সুমন সাজ্জাদ
সাম্প্রতিক কালে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসাহিত্য কতখানি প্রাসঙ্গিক—এ রকম একটি প্রশ্ন কেউ কেউ তুলতে চান, তুলেও থাকেন। সাহিত্যের দীক্ষিত পাঠক থেকে শুরু করে অদীক্ষিত শখের পাঠকও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন—আদতেই রবীন্দ্রনাথ কিংবা রবীন্দ্রসাহিত্যের ‘দরকার’ আছে কি না! প্রশ্নটি অথবা প্রশ্নগুচ্ছে জড়িয়ে থাকে প্রায়োগিক জীবনব্যবস্থার চিহ্ন। যেমন করে আমরা প্রশ্ন তুলে থাকি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, নাসার মঙ্গল অভিযান কিংবা শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহারিক গুরুত্ব আছে কি নেই! একইভাবে যেন জিজ্ঞাসা জন্মায়, ফলিত বিশ্বে রবীন্দ্রনাথ দরকারি কি না! মজার ব্যাপার এই যে, প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিকতার প্রশ্ন তোলা যায় আরও আরও মহাজন প্রসঙ্গে। তবে ঘুরেফিরে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে এই প্রশ্নের মরা গাঙে জোয়ার আসে।
গ্রিক তরুণ কবিরা নিশ্চয়ই দল বেঁধে প্রশ্ন তুলতে পারেন, দেউলিয়া ও ঋণগ্রস্ত সমকালীন গ্রিসে হোমারের প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? হোমারের প্রাচীন লেখাপত্র পড়েই-বা কী লাভ? হোমারের কলাকৌশল একালের গ্রিক কবিতাকে কতটুকু উৎকর্ষের দিকে নিয়ে যাবে? প্রযুক্তি আচ্ছাদিত দুনিয়ায় সফোক্লিস, কালিদাস, ওভিদেরই বা কোন প্রাসঙ্গিকতা পাওয়া যাবে? এসব প্রশ্নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাঙালি নবীন কবি-লেখকেরাও তুলতে পারেন সমান তালের প্রশ্ন। প্রশ্ন তুলতে সমস্যা নেই। তবে প্রশ্নটি নিজেই যৌক্তিক কি না, সে বিষয়ে ভাবার সুযোগ আছে।
রবীন্দ্রসাহিত্যকে অনেকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চান। কিন্তু ইতিহাসের মুষ্টাঘাতে তুড়ি ঠিক তালে তাল ঠুকে বাজে না। কারণটা এই: নন্দনতাত্ত্বিকতা ছাড়িয়েই রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছেন বাংলা অঞ্চলের সাংস্কৃতিক প্রতীক। এক দিন-দুই দিনের আনুষ্ঠানিক আলাপ আর বৈঠকে বসে তাঁকে সম্মিলিতভাবে প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি। ইতিহাসের এক দীর্ঘ পর্ব তাঁকে নির্মাণ করেছে। সময়ের সঙ্গে সাড়া দিয়ে, সময়কে নেড়েচেড়ে নিজের মতো গড়েপিটে তিনিও সময়কে নিজের জন্য নির্মাণ করে নিয়েছেন। তাহলে ঐতিহাসিকতা আর ঐতিহাসিক পাঠই কি সাহিত্যের প্রতীক-প্রতিম কবি-লেখকদের জন্য পরম নিয়তি? সেই সূত্রেই ধেয়ে আসে অপর এক জিজ্ঞাসা : নন্দনতাত্ত্বিকভাবে রবীন্দ্রনাথ কি প্রাসঙ্গিক নন? জরুরি নন?
বিনা দ্বিধায় বলা যায়, ঘোরতরভাবে প্রাসঙ্গিক। আমাদের মনে রাখতে হবে, উনিশ শতকের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বাংলা একটি অবিকশিত প্রাদেশিক ভাষামাত্র। ওড়িয়া, অসমিয়া ভাষার মতোই বাংলা খুঁজে বেড়াচ্ছে ভবিষ্যতের দিশা। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে একদিকে চলছে ঔপনিবেশিক পণ্ডিত ও কর্মকর্তাদের অনুশীলন, অন্যদিকে চলছে সংস্কৃতসেবীদের শুদ্ধি অভিযান। তার ওপর সবকিছু টপকে গিয়ে চূড়ায় বসে আছে নব্য বাঙালির ইংরেজিয়ানা। ভাষাগত এই পটভূমির ওপর গড়ে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর প্রাসঙ্গিকতা ফুরিয়ে যাবে, দুম করে এমন কথা বলা যায় না।
শিল্প-সাহিত্যের নানা নিরীক্ষায় রবীন্দ্রনাথ হতে পারেন প্রেরণার উৎসভূমি। আমরা হয়তো জানি না যে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টিশীল নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টি করেছেন। কবিতাকে করেছেন নাটক, কাব্যনাট্যকে করেছেন গীতিনাট্য। যেমন—‘পরিশোধ’ কবিতাটি হয়ে গেল নৃত্যনাট্য শ্যামা। চিত্রাঙ্গদার কাহিনি পেয়ে গেল নৃত্যনাট্যের রূপ। লেখার এই রূপান্তরের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ জুড়ে দিয়েছেন ব্যাখ্যা। শেষ জীবনে ঝুঁকেছিলেন চিত্রকলায়। সেখানেও ফলেছে নতুন শস্য।
সাহিত্যের ভাব ও ভাষার খোঁজে অনেক পথ খুঁড়তে হয়েছে তাঁকে। তরুণ রবীন্দ্রনাথের সামনে ছিল মধুসূদন-বঙ্কিমচন্দ্র অধ্যুষিত পথ। আজ আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও অসম্ভব যে উনিশ শতকের বাংলা কবিতায় মধুসূদন কতখানি প্রভাববিস্তারী হয়ে উঠেছিলেন; নানাবিধ ‘বধ-কাব্যে’ ভরে উঠেছিল বাংলা কবিতা। নতুন কবিদের জন্য মধুসূদন ছিলেন এক বিরাট বাধা। মধুসূদনকে অনুসরণ করতে গিয়ে প্রভাবের চোরাবালিতে ডুবে মরেছেন অনেক অনেক কবি। ব্যতিক্রমী ছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তী। রবীন্দ্রনাথ যাঁর খাঁটি ঐতিহাসিক ও নন্দনতাত্ত্বিক মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন।
বাংলা সাহিত্যের বাজারে তত দিনে এসে গেছেন শেক্সপিয়ার, মিলটন, শেলি, কিটস, বায়রন। বিহারীলালের মতো করেই রবীন্দ্রনাথ বেছে নিলেন গীতিকবিতার পথ। বিরহী রাধার নূপুরধ্বনির মতো তাঁর কবিতায় শোনা গেল বৈষ্ণব কবিতার মৃদুমন্দ স্বর। ব্রজেন্দ্রনাথ শীলকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘বৈষ্ণব সাহিত্য ও উপনিষদ বিমিশ্রিত হইয়া আমার মনের হাওয়া তৈরি করিয়াছে।’ আর সেই হাওয়াতেই রচিত হলো গীতবিতানের কতশত গান।
ছোটগল্প নামক সাহিত্য আঙ্গিকটিকে নানা ভঙ্গিতে বিস্তৃত করেছেন তিনি। তাঁর হাতেই পাচ্ছি ‘ঘাটের কথা’, ‘রাজপথের কথা’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘গুপ্তধন’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘নষ্টনীড়ে’র মতো বিচিত্র ভঙ্গি ও স্বাদের গল্প; প্রয়োজন মাফিক তিনি বদলে নিয়েছেন কথকের রীতিগত অবস্থান, বেড়ে গিয়েছে গল্পের আকার ও প্রকার; আমাদের মনে পড়বে ‘রবিবার’ কিংবা ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পের কথা। গল্প লেখার হুলুস্থুল কাণ্ডকে নিজেই ব্যঙ্গ করে বলেছেন, ‘উল্কাবৃষ্টি’।
বঙ্কিমচন্দ্র-শাসিত কথকতায় রবীন্দ্রনাথ বের করে আনতে চাইলেন ‘আঁতের কথা’; ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের সূচনায় জানান দিয়েছেন, নতুন এই উপন্যাস শুধু তাঁর নিজের জন্য নয়, সেকালের বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেই এক ‘আকস্মিক’ ঘটনা। আরও বললেন, ‘এবারকার গল্প বানাতে হবে এ যুগের কারখানা ঘরে।’ কিন্তু কী আছে সেই ঘরে? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মনের সংসারের সেই কারখানা-ঘরে যেখানে আগুনের জ্বলুনি হাতুড়ির পিটুনি থেকে দৃঢ় ধাতুর মূর্তি জেগে উঠতে থাকে।’ আর তারপর? তিনি লিখলেন, ‘যেন পশুশালার দরজা খুলে দেওয়া হল, বেরিয়ে পড়ল হিংস্র ঘটনাগুলো অসংযত হয়ে।’ যার সঙ্গে মিশে আছে মানুষের ঈর্ষা, রিপু। রবীন্দ্রনাথ চিনতে চাইলেন মানুষের অন্ধ কুঠুরি। কারণ, ‘সাহিত্যের নবপর্যায়ের পদ্ধতি হচ্ছে ঘটনাপরম্পরার বিবরণ দেওয়া নয়, বিশ্লেষণ করে তাদের আঁতের কথা বের করে দেখানো।’ ‘চোখের বালি’তে এই পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটালেন তিনি; আবার এ-ও বলতে ভুললেন না যে গল্প লেখার দিনগুলোতেই চলছিল তাঁর প্রস্তুতি।
রবিঠাকুর সম্পর্কে সাধারণ ধারণা এই যে অলৌকিক আন্তর প্রেরণায় অভিভূত হয়ে রবীন্দ্রনাথ একের পর এক সাহিত্য সৃজন করে গিয়েছেন। তাঁর ওপর ভর করেছেন ‘জীবনদেবতা’, যিনি তাঁকে দিয়ে সবকিছু লিখিয়ে নিয়েছেন। রবীন্দ্রভাষ্য মোতাবেক এ কথা সত্যের এক পিঠ মাত্র। অপর পিঠে লুকিয়ে আছে অন্য এক সত্য; যেখানে রবীন্দ্রনাথ অনবরত লিখে যাচ্ছেন ফরমাশের চাপে; সৃষ্টিশীল আবেগের চেয়েও মনের ওপর জোরালোভাবে চেপে বসেছে নিরীক্ষার তাড়না। আসলে বলতে চাইছি, রবীন্দ্রনাথ আমাদের সেই বিরল প্রতিভা, ঋতুবদলের সঙ্গে সঙ্গে যিনি ধারণ করেছেন নতুন মুখ ও মুখশ্রী।
ব্যক্তির আত্মসচেতনতা, বিরাট ব্রহ্মাণ্ডে নিজেকে শনাক্ত করতে পারার দীক্ষা মেলে রবীন্দ্রসাহিত্যে। আর কে না জানে রোমান্টিক এই আত্মসচেতনতা আধুনিকতারও উৎস। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জন্য অহমের আত্মকেন্দ্রিকতা ছিল একেবারেই না-পছন্দ ব্যাপার। তার বদলে তিনি বলেন আত্মশক্তির কথা, যা সামষ্টিকতার অংশ। সবার সঙ্গে সবাই মেলার আয়োজন হিসেবে জাতীয় সাহিত্যকে পছন্দ করলেও জাতীয়তাবাদের সমালোচনায় তিনি দাঁড়াতে গেলেন ভিন্ন পাটাতনে। অথচ বাঙালির জাতীয় চৈতন্য ও জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠার পেছনে শেষ পর্যন্ত প্রবল প্রভাব রেখেছে রবীন্দ্রসাহিত্য। অনুমান করি, আজকের যুগের কট্টর জাতীয়তাবাদী প্রকাশগুলোর বিরুদ্ধে তিনি ভিন্ন মতই প্রকাশ করতেন।
