যে কারণে ফ্যাসিস্টরা বিশ্ববিদ্যালয় অপছন্দ করে 

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৬: ৪৮

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ছাত্র আন্দোলন গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে কতটা সোচ্চার হতে পারে এবং কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা কীভাবে ভিন্নমত দমনের লক্ষ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কণ্ঠ রোধ করে সে বিষয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে একটি নিবন্ধ লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক জেসন স্ট্যানলি। নিবন্ধটি আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান। 

বাংলাদেশে একটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটে গেছে। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে তা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রূপ নিয়ে ক্রমেই স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন ঘটায়। আন্দোলনের শুরুতে শেখ হাসিনা এমনভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন, যেটা তাঁকে রাজা চতুর্দশ লুইয়ের রানি মারি আঁতোয়ানেতের সঙ্গে একই কাতারে তুলে দিয়েছিল। 

কথিত আছে যে, ফরাসি বিপ্লবের শুরুতে যখন প্যারিসের জনসাধারণ ব্যাপক দুর্ভিক্ষের সময় রুটির দাম নিয়ে বিক্ষোভ করেন, তখন রাজা চতুর্দশ লুইয়ের রানি মারি আঁতোয়ানেত বলেছিলেন, ‘রুটি না পেলে তারা কেক খায় না কেন?’ সে সময়ে রুটির দাম এত বেশি বেড়ে গিয়েছিল যে, একজন মজুরের তার উপার্জনের বেশির ভাগ অর্থই রুটির পেছনে খরচ হয়ে যাচ্ছিল, অন্যান্য ব্যয়ের জন্য খুব কম অর্থ থাকছিল। ফলে সৃষ্টি হয় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি, এরপর বিক্ষোভ শুরু হয়, যা পরে ফরাসি বিপ্লবে রূপান্তরিত হয় এবং রাজা চতুর্দশ লুইয়ের শাসনের পতন ঘটায় এবং পরে রাজা ও রানিকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে গিয়েছিল। একইভাবে শেখ হাসিনার কিছু মন্তব্য আন্দোলনকে শান্ত না করে, দেশব্যাপী রূপ দেয়। 
 
জুলাইয়ের মাঝামাঝি সরকার আন্দোলনের মোকাবিলায় ব্যাপক সহিংসতা শুরু করে। পুলিশের গুলিতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী-আন্দোলনকারী নিহত হন। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে পুলিশের বর্বরতার প্রমাণ ছেয়ে যায়। জুলাইয়ের শেষ নাগাদ বিক্ষোভ দেশব্যাপী গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনে পরিণত হয়। অবশেষে, সামরিক বাহিনী ছাত্রদের পক্ষাবলম্বন করলে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যান। দেশব্যাপী ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণতন্ত্র আন্দোলন সফলভাবে একজন সহিংস স্বৈরাচারী নেতাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল এবং অন্তত আপাতত তারাই জয়ী হয়েছে। 

বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন প্রতিবেশী দেশগুলোতেও প্রভাব ফেলেছে। পাকিস্তানের জনপ্রিয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেতা ইমরান খানকে এক বছর আগে কারাগারে পাঠানো হয়। যা মূলত দেশটির সামরিক বাহিনীর নির্দেশে করা হয়েছিল। গণমাধ্যমে তাঁর নাম উল্লেখ না করতে, তাঁর কথা উদ্ধৃত করতে বা তাঁর ছবি না দেখাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সরকারের তরফ থেকে। তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের কারারুদ্ধ করা হয়। কিন্তু সেখানেও শুরু হয়েছে বিস্ময়কর কিছু। বাংলাদেশে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের সাফল্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন সরকারকে আল্টিমেটাম দেয়: ৩০ আগস্টের মধ্যে খানকে মুক্ত দাও নয়তো দেশব্যাপী ছাত্র বিক্ষোভের মুখোমুখি হও। 

বাংলাদেশে যা ঘটেছে এবং এখন পাকিস্তানেও তা ঘটতে পারে। এই বিষয়টি প্রতিটি স্বৈরাচারী সরকারের জন্য দুঃস্বপ্ন। কর্তৃত্ববাদী ও সম্ভাব্য স্বৈরাচারীরা খুব সচেতন যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারের সমালোচনা ও ভিন্নমতের প্রাথমিক উৎস। তারা মনে করে, ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আঘাত মানে ফ্যাসিবাদের ওপর চূড়ান্ত হামলা আসন্ন। 

ভারতের স্বৈরাচারী হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সাল থেকে দেশ শাসন করছেন। ভারতের অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ‘ভারতবিরোধী’ হিসেবে আক্রমণ করা তাঁর সরকারের একটি বৈশিষ্ট্য। একইভাবে, হাঙ্গেরির স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর অরবান বুদাপেস্টের সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটিকে কথার বাণে বিদ্ধ করে তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছিলেন। আইন ব্যবহার করে অরবানের সরকার বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দেশ থেকে বিতাড়িত করতেও উঠেপড়ে লেগেছিল। 

পরিস্থিতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও কাঠামোগতভাবে একই—কর্তৃত্ববাদী ও একদলীয় অঙ্গরাজ্যগুলো ভিন্নমত দমনের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে টার্গেট করে। ফ্লোরিডার রিপাবলিকান গভর্নর ইয়েল ইউনিভার্সিটি এবং হার্ভার্ড ল স্কুলের স্নাতক রন ডিস্যান্টিস একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বৈরশাসক যিনি সংখ্যালঘুদের ভোটকে কঠোরভাবে সীমাবদ্ধ করার জন্য ব্যাপক ভোটার জালিয়াতির মিথ ব্যবহার করেছেন। অথচ, গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ভোট জালিয়াতির নজির তেমনটা পাওয়া যায়নি। কেবল মিথ ব্যবহার করেই ক্ষান্ত থাকেননি ডিস্যান্টিস। তিনি ভোটার জালিয়াতির সম্ভাব্য ঘটনাগুলো নিয়ে আরও কাজ করার জন্য একটি কার্যালয়ও খুলেছেন। 

এই কাজ করতে গিয়ে, ডিস্যান্টিস সংখ্যালঘু জনসংখ্যার পাশাপাশি মূল লক্ষ্য হিসেবে সরকারি ও বেসরকারি অর্থায়নে পরিচালিত উচ্চ শিক্ষার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। ২০২৩ সালের মে মাসে ফ্লোরিডার পাবলিক এডুকেশন সিস্টেমে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও একাডেমিক স্বাধীনতা সম্পর্কিত বিশেষ কমিটির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ফ্লোরিডার রাষ্ট্র পরিচালিত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে একাডেমিক স্বাধীনতা, মেয়াদ এবং পরিচালনার বিষয়টি বর্তমানে মার্কিন ইতিহাসে অতুলনীয়ভাবে রাজনৈতিক ও আদর্শিক আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে।’ কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে ভয়ভীতি ও প্রকৃতপক্ষে সন্ত্রাসের পরিবেশে কথা প্রকাশ করা হয়েছে। কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের জন্য প্রশাসনিক হুমকি খুবই বাস্তব ও কার্যকর হিসেবে দেখা গেছে। 

ফ্লোরিডার চেয়েও বেশি কড়া একদলীয় শাসন চলে টেনেসিতে। যেখানে একজন গভর্নর একজন রিপাবলিকান এবং আইনসভায়ও রিপাবলিকানদের প্রাধান্য। টেনেসির হাউস এবং সিনেট হাঙ্গেরির দানিউব ইনস্টিটিউটকে সম্মান জানাতে একটি প্রস্তাব পাস করেছে। সে সময় টেনেসি হাউসে রাজ্য প্রতিনিধি জাস্টিন জোনস প্রশ্ন করেছিলেন, কেন রাজ্য হাঙ্গেরির স্বৈরশাসক ভিক্তর অরবানের থিঙ্কট্যাঙ্ককে সম্মান করা হচ্ছে। টেনেসিতে ‘বিভাজনমূলক ধারণা’ দেয় এমন শিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। এ ধরনের কোনো বিষয়ে শেখানোর জন্য একজন অধ্যাপককে আগে সরকারকে জানাতে হয়। 

মানুষের ভোটাধিকার হরণ এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। বিষয়টা যেন, একে অপরের পরিপূরকের মতো। ইয়েল ল স্কুলের স্নাতক ও বর্তমান রিপাবলিকান ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জেডি ভ্যান্স দাবি করেছেন, ভোটার জালিয়াতির সন্দেহের কারণে ২০২০ সালের নির্বাচনকে প্রত্যয়িত করা উচিত হয়নি না। ন্যাশনাল কনজারভেটিজম কনফারেন্সে বক্তৃতায় ভ্যান্সও ঘোষণা করেছিলেন—রিচার্ড নিক্সনের প্রতিধ্বনি করে—‘অধ্যাপকেরা জাতির শত্রু।’ 

এ ছাড়া, ২০২৩ সালের শরতে গাজায় ইসরায়েলের নৃশংস প্রতিশোধের প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গণহত্যাবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। এতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইহুদি ছাত্র সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। এই গণহত্যাবিরোধী বিক্ষোভগুলোকে হামাসপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং তাদের প্রশাসনকে মৌখিক, রাজনৈতিক এবং শারীরিকভাবে আক্রমণ করা করা হয়েছিল। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান পার্টি দীর্ঘদিন ধরেই ছাত্র আন্দোলনের গণতান্ত্রিক সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন। যেহেতু দলটি কর্তৃত্ববাদের কাছাকাছি এবং সাম্প্রতিক সময়ে আরও কাছাকাছি যাচ্ছে তাই এটি বিশ্বব্যাপী সব ডানপন্থী কর্তৃত্ববাদীদের মতোই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের থেকে শুরু করে ভিন্নমতকে দমন করার চেষ্টা করবে। অত্যন্ত সাহসিকতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা দেখিয়েছে যে এই কৌশলটি ঠেকিয়ে দেওয়া যায়।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি চাকরিজীবীরা সম্পদের হিসাব না দিলে যেসব শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন

শেখ হাসিনাকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে এম সাখাওয়াতের বিস্ফোরক মন্তব্য, কী বলেছেন এই উপদেষ্টা

শিক্ষকের নতুন ২০ হাজার পদ, প্রাথমিকে আসছে বড় পরিবর্তন

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

শ্রীপুরে পিকনিকের বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু, আহত ৩

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত