অনলাইন ডেস্ক
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হুমকি দিয়েছিলেন, হিজবুল্লাহ যদি ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায় তাহলে বৈরুত এবং দক্ষিণ লেবাননকে আরেক গাজায় পরিণত করা হবে। কিন্তু হিজবুল্লাহ নয়, নেতানিয়াহু নিজেই যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন অঞ্চলটিতে। বিগত ১৮ বছরের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিতীয়বার হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধে জড়াল ইসরায়েল।
দক্ষিণ লেবানন থেকে হিজবুল্লাহকে সরিয়ে দিয়ে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের ৬০ হাজার বাসিন্দাকে তাদের নিজ বাড়িতে ফেরত আনার জন্য ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করেছে। এ বিষয়ে নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমরা আমাদের অস্তিত্বের জন্য লড়াই করছি। আমরা একত্র হয়ে আমাদের শত্রুদের পরাজিত করব।’
কিন্তু লেবাননের গভীরে ব্যাপক অভিযান চালানো ছাড়া ইসরায়েল কীভাবে এই লক্ষ্য অর্জন করবে তা নিশ্চিত নয়। যদিও ইসরায়েল বিমান হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহর অবকাঠামো ধ্বংসের দাবি করেছে, কিন্তু বিশ্লেষকদের আশঙ্কা সামগ্রিকভাবে ইসরায়েল হিজবুল্লাহর কাছ থেকে ২০০৬ সালের চেয়েও বড় ধাক্কা খাবে। সেবার ইসরায়েল মাঝপথে যুদ্ধ বন্ধ করে লেবানন থেকে সেনা সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের আঞ্চলিক নিরাপত্তার পরিচালক এমিল হোকায়েম বলেছেন, ‘এই যুদ্ধ ২০০৬ সালের তুলনায় আরও গভীর, কঠিন এবং দীর্ঘতর হতে চলেছে। এটিতে খুবই ভয়াবহ হতে চলেছে—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।’
ইসরায়েল হিজবুল্লাহর সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে এবং তাদের বেশ কয়েকজন সেনা হতাহত হয়েছে। এই বিষয়টি ইঙ্গিত দেয় যে ইসরায়েলি সেনাদের জন্য এই লড়াই অনেক কঠিন হবে। এ ছাড়া এই সংঘাত মধ্যপ্রাচ্য একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুও করে দিতে পারে। কারণ, এরই মধ্যে হিজবুল্লাহর সবচেয়ে বড় মিত্র ইরান গত মঙ্গলবার ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এখনো এই যুদ্ধের চূড়ান্ত আঞ্চলিক উদ্দেশ্য প্রকাশ করেনি। লেবাননে উদ্বেগ আছে যে এই আক্রমণ লেবাননের সীমান্ত এলাকায় ইসরায়েলি দখলদারত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এই বিষয়টি নির্ভর করছে, ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করতে লেবাননের কতটা গভীরে যেতে চায় এবং যেতে পারবে তার ওপর।
ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি এমআই-৬–এর সাবেক প্রধান স্যার জন সয়ার্স বলেন, ‘কেবল আকাশপথে হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করা কঠিন। কারণ, (ইসরায়েলের) উত্তরে বেকা উপত্যকায় হিজবুল্লাহর ব্যাপক অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র আছে। যার জন্য ইসরায়েল পদাতিক সেনাদের অনেক গভীরে প্রবেশ করতে হবে।’
চলমান যুদ্ধের সঙ্গে ২০০৬ সালের ৩৪ দিনের যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আছে। সে সময় হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে অভিযান চালিয়ে দুই ইসরায়েলি সৈন্যকে বন্দী করে। পরে ইসরায়েল লেবানন ত্যাগ করে চলে যায়। তবে এবারের যুদ্ধ শুরুর আগে, ইসরায়েল প্রায় এক বছর ধরে হিজবুল্লাহর বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে।
গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে বেশ কয়েকটি শক্ত ধাক্কা দিয়েছে। ইসরায়েল হিজবুল্লাহর কমান্ড সেন্টার ধ্বংস করে দিয়েছে, গোষ্ঠীটির প্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করেছে। গোষ্ঠীটির যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। লেবাননের রাজধানী বৈরুতের উপকণ্ঠে ব্যাপক হামলা চালিয়ে ইসরায়েল প্রায় এক হাজার লেবানিজকে হত্যা করেছে।
কিন্তু নিজ মাটিতে হিজবুল্লাহকে সামনাসামনি মোকাবিলা করা অন্য বিষয়। এই বিষয়টি ইসরায়েলের আকাশ যুদ্ধের অর্জনকে ম্লান করে দিতে পারে। এ বিষয়ে এমিল হোকায়েম বলেন, ‘হিজবুল্লাহ সম্ভবত ইসরায়েলকে তাদের নিজ মাটিতে ডেকে আনতে চায়। কারণ, সেখানে তাদের গুণগত সুবিধা, উন্নত প্রস্তুতি, নমনীয় কাঠামো এবং ভূ-কৌশলগত জ্ঞান আছে। তবে দক্ষিণে এখনো হিজবুল্লাহর জয়ের সক্ষমতা ও কমান্ড বজায় আছে কি না, সেটাই প্রশ্ন।’
ইসরায়েল ১৯৮২ সালে দক্ষিণ লেবাননের সীমান্তবর্তী এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর টানা ১৮ বছর সেখানে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোর সহায়তায়। কিন্তু হিজবুল্লাহর ক্রমাগত আক্রমণের মুখে এক চোরাবালিতে আটকে যায় ইসরায়েল। পরে ২০০০ সালে তারা সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে।
এর পর থেকেই হিজবুল্লাহই এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। এরপর ২০০৬ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে আবারও যুদ্ধে জড়ায় তারা। ইসরায়েলি থিংক ট্যাংক বেগিন-সাত সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের একজন সিনিয়র রিসার্চ ফেলো আদো হেখটের মতে, তার পর থেকেই অঞ্চলটিতে হিজবুল্লাহ কৌশলগত প্রতিরক্ষা কাঠামো দাঁড় করিয়েছে। নিজস্ব রণকৌশল ঠিক করেছে। হিজবুল্লাহর তিনটি আঞ্চলিক কমান্ড আছে। যার একেকটির সক্ষমতা একটি পূর্ণাঙ্গ পদাতিক ডিভিশনের সমান। এই তিনটি কমান্ডই স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম।
দক্ষিণ লেবানন মূলত একাধিক গিরিখাত, খাঁড়া চূড়াবিশিষ্ট একটি এলাকা। যেখানে সামরিক চলাচল খুবই কঠিন। আর যেসব পথে সহজে চলাচল করা সম্ভব সেগুলোতে হিজবুল্লাহ ব্যাপকভাবে মাইন পেতে রেখেছে। একই সঙ্গে পাহাড়ের তলদেশে টানেলের বিশাল নেটওয়ার্কও তৈরি করেছে।
আদো হেখট বলেন, ‘ইসরায়েলি হামলা এখন পর্যন্ত হিজবুল্লাহর কৌশলগত আর্টিলারি ও উচ্চতর কমান্ড অধিদপ্তরের কিছু সদস্যকে হত্যা করতে পেরেছে, দক্ষিণ কমান্ডেরও ক্ষয়ক্ষতি করেছে। তবে তাদের সামগ্রিক আকারের তুলনায় এই সংখ্যা খুবই নগণ্য।’
তবে হিজবুল্লাহকে মোকাবিলার জন্য ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীও (আইডিএফ) দীর্ঘ সময় পেয়েছে। ২০০৬ সালের যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা হিজবুল্লাহর কমান্ড কাঠামো এবং এর সামরিক সম্পদের একটি বিশদ গোয়েন্দা চিত্র তৈরি করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গাজায় দীর্ঘ এক বছর ধরে যুদ্ধ করে ইসরায়েলি সেনারা ক্লান্ত। গাজায় আইডিএফ হামাসকে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, গাজার মতো ছোট এলাকায় হিজবুল্লাহর চেয়ে আকারে অনেক ছোট হামাসকেই যখন ইসরায়েল হারাতে পারেনি। তখন তার চেয়ে কঠিন ভূমি বৈচিত্র্যের এলাকায় হামাসের চেয়ে কয়েক গুণ শক্তিশালী হিজবুল্লাহকে তারা কীভাবে হারাবে, তা–ই দেখার বিষয়।
আইডিএফ বলেছে, তারা হিজবুল্লাহ অবকাঠামো—যেমন টানেল, অস্ত্র ও গোলাবারুদ ধ্বংস করার জন্য সীমান্তের কাছাকাছি লক্ষ্যবস্তুতে অভিযান পরিচালনা করেছে। কিন্তু অভিযানের ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর ইসরায়েল লেবাননের বাসিন্দাদের সীমান্তের কাছাকাছি প্রায় ৩০টি খালি করে আওয়ালি নদীর ওপারে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। যা সীমান্ত থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে।
বিশ্লেষকদের অনুমান, ইসরায়েলের পরবর্তী লক্ষ্য সম্ভবত লেবাননের এমন সব গ্রাম দখল করা, যেখান থেকে সম্ভাব্যভাবে ইসরায়েলে হামলা চালানো হতো। কিন্তু এমনটা করা হবে খুবই একটি স্বল্পমেয়াদি সমাধান। সাবেক ব্রিটিশ কূটনীতিক জন রেইন বলেন, ‘ইসরায়েলের প্রকাশ্য লক্ষ্য হলো নিরাপত্তার একটি কর্ডন স্থাপন করা এবং সেখানে একটি বাফার জোন স্থাপন করা। কিন্তু কীভাবে ইসরায়েল এই অঞ্চলটিকে পুনরুদ্ধার করা থেকে বিরত রাখবে? ২০০৬ সালেও তো এমনটাই হয়েছিল।’
জন রেইন বলেন, ‘বিকল্প হিসেবে আইডিএফ তাদের গোয়েন্দা ঘাঁটিকে সহায়তা দেওয়ার জন্য সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে একগাদা দুর্গ গড়তে পারে ইসরায়েল। তবে এটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ। মার্কিন জোট আফগানিস্তানে এমন দুর্গের পরিণতি ভালোভাবেই দেখেছে।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, একটি বাফার জোন প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই যে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে রকেট ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারবে না, এমন নয়। তারপরও হিজবুল্লাহ তাদের কাছে থাকা মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলে অনায়াসে আঘাত হানতে পারবে।
এমনকি হিজবুল্লাহ যদি লিতানি নদীর এপারেও চলে আসে তারপরও তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলকে টার্গেট করতে সক্ষম হবে বিশেষ করে হিজবুল্লাহর গ্র্যাড-১২২ মিলিমিটার রকেট তখনো ইসরায়েল পর্যন্ত পৌঁছাবে। এর বাইরে হিজবুল্লাহর কাছে ৪০ কিলোমিটার পাল্লার রকেটের বিপুল মজুত আছে। গোষ্ঠীটির কাছে দূরপাল্লার ফজর রকেট, বিভিন্ন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন আছে। ইসরায়েলি গণমাধ্যমই জানাচ্ছে, গত মঙ্গলবার হিজবুল্লাহর ‘ফাদি-৪’ ক্ষেপণাস্ত্র তেল আবিবে আঘাত হেনেছে; যাতে দুজন আহত হয়েছে।
ইসরায়েলের সামরিক কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকেরা প্রায়ই বলেন, তারা ২০০৬ সালের যুদ্ধের সময় দেশটির ব্যর্থতা একাধিক মূল্যবান পাঠ শিখেছে। কিন্তু অন্যান্য দেশের সামরিক বাহিনীও এই সংঘাত নিয়ে গবেষণা করেছে। যার মধ্যে একজন মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা এক নির্ভুল উপসংহারে পৌঁছেছেন। তিনি বলেছেন, হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দিকটি আগের মতোই প্রাসঙ্গিক।
মার্কিন সেই গোয়েন্দা কর্মকর্তা ২০০৬ সালের সংঘাত শেষ হওয়ার পরপরই লিখেছিলেন, ব্যাপক বিধ্বংসী এয়ার পাওয়ার—সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইসরায়েল দেখিয়েছে—কোনো অমৃত নয়, বরং একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক কৌশলে সামরিক শক্তি শেষ পর্যন্ত এ ধরনের প্রতিপক্ষকে নত মস্তক হতে বাধ্য করতে পারে।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হুমকি দিয়েছিলেন, হিজবুল্লাহ যদি ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায় তাহলে বৈরুত এবং দক্ষিণ লেবাননকে আরেক গাজায় পরিণত করা হবে। কিন্তু হিজবুল্লাহ নয়, নেতানিয়াহু নিজেই যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন অঞ্চলটিতে। বিগত ১৮ বছরের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিতীয়বার হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধে জড়াল ইসরায়েল।
