Ajker Patrika

হানিয়া হত্যা ও বৈরুতে হামলা: মধ্যপ্রাচ্যে বেজে উঠল কি যুদ্ধের দামামা

আব্দুর রহমান
আপডেট : ৩১ জুলাই ২০২৪, ১৮: ২২
হানিয়া হত্যা ও বৈরুতে হামলা: মধ্যপ্রাচ্যে বেজে উঠল কি যুদ্ধের দামামা

৩১ জুলাই, ২০২৪—মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের জন্য হতে পারে যুগান্তকারী দিন। লাগাতার ইসরায়েলের বর্বরতম আক্রমণে জর্জরিত অঞ্চলটিতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়ার হত্যাকাণ্ড। ইরানের রাজধানী তেহরানে গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন তিনি। তাঁকে বিমান হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে হামাস। 

অন্যদিকে লেবাননের রাজধানী বৈরুতেও হামলা করেছে ইসরায়েল। এই হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডার ফুয়াদ শুক্‌রি নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে ইসরায়েল। দুটি ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিকে নতুন সন্ধিক্ষণে এনে দাঁড় করিয়েছে। তবে কি মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ বিস্তৃত ও সর্বাত্মক রূপ নিতে যাচ্ছে—এই প্রশ্ন ভাবিয়ে তুলছে বিশ্লেষকদের।

গত বছরের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে গাজা ও লেবানন সীমান্ত—দুটি ফ্রন্টে লড়াই চলছে। তবে মঙ্গলবার মাঝরাতের কাছাকাছি সময়ে সীমান্ত ডিঙিয়ে বৈরুতে হামলা এবং তেহরানে ইসমাইল হানিয়ার হত্যাকাণ্ড দুই রণক্ষেত্রকে আরও বিস্তৃত করতে পারে। হানিয়ার হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে হামাস। ইরানের মাটিতে হানিয়ার মৃত্যুর জবাব তেহরান কীভাবে দেবে, সেটিও ভাবার বিষয়। 
 
হামাসের জ্যেষ্ঠ মুখপাত্র সামি আবু জুহরি ইসমাইল হানিয়া হত্যাকাণ্ডকে ‘গুরুতর উসকানি’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, এ ঘটনার পর হামাস জেরুজালেম মুক্ত করার জন্য সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর হুমকি দিয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনে যেকোনো মূল্য দিতে তারা প্রস্তুত। গোষ্ঠীটির অন্যতম শীর্ষ নেতা মুসা আবু মারজুকও বলেছেন, ইসমাইল হানিয়াকে হত্যার জন্য যে ‘কাপুরুষোচিত হামলা’ হয়েছে, তার জবাব দেওয়া হবে। 

অবশ্য ইসমাইল হানিয়াকে হত্যার ঘটনায় খুব একটা অবাক হননি বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, হামাস নেতাদের হত্যা ইসরায়েলের ঘোষিত নীতি। এ বিষয়ে কাতার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হাসসান বারারি বলেন, ‘এটি ইসরায়েলের প্রকাশ্য নীতি। (ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন) নেতানিয়াহু একাধিকবার বলেছেন, গাজার বাইরে বা ভেতরে—যেখানেই হোক, তাঁর দেশ হামাসের নেতাদের হত্যার লক্ষ্যবস্তু করবে।’

তবে ইরানের মাটিতে ঘটনাটি ঘটায় বেশ অবাক হয়েছেন হাসসান। তিনি বলেন, ‘এটি স্পষ্ট যে তারা (ইসরায়েল) হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে। কিন্তু আমি আশা করিনি, এটা তেহরানের মাটিতে ঘটবে। কারণ, আমরা দেখেছি, ইসরায়েল যখন দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলা চালিয়েছিল, তখন ইরান কীভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কীভাবে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে একটি বিস্তৃত যুদ্ধ ঠেকিয়ে দিয়েছিল।’ 

সে সময় যুদ্ধের আশঙ্কা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তেহরানে হানিয়াকে লক্ষ্যবস্তু করার মাধ্যমে তেল আবিব বড় ঝুঁকি নিয়েছে বলে মনে করেন বারারি। তিনি বলেন, ‘এটি ইরান ও অন্য সবার জন্য স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে ইসরায়েল যুদ্ধ চালিয়ে যেতে প্রস্তুত।’ মার্কিন দূতিয়ালি উপেক্ষা করে লেবাননের রাজধানীতে ইসরায়েলি হামলার মধ্য দিয়ে বারারির কথাই যেন প্রতিফলিত হয়।

তবে গুপ্তহত্যার শিকার প্রথম হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া নন। আরও অনেককে হত্যা করা হয়েছে। হাসসান বারারির মতে, ২০০৪ সালে তারা (ইসরায়েল) হামাসের প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ ইয়াসিনকে হত্যা করে। এক মাস পর হামাসের প্রধান আবদ আল-আজিজ আল-রানতিসিকেও হত্যা করে। এবার সেই তালিকায় যুক্ত হলেন হানিয়া। বারারি বলেন, ‘তবে এসব হত্যাকাণ্ড হামাসকে নির্মূল করতে পারেনি।’ 

ইসমাইল হানিয়ার হত্যাকাণ্ড ও বৈরুতে ইসরায়েলি হামলার পর লেবানন, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলে ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এ ঘটনাগুলোর ফলে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন আরও তীব্র হতে পারে। আবার ইসরায়েলে হিজবুল্লাহর হামলা আরও বাড়তে পারে। এরই মধ্যে ইসরায়েলের সেনা অবস্থানকে লক্ষ্য করে হিজবুল্লাহ একাধিক রকেট-ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। একই সঙ্গে ইসরায়েলের এই ‘হামলার জবাব’ দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে তারা।

গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন তীব্র হওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ, কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা গোপন সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, হামাসের শীর্ষ নেতাদের হত্যা বা পাকড়াও করার জন্য নেতানিয়াহু তাঁর বাহিনীগুলোকে বারবার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন। তবে বিপরীত চিত্রও আছে। যেহেতু হামাসের প্রধান নিহত হয়েছেন, তাই জিম্মি মুক্ত করে দ্রুত যুদ্ধ বন্ধ করার ক্ষেত্রে নেতানিয়াহুর ওপর চাপ আরও বাড়তে পারে।

ইসরায়েলি নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাফ ওরিয়ন বলেছেন, হানিয়াকে হত্যার পর ইসরায়েলের ওপর হামাসের আঘাত এখন কেবল আর গাজা থেকে আসবে না, তা সামি জুহরির কথা থেকেও স্পষ্ট। তিনি স্পষ্টভাবেই জেরুজালেম পুনরুদ্ধার ও দখলের ঘোষণা দিয়েছেন। 

এ বিষয়ে তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র গবেষক ও ডায়ানে অ্যান্ড গিলফোর্ড গ্লেজার ইসরায়েল-চীন পলিসি সেন্টারের পরিচালক আসাফ ওরিওন আরও বলেন, ‘হামাস গাজা থেকে ব্যাপক প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য লড়াই করতে পারে। তবে সম্ভবত তারা পশ্চিম তীর থেকেও ইসরায়েলে আক্রমণের চেষ্টা করবে।’ তিনি বলছেন, এমনকি হামাস বিদেশের মাটি থেকেই ইসরায়েলে হামলা চালাতে পারে; বিশেষ করে সিরিয়া ও লেবানন থেকে। 

বৈরুতে ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত ভবন। ছবি: এএফপি এখন প্রশ্ন হলো, হানিয়া যেহেতু ইরানের মাটিতে নিহত হয়েছেন এবং অভিযোগের তির চিরশত্রু ইসরায়েলের দিকে। তাই এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ যে ইরান আসলে কীভাবে জবাব দেবে। হিজবুল্লাহ ও হামাস—উভয়ই ইরানের সমর্থনপুষ্ট এবং এক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স বা প্রতিরোধ অক্ষের অংশীদার, তাই এই বিষয়গুলো ইরানকে কঠোর জবাব দেওয়ার দিকে ঠেলে দিতে পারে। কিন্তু ইরানের জবাবে ইসরায়েল কী করবে—এসব মিলিয়ে একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। 

ইস্তাম্বুল জাইম ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইসলাম অ্যান্ড গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক সামি আল-আরিয়ান ইসরায়েলকে ‘নিয়ন্ত্রণহীন পাগলা কুকুর’ ও সন্ত্রাসী দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এটি (হানিয়ার হত্যাকাণ্ড) সারা বিশ্ব স্বীকৃত সভ্য রাষ্ট্রের আচরণ নয়। লেবাননে যা ঘটেছে, তেহরানে যা ঘটেছে—এগুলো এক বিশাল উসকানি এবং এর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ইসরায়েলের ওপর পড়তে যাচ্ছে।’ এ সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যেন দেশটি দুর্বৃত্ত ইসরায়েল রাষ্ট্রের লাগাম টেনে ধরে। 

ইসরায়েলি বিশ্লেষক আসাফ ওরিওনের মতে, ইরান-সমর্থিত বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রক্সি গোষ্ঠীগুলো আগামী দুই দিনের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে পারে। তিনি বলেন, ‘বৈরুত ও তেহরানে দুই নেতা হত্যার বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই প্রতিরোধ অক্ষকে আরও সক্রিয় করে তুলেছ। একই সঙ্গে গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মিলে ইরানের ইসরায়েলের ওপর হামলার বিষয়টি আলোচনার টেবিলের প্রধান মেনুতে পরিণত করেছে।’ 

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা, রয়টার্স, টাইমস অব ইসরায়েল, আল-মায়েদিন ও সিএনএন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মুসলিম থেকে খ্রিষ্টান হওয়া ইরানি নারী এখন পানামার জঙ্গলে

বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা হলেই মেয়াদ শেষ নতুন পরিচালনা কমিটির

ঢাবি ছাত্রীকে যৌন হেনস্তাকারীর পক্ষে নামা ‘তৌহিদী জনতার’ আড়ালে এরা কারা

এনসিপিকে চাঁদা দিচ্ছেন ধনীরা, ক্রাউডফান্ডিং করেও অর্থ সংগ্রহ করা হবে: নাহিদ ইসলাম

ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান, সন্তানসহ ছিটকে পড়তেই তরুণীর গালে ছুরিকাঘাত

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত