তু ঘাড় না গলা চেপে ধরেছে, তা বোঝা যাচ্ছিল না। অন্য হাতে গাছের ডাল কাটার বড় একটা কাঁচি। আমার শুধু মনে পড়ছে চিৎকার আর মায়ের কান্নাকাটি। এরপর আমরা তিনজন মিলে আবার রান্নাঘরে। বাবা জানালার ধারে বসে, মা চুলোর পাশে দাঁড়িয়ে, আমি সিঁড়ির একেবারে নিচের ধাপে বসে আছি।
আমি কাঁদছিলাম। কিছুতেই কান্না থামাতে পারছিলাম না। বাবা তখনো নিজের মধ্যে ফিরে আসেনি। তার কণ্ঠ থেকে যে স্বর বের হচ্ছে, সেটা কাঁপা কাঁপা অচেনা অন্য মানুষের কণ্ঠ।
সে শুধু বলে চলেছিল, ‘তুই কাঁদছিস কেন, আমি তো তোকে কিছুই করিনি।’ আমার মনে আছে, কী উত্তর দিয়েছিলাম বাবাকে—‘তোমার কারণেই আমি সারা জীবনের জন্য উন্মাদ হয়ে যাব।’ মা বলেছিল, ‘আর না আর না, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।’ এরপর আমরা তিনজন সাইকেলে করে শহর ঘুরতে বের হলাম। যখন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলাম, তখন প্রতি রোববারের মতোই আমার মা-বাবা তাদের ক্যাফে খুলল। আমাদের তিনজনের কেউই আর কোনো দিন এই ব্যাপারটা নিয়ে মুখ খুলিনি।
১৯৫২ সালের ১৫ জুন এই ঘটনাটি ঘটেছিল। শৈশবের এই তারিখটিকেই সর্বপ্রথম আমি মনে জায়গা দিয়েছি। এর আগে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে কিংবা আমার খাতায় যা লিখেছি, তা কখনোই ধারাবাহিকভাবে কার পর কোনটা, তা মনে রাখিনি।
পরে, আমার কয়েকজন প্রেমিককে আমি বলেছি, ‘জানো, আমার বয়স যখন বারো, তখন আমার বাবা আমার মাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল।’ কেন এই কথা তাদের বলার তৃষ্ণা জাগল আমার মনে, তার কারণ হিসেবে আমি দেখেছি যে এই পুরুষগুলোকে আমি খুব ভালো বাসতাম। কিন্তু আমার জীবনের এই গোপন কথা তাদের কাছে ফাঁস করায় আমাকে কম ভুগতে হয়নি। এ কথা শোনার পরই তারা মৌন হয়ে যেত। আমি বুঝতে পেরেছি, কথাটা বলা আমার ভুলই হয়েছে, আমার প্রেমিকদের কেউই ঘটনাটি হজম করার জন্য প্রস্তুত ছিল না।
ঘটনাটা আমি এবারই প্রথম লিখলাম। আজকের দিনের আগ পর্যন্ত আমি ভেবেছিলাম, এই ঘটনা আমি কখনোই লিখতে পারব না, এমনকি নিজের ডায়েরিতেও নয়। ভয় পেয়েছি, কোনো গোপন নিষেধাজ্ঞা তাতে ভঙ্গ হবে বলে, হয়তো তাতে চিরতরে লেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারি। এখন হালকা লাগছে। দেখছি, তেমন ভয়ংকর কিছু ঘটেনি, আগে যেভাবে লিখতাম সেভাবেই লিখতে পারছি। যখন আমি কাগজে লিখে ফেলেছি ঘটনাটা, তখন বুঝতে পারছি এটা এমন কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়, একেবারেই সাধারণ পারিবারিক ঘটনা, এবং বলতে হয়, খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটা গল্প করতে করতে সেটা তার ব্যতিক্রমী আমেজটা হারিয়ে সাদামাটা ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
কিন্তু দৃশ্যটি আমার মনে ভয়ংকর ও বচনহীনভাবে পোক্ত হয়ে বসায়, আমি আমার প্রেমিকদের কাছে তা বর্ণনা করেছিলাম এমন সব শব্দ নির্মাণ করে, যা আমার কাছে অদ্ভুত বলে মনে হয়। এখন থেকে দৃশ্যটি শুধুই আমার নয়।
এতদিন আমার মনে হতো, ঘটনাটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমার মনে স্থায়ী আসন পেয়েছে। কিন্তু আসলে আমার স্মৃতিতে রয়েছে শুধু সেদিনের পরিবেশটার কথা আর কে কী ধরনের অঙ্গভঙ্গি করেছিল সে কথা আর সঙ্গে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন শব্দ। আমার মনে ছিল না, কী নিয়ে ঝগড়া হচ্ছিল বাবা-মায়ের মধ্যে, মায়ের শরীরে কি ক্যাফেতে কাজ করার সেই সাদা অ্যাপ্রোনটা ছিল, নাকি তিনি আগেই তা বিকেলে ঘুরতে বেরোবেন বলে খুলে রেখেছিলেন, তা আমার মনে নেই। সকালের নাশতা হিসেবে কী খেয়েছিলাম, সেটাও আমার মনে নেই।
যেকোনো রোববারের মতোই ছিল সেই রোববারটি; সেই প্রার্থনায় যাওয়া, পেস্ট্রিশপে যাওয়া—কিছুই মনে রাখার মতো নয়, কিন্তু মনে রাখা উচিত ছিল, কারণ কোনো এক দিন ঘটনাগুলো স্মরণ করতে হবে। মনে আছে শুধু, আমার পরনে ছিল সাদা ফুটকি দেওয়া নীল রঙের ফ্রক। এটা মনে আছে, কারণ পরপর দুই বছর গ্রীষ্মকালে আমি এই ফ্রক পরেছি এবং পরার সময় ভেবেছি, ‘এই তো সেই ফ্রক।' আরও মনে আছে, সে দিনটি ছিল হাওয়ার দিন, সূর্য সুযোগ পেলেই হারিয়ে যাচ্ছিল মেঘের মধ্যে।
এই রোববারের পর আমি যেন মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে বসবাস করছিলাম। আমি খেলতাম, পড়তাম, সবকিছুই করতাম; কিন্তু সাধারণত আমার চিন্তাভাবনা পড়ে থাকত অনেক অনেক দূরে। সবকিছুই আমার কাছে অবাস্তব বলে মনে হতো। আমি পড়াশোনায় অমনোযাগী হয়ে পড়লাম, যদিও গ্রীষ্মের ছুটিতে সবকিছুই ছিল আয়ত্তের মধ্যে। একজন মেধাবী কিন্তু অসতর্ক শিক্ষার্থী থেকে আমি পরিণত হয়েছিলাম এক অমনোযোগী শিক্ষার্থীতে। আমি কিছুতেই দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে পারছিলাম না। আমার বাবা, যে আমার মাকে খুন করতে চেয়েছিল, সে আমাকে খুব আদর করত, মা-ও আমাকে আদর করত। মা ছিল বাবার চেয়ে বেশি ধার্মিক, টাকা-পয়সার লেনদেন সে-ই বেশি করত, আমার শিক্ষকদের কাছে সে-ই মূলত যেত, এবং সে বাবার ওপর চিল্লাচিল্লিও করত, আমার ওপরও চিল্লাচিল্লি করত, তাতে আমার কিছু মনে হতো না। আমি এ থেকে কে ঠিক আর কে বেঠিক, সেটা ভাবতাম না। আমি শুধু মাকে খুন করার সময় বাবাকে বাধা দিয়েছি স্রেফ এ জন্য যে খুন করে যেন তাকে জেলে যেতে না হয়।
মনে আছে, এরপর মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আমি এ রকম আরেকটি দৃশ্যের অবতারণার আশঙ্কা মনে নিয়ে কীভাবে সময় কাটিয়েছি। যখন আমাদের ক্যাফেতে খদ্দের থাকত, তখন আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত থাকতাম, কিন্তু যখন রাতে আমরাই শুধু থাকতাম বাড়িতে, কিংবা রোববার দুপুরের পর আতঙ্ক এসে আমার ওপর ভর করত। বাবা-মা যে কেউ একজন গলা চড়িয়ে কথা বললে আমি চকিতে বাবার দিকে তাকাতাম, তার প্রতিটি পদক্ষেপের দিকে নজর রাখতাম। যদি সবকিছু শান্ত হয়ে যেত, তাহলেও কিছু একটা অকল্যাণের আশঙ্কায় আমি বিবর্ণ হয়ে পড়তাম। স্কুলে ক্লাস করার সময় আমি ভাবতাম বাড়ি ফেরার পর আমার জন্য না জানি কোন নাটক অপেক্ষা করছে!
যখন তাদের দুজনের মধ্যে ভালোবাসার পরশ দেখতে পেতাম, তখন তাদের প্রতিটি হাসি, রসিকতা আমি উপভোগ করতাম, মনে করতাম, সবকিছুই চলছে আগের মতো। আর ওই ভয়ংকর ঘটনাটা আসলে একটা দুঃস্বপ্ন। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরই বুঝতে পারতাম, যে পেলবতা দেখা যাচ্ছে, তা ভবিষ্যৎকে আশঙ্কামুক্ত রাখার গ্যারান্টি দিতে পারে না।
সেই বছরগুলোয় রেডিওতে একটা অদ্ভুত গান বাজত। একটি জায়গায় শান্ত নীরবতা, এ সময় কেউ ফিসফিস করে বলছে, ‘মাছি উড়ে গেলেও তার শব্দ শোনা যাবে।’ আর তখনই সশব্দ আর্তচিৎকার আর যুক্তিহীন কথাবার্তার ভিড়। এই গানটি সব সময় আমাকে বিষাদাক্রান্ত করত। একবার গোয়েন্দা গল্পভক্ত আমার এক চাচা হঠাৎ আমাকে বলেছিল, ‘তোর কী মনে হয়? যদি তোর বাবাকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয় এবং সে যদি খুনি না হয়, তাহলে কী হবে?’ আমি বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলাম। সব সময় আমার মনে এসে ধাক্কা দিচ্ছিল সেই ঘটনা।
এই দৃশ্যের অবতারণা আর কখনো হয়নি। এর পনের বছর পর বাবা মারা গিয়েছিল। সেটাও ছিল জুনের কোনো এক রোববার।
এখন আমি ভাবি, এমন তো হতে পারে, মা-বাবা ওই রোববারের ঘটনা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ করেছে। বাবার সেদিনকার আচরণ নিয়ে তারা কথা বলেছে এবং দুজনে মিলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ভুলে যাবে ঘটনাটি। এটা ঘটতে পারে ঠিক সেই রোববার রাতেই, বিছানায় শুয়ে শুয়ে। সেখানেই সঙ্গমের সময় তারা সবকিছু মিটিয়ে ফেলেছিল। এই ভাবনা এবং এরপর অনেক ভাবনা আমার মাথায় এসেছে অনেক অনেক পরে। আজ আর তার কিছুই আমি বদলাতে পারব না এবং সেই ভয়ংকর ঘটনা ভুলতে পারব না, যে ঘটনার জন্ম দিয়েছিল সেই রোববার।
দক্ষিণ ফ্রান্সে কোনো এক জনশূন্য রাস্তার ধারে কয়েকজন ইংরেজ একটা তাঁবু খাটিয়েছিল রাতে। পরদিন সকালে দেখা গেল, তারা সবাই খুনের শিকার হয়েছে। পরিবারের মাথা, বাবা স্যার জ্যাক ড্র্যামোন্ড, তার স্ত্রী লেডি আনা এবং মেয়ে এলিজাবেথ। দোমিনিচি পদবির একটি ইতালীয় পরিবার থাকত সে রাস্তার ধারে-কাছেই। সে পরিবারের ছেলে গুস্তাভ তিনটি খুনের দায়ে জেল খেটে এসেছে। দোমিনিচি পরিবারের লোকেরা ফরাসি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারত না। এমনকি ইংরেজ ড্র্যামোন্ড পরিবারের লোকেরাও হয়তো তাদের চেয়ে ভালো ফরাসি বলতে পারত। আমি শুধু ইংরেজি আর ইতালীয় ভাষায় লেখা ‘বাইরের দিকে ঝুঁকবেন না’ বুঝতে পেরেছিলাম। লেখাগুলো ছিল বড় ট্রাকের গায়ে লেখা। সবাই খুব অবাক হয়েছিল এই ভেবে যে, এই বড়লোক ইংরেজ পরিবারটি হোটেলে রুম ভাড়া না নিয়ে কেন রাস্তার ধারে খোলা আকাশের নিচে তাঁবুতে রাত কাটানোর কথা ভেবেছিল। আর আমি কল্পনা করেছি, রাস্তার ধারে খুন হয়ে পড়ে আছি আমি আর আমার মা-বাবা।
