গোলাম ওয়াদুদ
বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতি ও এর নিয়ন্ত্রণ এবং জনজীবন—এই মিলিয়ে একটা শাঁখের করাতের ওপরই পড়া গেছে বলা যায়। করোনার বিস্তার রোধে সত্যিকার অর্থে লকডাউন কার্যকরের কোনো বিকল্প নেই। আবার তেমন লকডাউন আরোপ হলে নিম্ন আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে।
এই পুরো করোনাকালে বাংলাদেশের মানুষের নানা ধরনের লকডাউনের অভিজ্ঞতা হচ্ছে। কোনোটি লকডাউন, কোনোটি কঠোর, কোনোটি সর্বাত্মক, আবার কোনোটি শিথিল। সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রেই ‘বিধিনিষেধ’ শব্দটি সতর্কতার সঙ্গে প্রয়োগ করলেও সাধারণ্যে তা ‘লকডাউন’ হিসেবেই গ্রাহ্য হচ্ছে। বাংলাদেশ এই মুহূর্তে সংক্রমণ ও মৃত্যু—দুই বিচারেই করোনার সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেও সরকার গত দুই সপ্তাহের কঠোর বিধিনিষেধ আট দিনের জন্য শিথিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে বলছেন, এই সিদ্ধান্তের কারণে পস্তাতে হবে। প্রশ্ন যা রয়েছে, তা হলো মাত্রা নিয়ে।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) থেকে ২২ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ঈদুল আজহা উদ্যাপন, জনসাধারণের যাতায়াত, ঈদ–পূর্ববর্তী ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে আরোপিত সব বিধিনিষেধ শিথিল করা হলো। একই প্রজ্ঞাপনে আগামী ২৩ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আবারও কঠোর বিধিনিষেধ জারির ঘোষণাও দিয়েছে সরকার।
কথা হলো, ঈদুল আজহা উদ্যাপন, জনসাধারণের যাতায়াত ও দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার যে উল্লেখ প্রজ্ঞাপনে করা হয়েছে, তা কাঠগড়ায় দাঁড়ায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের পরবর্তী তারিখটির দিকে তাকালে। ঈদের পর মাত্র একদিন বিধিনিষেধ শিথিল রাখলে জনসাধারণের যাতায়াত কী প্রকারে সহজ হবে, তা ঠিক বোধগম্য নয়। বলা হয়েছে, আর্থ–সামাজিক পরিস্থিতির কথা। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন প্রায় পুরোপুরি শহরনির্ভর। ফলে ঈদের আগের শিথিল লকডাউনের সময়ে গ্রামের বাড়িতে ফেরা মানুষেরা জীবিকার জন্য শহরে ফিরবেন কীভাবে? আর ফিরতে না পারলে, তার প্রভাব সার্বিক আর্থসামাজিক পরিস্থিতির ওপর কেমন হবে?
এই দুই প্রশ্নের ভিতে দাঁড়িয়ে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, কেন্দ্রকে করোনার হাত থেকে বাঁচাতেই বোধ হয় এমন পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। বিশেষত ঢাকার মতো জনবহুল শহরগুলো এই শিথিল লকডাউনের সময়ে ফাঁকা হলে করোনা নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে বলে হয়তো প্রশাসন মনে করছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, করোনা এখন আর কেন্দ্রে আবদ্ধ নেই। বছরের শুরুর দিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ও ঢাকার চট্টগ্রামের মতো শহরই ছিল ভাইরাসটির বিস্তারের মূল কেন্দ্র। কিন্তু গেল ঈদুল ফিতরের সময় গ্রামমুখী মানুষের ঢল, সীমান্ত এলাকাগুলোয় নজরদারির অভাবের কারণে এই কেন্দ্র এখন অতীত। করোনা এখন আর কেন্দ্রে আবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে পড়েছে বিভাগ থেকে জেলায়। খুলনা, রাজশাহী, ময়মনসিংহে আক্রান্তের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী। গ্রাম পর্যায়ে সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বাড়ছে বলে আগেই খবর বেরিয়েছে। এই সময়ে লকডাউন শিথিলের মতো সিদ্ধান্ত তাই সংক্রমণ ঝুঁকি আরও বাড়াবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