প্রতিরোধের চৈতন্য বোঝার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ হতে পারেন দারুণ এক শক্তি। তাঁর এই দিকটি নিয়ে দরকারি আলোচনার ভাগ কম বলেই মনে হয়। আমরা রবীন্দ্রনাথকে একজন নিষ্ক্রিয় রোমান্টিক হিসেবে দেখতেই অভ্যস্ত। অথচ তাঁর বিস্তৃত জীবনজুড়ে খুঁজে পাব সক্রিয় সব কর্মযজ্ঞের ইতিহাস। তাঁর মধ্যে ব্যাপকভাবে বিদ্যমান সমকালকে বোঝার তাগিদ। আপন দেশ ও বিশ্বপরিস্থিতিকে তিনি চমৎকারভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। সেই সবের ঐতিহাসিক সাক্ষ্য হয়ে আছে কালান্তর বইয়ের প্রবন্ধগুলো। আমি বিশেষভাবে বলব তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধটির কথা। এই প্রবন্ধে ঔপনিবেশিক শাসন ও সাম্রাজ্যবাদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। আশি বছরব্যাপী প্রসারিত জীবনের পটভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ যেন দাঁড়িয়ে ছিলেন আত্মসমীক্ষার সামনে। তাঁর মনে হয়েছে, তিনি এবং তাঁর দেশের ‘মনোবৃত্তির পরিণতি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে।’ গভীরতরভাবে বাসা বেঁধেছে বিচ্ছিন্নতা।
রবীন্দ্রনাথের উপনিবেশিত মন আজ যেন বুঝতে পারল ‘সাম্রাজ্যমদমত্ততা’য় ভরা ইংরেজদের কলুষিত হৃদয়। তার আগ পর্যন্ত নব্য শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোকের সাংস্কৃতিক সূত্র মেনে রবীন্দ্রনাথও মুগ্ধ ছিলেন ‘বার্কের বাগ্মিতায়, মেকলের ভাষাপ্রবাহের তরঙ্গভঙ্গে’; সাহিত্যিক সংস্পর্শ হিসেবে অন্তরের অন্দরমহলে টোকা দিয়েছিল শেকশপিয়রের নাটক, বায়রনের কবিতা। ইংরেজের রাজনীতি সম্পর্কে উপলব্ধি ছিল ‘সর্বমানবের বিজয়ঘোষণা’। ইংল্যান্ড ছিল ‘অত্যাচারপ্রপীড়িত জাতির আশ্রয়স্থল’। স্মৃতির অন্দর হাতড়ে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘মানবমৈত্রীর বিশুদ্ধ পরিচয় দেখেছি ইংরেজ-চরিত্রে, তাই আন্তরিক শ্রদ্ধা নিয়ে ইংরেজকে হৃদয়ের উচ্চাসনে বসিয়েছিলেম।’ অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের মনে আসন পেয়েছিল ইউরোপের উদার মানবিকতাবাদ।
কিন্তু প্রৌঢ়ত্বের গোধূলিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন অন্য কথা; ‘সভ্যতা’র ধারণাটিই আজ তাঁর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি দেখতে পেলেন, ‘সভ্যতাকে যারা চরিত্র-উৎস থেকে উৎসারিতরূপে স্বীকার করেছে, রিপুর প্রবর্তনায় তারা তাকে কী অনায়াসে লঙ্ঘন করতে পারে।’ ইংরেজি সাহিত্যের ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’ ঘটল রবীন্দ্রনাথের। উন্মোচিত হলো অন্য এক দৃশ্যপট। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘নিভৃতে সাহিত্যের রস সম্ভোগের উপকরণের বেষ্টন হতে একদিন আমাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। সেদিন ভারতবর্ষের জনসাধারণের যে নিদারুণ দারিদ্র্য আমার সম্মুখে উদ্ঘাটিত হলো, তা হৃদয়বিদারক। অন্ন বস্ত্র পানীয় শিক্ষা আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের শরীর-মনের পক্ষে যা-কিছু অত্যাবশ্যক, তার এমন নিরতিশয় অভাব বোধ হয় পৃথিবীর আধুনিক শাসনচালিত কোনো দেশেই ঘটেনি। অথচ এই দেশ ইংরেজকে দীর্ঘকাল ধরে তার ঐশ্বর্য জুগিয়ে এসেছে। যখন সভ্যজগতের মহিমা ধ্যানে একান্ত মনে নিবিষ্ট ছিলেম, তখন কোনো দিন সভ্য নামধারী মানব-আদর্শের এত বড়ো নিষ্ঠুর বিকৃত রূপ কল্পনা করতেই পারিনি ; অবশেষে দেখছি, একদিন এই বিকারের ভেতর দিয়ে বহু কোটি জনসাধারণের প্রতি সভ্য জাতির অপরিসীম অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদাসীন্য।’
একই দেহে লীন সভ্যতা ও সাম্রাজ্যবাদের জাতিক ও আন্তর্জাতিক বিস্তার তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছে। আর তাই ভাবনার পরিসরে এসে গেছে সেকালের চীন, জাপান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, ইরান। ইউরোপ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘সমস্ত ইউরোপে বর্বরতা কী রকম নখদন্ত বিকাশ করে বিভীষিকা বিস্তার করতে উদ্যত। এই মানবপীড়নের মহামারি পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভেতর থেকে জাগ্রত হয়ে উঠে আজ মানবাত্মার অপমানে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত বাতাস কলুষিত করে দিয়েছে।’ রবীন্দ্রনাথের এই সব উক্তি ও উপলব্ধি আজও কি প্রাসঙ্গিক নয়? খানিকটা আত্মগ্লানিতে ভরা মন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আমাদের হতভাগ্য নিঃসহায় নীরন্ধ্র অকিঞ্চনতার মধ্যে আমরা কি তার কোনো আভাস পাইনি?’