সেই বছরের দুটি ছবি আমার সংগ্রহে আছে। তার একটি নান্দনিক সাদা-কালো ছবি। সেটা ঢোকানো আছে কাগজের ফ্রেমে। অন্য পিঠে ফটোগ্রাফারের স্বাক্ষর রয়েছে।
ছবিটিতে একটি পরিষ্কার গোলমুখো বালিকা, যার উঁচু চোয়ালের হাড়, বড় বড় নাকের ফুটো। তার মুখের অর্ধেকটা জুড়েই চশমা। চোখ সরাসরি ক্যামেরার দিকে নিবদ্ধ। চোয়ালের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বাঁধা টুপির ফাঁক দিয়ে তার ঢেউখেলানো চুলগুলো বেরিয়ে আছে, ঠোঁটের কোণে তার সহজ হাসি লুকিয়ে আছে। এই ছোট্ট বালিকাটিকে বয়সের তুলনায় একটু বেশি বয়স্ক লাগছে বড় গোল চশমাটার কারণে।
ছবিটায় তারিখ দেওয়া ছিল ৫ জুন, ১৯৫২। ছবিটি ১৯৫১ সালে তোলা হয়নি, কিন্তু সে বছর ‘ব্রত পুনর্নবীকরণে’র সময় যে পোশাক পরেছিলাম, সে পোশাকটিই পরেছিলাম ছবিটায়।
দ্বিতীয় ছবিটায় ছিলাম আমি আর বাবা, ফুলভর্তি টবের পাশে। এ ছবি তোলা হয়েছিল বিয়ারিৎসে, ১৯৫২ সালের আগস্ট মাসে, সম্ভবত সমুদ্রসৈকতে (ছবিতে সে সৈকত নেই), লুর্দে আমরা যখন ভ্রমণে গিয়েছিলাম, সম্ভবত তখনকার ছবি। আমার উচ্চতা তখন এক মিটার ষাট সেন্টিমিটারের বেশি হবে না। আমার মাথাটা বাবার ঘাড়ের কাছাকাছি হয়েছে ততদিনে, বাবার উচ্চতা ছিল এক মিটার তিয়াত্তর সেন্টিমিটার। এই তিন মাসের মধ্যেই আমার চুল অনেক বড় হয়ে উঠেছিল, এবং তা চোয়ালে ফিতে বাঁধা ঢেউখেলানো টুপির মতো দেখাত। এই ছবিটি তোলা হয়েছিল পুরোনো বক্স ক্যামেরা দিয়ে, যুদ্ধের আগেই বাবা-মা মেলায় লটারিতে জিতেছিলেন সে ক্যামেরাটা। অবয়ব আর চশমাটা খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না, শুধু দেখা যাচ্ছিল, আমি হাসছি। আমার পরনে সাদা স্কার্ট আর ব্লাউজ, স্কুলড্রেস, যেটা খ্রিষ্টান স্কুলের উৎসবের সময় পরা হয়েছিল। আমার কাঁধের ওপর একটা জ্যাকেট। এই ছবিতে আমাকে খুব শীর্ণ ও চিকন-চাকন লাগছে স্কার্টের কারণে। এই পোশাকে আমাকে ছোট্ট একজন মহিলা বলে মনে হচ্ছে। বাবার পরনে গাঢ় রঙের কোট আর গাঢ় রঙের টাই, উজ্জ্বল রঙের শার্ট আর প্যান্ট। ছবিতে বাবা অতিকষ্টে হাসছে। ছবিতে সব সময়ই বাবা খুব শক্ত হয়ে থাকে। আমার হালও ছিল তেমনই, কারণ আমরা দুজনেই জানতাম, অন্যান্য বড়লোক পর্যটকের ভিড়ে আমাদের থাকতে হচ্ছে এবং তাদের মতো ভান করতে করতে। দুটো ছবিতে হাসলেও আমার দাঁত দেখা যাচ্ছে না, কারণ আমি জানতাম আমার দাঁতগুলো এবড়োখেবড়ো, পচা।
এ ছবিগুলো দেখার সময় আমার মাথা কাজ করে না, যেন মনে হয়, আমি সেই বালিকা যে বিয়ারিৎসে দাঁড়িয়ে আছে বাবার পাশে। কিন্তু যদি আমি এই ছবি জীবনে প্রথমবারের মতো দেখতাম, তাহলে নিজেকে একেবারেই চিনতে পারতাম না। (আমি নিশ্চিত ‘এই আমি’কে কখনোই নিজেকে চিনতে পারতাম না, বলতাম ‘না, এটা আমি নই’)।