যখন দেশে সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে তখন সরকারের এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। যেখানে বিশেষজ্ঞরা কারফিউ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেখানে করা হলো শিথিল। ঈদ–পরবর্তী দেশের কেমন চিত্র হতে পারে, তা এরই মধ্যে আলোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারের এমন সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরি বলেছেন, বর্তমানে বাংলাদেশে যে বিধিনিষেধ রয়েছে, সেটা অসম্পূর্ণ। সামনে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বিজ্ঞানসম্মত স্টান্ডার্ড লকডাউন এবং কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত। এটা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বিজ্ঞানসম্মত পদক্ষেপ। লকডাউন শিথিল করা মানে হলো সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া, রোগীর সংখ্যা বাড়া, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়া, হাসপাতালে রোগীর উপচে পড়া ভিড় হওয়ার আশঙ্কা।
এই শঙ্কা এরই মধ্যে প্রকাশ করেছেন করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ডা. ইকবাল আর্সলান। তাঁর মতে, দুই সপ্তাহের দেওয়া লকডাউনের ফল কিছুটা হলেও পাওয়া যাবে। তবে সংক্রমণের চূড়ার মাঝেই বিধিনিষেধ শিথিল করায় সামনে ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। ঈদে ঘরমুখো মানুষের স্রোত ও পশু কেনাকে কেন্দ্রকে আগামী এক সপ্তাহ অবাধে চলবে মানুষ। পাশাপাশি হাটবাজার, শপিংমলে মানুষের ব্যাপক ভিড় দেখা যাবে। ফলে সংক্রমণের মাত্রা আরও বাড়বে।
লকডাউন শিথিলের কারণে ঈদের পর করোনা পরিস্থিতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদও। সব মিলিয়ে বিধিনিষেধ শিথিলের এই সিদ্ধান্তের কারণে ঈদের পর করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেওয়ার শঙ্কা নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে অন্তত কোনো দ্বিমত নেই। তাহলে এই সিদ্ধান্ত কেন? একটু আগেই বলা হয়েছে, লকডাউন শিথিল করার সময়সীমার দিকে তাকালে একটি অঘোষিত লক্ষ্যের দিশা পাওয়া যায়। জনবহুল শহরগুলোকে ফাঁকা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের এটা একটা চেষ্টা বলা যেতে পারে। অনুমানটি আরও প্রবল হয়, যখন ঈদ–পরবর্তী কঠোর লকডাউনের সময় কারখানাও বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ, প্রশাসন চাইছে, ঈদের এই সময়ে যারা শহর ছাড়ল, তারা যেন ২৩ তারিখ থেকে আরোপ হওয়ার অপেক্ষায় থাকা কঠোর বিধিনিষেধ উঠলেই কেবল ফেরেন।
প্রশ্ন হলো—শহর বাঁচাতে এই যে পদক্ষেপটি নেওয়া হলো, তা কি শেষ রক্ষা করতে পারবে? নাকি এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গ্রাম ও প্রত্যন্ত জনপদকেও এক রকম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে? ঈদুল ফিতরের সময় নেওয়া সিদ্ধান্ত এবং তার পরবর্তী পরিস্থিতি অন্তত দ্বিতীয় প্রশ্নটিকে জোরালো করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদের আগে মানুষের যাতায়াতের জন্য আট দিনের সময় দেওয়ার মধ্য দিয়ে পুরো দেশে সংক্রমণ আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার রাস্তা তৈরি হলো। আর ঈদের পর কর্মক্ষেত্রে ফেরার জন্য মাত্র একদিন সময় রাখার কারণে একসঙ্গে বহু মানুষ একই সময়ে শহরগুলোয় ফেরার চেষ্টা করবেন। ফলে পরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানাটা হয়ে যাবে কাগুজে বিষয়। এতে সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়বে ভয়াবহভাবে। অর্থাৎ, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে শহর বা গ্রাম কোনোটারই উপকৃত হওয়ার কিছু নেই। বরং রয়েছে বড় ঝুঁকি।