আভাস নিশ্চয়ই তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ বলে যিনি জ্ঞান করেন, তার পক্ষে ‘সমালোচনাত্মক’ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা খানিকটা মুশকিলের ব্যাপার। তবে তিনি ঠিকঠাক বুঝতে পেরেছিলেন, ‘ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে এই ভারত সাম্রাজ্য ত্যাগ করে যেতে হবে।’ পরিত্যক্ত ভারতবর্ষের জন্য তারা রেখে যাবে ‘দীনতার আবর্জনা’, ‘বিস্তীর্ণ পঙ্কশয্যা’, ‘দুর্বিষহ নিষ্ফলতা’; বিশেষণে ঢাকা এসব চিত্রায়ণের পর রবীন্দ্রনাথ স্বীকারোক্তি করছেন, ‘জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম য়ুরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল।’ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য কী রেখে গেলেন?
রবীন্দ্রনাথ দিয়ে গেলেন বিপুল সাহিত্যসম্ভার, বিকশিত বাংলা ভাষা, বহুবিধ সাংস্কৃতিক কৃত্য, জাতীয় চৈতন্য আর এক সর্বগ্রাহী মন। বাঙালির মনে অবচেতনে রেখে গেলেন স্বপ্নগ্রস্ত ‘ইউটোপিয়া’। শান্তিনিকেতন, তপোবন, আশ্রমকেন্দ্রিক প্রকল্পনা এখনো ধরা দেয় কোনো কোনো বাঙালির স্বপ্ন ও কল্পনায়। ব্রাহ্মধর্ম ও ব্রহ্মবিশ্বাসের সুতো দিয়ে বেঁধে নিয়ে এই ইউটোপিয়াকে যাঁরা পড়তে চান, তাঁরা পড়তে পারেন; তার আগে কল্পনা করে দেখুন, একজন দিগন্তবিহারী কবি মগ্ন হয়ে ভাবছেন প্রকৃতি-আশ্রিত শিক্ষা প্রসঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে যোগ করে নিচ্ছেন উৎসব ও আনন্দকে, সনাতন গ্রাম-কৃষি ও কৃষকের সম্পর্ককে দিতে চাইছেন নতুন এক বন্দোবস্ত, প্রকৃতি ও মানুষের চিরায়ত সম্বন্ধকে বুঝতে চাইছেন দার্শনিক ও প্রায়োগিকভাবে। একালে এই সব ভাবনা কি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে? রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার বিপরীতে হাল আমলের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বঙ্গদেশে এত হাহাকার কেন? প্রকৃতি কিংবা ছয় ঋতু ‘গেল গেল’, ‘নেই নেই’ বলে এত কোলাহল কেন? অসহিষ্ণু মন নিয়ে কেন এত মাথাব্যথা আমাদের?
সত্যি বলতে কি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির জন্য এক মহাবয়ান। ‘উচ্চ সংস্কৃতি’র অভিযোগে মামলা দায়ের করে এই বয়ানের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা যায়; একে ভাঙা যায়, হ্যাঁচকা টানও দেওয়া যায়, কিন্তু উপড়ে ফেলা যায় না। যদি তা-ই হতো, রুশ বিপ্লবের পর একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়তেন লিয়েফ তলস্তয়। উল্টো ভ্লাদিমির লেনিন তাঁকে বললেন রুশ বিপ্লবের দর্পণ। এই ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতীককে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নবায়নও করে নিতে হয়। যেমন শেক্সপিয়র নবায়িত হন ভিন্ন দেশের ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষার ভেতর দিয়ে, যেমন বহু ভাষায় নবায়িত হয়েছেন হোমার। আমরা কি প্রস্তুত রবীন্দ্রনাথকে ‘নতুন করে পাবো বলে’? নাকি তাঁকে আটকে রাখব প্রাতিষ্ঠানিক খোঁয়াড়ে? তাঁর সাহিত্য ও সৃষ্টিশীলতাকে কতখানি ভাঙব, কতখানি গড়ব, প্যারোডি আর ক্যারিকেচারের ঠোঙায় কতখানি মোড়াব তাঁর লেখাকে—সেটুকু কাণ্ডজ্ঞান কি আমাদের হয়েছে? নাকি জ্ঞানকাণ্ডের বোঝার ভারে মূলসহ নিজেরাই উপড়ে পড়ছি লন্ডভণ্ড কাণ্ডকারখানায়?
সাম্প্রতিক কালে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসাহিত্য কতখানি প্রাসঙ্গিক—এ রকম একটি প্রশ্ন কেউ কেউ তুলতে চান, তুলেও থাকেন। সাহিত্যের দীক্ষিত পাঠক থেকে শুরু করে অদীক্ষিত শখের পাঠকও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন—আদতেই রবীন্দ্রনাথ কিংবা রবীন্দ্রসাহিত্যের ‘দরকার’ আছে কি না! প্রশ্নটি অথবা প্রশ্নগুচ্ছে জড়িয়ে থাকে প্রায়োগিক জীবনব্যবস্থার চিহ্ন। যেমন করে আমরা প্রশ্ন তুলে থাকি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, নাসার মঙ্গল অভিযান কিংবা শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহারিক গুরুত্ব আছে কি নেই! একইভাবে যেন জিজ্ঞাসা জন্মায়, ফলিত বিশ্বে রবীন্দ্রনাথ দরকারি কি না! মজার ব্যাপার এই যে, প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিকতার প্রশ্ন তোলা যায় আরও আরও মহাজন প্রসঙ্গে। তবে ঘুরেফিরে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে এই প্রশ্নের মরা গাঙে জোয়ার আসে।
গ্রিক তরুণ কবিরা নিশ্চয়ই দল বেঁধে প্রশ্ন তুলতে পারেন, দেউলিয়া ও ঋণগ্রস্ত সমকালীন গ্রিসে হোমারের প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? হোমারের প্রাচীন লেখাপত্র পড়েই-বা কী লাভ? হোমারের কলাকৌশল একালের গ্রিক কবিতাকে কতটুকু উৎকর্ষের দিকে নিয়ে যাবে? প্রযুক্তি আচ্ছাদিত দুনিয়ায় সফোক্লিস, কালিদাস, ওভিদেরই বা কোন প্রাসঙ্গিকতা পাওয়া যাবে? এসব প্রশ্নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাঙালি নবীন কবি-লেখকেরাও তুলতে পারেন সমান তালের প্রশ্ন। প্রশ্ন তুলতে সমস্যা নেই। তবে প্রশ্নটি নিজেই যৌক্তিক কি না, সে বিষয়ে ভাবার সুযোগ আছে।
রবীন্দ্রসাহিত্যকে অনেকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চান। কিন্তু ইতিহাসের মুষ্টাঘাতে তুড়ি ঠিক তালে তাল ঠুকে বাজে না। কারণটা এই: নন্দনতাত্ত্বিকতা ছাড়িয়েই রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছেন বাংলা অঞ্চলের সাংস্কৃতিক প্রতীক। এক দিন-দুই দিনের আনুষ্ঠানিক আলাপ আর বৈঠকে বসে তাঁকে সম্মিলিতভাবে প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি। ইতিহাসের এক দীর্ঘ পর্ব তাঁকে নির্মাণ করেছে। সময়ের সঙ্গে সাড়া দিয়ে, সময়কে নেড়েচেড়ে নিজের মতো গড়েপিটে তিনিও সময়কে নিজের জন্য নির্মাণ করে নিয়েছেন। তাহলে ঐতিহাসিকতা আর ঐতিহাসিক পাঠই কি সাহিত্যের প্রতীক-প্রতিম কবি-লেখকদের জন্য পরম নিয়তি? সেই সূত্রেই ধেয়ে আসে অপর এক জিজ্ঞাসা : নন্দনতাত্ত্বিকভাবে রবীন্দ্রনাথ কি প্রাসঙ্গিক নন? জরুরি নন?
বিনা দ্বিধায় বলা যায়, ঘোরতরভাবে প্রাসঙ্গিক। আমাদের মনে রাখতে হবে, উনিশ শতকের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বাংলা একটি অবিকশিত প্রাদেশিক ভাষামাত্র। ওড়িয়া, অসমিয়া ভাষার মতোই বাংলা খুঁজে বেড়াচ্ছে ভবিষ্যতের দিশা। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে একদিকে চলছে ঔপনিবেশিক পণ্ডিত ও কর্মকর্তাদের অনুশীলন, অন্যদিকে চলছে সংস্কৃতসেবীদের শুদ্ধি অভিযান। তার ওপর সবকিছু টপকে গিয়ে চূড়ায় বসে আছে নব্য বাঙালির ইংরেজিয়ানা। ভাষাগত এই পটভূমির ওপর গড়ে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর প্রাসঙ্গিকতা ফুরিয়ে যাবে, দুম করে এমন কথা বলা যায় না।
শিল্প-সাহিত্যের নানা নিরীক্ষায় রবীন্দ্রনাথ হতে পারেন প্রেরণার উৎসভূমি। আমরা হয়তো জানি না যে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টিশীল নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টি করেছেন। কবিতাকে করেছেন নাটক, কাব্যনাট্যকে করেছেন গীতিনাট্য। যেমন—‘পরিশোধ’ কবিতাটি হয়ে গেল নৃত্যনাট্য শ্যামা। চিত্রাঙ্গদার কাহিনি পেয়ে গেল নৃত্যনাট্যের রূপ। লেখার এই রূপান্তরের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ জুড়ে দিয়েছেন ব্যাখ্যা। শেষ জীবনে ঝুঁকেছিলেন চিত্রকলায়। সেখানেও ফলেছে নতুন শস্য।
সাহিত্যের ভাব ও ভাষার খোঁজে অনেক পথ খুঁড়তে হয়েছে তাঁকে। তরুণ রবীন্দ্রনাথের সামনে ছিল মধুসূদন-বঙ্কিমচন্দ্র অধ্যুষিত পথ। আজ আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও অসম্ভব যে উনিশ শতকের বাংলা কবিতায় মধুসূদন কতখানি প্রভাববিস্তারী হয়ে উঠেছিলেন; নানাবিধ ‘বধ-কাব্যে’ ভরে উঠেছিল বাংলা কবিতা। নতুন কবিদের জন্য মধুসূদন ছিলেন এক বিরাট বাধা। মধুসূদনকে অনুসরণ করতে গিয়ে প্রভাবের চোরাবালিতে ডুবে মরেছেন অনেক অনেক কবি। ব্যতিক্রমী ছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তী। রবীন্দ্রনাথ যাঁর খাঁটি ঐতিহাসিক ও নন্দনতাত্ত্বিক মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন।
বাংলা সাহিত্যের বাজারে তত দিনে এসে গেছেন শেক্সপিয়ার, মিলটন, শেলি, কিটস, বায়রন। বিহারীলালের মতো করেই রবীন্দ্রনাথ বেছে নিলেন গীতিকবিতার পথ। বিরহী রাধার নূপুরধ্বনির মতো তাঁর কবিতায় শোনা গেল বৈষ্ণব কবিতার মৃদুমন্দ স্বর। ব্রজেন্দ্রনাথ শীলকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘বৈষ্ণব সাহিত্য ও উপনিষদ বিমিশ্রিত হইয়া আমার মনের হাওয়া তৈরি করিয়াছে।’ আর সেই হাওয়াতেই রচিত হলো গীতবিতানের কতশত গান।
ছোটগল্প নামক সাহিত্য আঙ্গিকটিকে নানা ভঙ্গিতে বিস্তৃত করেছেন তিনি। তাঁর হাতেই পাচ্ছি ‘ঘাটের কথা’, ‘রাজপথের কথা’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘গুপ্তধন’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘নষ্টনীড়ে’র মতো বিচিত্র ভঙ্গি ও স্বাদের গল্প; প্রয়োজন মাফিক তিনি বদলে নিয়েছেন কথকের রীতিগত অবস্থান, বেড়ে গিয়েছে গল্পের আকার ও প্রকার; আমাদের মনে পড়বে ‘রবিবার’ কিংবা ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পের কথা। গল্প লেখার হুলুস্থুল কাণ্ডকে নিজেই ব্যঙ্গ করে বলেছেন, ‘উল্কাবৃষ্টি’।
বঙ্কিমচন্দ্র-শাসিত কথকতায় রবীন্দ্রনাথ বের করে আনতে চাইলেন ‘আঁতের কথা’; ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের সূচনায় জানান দিয়েছেন, নতুন এই উপন্যাস শুধু তাঁর নিজের জন্য নয়, সেকালের বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেই এক ‘আকস্মিক’ ঘটনা। আরও বললেন, ‘এবারকার গল্প বানাতে হবে এ যুগের কারখানা ঘরে।’ কিন্তু কী আছে সেই ঘরে? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মনের সংসারের সেই কারখানা-ঘরে যেখানে আগুনের জ্বলুনি হাতুড়ির পিটুনি থেকে দৃঢ় ধাতুর মূর্তি জেগে উঠতে থাকে।’ আর তারপর? তিনি লিখলেন, ‘যেন পশুশালার দরজা খুলে দেওয়া হল, বেরিয়ে পড়ল হিংস্র ঘটনাগুলো অসংযত হয়ে।’ যার সঙ্গে মিশে আছে মানুষের ঈর্ষা, রিপু। রবীন্দ্রনাথ চিনতে চাইলেন মানুষের অন্ধ কুঠুরি। কারণ, ‘সাহিত্যের নবপর্যায়ের পদ্ধতি হচ্ছে ঘটনাপরম্পরার বিবরণ দেওয়া নয়, বিশ্লেষণ করে তাদের আঁতের কথা বের করে দেখানো।’ ‘চোখের বালি’তে এই পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটালেন তিনি; আবার এ-ও বলতে ভুললেন না যে গল্প লেখার দিনগুলোতেই চলছিল তাঁর প্রস্তুতি।
রবিঠাকুর সম্পর্কে সাধারণ ধারণা এই যে অলৌকিক আন্তর প্রেরণায় অভিভূত হয়ে রবীন্দ্রনাথ একের পর এক সাহিত্য সৃজন করে গিয়েছেন। তাঁর ওপর ভর করেছেন ‘জীবনদেবতা’, যিনি তাঁকে দিয়ে সবকিছু লিখিয়ে নিয়েছেন। রবীন্দ্রভাষ্য মোতাবেক এ কথা সত্যের এক পিঠ মাত্র। অপর পিঠে লুকিয়ে আছে অন্য এক সত্য; যেখানে রবীন্দ্রনাথ অনবরত লিখে যাচ্ছেন ফরমাশের চাপে; সৃষ্টিশীল আবেগের চেয়েও মনের ওপর জোরালোভাবে চেপে বসেছে নিরীক্ষার তাড়না। আসলে বলতে চাইছি, রবীন্দ্রনাথ আমাদের সেই বিরল প্রতিভা, ঋতুবদলের সঙ্গে সঙ্গে যিনি ধারণ করেছেন নতুন মুখ ও মুখশ্রী।
ব্যক্তির আত্মসচেতনতা, বিরাট ব্রহ্মাণ্ডে নিজেকে শনাক্ত করতে পারার দীক্ষা মেলে রবীন্দ্রসাহিত্যে। আর কে না জানে রোমান্টিক এই আত্মসচেতনতা আধুনিকতারও উৎস। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জন্য অহমের আত্মকেন্দ্রিকতা ছিল একেবারেই না-পছন্দ ব্যাপার। তার বদলে তিনি বলেন আত্মশক্তির কথা, যা সামষ্টিকতার অংশ। সবার সঙ্গে সবাই মেলার আয়োজন হিসেবে জাতীয় সাহিত্যকে পছন্দ করলেও জাতীয়তাবাদের সমালোচনায় তিনি দাঁড়াতে গেলেন ভিন্ন পাটাতনে। অথচ বাঙালির জাতীয় চৈতন্য ও জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠার পেছনে শেষ পর্যন্ত প্রবল প্রভাব রেখেছে রবীন্দ্রসাহিত্য। অনুমান করি, আজকের যুগের কট্টর জাতীয়তাবাদী প্রকাশগুলোর বিরুদ্ধে তিনি ভিন্ন মতই প্রকাশ করতেন।
