Ajker Patrika

টুইটারের মন নাচাইয়া ইলন যায় চলিয়া

অর্ণব সান্যাল
আপডেট : ০৯ জুলাই ২০২২, ১৮: ৩১
টুইটারের মন নাচাইয়া ইলন যায় চলিয়া

প্রথমে এল চমক জাগানিয়া ঘোষণা। এর পর এল হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা, টুইটার বদলে ফেলেঙ্গা! এখন তিনি জানাচ্ছেন শর্তের কথা। বলছেন, তা পূরণ না হলে ‘খেলবেন’ না। ফলে সংশয় জাগছে—আদৌ কি টুইটার কেনার ইচ্ছে আছে ইলন মাস্কের? নাকি পুরোটাই ছল? 

না, পাঠক। এই সংশয় শুধু আমার মনে জেগেছে এমন নয়। পুরো প্রযুক্তি বিশ্বই এখন এ নিয়ে সরগরম। একদিকে ইলন মাস্ক বলছেন, টুইটারের ৫ শতাংশ বট ইউজারের পরিসংখ্যান প্রমাণ করতে হবে, নইলে টুইটার কেনা বন্ধ। আর অন্যদিকে টুইটার কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে, চাইলেই এভাবে ‘কিনব না’ বলা যায় না। প্রয়োজনে আদালতের রাস্তায় হাঁটার পরোক্ষ হুমকিও দিয়ে রেখেছে টুইটার। 

অবস্থাদৃষ্টে মনে গুনগুন করে ওঠে বাংলা সিনেমার সেই গানের লাইন—‘পাগলির মন নাচাইয়া পাগলা যায় চলিয়া…।’ কিন্তু ‘পাগলি’ টুইটারের পক্ষে কী ‘পাগলা’ ইলন মাস্ককে ধরে রাখা সম্ভব হবে? 

এই প্রশ্নের উত্তরের আগে এবার এই টাগ অব ওয়ারের আগের ঘটনার সারাংশ একটু জানা যাক। কিছুদিন আগে বিশাল ঘোষণা দিয়ে টুইটার কিনে ফেলার তথ্য জানিয়েছিলেন বিখ্যাত উদ্যোক্তা ও বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ক। টেসলাস্পেসএক্স দিয়ে খ্যাতি কুড়ানো ইলনের টুইটার কেনার ঘোষণায় পুরো প্রযুক্তি বিশ্বেই আলোড়ন ওঠে। ইলন দিয়েছিলেন ৪৪ বিলিয়ন ডলারে টুইটার কেনার ঘোষণা। এর পর টুইটার কর্তৃপক্ষও নির্দিষ্ট বিরতির পর তাতে সম্মতি জানিয়েছিল। আর তখন থেকেই ইলনের পক্ষ থেকে আসতে থাকে টুইটারের খোলনলচে পাল্টানোর হরেক রকমের কথা। 

ইলন মাস্কইলন জানিয়েছিলেন, তিনি টুইটারকে আরও ভালো অবস্থানে নিতে চান, এতে নিত্যনতুন ফিচার যোগ করতে চান। এমনকি টুইটারের অ্যালগরিদমও উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন ইলন। স্প্যাম প্রতিরোধের পাশাপাশি সব ব্যবহারকারীর পরিচয় নিশ্চিতের ব্যবস্থাও করার কথা বলেছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে টুইটারে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের কথা বলে বিতর্কও সৃষ্টি করেছিলেন। ইলন জানিয়েছিলেন, ‘আমি আশা করি, আমার সবচেয়ে কঠোর এবং বাজে সমালোচকও টুইটারে বহাল তবিয়তে থাকবেন। কারণ, এটাই হলো স্বাধীন মত বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা।’ যদিও সমালোচকেরা বলে আসছেন, এতে করে টুইটারে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর শঙ্কা সৃষ্টি হতে পারে। 

অথচ টুইটারে প্রধান ব্যক্তি হওয়ার গুঞ্জনের মধ্যেই দিন-দশেকের মাথায় গত ১৩ মে ইলন জানিয়ে দিলেন, টুইটার কেনা আপাতত অস্থায়ীভাবে স্থগিত। কারণ, টুইটারের মোট ব্যবহারকারীর ৫ শতাংশেরও কম অ্যাকাউন্ট স্প্যাম বা ভুয়া—টুইটারের এমন দাবি আমলে নেওয়া হয়েছে। আর এই দাবির সত্যাসত্য টুইটার প্রমাণ করতে না পারলে টুইটার আর কেনাই হবে না। 

টুইটারের সিইও পরাগ আগরওয়াল এর প্রত্যুত্তরও দিয়েছেন। তিনি বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যাও করেছেন। সেই সঙ্গে ইলন মাস্কের টুইটার অধিগ্রহণের বিষয়ে ব্যক্ত করেছেন আশাবাদও। 