সরকার গত রোজার ঈদে কঠোর বিধিনিষেধ দিয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল, লাখ লাখ মানুষ বিভিন্ন পন্থায় রাজধানী ছাড়লেন। আবার ঠিক একইভাবে ঈদের পর রাজধানীতে প্রবেশ করলেন। এর ফল কী হয়েছে, তা এখন হাড়ে হাড়ে সবাই টের পাচ্ছে। রোজার ঈদের আগে সংক্রমণের হার সামান্য ঊর্ধ্বমুখী ছিল। ঈদ যাত্রার পর সংক্রমণ বাড়ল লাফিয়ে লাফিয়ে। রোজার ঈদের পর বিভিন্ন সময় কঠোর লকডাউন বা বিধিনিষেধের ঘোষণা দিলেও সঠিকভাবে তা পালন করা হয়নি। ফলে আমরা এখন প্রতিদিনের মৃত্যুর তালিকায় বিশ্বে চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছি। গত দুই সপ্তাহ ধরে করোনায় একদিনে দেশে মৃত্যু সংখ্যা ২০০ বা তার আশপাশে অবস্থান করছে। শনাক্তের হারও অনেক। কোনো দিন মৃত্যুর রেকর্ড হচ্ছে, আবার কোনো দিন হচ্ছে শনাক্তের রেকর্ড।
যদি গত এক সপ্তাহের হিসেবের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে, গত ৮ জুলাই করোনায় মৃত্যু হয়েছে ১৯৯ জনের, শনাক্ত ১১ হাজার ৬৫১ জন। পরদিন মৃত্যু বেড়ে দাঁড়াল ২১২ জনে, এদিন শনাক্ত কমে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৩২৪ জন। ১০ জুলাই মৃত্যু আবার কমে ১৮৫ জনে এবং শনাক্ত সংখ্যা ৮ হাজার ৭৭২ জনে দাঁড়ায়। ঠিক পরদিন ১১ জুলাই এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা ২৩০ ছুঁল। আর শনাক্ত হলো ১১ হাজার ৮৭৪ জন। আজসহ পরের তিন দিনও মৃত্যু সংখ্যা ২০০–এর ওপরে অবস্থান করছে। আজ ১৪ জুলাই এ সংখ্যা ২১০ বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
গত সাত দিনের পরিস্থিতি দেখেই বোঝা যায় করোনার ভয়াবহতা। এই সাত দিন যদি বিভাগীয় এবং জেলা শহরের দিকে তাকাই তাহলে পরিসংখ্যানটি আঁতকে ওঠার মতো। দৈনিক এই মৃত্যু সংখ্যার বেশির ভাগই হচ্ছে জেলা বা বিভাগীয় শহরে। ভারতের ডেলটা ভেরিয়্যান্ট শনাক্ত হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে সীমান্তবর্তী খুলনা, রাজশাহী বিভাগে বেশি মানুষের মৃত্যু ও শনাক্ত হচ্ছে। প্রতিদিন রাজশাহী মেডিকেল, খুলনা মেডিকেল, চট্টগ্রাম মেডিকেলসহ জেলা শহরের হাসপাতালগুলোতে মৃত্যু বাড়ছে। আক্রান্ত বাড়া মানে কিন্তু চিকিৎসা দেওয়ার সীমিত সক্ষমতায় টান পড়াও। আর চিকিৎসা সেবার পরিসরটি সংকুচিত হওয়া মানে মৃত্যু সংখ্যা বেড়ে যাওয়া।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে দেশের স্বাস্থ্য সেবা এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতেই পর্যাপ্ত আইসিইউ নেই। নেই অক্সিজেন। আর জেলার হাসপাতালে তো এসব অপ্রতুল। নেই ন্যাজল ক্যানাল। কয়েক দিন আগে বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ন্যাজল ক্যানালের সংকটে ঝরে গেল বহু প্রাণ। এমন অবস্থা প্রায় সব জেলাতেই রয়েছে। ফলে করোনার সংক্রমণ গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে যাওয়ার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।
যে মানুষগুলো শহর ছেড়ে গ্রামে যাবে তারা কি সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানবে? আর উপজেলা বা গ্রামে কি সঠিকভাবে কোয়ারেন্টিন করা যায়, না মানা হয়? যেখানে প্রশাসনের নাকের ডগায় বসেই মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা, সেখানে নিজ পরিসরে গিয়ে তা মানবে—এমন চাওয়া কি হাস্যকর নয়? ফলে সামনে যে ভয়াবহ কিছু অপেক্ষা করছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এর মাত্রা কত—তা এখনই বলা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা শুধু সতর্ক করে বারবার বলছেন—এই সিদ্ধান্তের কারণে সামনে খুব বাজে সময় অপেক্ষা করছে।
বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতি ও এর নিয়ন্ত্রণ এবং জনজীবন—এই মিলিয়ে একটা শাঁখের করাতের ওপরই পড়া গেছে বলা যায়। করোনার বিস্তার রোধে সত্যিকার অর্থে লকডাউন কার্যকরের কোনো বিকল্প নেই। আবার তেমন লকডাউন আরোপ হলে নিম্ন আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে।