ছবি দুটোর মধ্যে ব্যবধান মাত্র তিন মাসের। প্রথমটিতে তারিখ দেওয়া আছে জুনের শুরুর দিকের, দ্বিতীয়টায় আগস্টের শেষের দিকের। ছবি দুটো মানে ও গুণে একেবারেই আলাদা বলে ছবির সূত্র ধরে আমার চেহারা ও শরীরের পরিবর্তনগুলো চোখে পড়বে না। কিন্তু এই দুটো ছবি আমার চোখে দুই যুগের ব্যবধানে তোলা। প্রথম ছবিটি শুভ্র পোশাকে, যেন এটা শৈশব থেকে বিদায়ের ছবি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে সেই সময়ের ছবি, যখন থেকে আমি বেঁচে থাকছি লজ্জাকে সঙ্গী করে। হতে পারে, সেই গ্রীষ্মের মাসগুলোকে আমি ইতিহাসবিদের মতো কোনো নির্দিষ্ট সময় হিসেবে দেখতে চাইছি। (‘সেই গ্রীষ্মে বলে কিংবা ‘ঘটনাটি ঘটেছিল সেই গ্রীষ্মে, যখন আমার বয়স বারো বছর পূর্ণ হলো, আমি সময়টিকে রূপকথার রোমান্টিকতার মধ্যে নিয়ে যেতে চাই, কিন্তু আসলে সেই গ্রীষ্ম ১৯৯৫ সালের গ্রীষ্মের চেয়ে মোটেই বেশি রোমান্টিক ছিল না।)
[চলবে]
দ্য ভেজিটেরিয়ানের পর হান কাঙের পরের উপন্যাস ছিল ‘দ্য উইন্ড ব্লোজ, গো’। এই উপন্যাস লেখার সময়ই ঘটে বিপত্তি! হান অনুভব করেন তিনি আর লিখতে পারছেন না। গত বছর নিজের পঞ্চম উপন্যাস ‘গ্রিক লেসন’ ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হলে স্পেনের এল-পাইস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি।
২১ দিন আগে‘প্রগাঢ় কাব্যিক গদ্যে ঐতিহাসিক ক্ষত তুলে ধরা এবং মানবজীবনের নাজুক পরিস্থিতির উন্মোচনের জন্য’ তাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান পুরস্কারের জন্য বেছে নিয়েছে নোবেল কমিটি।
২১ দিন আগেতানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর জন্মদিন উপলক্ষে ‘দশম জাতীয় ত্বকী চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতা’–এর আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের প্রথম দশ জনকে সনদ, বই ও ক্রেস্ট দেওয়া হবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীকে বই, বিশেষ ক্রেস্ট ও সনদ এবং প্রথম স্থান অধিকারীকে ‘ত্বকী পদক ২০২৪’ দেওয়া হবে। প্রতিযোগিতায় বিজয়ী
০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও পরে সরকার পতনের আন্দোলনে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতারা আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁদের কর্মকাণ্ডে প্রতীয়মান তাঁরা গণহত্যার সমর্থক। এ কারণে একটি গণ আদালত গঠন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের এই নেতাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি জানিয়েছে উদীচী।
১৭ আগস্ট ২০২৪