মন্টি বৈষ্ণব
আজ ১৭ সেপ্টেম্বর; মহান শিক্ষা দিবস। শিক্ষার অধিকার আদায়ে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই দিন। ১৯৬২ সালের এই দিনে শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হন ওয়াজীউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, বাবুলসহ নাম না জানা আরও অনেকে। তাঁদের আত্মত্যাগের স্মরণে দিনটি ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে পালন হয়ে আসছে। ছাত্র আন্দোলনে ইতিহাসে ১৭ সেপ্টেম্বরের মতো এত বড় গণ-আন্দোলন এ দেশের ইতিহাসে নেই বললেই চলে। কিন্তু শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, তা আজও তো অর্জিত হয়নি।
তৎকালীন পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। শরিফ কমিশন নামে পরিচিত এই কমিশন তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। এই প্রতিবেদনের মূল বিষয় ছিল শিক্ষা সংকোচননীতি। শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতির কাঠামোতে তিন বছরে উচ্চতর ডিগ্রি কোর্স ও দুই বছরের স্নাতকোত্তর কোর্সের ব্যবস্থা থাকবে বলে প্রস্তাব করা হয়। এতে উচ্চশিক্ষার পথ ধনিক শ্রেণির সন্তানদের জন্য নির্ধারিত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া এই কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ছাত্র-শিক্ষকদের কার্যকলাপের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার প্রস্তাব করে। এই প্রতিবেদনের সবচেয়ে আপত্তিকর প্রস্তাব ছিল—শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার পুরো ব্যয় বহন করতে হবে।
আইয়ুবের এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় সে সময়কার বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। শিক্ষাকে অধিকার হিসেবে বিবেচনা করে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির দাবিতে ছাত্রদের প্রতিরোধে দেশব্যাপী গড়ে ওঠে গণ-আন্দোলন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই দিন সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশাল জমায়েতের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ শেষে মিছিলে পুলিশ লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস ও গুলিবর্ষণ করে। এতে ওয়াজীউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, বাবুলসহ আরও অনেকে নিহত হন। সে সময়ের স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বলে তখনকার ছাত্র-যুবাদের মধ্যে। অধ্যাপক যতীন সরকার তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
সে সময়ের স্মৃতি নিয়ে যতীন সরকার বলেন, ‘আইয়ুবের ভেতরে ভয়ের কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল ১৯৬২-এর ছাত্র আন্দোলন। ১৯৫৯ সালে বিএ পাসের পর আমি বাংলায় এমএ পড়ার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। এরই মধ্যে ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে দুটো ঘটনা ঘটল। প্রথমটি ছাত্র আন্দোলন ও পরেরটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। কিন্তু ঢাকায় আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরুর অনেক দিন পরও রাজশাহীর ছাত্ররা নিরুত্তাপ ছিল। রাজধানীর তুলনায় এই বিভাগীয় সদরের ছাত্রদের রাজনৈতিক সচেতনতা কিছুটা কম থাকা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে একটা বিশ্ববিদ্যালয় তো আছে সেখানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এতটা পিছিয়ে থাকবে কেন—এ ধরনের অনুযোগ ঢাকার ছাত্রদের কাছ থেকে প্রতিনিয়তই আসতে লাগল। (তারা বলত— ) রাজশাহীর ছাত্ররা কি মার্শাল ল ডান্ডার ভয়ে আন্দোলনে নামছে না? এতই যদি ভয়, তবে তারা শাড়ি আর চুড়ি পরে অন্দরে চলে গেলেই পারে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসার শখ কেন তাদের? সত্যি কিনা জানি না, এ কথাটাই স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নাকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নামে ডাকযোগে শাড়ি ও চুড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। হতে পারে এসব কথা নিতান্তই রটনা; তার পেছনে ঘটনা হয়তো একটুও ছিল না। পুরুষের শাড়ি আর চুড়ি পড়ার কথা বলে কাপুরুষ বাঙালি পুরুষতন্ত্রের অহমিকার তৃপ্তি ঘটায়। এ ধরনের রটনার মূলেও হয়তো এ রকমই তৃপ্তি লাভের অভিলাষ কার্যকর ছিল।’
তবে দেরিতে হলেও আন্দোলনের আঁচ এসে লাগে রাজশাহীতে। যতীন সরকারের ভাষ্যমতে, ‘কিছুটা দেরিতে হলেও ১৯৬২ সালে সেপ্টেম্বরে রাজশাহীতে যে ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল, প্রচণ্ডতা ও তীব্রতায় তা ঢাকার চেয়ে কম ছিল না। একদিন সরকারি কলেজের ক্যাম্পাসে রাজশাহীর প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিপুলসংখ্যক ছাত্র সমবেত হয়ে এক বিরাট মিছিল বের করার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু কলেজের গেট অতিক্রমের আগেই পুলিশের ব্যারিকেডের সামনে পড়ে যায়। ছাত্রদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের পর পুলিশ সমানে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়তে থাকে। ছাত্ররা দৌড়ে ফুলার হোস্টেলে আশ্রয় নেয় এবং ছাদের ওপর থেকে পুলিশদের লক্ষ্য করে ইট ছুড়ে মারে। কয়েক ঘণ্টা প্রচণ্ড লড়াই চলে। বহু ছাত্র গ্রেপ্তার হয়। আইয়ুব বিরোধী, তথা মার্শাল ল বিরোধী ছাত্র আন্দোলন জনমনে বিশেষ আশা সঞ্চার করে। এই আন্দোলন সে সময় দেশের মানুষের দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয়।’
এ তো গেল রাজশাহীর পরিস্থিতি। কিন্তু যে ঢাকার আঁচ সেখানে গিয়ে লেগেছিল, সেই ঢাকার পরিস্থিতি কেমন ছিল? শোনা যাক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হায়দার আকবর খান রনোর কাছ থেকে। ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ও তার প্রেক্ষাপট নিয়ে রনো বলেন, ১৭ সেপ্টেম্বর আইয়ুবের সামরিক শাসনামলের প্রথম হরতাল। তবে শিক্ষা আন্দোলনের আগেই আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যা একটা পর্যায়ে শিক্ষা আন্দোলনে পরিণত হয়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন ঘোষণা করেন। সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, যেকোনো ধরনের গণসংগঠন নিষিদ্ধ এবং সামরিক আইনে দণ্ডনীয় ছিল। এই শাসন ছিল খুবই প্রতিক্রিয়াশীল। এ রকম পরিস্থিতিতে জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন শরীফ কমিশন যে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট দিয়েছিল, তা বাতিলের জন্য তাঁরা দাবি জানান। বিষয়টি আমরাও কেন্দ্রীয়ভাবে গ্রহণ করি। শুরু হলো শরীফ কমিশনের রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলন, যা ক্রমে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এমন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না, যেখানে এই আন্দোলন হয়নি।’
১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন কেন হয়েছিল? শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ও উচ্চশিক্ষায় সরকারি নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে ছিল এ আন্দোলন। মানুষ সে সময় গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শিক্ষা বিষয়ে নিজের অবস্থান সোচ্চারে জানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এই এত বছর পরও শিক্ষার অভীষ্ট কি অর্জিত হয়েছে? শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ কি ঠেকানো গেছে? এক কথায় উত্তর—‘না’। হায়দার আকবর খান রনো যেমন বলছেন, ‘বর্তমানে শিক্ষাটা হলো পুরোপুরি ব্যবসাকেন্দ্রিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের মানে হচ্ছে বিশাল জ্ঞানের ভান্ডার। কিন্তু এখন দেশের আনাচে-কানাচে দেখা যায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। কোনো এক বিল্ডিংয়ের কয়েকটা রুম নিয়ে তৈরি করা হয়েছে একেকটা বিশ্ববিদ্যালয়। আবার বেশির ভাগ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই গণিত, বিজ্ঞানের মতো বিভাগ। জ্ঞানের বহু শাখা-প্রশাখা অনুপস্থিত এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে। এখানে মূল্য নেই কবিতার, মূল্য নেই সাহিত্যের, মূল্য নেই আইনস্টাইনের থিওরির। এখানে মূল্য আছে সেসব বিভাগের, যেসব বিভাগ দিয়ে লোভনীয় চাকরি পাওয়া যাবে।’
প্রবীণ এই রাজনীতিক বলেন, ‘আমাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গড়ে উঠেছে পুরোপুরি ব্যবসার জন্য। এখানে জ্ঞানের কোনো বিষয় নেই। বিষয়টা হলো টাকার। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই কোনো ভালো লাইব্রেরি, নেই কোনো গবেষণাগার, নেই কোনো খেলার মাঠ। তাই এটা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো সার্টিফিকেট দেওয়ার দোকান।’ তিনি বলেন, ‘আমি বছর চারেক একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে পাঠদানের জন্য গিয়েছিলাম। সেখানে কয়েকটি বিভাগের শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের ইতিহাস ও মার্কসবাদ নিয়ে পড়াতে বলা হয়েছিল। দুঃখের বিষয় সেখানকার শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার খাতায় যা লিখেছে, তাতে শূন্য নম্বর পাওয়ারও যোগ্যতা ছিল না। কিন্তু তাদের খাতায় কম নম্বর দিতে পারতাম না। কারণ, আমি কম নম্বর দিলে তো ছাত্ররা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে না। তারা তো আগেই হাজার হাজার টাকা দিয়ে সেখানে ভর্তি হয়েছে। তাই তাদের ফেল করানো যাবে না। অর্থাৎ, এখানে টাকার বিনিময়ে শিক্ষার লেনদেন হয়।’
বছর বছর শিক্ষা দিবস পালন হলেও যে জন্য এই দিবস, সেই লক্ষ্য কিন্তু অর্জিত হয়নি। শিক্ষা এখনো পণ্য হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। বরং আগের চেয়ে বেশি। এ বিষয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, শিক্ষাকে আমাদের দেশের জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করে, রাষ্ট্রের সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এটাই হলো শিক্ষা আন্দোলনের মর্মকথা। শিক্ষার মূল যে আন্দোলন, সেটা ৬০ দশকের আন্দোলনকে বোঝানো হয়। তবে, ৬০ দশকের এ আন্দোলন শিক্ষার পাশাপাশি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ও গণতন্ত্রের দাবিতে সংগঠিত হয়েছিল। আইয়ুব খানের শরীফ কমিশন রিপোর্টে শিক্ষাকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিবেচনা করা হয়েছিল। এটা শিক্ষার দর্শনের ক্ষেত্রে চরম প্রতিক্রিয়াশীল নীতি ছিল। কারণ, শিক্ষা কোনো পণ্য নয়। শিক্ষার মাধ্যমে একটা সমাজ সামনের দিকে এগিয়ে যায়। শিক্ষা হলো দেশের নাগরিকদের অধিকার। সেই অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা মানে, সমগ্র জাতিকে তার অধিকারের জায়গা থেকে বঞ্চিত করা।’
শিক্ষার অধিকার আদায়ে ৬২ শিক্ষা আন্দোলনে যেসব দাবি উত্থাপিত করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাধ্যমে সে দাবিগুলো বাস্তবায়ন হবে বলে আশা করা হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিক্ষার যাত্রাও শুরু হয়েছিল সেই পথে। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকারের কুদরত-এ খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে সবার উপযোগী করে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নের ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সে শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে করা সুপারিশ আজও বাস্তবায়ন হয়নি। বরং উল্টো পথে হেঁটেছে। সময়ের সঙ্গে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ কেবল বেড়েছে। সবার জন্য একমুখী শিক্ষা এখনো একটি আন্দোলনের বিষয় হয়েই রয়েছে। শিক্ষা দিবসেও তাই সেই আন্দোলনের কথাই বারবার ফিরে আসে।
আজ ১৭ সেপ্টেম্বর; মহান শিক্ষা দিবস। শিক্ষার অধিকার আদায়ে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই দিন। ১৯৬২ সালের এই দিনে শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হন ওয়াজীউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, বাবুলসহ নাম না জানা আরও অনেকে। তাঁদের আত্মত্যাগের স্মরণে দিনটি ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে পালন হয়ে আসছে। ছাত্র আন্দোলনে ইতিহাসে ১৭ সেপ্টেম্বরের মতো এত বড় গণ-আন্দোলন এ দেশের ইতিহাসে নেই বললেই চলে। কিন্তু শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, তা আজও তো অর্জিত হয়নি।
তৎকালীন পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। শরিফ কমিশন নামে পরিচিত এই কমিশন তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। এই প্রতিবেদনের মূল বিষয় ছিল শিক্ষা সংকোচননীতি। শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতির কাঠামোতে তিন বছরে উচ্চতর ডিগ্রি কোর্স ও দুই বছরের স্নাতকোত্তর কোর্সের ব্যবস্থা থাকবে বলে প্রস্তাব করা হয়। এতে উচ্চশিক্ষার পথ ধনিক শ্রেণির সন্তানদের জন্য নির্ধারিত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া এই কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ছাত্র-শিক্ষকদের কার্যকলাপের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার প্রস্তাব করে। এই প্রতিবেদনের সবচেয়ে আপত্তিকর প্রস্তাব ছিল—শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার পুরো ব্যয় বহন করতে হবে।
আইয়ুবের এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় সে সময়কার বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। শিক্ষাকে অধিকার হিসেবে বিবেচনা করে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির দাবিতে ছাত্রদের প্রতিরোধে দেশব্যাপী গড়ে ওঠে গণ-আন্দোলন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই দিন সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশাল জমায়েতের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ শেষে মিছিলে পুলিশ লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস ও গুলিবর্ষণ করে। এতে ওয়াজীউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, বাবুলসহ আরও অনেকে নিহত হন। সে সময়ের স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বলে তখনকার ছাত্র-যুবাদের মধ্যে। অধ্যাপক যতীন সরকার তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
সে সময়ের স্মৃতি নিয়ে যতীন সরকার বলেন, ‘আইয়ুবের ভেতরে ভয়ের কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল ১৯৬২-এর ছাত্র আন্দোলন। ১৯৫৯ সালে বিএ পাসের পর আমি বাংলায় এমএ পড়ার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। এরই মধ্যে ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে দুটো ঘটনা ঘটল। প্রথমটি ছাত্র আন্দোলন ও পরেরটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। কিন্তু ঢাকায় আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরুর অনেক দিন পরও রাজশাহীর ছাত্ররা নিরুত্তাপ ছিল। রাজধানীর তুলনায় এই বিভাগীয় সদরের ছাত্রদের রাজনৈতিক সচেতনতা কিছুটা কম থাকা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে একটা বিশ্ববিদ্যালয় তো আছে সেখানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এতটা পিছিয়ে থাকবে কেন—এ ধরনের অনুযোগ ঢাকার ছাত্রদের কাছ থেকে প্রতিনিয়তই আসতে লাগল। (তারা বলত— ) রাজশাহীর ছাত্ররা কি মার্শাল ল ডান্ডার ভয়ে আন্দোলনে নামছে না? এতই যদি ভয়, তবে তারা শাড়ি আর চুড়ি পরে অন্দরে চলে গেলেই পারে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসার শখ কেন তাদের? সত্যি কিনা জানি না, এ কথাটাই স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নাকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নামে ডাকযোগে শাড়ি ও চুড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। হতে পারে এসব কথা নিতান্তই রটনা; তার পেছনে ঘটনা হয়তো একটুও ছিল না। পুরুষের শাড়ি আর চুড়ি পড়ার কথা বলে কাপুরুষ বাঙালি পুরুষতন্ত্রের অহমিকার তৃপ্তি ঘটায়। এ ধরনের রটনার মূলেও হয়তো এ রকমই তৃপ্তি লাভের অভিলাষ কার্যকর ছিল।’
তবে দেরিতে হলেও আন্দোলনের আঁচ এসে লাগে রাজশাহীতে। যতীন সরকারের ভাষ্যমতে, ‘কিছুটা দেরিতে হলেও ১৯৬২ সালে সেপ্টেম্বরে রাজশাহীতে যে ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল, প্রচণ্ডতা ও তীব্রতায় তা ঢাকার চেয়ে কম ছিল না। একদিন সরকারি কলেজের ক্যাম্পাসে রাজশাহীর প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিপুলসংখ্যক ছাত্র সমবেত হয়ে এক বিরাট মিছিল বের করার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু কলেজের গেট অতিক্রমের আগেই পুলিশের ব্যারিকেডের সামনে পড়ে যায়। ছাত্রদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের পর পুলিশ সমানে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়তে থাকে। ছাত্ররা দৌড়ে ফুলার হোস্টেলে আশ্রয় নেয় এবং ছাদের ওপর থেকে পুলিশদের লক্ষ্য করে ইট ছুড়ে মারে। কয়েক ঘণ্টা প্রচণ্ড লড়াই চলে। বহু ছাত্র গ্রেপ্তার হয়। আইয়ুব বিরোধী, তথা মার্শাল ল বিরোধী ছাত্র আন্দোলন জনমনে বিশেষ আশা সঞ্চার করে। এই আন্দোলন সে সময় দেশের মানুষের দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয়।’
এ তো গেল রাজশাহীর পরিস্থিতি। কিন্তু যে ঢাকার আঁচ সেখানে গিয়ে লেগেছিল, সেই ঢাকার পরিস্থিতি কেমন ছিল? শোনা যাক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হায়দার আকবর খান রনোর কাছ থেকে। ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ও তার প্রেক্ষাপট নিয়ে রনো বলেন, ১৭ সেপ্টেম্বর আইয়ুবের সামরিক শাসনামলের প্রথম হরতাল। তবে শিক্ষা আন্দোলনের আগেই আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যা একটা পর্যায়ে শিক্ষা আন্দোলনে পরিণত হয়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন ঘোষণা করেন। সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, যেকোনো ধরনের গণসংগঠন নিষিদ্ধ এবং সামরিক আইনে দণ্ডনীয় ছিল। এই শাসন ছিল খুবই প্রতিক্রিয়াশীল। এ রকম পরিস্থিতিতে জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন শরীফ কমিশন যে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট দিয়েছিল, তা বাতিলের জন্য তাঁরা দাবি জানান। বিষয়টি আমরাও কেন্দ্রীয়ভাবে গ্রহণ করি। শুরু হলো শরীফ কমিশনের রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলন, যা ক্রমে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এমন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না, যেখানে এই আন্দোলন হয়নি।’
১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন কেন হয়েছিল? শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ও উচ্চশিক্ষায় সরকারি নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে ছিল এ আন্দোলন। মানুষ সে সময় গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শিক্ষা বিষয়ে নিজের অবস্থান সোচ্চারে জানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এই এত বছর পরও শিক্ষার অভীষ্ট কি অর্জিত হয়েছে? শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ কি ঠেকানো গেছে? এক কথায় উত্তর—‘না’। হায়দার আকবর খান রনো যেমন বলছেন, ‘বর্তমানে শিক্ষাটা হলো পুরোপুরি ব্যবসাকেন্দ্রিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের মানে হচ্ছে বিশাল জ্ঞানের ভান্ডার। কিন্তু এখন দেশের আনাচে-কানাচে দেখা যায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। কোনো এক বিল্ডিংয়ের কয়েকটা রুম নিয়ে তৈরি করা হয়েছে একেকটা বিশ্ববিদ্যালয়। আবার বেশির ভাগ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই গণিত, বিজ্ঞানের মতো বিভাগ। জ্ঞানের বহু শাখা-প্রশাখা অনুপস্থিত এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে। এখানে মূল্য নেই কবিতার, মূল্য নেই সাহিত্যের, মূল্য নেই আইনস্টাইনের থিওরির। এখানে মূল্য আছে সেসব বিভাগের, যেসব বিভাগ দিয়ে লোভনীয় চাকরি পাওয়া যাবে।’
প্রবীণ এই রাজনীতিক বলেন, ‘আমাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গড়ে উঠেছে পুরোপুরি ব্যবসার জন্য। এখানে জ্ঞানের কোনো বিষয় নেই। বিষয়টা হলো টাকার। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই কোনো ভালো লাইব্রেরি, নেই কোনো গবেষণাগার, নেই কোনো খেলার মাঠ। তাই এটা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো সার্টিফিকেট দেওয়ার দোকান।’ তিনি বলেন, ‘আমি বছর চারেক একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে পাঠদানের জন্য গিয়েছিলাম। সেখানে কয়েকটি বিভাগের শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের ইতিহাস ও মার্কসবাদ নিয়ে পড়াতে বলা হয়েছিল। দুঃখের বিষয় সেখানকার শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার খাতায় যা লিখেছে, তাতে শূন্য নম্বর পাওয়ারও যোগ্যতা ছিল না। কিন্তু তাদের খাতায় কম নম্বর দিতে পারতাম না। কারণ, আমি কম নম্বর দিলে তো ছাত্ররা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে না। তারা তো আগেই হাজার হাজার টাকা দিয়ে সেখানে ভর্তি হয়েছে। তাই তাদের ফেল করানো যাবে না। অর্থাৎ, এখানে টাকার বিনিময়ে শিক্ষার লেনদেন হয়।’
বছর বছর শিক্ষা দিবস পালন হলেও যে জন্য এই দিবস, সেই লক্ষ্য কিন্তু অর্জিত হয়নি। শিক্ষা এখনো পণ্য হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। বরং আগের চেয়ে বেশি। এ বিষয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, শিক্ষাকে আমাদের দেশের জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করে, রাষ্ট্রের সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এটাই হলো শিক্ষা আন্দোলনের মর্মকথা। শিক্ষার মূল যে আন্দোলন, সেটা ৬০ দশকের আন্দোলনকে বোঝানো হয়। তবে, ৬০ দশকের এ আন্দোলন শিক্ষার পাশাপাশি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ও গণতন্ত্রের দাবিতে সংগঠিত হয়েছিল। আইয়ুব খানের শরীফ কমিশন রিপোর্টে শিক্ষাকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিবেচনা করা হয়েছিল। এটা শিক্ষার দর্শনের ক্ষেত্রে চরম প্রতিক্রিয়াশীল নীতি ছিল। কারণ, শিক্ষা কোনো পণ্য নয়। শিক্ষার মাধ্যমে একটা সমাজ সামনের দিকে এগিয়ে যায়। শিক্ষা হলো দেশের নাগরিকদের অধিকার। সেই অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা মানে, সমগ্র জাতিকে তার অধিকারের জায়গা থেকে বঞ্চিত করা।’
শিক্ষার অধিকার আদায়ে ৬২ শিক্ষা আন্দোলনে যেসব দাবি উত্থাপিত করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাধ্যমে সে দাবিগুলো বাস্তবায়ন হবে বলে আশা করা হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিক্ষার যাত্রাও শুরু হয়েছিল সেই পথে। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকারের কুদরত-এ খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে সবার উপযোগী করে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নের ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সে শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে করা সুপারিশ আজও বাস্তবায়ন হয়নি। বরং উল্টো পথে হেঁটেছে। সময়ের সঙ্গে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ কেবল বেড়েছে। সবার জন্য একমুখী শিক্ষা এখনো একটি আন্দোলনের বিষয় হয়েই রয়েছে। শিক্ষা দিবসেও তাই সেই আন্দোলনের কথাই বারবার ফিরে আসে।
ইউক্রেনের ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র সারা বিশ্বে আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও, রাশিয়ার এ ধরনের আক্রমণকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে—যেমনটি ইসরায়েল উত্তর গাজাকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে হয়েছে।
১ দিন আগেট্রাম্প ফিরে আসায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের ধারাবাহিকতাই বজায় থাকতে পারে, সামান্য কিছু পরিবর্তন নিয়ে। ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান পেছনের সারিতে থাকলেও বাংলাদেশ,
১ দিন আগেড. ইউনূস যখন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন পুরো জাতি তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল। তবে তাঁকে পরিষ্কারভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে যে, তিনি কীভাবে দেশ শাসন করবেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
২ দিন আগেসম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
৩ দিন আগে