এই পুরো করোনাকালে বাংলাদেশের মানুষের নানা ধরনের লকডাউনের অভিজ্ঞতা হচ্ছে। কোনোটি লকডাউন, কোনোটি কঠোর, কোনোটি সর্বাত্মক, আবার কোনোটি শিথিল। সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রেই ‘বিধিনিষেধ’ শব্দটি সতর্কতার সঙ্গে প্রয়োগ করলেও সাধারণ্যে তা ‘লকডাউন’ হিসেবেই গ্রাহ্য হচ্ছে। বাংলাদেশ এই মুহূর্তে সংক্রমণ ও মৃত্যু—দুই বিচারেই করোনার সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেও সরকার গত দুই সপ্তাহের কঠোর বিধিনিষেধ আট দিনের জন্য শিথিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে বলছেন, এই সিদ্ধান্তের কারণে পস্তাতে হবে। প্রশ্ন যা রয়েছে, তা হলো মাত্রা নিয়ে।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) থেকে ২২ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ঈদুল আজহা উদ্যাপন, জনসাধারণের যাতায়াত, ঈদ–পূর্ববর্তী ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে আরোপিত সব বিধিনিষেধ শিথিল করা হলো। একই প্রজ্ঞাপনে আগামী ২৩ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আবারও কঠোর বিধিনিষেধ জারির ঘোষণাও দিয়েছে সরকার।
কথা হলো, ঈদুল আজহা উদ্যাপন, জনসাধারণের যাতায়াত ও দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার যে উল্লেখ প্রজ্ঞাপনে করা হয়েছে, তা কাঠগড়ায় দাঁড়ায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের পরবর্তী তারিখটির দিকে তাকালে। ঈদের পর মাত্র একদিন বিধিনিষেধ শিথিল রাখলে জনসাধারণের যাতায়াত কী প্রকারে সহজ হবে, তা ঠিক বোধগম্য নয়। বলা হয়েছে, আর্থ–সামাজিক পরিস্থিতির কথা। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন প্রায় পুরোপুরি শহরনির্ভর। ফলে ঈদের আগের শিথিল লকডাউনের সময়ে গ্রামের বাড়িতে ফেরা মানুষেরা জীবিকার জন্য শহরে ফিরবেন কীভাবে? আর ফিরতে না পারলে, তার প্রভাব সার্বিক আর্থসামাজিক পরিস্থিতির ওপর কেমন হবে?
এই দুই প্রশ্নের ভিতে দাঁড়িয়ে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, কেন্দ্রকে করোনার হাত থেকে বাঁচাতেই বোধ হয় এমন পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। বিশেষত ঢাকার মতো জনবহুল শহরগুলো এই শিথিল লকডাউনের সময়ে ফাঁকা হলে করোনা নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে বলে হয়তো প্রশাসন মনে করছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, করোনা এখন আর কেন্দ্রে আবদ্ধ নেই। বছরের শুরুর দিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ও ঢাকার চট্টগ্রামের মতো শহরই ছিল ভাইরাসটির বিস্তারের মূল কেন্দ্র। কিন্তু গেল ঈদুল ফিতরের সময় গ্রামমুখী মানুষের ঢল, সীমান্ত এলাকাগুলোয় নজরদারির অভাবের কারণে এই কেন্দ্র এখন অতীত। করোনা এখন আর কেন্দ্রে আবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে পড়েছে বিভাগ থেকে জেলায়। খুলনা, রাজশাহী, ময়মনসিংহে আক্রান্তের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী। গ্রাম পর্যায়ে সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বাড়ছে বলে আগেই খবর বেরিয়েছে। এই সময়ে লকডাউন শিথিলের মতো সিদ্ধান্ত তাই সংক্রমণ ঝুঁকি আরও বাড়াবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
যখন দেশে সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে তখন সরকারের এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। যেখানে বিশেষজ্ঞরা কারফিউ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেখানে করা হলো শিথিল। ঈদ–পরবর্তী দেশের কেমন চিত্র হতে পারে, তা এরই মধ্যে আলোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারের এমন সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরি বলেছেন, বর্তমানে বাংলাদেশে যে বিধিনিষেধ রয়েছে, সেটা অসম্পূর্ণ। সামনে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বিজ্ঞানসম্মত স্টান্ডার্ড লকডাউন এবং কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত। এটা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বিজ্ঞানসম্মত পদক্ষেপ। লকডাউন শিথিল করা মানে হলো সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া, রোগীর সংখ্যা বাড়া, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়া, হাসপাতালে রোগীর উপচে পড়া ভিড় হওয়ার আশঙ্কা।
এই শঙ্কা এরই মধ্যে প্রকাশ করেছেন করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ডা. ইকবাল আর্সলান। তাঁর মতে, দুই সপ্তাহের দেওয়া লকডাউনের ফল কিছুটা হলেও পাওয়া যাবে। তবে সংক্রমণের চূড়ার মাঝেই বিধিনিষেধ শিথিল করায় সামনে ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। ঈদে ঘরমুখো মানুষের স্রোত ও পশু কেনাকে কেন্দ্রকে আগামী এক সপ্তাহ অবাধে চলবে মানুষ। পাশাপাশি হাটবাজার, শপিংমলে মানুষের ব্যাপক ভিড় দেখা যাবে। ফলে সংক্রমণের মাত্রা আরও বাড়বে।
লকডাউন শিথিলের কারণে ঈদের পর করোনা পরিস্থিতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদও। সব মিলিয়ে বিধিনিষেধ শিথিলের এই সিদ্ধান্তের কারণে ঈদের পর করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেওয়ার শঙ্কা নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে অন্তত কোনো দ্বিমত নেই। তাহলে এই সিদ্ধান্ত কেন? একটু আগেই বলা হয়েছে, লকডাউন শিথিল করার সময়সীমার দিকে তাকালে একটি অঘোষিত লক্ষ্যের দিশা পাওয়া যায়। জনবহুল শহরগুলোকে ফাঁকা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের এটা একটা চেষ্টা বলা যেতে পারে। অনুমানটি আরও প্রবল হয়, যখন ঈদ–পরবর্তী কঠোর লকডাউনের সময় কারখানাও বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ, প্রশাসন চাইছে, ঈদের এই সময়ে যারা শহর ছাড়ল, তারা যেন ২৩ তারিখ থেকে আরোপ হওয়ার অপেক্ষায় থাকা কঠোর বিধিনিষেধ উঠলেই কেবল ফেরেন।
প্রশ্ন হলো—শহর বাঁচাতে এই যে পদক্ষেপটি নেওয়া হলো, তা কি শেষ রক্ষা করতে পারবে? নাকি এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গ্রাম ও প্রত্যন্ত জনপদকেও এক রকম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে? ঈদুল ফিতরের সময় নেওয়া সিদ্ধান্ত এবং তার পরবর্তী পরিস্থিতি অন্তত দ্বিতীয় প্রশ্নটিকে জোরালো করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদের আগে মানুষের যাতায়াতের জন্য আট দিনের সময় দেওয়ার মধ্য দিয়ে পুরো দেশে সংক্রমণ আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার রাস্তা তৈরি হলো। আর ঈদের পর কর্মক্ষেত্রে ফেরার জন্য মাত্র একদিন সময় রাখার কারণে একসঙ্গে বহু মানুষ একই সময়ে শহরগুলোয় ফেরার চেষ্টা করবেন। ফলে পরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানাটা হয়ে যাবে কাগুজে বিষয়। এতে সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়বে ভয়াবহভাবে। অর্থাৎ, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে শহর বা গ্রাম কোনোটারই উপকৃত হওয়ার কিছু নেই। বরং রয়েছে বড় ঝুঁকি।
সরকার গত রোজার ঈদে কঠোর বিধিনিষেধ দিয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল, লাখ লাখ মানুষ বিভিন্ন পন্থায় রাজধানী ছাড়লেন। আবার ঠিক একইভাবে ঈদের পর রাজধানীতে প্রবেশ করলেন। এর ফল কী হয়েছে, তা এখন হাড়ে হাড়ে সবাই টের পাচ্ছে। রোজার ঈদের আগে সংক্রমণের হার সামান্য ঊর্ধ্বমুখী ছিল। ঈদ যাত্রার পর সংক্রমণ বাড়ল লাফিয়ে লাফিয়ে। রোজার ঈদের পর বিভিন্ন সময় কঠোর লকডাউন বা বিধিনিষেধের ঘোষণা দিলেও সঠিকভাবে তা পালন করা হয়নি। ফলে আমরা এখন প্রতিদিনের মৃত্যুর তালিকায় বিশ্বে চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছি। গত দুই সপ্তাহ ধরে করোনায় একদিনে দেশে মৃত্যু সংখ্যা ২০০ বা তার আশপাশে অবস্থান করছে। শনাক্তের হারও অনেক। কোনো দিন মৃত্যুর রেকর্ড হচ্ছে, আবার কোনো দিন হচ্ছে শনাক্তের রেকর্ড।