প্রতিরোধের চৈতন্য বোঝার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ হতে পারেন দারুণ এক শক্তি। তাঁর এই দিকটি নিয়ে দরকারি আলোচনার ভাগ কম বলেই মনে হয়। আমরা রবীন্দ্রনাথকে একজন নিষ্ক্রিয় রোমান্টিক হিসেবে দেখতেই অভ্যস্ত। অথচ তাঁর বিস্তৃত জীবনজুড়ে খুঁজে পাব সক্রিয় সব কর্মযজ্ঞের ইতিহাস। তাঁর মধ্যে ব্যাপকভাবে বিদ্যমান সমকালকে বোঝার তাগিদ। আপন দেশ ও বিশ্বপরিস্থিতিকে তিনি চমৎকারভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। সেই সবের ঐতিহাসিক সাক্ষ্য হয়ে আছে কালান্তর বইয়ের প্রবন্ধগুলো। আমি বিশেষভাবে বলব তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধটির কথা। এই প্রবন্ধে ঔপনিবেশিক শাসন ও সাম্রাজ্যবাদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। আশি বছরব্যাপী প্রসারিত জীবনের পটভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ যেন দাঁড়িয়ে ছিলেন আত্মসমীক্ষার সামনে। তাঁর মনে হয়েছে, তিনি এবং তাঁর দেশের ‘মনোবৃত্তির পরিণতি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে।’ গভীরতরভাবে বাসা বেঁধেছে বিচ্ছিন্নতা।
রবীন্দ্রনাথের উপনিবেশিত মন আজ যেন বুঝতে পারল ‘সাম্রাজ্যমদমত্ততা’য় ভরা ইংরেজদের কলুষিত হৃদয়। তার আগ পর্যন্ত নব্য শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোকের সাংস্কৃতিক সূত্র মেনে রবীন্দ্রনাথও মুগ্ধ ছিলেন ‘বার্কের বাগ্মিতায়, মেকলের ভাষাপ্রবাহের তরঙ্গভঙ্গে’; সাহিত্যিক সংস্পর্শ হিসেবে অন্তরের অন্দরমহলে টোকা দিয়েছিল শেকশপিয়রের নাটক, বায়রনের কবিতা। ইংরেজের রাজনীতি সম্পর্কে উপলব্ধি ছিল ‘সর্বমানবের বিজয়ঘোষণা’। ইংল্যান্ড ছিল ‘অত্যাচারপ্রপীড়িত জাতির আশ্রয়স্থল’। স্মৃতির অন্দর হাতড়ে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘মানবমৈত্রীর বিশুদ্ধ পরিচয় দেখেছি ইংরেজ-চরিত্রে, তাই আন্তরিক শ্রদ্ধা নিয়ে ইংরেজকে হৃদয়ের উচ্চাসনে বসিয়েছিলেম।’ অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের মনে আসন পেয়েছিল ইউরোপের উদার মানবিকতাবাদ।
কিন্তু প্রৌঢ়ত্বের গোধূলিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন অন্য কথা; ‘সভ্যতা’র ধারণাটিই আজ তাঁর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি দেখতে পেলেন, ‘সভ্যতাকে যারা চরিত্র-উৎস থেকে উৎসারিতরূপে স্বীকার করেছে, রিপুর প্রবর্তনায় তারা তাকে কী অনায়াসে লঙ্ঘন করতে পারে।’ ইংরেজি সাহিত্যের ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’ ঘটল রবীন্দ্রনাথের। উন্মোচিত হলো অন্য এক দৃশ্যপট। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘নিভৃতে সাহিত্যের রস সম্ভোগের উপকরণের বেষ্টন হতে একদিন আমাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। সেদিন ভারতবর্ষের জনসাধারণের যে নিদারুণ দারিদ্র্য আমার সম্মুখে উদ্ঘাটিত হলো, তা হৃদয়বিদারক। অন্ন বস্ত্র পানীয় শিক্ষা আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের শরীর-মনের পক্ষে যা-কিছু অত্যাবশ্যক, তার এমন নিরতিশয় অভাব বোধ হয় পৃথিবীর আধুনিক শাসনচালিত কোনো দেশেই ঘটেনি। অথচ এই দেশ ইংরেজকে দীর্ঘকাল ধরে তার ঐশ্বর্য জুগিয়ে এসেছে। যখন সভ্যজগতের মহিমা ধ্যানে একান্ত মনে নিবিষ্ট ছিলেম, তখন কোনো দিন সভ্য নামধারী মানব-আদর্শের এত বড়ো নিষ্ঠুর বিকৃত রূপ কল্পনা করতেই পারিনি ; অবশেষে দেখছি, একদিন এই বিকারের ভেতর দিয়ে বহু কোটি জনসাধারণের প্রতি সভ্য জাতির অপরিসীম অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদাসীন্য।’
একই দেহে লীন সভ্যতা ও সাম্রাজ্যবাদের জাতিক ও আন্তর্জাতিক বিস্তার তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছে। আর তাই ভাবনার পরিসরে এসে গেছে সেকালের চীন, জাপান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, ইরান। ইউরোপ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘সমস্ত ইউরোপে বর্বরতা কী রকম নখদন্ত বিকাশ করে বিভীষিকা বিস্তার করতে উদ্যত। এই মানবপীড়নের মহামারি পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভেতর থেকে জাগ্রত হয়ে উঠে আজ মানবাত্মার অপমানে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত বাতাস কলুষিত করে দিয়েছে।’ রবীন্দ্রনাথের এই সব উক্তি ও উপলব্ধি আজও কি প্রাসঙ্গিক নয়? খানিকটা আত্মগ্লানিতে ভরা মন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আমাদের হতভাগ্য নিঃসহায় নীরন্ধ্র অকিঞ্চনতার মধ্যে আমরা কি তার কোনো আভাস পাইনি?’