দক্ষিণ লেবানন থেকে হিজবুল্লাহকে সরিয়ে দিয়ে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের ৬০ হাজার বাসিন্দাকে তাদের নিজ বাড়িতে ফেরত আনার জন্য ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করেছে। এ বিষয়ে নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমরা আমাদের অস্তিত্বের জন্য লড়াই করছি। আমরা একত্র হয়ে আমাদের শত্রুদের পরাজিত করব।’
কিন্তু লেবাননের গভীরে ব্যাপক অভিযান চালানো ছাড়া ইসরায়েল কীভাবে এই লক্ষ্য অর্জন করবে তা নিশ্চিত নয়। যদিও ইসরায়েল বিমান হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহর অবকাঠামো ধ্বংসের দাবি করেছে, কিন্তু বিশ্লেষকদের আশঙ্কা সামগ্রিকভাবে ইসরায়েল হিজবুল্লাহর কাছ থেকে ২০০৬ সালের চেয়েও বড় ধাক্কা খাবে। সেবার ইসরায়েল মাঝপথে যুদ্ধ বন্ধ করে লেবানন থেকে সেনা সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের আঞ্চলিক নিরাপত্তার পরিচালক এমিল হোকায়েম বলেছেন, ‘এই যুদ্ধ ২০০৬ সালের তুলনায় আরও গভীর, কঠিন এবং দীর্ঘতর হতে চলেছে। এটিতে খুবই ভয়াবহ হতে চলেছে—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।’
ইসরায়েল হিজবুল্লাহর সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে এবং তাদের বেশ কয়েকজন সেনা হতাহত হয়েছে। এই বিষয়টি ইঙ্গিত দেয় যে ইসরায়েলি সেনাদের জন্য এই লড়াই অনেক কঠিন হবে। এ ছাড়া এই সংঘাত মধ্যপ্রাচ্য একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুও করে দিতে পারে। কারণ, এরই মধ্যে হিজবুল্লাহর সবচেয়ে বড় মিত্র ইরান গত মঙ্গলবার ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এখনো এই যুদ্ধের চূড়ান্ত আঞ্চলিক উদ্দেশ্য প্রকাশ করেনি। লেবাননে উদ্বেগ আছে যে এই আক্রমণ লেবাননের সীমান্ত এলাকায় ইসরায়েলি দখলদারত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এই বিষয়টি নির্ভর করছে, ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করতে লেবাননের কতটা গভীরে যেতে চায় এবং যেতে পারবে তার ওপর।
ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি এমআই-৬–এর সাবেক প্রধান স্যার জন সয়ার্স বলেন, ‘কেবল আকাশপথে হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করা কঠিন। কারণ, (ইসরায়েলের) উত্তরে বেকা উপত্যকায় হিজবুল্লাহর ব্যাপক অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র আছে। যার জন্য ইসরায়েল পদাতিক সেনাদের অনেক গভীরে প্রবেশ করতে হবে।’
চলমান যুদ্ধের সঙ্গে ২০০৬ সালের ৩৪ দিনের যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আছে। সে সময় হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে অভিযান চালিয়ে দুই ইসরায়েলি সৈন্যকে বন্দী করে। পরে ইসরায়েল লেবানন ত্যাগ করে চলে যায়। তবে এবারের যুদ্ধ শুরুর আগে, ইসরায়েল প্রায় এক বছর ধরে হিজবুল্লাহর বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে।
গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে বেশ কয়েকটি শক্ত ধাক্কা দিয়েছে। ইসরায়েল হিজবুল্লাহর কমান্ড সেন্টার ধ্বংস করে দিয়েছে, গোষ্ঠীটির প্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করেছে। গোষ্ঠীটির যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। লেবাননের রাজধানী বৈরুতের উপকণ্ঠে ব্যাপক হামলা চালিয়ে ইসরায়েল প্রায় এক হাজার লেবানিজকে হত্যা করেছে।
কিন্তু নিজ মাটিতে হিজবুল্লাহকে সামনাসামনি মোকাবিলা করা অন্য বিষয়। এই বিষয়টি ইসরায়েলের আকাশ যুদ্ধের অর্জনকে ম্লান করে দিতে পারে। এ বিষয়ে এমিল হোকায়েম বলেন, ‘হিজবুল্লাহ সম্ভবত ইসরায়েলকে তাদের নিজ মাটিতে ডেকে আনতে চায়। কারণ, সেখানে তাদের গুণগত সুবিধা, উন্নত প্রস্তুতি, নমনীয় কাঠামো এবং ভূ-কৌশলগত জ্ঞান আছে। তবে দক্ষিণে এখনো হিজবুল্লাহর জয়ের সক্ষমতা ও কমান্ড বজায় আছে কি না, সেটাই প্রশ্ন।’
ইসরায়েল ১৯৮২ সালে দক্ষিণ লেবাননের সীমান্তবর্তী এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর টানা ১৮ বছর সেখানে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোর সহায়তায়। কিন্তু হিজবুল্লাহর ক্রমাগত আক্রমণের মুখে এক চোরাবালিতে আটকে যায় ইসরায়েল। পরে ২০০০ সালে তারা সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে।
এর পর থেকেই হিজবুল্লাহই এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। এরপর ২০০৬ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে আবারও যুদ্ধে জড়ায় তারা। ইসরায়েলি থিংক ট্যাংক বেগিন-সাত সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের একজন সিনিয়র রিসার্চ ফেলো আদো হেখটের মতে, তার পর থেকেই অঞ্চলটিতে হিজবুল্লাহ কৌশলগত প্রতিরক্ষা কাঠামো দাঁড় করিয়েছে। নিজস্ব রণকৌশল ঠিক করেছে। হিজবুল্লাহর তিনটি আঞ্চলিক কমান্ড আছে। যার একেকটির সক্ষমতা একটি পূর্ণাঙ্গ পদাতিক ডিভিশনের সমান। এই তিনটি কমান্ডই স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম।
দক্ষিণ লেবানন মূলত একাধিক গিরিখাত, খাঁড়া চূড়াবিশিষ্ট একটি এলাকা। যেখানে সামরিক চলাচল খুবই কঠিন। আর যেসব পথে সহজে চলাচল করা সম্ভব সেগুলোতে হিজবুল্লাহ ব্যাপকভাবে মাইন পেতে রেখেছে। একই সঙ্গে পাহাড়ের তলদেশে টানেলের বিশাল নেটওয়ার্কও তৈরি করেছে।
আদো হেখট বলেন, ‘ইসরায়েলি হামলা এখন পর্যন্ত হিজবুল্লাহর কৌশলগত আর্টিলারি ও উচ্চতর কমান্ড অধিদপ্তরের কিছু সদস্যকে হত্যা করতে পেরেছে, দক্ষিণ কমান্ডেরও ক্ষয়ক্ষতি করেছে। তবে তাদের সামগ্রিক আকারের তুলনায় এই সংখ্যা খুবই নগণ্য।’
তবে হিজবুল্লাহকে মোকাবিলার জন্য ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীও (আইডিএফ) দীর্ঘ সময় পেয়েছে। ২০০৬ সালের যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা হিজবুল্লাহর কমান্ড কাঠামো এবং এর সামরিক সম্পদের একটি বিশদ গোয়েন্দা চিত্র তৈরি করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গাজায় দীর্ঘ এক বছর ধরে যুদ্ধ করে ইসরায়েলি সেনারা ক্লান্ত। গাজায় আইডিএফ হামাসকে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, গাজার মতো ছোট এলাকায় হিজবুল্লাহর চেয়ে আকারে অনেক ছোট হামাসকেই যখন ইসরায়েল হারাতে পারেনি। তখন তার চেয়ে কঠিন ভূমি বৈচিত্র্যের এলাকায় হামাসের চেয়ে কয়েক গুণ শক্তিশালী হিজবুল্লাহকে তারা কীভাবে হারাবে, তা–ই দেখার বিষয়।