যদি গত এক সপ্তাহের হিসেবের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে, গত ৮ জুলাই করোনায় মৃত্যু হয়েছে ১৯৯ জনের, শনাক্ত ১১ হাজার ৬৫১ জন। পরদিন মৃত্যু বেড়ে দাঁড়াল ২১২ জনে, এদিন শনাক্ত কমে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৩২৪ জন। ১০ জুলাই মৃত্যু আবার কমে ১৮৫ জনে এবং শনাক্ত সংখ্যা ৮ হাজার ৭৭২ জনে দাঁড়ায়। ঠিক পরদিন ১১ জুলাই এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা ২৩০ ছুঁল। আর শনাক্ত হলো ১১ হাজার ৮৭৪ জন। আজসহ পরের তিন দিনও মৃত্যু সংখ্যা ২০০–এর ওপরে অবস্থান করছে। আজ ১৪ জুলাই এ সংখ্যা ২১০ বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
গত সাত দিনের পরিস্থিতি দেখেই বোঝা যায় করোনার ভয়াবহতা। এই সাত দিন যদি বিভাগীয় এবং জেলা শহরের দিকে তাকাই তাহলে পরিসংখ্যানটি আঁতকে ওঠার মতো। দৈনিক এই মৃত্যু সংখ্যার বেশির ভাগই হচ্ছে জেলা বা বিভাগীয় শহরে। ভারতের ডেলটা ভেরিয়্যান্ট শনাক্ত হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে সীমান্তবর্তী খুলনা, রাজশাহী বিভাগে বেশি মানুষের মৃত্যু ও শনাক্ত হচ্ছে। প্রতিদিন রাজশাহী মেডিকেল, খুলনা মেডিকেল, চট্টগ্রাম মেডিকেলসহ জেলা শহরের হাসপাতালগুলোতে মৃত্যু বাড়ছে। আক্রান্ত বাড়া মানে কিন্তু চিকিৎসা দেওয়ার সীমিত সক্ষমতায় টান পড়াও। আর চিকিৎসা সেবার পরিসরটি সংকুচিত হওয়া মানে মৃত্যু সংখ্যা বেড়ে যাওয়া।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে দেশের স্বাস্থ্য সেবা এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতেই পর্যাপ্ত আইসিইউ নেই। নেই অক্সিজেন। আর জেলার হাসপাতালে তো এসব অপ্রতুল। নেই ন্যাজল ক্যানাল। কয়েক দিন আগে বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ন্যাজল ক্যানালের সংকটে ঝরে গেল বহু প্রাণ। এমন অবস্থা প্রায় সব জেলাতেই রয়েছে। ফলে করোনার সংক্রমণ গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে যাওয়ার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।
যে মানুষগুলো শহর ছেড়ে গ্রামে যাবে তারা কি সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানবে? আর উপজেলা বা গ্রামে কি সঠিকভাবে কোয়ারেন্টিন করা যায়, না মানা হয়? যেখানে প্রশাসনের নাকের ডগায় বসেই মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা, সেখানে নিজ পরিসরে গিয়ে তা মানবে—এমন চাওয়া কি হাস্যকর নয়? ফলে সামনে যে ভয়াবহ কিছু অপেক্ষা করছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এর মাত্রা কত—তা এখনই বলা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা শুধু সতর্ক করে বারবার বলছেন—এই সিদ্ধান্তের কারণে সামনে খুব বাজে সময় অপেক্ষা করছে।
ড. ইউনূস যখন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন পুরো জাতি তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল। তবে তাঁকে পরিষ্কারভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে যে, তিনি কীভাবে দেশ শাসন করবেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
৯ ঘণ্টা আগেসম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
১ দিন আগেএকটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলো
১ দিন আগেট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
৩ দিন আগে