আভাস নিশ্চয়ই তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ বলে যিনি জ্ঞান করেন, তার পক্ষে ‘সমালোচনাত্মক’ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা খানিকটা মুশকিলের ব্যাপার। তবে তিনি ঠিকঠাক বুঝতে পেরেছিলেন, ‘ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে এই ভারত সাম্রাজ্য ত্যাগ করে যেতে হবে।’ পরিত্যক্ত ভারতবর্ষের জন্য তারা রেখে যাবে ‘দীনতার আবর্জনা’, ‘বিস্তীর্ণ পঙ্কশয্যা’, ‘দুর্বিষহ নিষ্ফলতা’; বিশেষণে ঢাকা এসব চিত্রায়ণের পর রবীন্দ্রনাথ স্বীকারোক্তি করছেন, ‘জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম য়ুরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল।’ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য কী রেখে গেলেন?
রবীন্দ্রনাথ দিয়ে গেলেন বিপুল সাহিত্যসম্ভার, বিকশিত বাংলা ভাষা, বহুবিধ সাংস্কৃতিক কৃত্য, জাতীয় চৈতন্য আর এক সর্বগ্রাহী মন। বাঙালির মনে অবচেতনে রেখে গেলেন স্বপ্নগ্রস্ত ‘ইউটোপিয়া’। শান্তিনিকেতন, তপোবন, আশ্রমকেন্দ্রিক প্রকল্পনা এখনো ধরা দেয় কোনো কোনো বাঙালির স্বপ্ন ও কল্পনায়। ব্রাহ্মধর্ম ও ব্রহ্মবিশ্বাসের সুতো দিয়ে বেঁধে নিয়ে এই ইউটোপিয়াকে যাঁরা পড়তে চান, তাঁরা পড়তে পারেন; তার আগে কল্পনা করে দেখুন, একজন দিগন্তবিহারী কবি মগ্ন হয়ে ভাবছেন প্রকৃতি-আশ্রিত শিক্ষা প্রসঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে যোগ করে নিচ্ছেন উৎসব ও আনন্দকে, সনাতন গ্রাম-কৃষি ও কৃষকের সম্পর্ককে দিতে চাইছেন নতুন এক বন্দোবস্ত, প্রকৃতি ও মানুষের চিরায়ত সম্বন্ধকে বুঝতে চাইছেন দার্শনিক ও প্রায়োগিকভাবে। একালে এই সব ভাবনা কি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে? রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার বিপরীতে হাল আমলের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বঙ্গদেশে এত হাহাকার কেন? প্রকৃতি কিংবা ছয় ঋতু ‘গেল গেল’, ‘নেই নেই’ বলে এত কোলাহল কেন? অসহিষ্ণু মন নিয়ে কেন এত মাথাব্যথা আমাদের?
সত্যি বলতে কি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির জন্য এক মহাবয়ান। ‘উচ্চ সংস্কৃতি’র অভিযোগে মামলা দায়ের করে এই বয়ানের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা যায়; একে ভাঙা যায়, হ্যাঁচকা টানও দেওয়া যায়, কিন্তু উপড়ে ফেলা যায় না। যদি তা-ই হতো, রুশ বিপ্লবের পর একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়তেন লিয়েফ তলস্তয়। উল্টো ভ্লাদিমির লেনিন তাঁকে বললেন রুশ বিপ্লবের দর্পণ। এই ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতীককে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নবায়নও করে নিতে হয়। যেমন শেক্সপিয়র নবায়িত হন ভিন্ন দেশের ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষার ভেতর দিয়ে, যেমন বহু ভাষায় নবায়িত হয়েছেন হোমার। আমরা কি প্রস্তুত রবীন্দ্রনাথকে ‘নতুন করে পাবো বলে’? নাকি তাঁকে আটকে রাখব প্রাতিষ্ঠানিক খোঁয়াড়ে? তাঁর সাহিত্য ও সৃষ্টিশীলতাকে কতখানি ভাঙব, কতখানি গড়ব, প্যারোডি আর ক্যারিকেচারের ঠোঙায় কতখানি মোড়াব তাঁর লেখাকে—সেটুকু কাণ্ডজ্ঞান কি আমাদের হয়েছে? নাকি জ্ঞানকাণ্ডের বোঝার ভারে মূলসহ নিজেরাই উপড়ে পড়ছি লন্ডভণ্ড কাণ্ডকারখানায়?
দ্য ভেজিটেরিয়ানের পর হান কাঙের পরের উপন্যাস ছিল ‘দ্য উইন্ড ব্লোজ, গো’। এই উপন্যাস লেখার সময়ই ঘটে বিপত্তি! হান অনুভব করেন তিনি আর লিখতে পারছেন না। গত বছর নিজের পঞ্চম উপন্যাস ‘গ্রিক লেসন’ ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হলে স্পেনের এল-পাইস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি।
২১ দিন আগে‘প্রগাঢ় কাব্যিক গদ্যে ঐতিহাসিক ক্ষত তুলে ধরা এবং মানবজীবনের নাজুক পরিস্থিতির উন্মোচনের জন্য’ তাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান পুরস্কারের জন্য বেছে নিয়েছে নোবেল কমিটি।
২১ দিন আগেতানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর জন্মদিন উপলক্ষে ‘দশম জাতীয় ত্বকী চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতা’–এর আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের প্রথম দশ জনকে সনদ, বই ও ক্রেস্ট দেওয়া হবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীকে বই, বিশেষ ক্রেস্ট ও সনদ এবং প্রথম স্থান অধিকারীকে ‘ত্বকী পদক ২০২৪’ দেওয়া হবে। প্রতিযোগিতায় বিজয়ী
০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও পরে সরকার পতনের আন্দোলনে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতারা আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁদের কর্মকাণ্ডে প্রতীয়মান তাঁরা গণহত্যার সমর্থক। এ কারণে একটি গণ আদালত গঠন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের এই নেতাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি জানিয়েছে উদীচী।
১৭ আগস্ট ২০২৪