আইডিএফ বলেছে, তারা হিজবুল্লাহ অবকাঠামো—যেমন টানেল, অস্ত্র ও গোলাবারুদ ধ্বংস করার জন্য সীমান্তের কাছাকাছি লক্ষ্যবস্তুতে অভিযান পরিচালনা করেছে। কিন্তু অভিযানের ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর ইসরায়েল লেবাননের বাসিন্দাদের সীমান্তের কাছাকাছি প্রায় ৩০টি খালি করে আওয়ালি নদীর ওপারে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। যা সীমান্ত থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে।
বিশ্লেষকদের অনুমান, ইসরায়েলের পরবর্তী লক্ষ্য সম্ভবত লেবাননের এমন সব গ্রাম দখল করা, যেখান থেকে সম্ভাব্যভাবে ইসরায়েলে হামলা চালানো হতো। কিন্তু এমনটা করা হবে খুবই একটি স্বল্পমেয়াদি সমাধান। সাবেক ব্রিটিশ কূটনীতিক জন রেইন বলেন, ‘ইসরায়েলের প্রকাশ্য লক্ষ্য হলো নিরাপত্তার একটি কর্ডন স্থাপন করা এবং সেখানে একটি বাফার জোন স্থাপন করা। কিন্তু কীভাবে ইসরায়েল এই অঞ্চলটিকে পুনরুদ্ধার করা থেকে বিরত রাখবে? ২০০৬ সালেও তো এমনটাই হয়েছিল।’
জন রেইন বলেন, ‘বিকল্প হিসেবে আইডিএফ তাদের গোয়েন্দা ঘাঁটিকে সহায়তা দেওয়ার জন্য সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে একগাদা দুর্গ গড়তে পারে ইসরায়েল। তবে এটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ। মার্কিন জোট আফগানিস্তানে এমন দুর্গের পরিণতি ভালোভাবেই দেখেছে।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, একটি বাফার জোন প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই যে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে রকেট ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারবে না, এমন নয়। তারপরও হিজবুল্লাহ তাদের কাছে থাকা মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলে অনায়াসে আঘাত হানতে পারবে।
এমনকি হিজবুল্লাহ যদি লিতানি নদীর এপারেও চলে আসে তারপরও তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলকে টার্গেট করতে সক্ষম হবে বিশেষ করে হিজবুল্লাহর গ্র্যাড-১২২ মিলিমিটার রকেট তখনো ইসরায়েল পর্যন্ত পৌঁছাবে। এর বাইরে হিজবুল্লাহর কাছে ৪০ কিলোমিটার পাল্লার রকেটের বিপুল মজুত আছে। গোষ্ঠীটির কাছে দূরপাল্লার ফজর রকেট, বিভিন্ন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন আছে। ইসরায়েলি গণমাধ্যমই জানাচ্ছে, গত মঙ্গলবার হিজবুল্লাহর ‘ফাদি-৪’ ক্ষেপণাস্ত্র তেল আবিবে আঘাত হেনেছে; যাতে দুজন আহত হয়েছে।
ইসরায়েলের সামরিক কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকেরা প্রায়ই বলেন, তারা ২০০৬ সালের যুদ্ধের সময় দেশটির ব্যর্থতা একাধিক মূল্যবান পাঠ শিখেছে। কিন্তু অন্যান্য দেশের সামরিক বাহিনীও এই সংঘাত নিয়ে গবেষণা করেছে। যার মধ্যে একজন মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা এক নির্ভুল উপসংহারে পৌঁছেছেন। তিনি বলেছেন, হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দিকটি আগের মতোই প্রাসঙ্গিক।
মার্কিন সেই গোয়েন্দা কর্মকর্তা ২০০৬ সালের সংঘাত শেষ হওয়ার পরপরই লিখেছিলেন, ব্যাপক বিধ্বংসী এয়ার পাওয়ার—সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইসরায়েল দেখিয়েছে—কোনো অমৃত নয়, বরং একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক কৌশলে সামরিক শক্তি শেষ পর্যন্ত এ ধরনের প্রতিপক্ষকে নত মস্তক হতে বাধ্য করতে পারে।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
১৮ ঘণ্টা আগেকোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
৩ দিন আগেনবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
৭ দিন আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
১১ দিন আগে