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুয়া বা বট অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করা কোনো সহজ কাজ নয়। টুইটার কখনোই এ ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। শুধু টুইটার কেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কোনো প্ল্যাটফর্মের ক্ষেত্রেই নিজেদের ব্যবহারকারীদের মধ্যে ঠিক কতগুলো বট বা ভুয়া, সেটি নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। 

বিনিয়োগকারী সংস্থা ওয়েডবুশ সিকিউরিটিজের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ড্যান আইভস মনে করেন, যে বিষয়টি নিখুঁতভাবে প্রমাণ করাই সম্ভব নয়, সেটির ওপর ভিত্তি করে অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া থামিয়ে দেওয়া অর্থহীন। অন্তত শুধু ওই কারণে কারও পক্ষে সম্ভাব্য বিনিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। এটি একটি অজুহাত মাত্র। আর সেই অজুহাতকে সামনে রেখেই হয়তো নতুন খেলায় মেতেছেন ইলন মাস্ক

তা সেই নতুন খেলাটা কী? বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইলন হয়তো টুইটার অধিগ্রহণের বিনিময় মূল্য কমিয়ে আনতে চাইছেন। শুরুতে ৪৪ বিলিয়ন ডলারের বিশাল অঙ্কে টুইটার কেনার হিসাব করলেও, বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এত অর্থ খরচ করার হ্যাপা এখন তাঁর মাথায় চেপে বসেছে। টুইটার কেনার ঘোষণা দেওয়ার সময় প্রতিষ্ঠানটির প্রতি শেয়ার বাবদ ৫৪ দশমিক ২০ ডলার দিতে চেয়েছিলেন ইলন। কিন্তু ঘোষণাটি রাষ্ট্র হওয়ার পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের মূল্য বাজারে নিম্নমুখী হয়। চলতি সপ্তাহে টুইটারের প্রতি শেয়ারের মূল্য ছিল ৩৭ ডলার। ধারণা করা হচ্ছে, মাস্কের টুইটার না কেনার ঘোষণার পর শেয়ারের মূল্য আরও কমে যেতে পারে, এমনকি তা ৩০ ডলারের নিচেও নেমে যেতে পারে! 

twitterনিন্দুকেরা বলছেন, এমতাবস্থায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার খরচের বদলে আরও কমে টুইটার অধিগ্রহণ করার চিন্তা করতে পারেন ইলন মাস্ক। কারণ তাঁর প্রস্তাবিত অঙ্ক বাজারমূল্যের তুলনায় অনেক বেশি। কলাম লেখক ও সংশ্লিষ্ট খাত বিশেষজ্ঞ ম্যাট লেভিনের ভাষায়, ‘একটি বিষয় স্পষ্ট থাকা উচিত যে, মাস্ক আসলে মিথ্যা কথা বলছেন। স্প্যাম বট নিয়ে বিতর্ক অযথাই তোলা হয়েছে। তাঁর মূল লক্ষ্য, টুইটার অধিগ্রহণে কম অর্থ খরচ করা!’ 

আবার ইলন মূলত টুইটার কিনছেন তাঁর অন্যান্য ব্যবসা থেকে পাওয়া অর্থে। কিন্তু বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি নির্মাতা টেসলার বাজারমূল্য ২৯ শতাংশ কমে গেছে শুধু টুইটার কেনার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে আজতক! আবার শঙ্কা আছে যে, টুইটার অধিগ্রহণ করলে চীনে টেসলার ব্যবসা মার খেয়ে যেতে পারে। কারণ, চীনে টুইটার নিষিদ্ধ। তাই সবকিছু বিবেচনা করেই ইলন উল্টো রথে যাত্রা শুরু করেছেন বললে কি ভুল হবে? 

কিন্তু ইলনের উল্টো রথের যাত্রাটা স্বস্তির হচ্ছে না মোটেও। এটা তো মুদির দোকানে কেনাকাটা নয় যে, একবার নেবেন বলে পরে বাদ দেবেন! কারণ টুইটার যুদ্ধ না করে ‘সূচ্যগ্র মেদিনী’ ছাড়তেও রাজি নয়। টুইটারের পরিচালনের পর্ষদের একটি সূত্র বলছে, একীভূত হওয়ার চুক্তিটি ‘বুলেটপ্রুফ’, চাইলেই এ থেকে সরে আসা যাবে না। আর যদি শেষতক মরিয়া হয়ে টুইটার অধিগ্রহণ স্থগিত করেই দেন স্পেসএক্সের প্রধান, তবেও তাঁকে দিতে হবে ১ বিলিয়ন ডলার। কারণ একীভূত হওয়ার চুক্তিতে আছে ‘রিভার্স টারমিনেশন ফি’ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা এবং এ ক্ষেত্রে অঙ্কটি ১ বিলিয়ন ডলারের। অর্থাৎ, চুক্তি থেকে সরে গেলেই এই অর্থ দিতে হবে। ফলে বড় ধরনের অর্থক্ষয় সহ্য করতেই হবে ইলন মাস্ককে। 

ইলন মাস্কের টুইটার কেনা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছেতবে হ্যাঁ,৫ শতাংশ স্প্যাম অ্যাকাউন্টের বিষয়টি নিয়ে আদালতের দরজায় কড়া নাড়তেই পারেন মাস্ক। কিন্তু সেটি হবে এক দীর্ঘ আইনি লড়াই। ৫ শতাংশ স্প্যাম অ্যাকাউন্টের বিষয়টির সত্যাসত্য প্রমাণ করা এবং তার কারণে যে ব্যবসায়িক ক্ষতি হবে—সেটি প্রতিষ্ঠিত করা বেশ কঠিন। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক গুসতাভো শোয়েদ মনে করেন, আদালতে যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে এভাবে বিজয়ী হওয়া ইলন মাস্কের জন্য খুবই কঠিন। কারণ ভুয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের আয় কম হবে, সেটি দেখানো সহজ হবে না। 

আবার টুইটারও আছে গ্যাঁড়াকলে। মুখে যতই ইলনকে আদালতের চৌহদ্দি দেখিয়ে দেওয়া হোক, বাস্তবে সেই প্রক্রিয়াটি কুসুমাস্তীর্ণ নয়। বরং সেটি এতটাই দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে যে, টুইটার পরিচালনা পর্ষদের হাঁপিয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়। তাই আইন বিশেষজ্ঞদের ধারণা, টুইটার কর্তৃপক্ষ প্রথমে হুমকি দেবে এবং পরে আদালতের বাইরেই ঝামেলা মেটানোর চেষ্টা করবে। আর সে ক্ষেত্রে নির্ধারিত রিভার্স টারমিনেশন ফি-এর চেয়েও বেশি অর্থ চাওয়া হতে পারে। কারণ, এভাবে চুক্তি না হওয়া বা চুক্তি থেকে সরে আসা দুই পক্ষের ব্যবসায়িক ভাবমূর্তির জন্যই ক্ষতিকর। এমনটা যদি হাসিমুখে শালীনভাবে না হয় তবে পস্তাতে হবে ইলন মাস্ক ও টুইটারকে। ইলনও ব্যবসায়ী হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবেন এবং টুইটারও বিনিয়োগকারী খুঁজতে হয়রান হবে। তাই করনেলের আইনের অধ্যাপক চার্লস হোয়াইটহেড মনে করেন, আদালতের বাইরেই দুপক্ষে ‘হ্যান্ডশেক’ হবে এবং টুইটার কর্তৃপক্ষ সে ক্ষেত্রে ২ বিলিয়ন ডলার চেয়ে বসতে পারে। 

ইলন মাস্কের জন্য সহজে পার পাওয়াটা আরও কঠিন করে দিয়েছে সম্প্রতি তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হয়রানির অভিযোগ। যদিও তিনি অভিযোগ অস্বীকার করছেন, কিন্তু ইলনের ভাবমূর্তির বারোটা বাজানোর জন্য এটি যথেষ্ট। এর ওপর যদি যুক্ত হয় টুইটার অধিগ্রহণ-সংক্রান্ত আস্থাহীনতা, তবে বাজারে ইলনের শক্তিশালী অবস্থান অনেকটাই টলে যেতে পারে। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ‘মেধাবী মুখ’ ইলন কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেন, সেটি দেখার জন্য তাই গ্যালারিতে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই! 

তথ্যসূত্র: দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, অ্যাক্সিওস ডট কম, দ্য ইকোনমিস্ট, ব্লুমবার্গ, রয়টার্স ও সিএনএন

ইলন মাস্ক সম্পর্কিত পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

গণপিটুনিতে নিহত জামায়াত কর্মী নেজাম ও তাঁর বাহিনী গুলি ছোড়ে, মিলেছে বিদেশি পিস্তল: পুলিশ

রাজধানীতে ছিনতাইকারী সন্দেহে ইরানের দুই নাগরিককে মারধর

এক ছাতায় সব নাগরিক সেবা

‘তল্লাশির’ জন্য উসকানি দিয়েছে গুলশানের ওই বাসার সাবেক কেয়ারটেকার: প্রেস উইং

তানভীর ইমামের বাড়ি ভেবে গুলশানের একটি বাসায় মধ্যরাতে শতাধিক ব্যক্তির অনুপ্রবেশ, তছনছ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত