আব্দুর রহমান
এক মাসেরও কম সময়, মাত্র ১৭ দিনের মধ্যে চার দফা বিভিন্ন পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে উত্তর কোরিয়া। সম্প্রতি জাপানের জলসীমা-সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকার কাছাকাছি স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায় উত্তর কোরিয়া। আজ সোমবার সকালে দেশটির রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ের বিমানবন্দর এলাকার কাছাকাছি একটি এলাকা থেকে এই ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সব ধরনের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালানোর বিষয়ে উত্তর কোরিয়ার ওপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। একই সঙ্গে দেশটির ওপর সংস্থাটি অবরোধ আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞা থোড়াই কেয়ার করে উত্তর কোরিয়া একের পর এক পরীক্ষা চালিয়েই যাচ্ছে। দেশটির নেতা কিম জং উন প্রতিজ্ঞা করেছেন, যেকোনো মূল্যে তিনি তাঁর দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেবেন।
এর আগে গত শুক্রবার, দেশটির প্রতিরক্ষা বিভাগ জানায়, তারা ট্রেন থেকে নিক্ষেপণযোগ্য স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে। তারও কয়েক দিন আগে তারা হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে বলে দাবি করে। কিন্তু, ঠিক নতুন বছরের শুরুতেই উত্তর কোরিয়া এত বেশি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালাচ্ছে কেন?
উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোর হার অনেক বেশি। চলতি জানুয়ারি মাসের প্রথম ১৭ দিনেই চারটি পরীক্ষা চালানো হয়ে গেছে। পরীক্ষা চালানোর সময় এবং হার—দুটোই অস্বাভাবিক। ধারণা করা হচ্ছে, উত্তর কোরিয়া প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সামরিক মহড়াকে ভালোভাবে নেয়নি এবং তারই প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেশটি এই পরীক্ষা চালিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংকট্যাংক কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের বিশেষজ্ঞ অঙ্কিত পান্ডা বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘উত্তর কোরিয়া সাধারণত তাদের ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর পরীক্ষা চালায় সেগুলোর মান উন্নয়ন এবং সেগুলোকে কার্যক্ষম রাখতে। সর্বশেষ পরীক্ষা এই বিষয়টিই নিশ্চিত করছে।’
ওই সাক্ষাৎকারে অঙ্কিত পান্ডা যে বিষয়টিতে আলোকপাত করেছেন, তা হলো দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনৈতিক অবস্থা। তিনি বলছেন, ‘কিম জং উনের রাজনৈতিক বিবেচনাও আছে। এই পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে তিনি এই বার্তা দিতে চান যে, দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটও জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নে গৃহীত পদক্ষেপ থেকে তাঁকে এক পা-ও পিছু হটাবে না।’
কোভিড মহামারি থেকে বাঁচতে দেশটি সম্প্রতি ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশ চীনের সঙ্গেও তাদের সব ধরনের লেনদেন বন্ধ করে দেয়। ফলে দেশটি সম্প্রতি খাদ্যসংকট এবং অর্থনৈতিকভাবে নড়বড়ে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে বিভিন্ন সূত্র বলছে, শিগগিরই এই বাণিজ্যিক লেনদেন আবার চালু হবে।
দেশটির প্রেসিডেন্ট কিম জং উন সম্প্রতি স্বীকার করেছেন, তাঁর দেশ এক ‘জীবন-মরণ সমস্যা’র মুখোমুখি। একই সময়ে তিনি হাইপারসোনিক মিসাইলসহ দেশটির সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির অঙ্গীকারও করেন।
যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর উত্তর কোরিয়ার পরমাণু অস্ত্র তৈরি বন্ধে যে আলোচনা চলমান ছিল, তা স্থবির হয়ে গেছে। এ ছাড়া চলতি মাসের প্রথম দিকে কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোর জবাবে যুক্তরাষ্ট্র আবারও নতুন করে উত্তর কোরিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। তাই, সোমবারের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষাকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ‘কড়া জবাব’ বলে আখ্যায়িত করছেন, দক্ষিণ কোরিয়ার এওহা উইমেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর কোরিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ পার্ক উন-গন। তিনি বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে উত্তর কোরিয়া বলতে চায়, যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের কারণে তারা ভীত নয়।
এখানে চীনের অংশ কোথায়
মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের এ সম্পর্কিত এক বিশ্লেষণে বলা হয়, উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানো ও এর কারণে সৃষ্ট উত্তেজনা এমন এক সময়ে বাড়ছে, যখন চীন প্রস্তুতি নিচ্ছে শীতকালীন অলিম্পিকের আয়োজনের জন্য। আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি বেইজিংয়ে বসছে শীতকালীন অলিম্পিকের আসর। আবার দক্ষিণ কোরিয়ায় চলছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রস্তুতি। দেশটিতে আগামী ৯ মার্চ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সব মিলিয়ে গোটা অঞ্চলের জন্যই সময়টি গুরুত্বপূর্ণ। চীনের কাছে শীতকালীন অলিম্পিকের মহা আয়োজনটি রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্মানজনক। উত্তর কোরিয়াবিষয়ক আরেক বিশেষজ্ঞ শাদ ও’ক্যারল এ সম্পর্কিত এক টুইটে বলেছেন, ‘বেইজিং অলিম্পিকের প্রাক্কালে চীন তাদের ঘরের পেছনে এমন পরীক্ষাকে কোনোভাবেই স্বাগত জানাবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি এমন চলতে থাকে, তাহলে চীন-উত্তর কোরিয়া সম্পর্ক কিছুটা হলেও শীতল হবে না—এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
তবে এ প্রসঙ্গে অঙ্কিত পান্ডার বক্তব্য হলো—‘হয়তো চীন এই পরীক্ষাগুলোর কারণে সন্তুষ্ট নয়। কিন্তু তারা হয়তো এ ক্ষেত্রে ধৈর্যের পরিচয় দেবে।’
চীনের সঙ্গে আবারও বাণিজ্য শুরু হতে যাওয়ার বিষয়ে আলোকপাত করে আরেক উত্তর কোরীয় বিশেষজ্ঞ লেইফ এরিক ইজলি বিবিসিকে বলেন, ‘বাণিজ্য পুনরায় আরম্ভ করার এই সময়ই বলে দেয় চীনের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক যতটা ধারণা করা হয়, তার চেয়েও জটিল। চীন উত্তর কোরিয়াকে অর্থনৈতিক ও সামরিক উভয়ভাবেই সাহায্য করছে।’
তবে ধারণা করা যায়, উত্তর কোরিয়া হয়তো চীনের সঙ্গে তাদের কৌশলগত সম্পর্কের কথা বিবেচনা করে বেইজিং অলিম্পিকের আগে আরও পরীক্ষা চালানো থেকে বিরত থাকবে।
আছে আরও সমীকরণ
উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি ও পরীক্ষা চালানোর প্রসঙ্গে সবচেয়ে বেশি যে দেশটির নাম উচ্চারিত হয়, তা হলো যুক্তরাষ্ট্র। আর যুক্তরাষ্ট্রের নামটি জড়িয়ে আছে তাদের আঞ্চলিক মিত্র জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার কারণে। দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য আগামী কয়েক মাস বেশ গুরুত্বপূর্ণ, তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কারণেই। এই সময়ে তারা কোনো সংকট দেখতে চায় না। কিন্তু তারাই আবার ওয়াশিংটনের সঙ্গে মিলে যৌথ মহড়া চালাচ্ছে। এটি নিশ্চিতভাবেই পিয়ংইয়ংকে রুষ্ট করে থাকবে। সঙ্গে এশিয়া অঞ্চলে বাইডেন প্রশাসনের বর্ধিত আগ্রহের বিষয়টি যোগ করে নেওয়া যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেন ইস্যুতে আলোচনায় ব্যস্ত। আলোচনার মাঝপথেই যদিও তারা মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। একই কাজ তারা করেছে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রেও। একদিকে তারা পিয়ংইয়ংকে আলোচনার টেবিলে বসার আহ্বান জানাচ্ছে, অন্যদিকে আরোপ করছে নিষেধাজ্ঞা। এ অবস্থায় নিরাপত্তার কথা বলে কিম জং উনও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা বাড়াচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, ২০১৯ সালের পর থেকে তাদের পরীক্ষা চালানো ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আগের চেয়ে শক্তিশালী, যা দক্ষিণ, কোরিয়া, জাপান এবং অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রকে ভাবনায় ফেলার জন্য যথেষ্ট। ২০১৯ সালে হ্যানয়ে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলন ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই উত্তর কোরিয়া বলছে, তারা আলোচনার প্রাক্কালে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে বাধ্য নয়।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনেও ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যকার আলোচনার বিষয়টি উঠে এসেছে। সেখানে বলা হচ্ছে, ২০১৯ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উনের বৈঠক কোনো ফল আনতে পারেনি। হ্যানয়ের সেই সম্মেলনের ব্যর্থতা উত্তর কোরিয়াকে আশাহত করেছে। এখন জো বাইডেন বিনা শর্তে আলোচনার জন্য পিয়ংইয়ংকে ডাকছেন। কিন্তু কিম এতে কোনো আশ্বাস পাচ্ছেন না। দেশটির পক্ষ থেকে স্পষ্ট বলা হয়েছে—ওয়াশিংটন কূটনৈতিক আলাপের কথা বললেও ওয়াশিংটন তাদের পুরোনো চাপ প্রয়োগ ও একঘরে করার নীতিতে চলছে। তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে এই ভাষ্যের প্রমাণ হিসেবে সরাসরি ‘নিষেধাজ্ঞার’ কথা বলা হয়েছে।
সব মিলিয়ে উত্তর কোরিয়া আসলে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে নিরাপত্তা প্রশ্নে একটি নিশ্চয়তা চাইছে। তাহলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় ফিরছে না কেন? সোজা উত্তর—অবিশ্বাস। আর এই অবিশ্বাস থেকেই তারা পাল্টা চাপ প্রয়োগের নীতি নিয়েছে। আর চাপ প্রয়োগের জন্য তারা এই সময়টিকে বেছে নিয়েছে কারণ, এটি সংশ্লিষ্ট সবগুলো পক্ষের জন্যই ভীষণভাবে সংবেদনশীল একটা সময়। যুক্তরাষ্ট্রের সামনে আছে ইউক্রেন সূত্রে রাশিয়া, চীনের সামনে আছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের শৌর্য প্রদর্শনের উপলক্ষ, দক্ষিণ কোরিয়ার সামনে অভ্যন্তরীণ গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন। মূল লক্ষ্য দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থবহ আলোচনায় ফেরাতে তাই এই সময়টিই বেছে নিয়েছে দেশটি, যেখানে তারা চায় চীনও পরোক্ষে অংশ নিক।
এই লক্ষ্যে তারা কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। অন্তত চীনকে এ খেলার গ্যালারিতে ডেকে আনা গেছে। উত্তর কোরিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে চীন এরই মধ্যে বলেছে, ‘কোরীয় উপসাগরের সংকটে নিষেধাজ্ঞা কোনো সমাধান তো আনতে পারবেই না, বরং আক্রমণাত্মক মনোভাব বাড়াবে।’
বিশ্লেষণ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
এক মাসেরও কম সময়, মাত্র ১৭ দিনের মধ্যে চার দফা বিভিন্ন পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে উত্তর কোরিয়া। সম্প্রতি জাপানের জলসীমা-সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকার কাছাকাছি স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায় উত্তর কোরিয়া। আজ সোমবার সকালে দেশটির রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ের বিমানবন্দর এলাকার কাছাকাছি একটি এলাকা থেকে এই ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সব ধরনের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালানোর বিষয়ে উত্তর কোরিয়ার ওপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। একই সঙ্গে দেশটির ওপর সংস্থাটি অবরোধ আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞা থোড়াই কেয়ার করে উত্তর কোরিয়া একের পর এক পরীক্ষা চালিয়েই যাচ্ছে। দেশটির নেতা কিম জং উন প্রতিজ্ঞা করেছেন, যেকোনো মূল্যে তিনি তাঁর দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেবেন।
এর আগে গত শুক্রবার, দেশটির প্রতিরক্ষা বিভাগ জানায়, তারা ট্রেন থেকে নিক্ষেপণযোগ্য স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে। তারও কয়েক দিন আগে তারা হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে বলে দাবি করে। কিন্তু, ঠিক নতুন বছরের শুরুতেই উত্তর কোরিয়া এত বেশি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালাচ্ছে কেন?
উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোর হার অনেক বেশি। চলতি জানুয়ারি মাসের প্রথম ১৭ দিনেই চারটি পরীক্ষা চালানো হয়ে গেছে। পরীক্ষা চালানোর সময় এবং হার—দুটোই অস্বাভাবিক। ধারণা করা হচ্ছে, উত্তর কোরিয়া প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সামরিক মহড়াকে ভালোভাবে নেয়নি এবং তারই প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেশটি এই পরীক্ষা চালিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংকট্যাংক কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের বিশেষজ্ঞ অঙ্কিত পান্ডা বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘উত্তর কোরিয়া সাধারণত তাদের ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর পরীক্ষা চালায় সেগুলোর মান উন্নয়ন এবং সেগুলোকে কার্যক্ষম রাখতে। সর্বশেষ পরীক্ষা এই বিষয়টিই নিশ্চিত করছে।’
ওই সাক্ষাৎকারে অঙ্কিত পান্ডা যে বিষয়টিতে আলোকপাত করেছেন, তা হলো দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনৈতিক অবস্থা। তিনি বলছেন, ‘কিম জং উনের রাজনৈতিক বিবেচনাও আছে। এই পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে তিনি এই বার্তা দিতে চান যে, দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটও জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নে গৃহীত পদক্ষেপ থেকে তাঁকে এক পা-ও পিছু হটাবে না।’
কোভিড মহামারি থেকে বাঁচতে দেশটি সম্প্রতি ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশ চীনের সঙ্গেও তাদের সব ধরনের লেনদেন বন্ধ করে দেয়। ফলে দেশটি সম্প্রতি খাদ্যসংকট এবং অর্থনৈতিকভাবে নড়বড়ে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে বিভিন্ন সূত্র বলছে, শিগগিরই এই বাণিজ্যিক লেনদেন আবার চালু হবে।
দেশটির প্রেসিডেন্ট কিম জং উন সম্প্রতি স্বীকার করেছেন, তাঁর দেশ এক ‘জীবন-মরণ সমস্যা’র মুখোমুখি। একই সময়ে তিনি হাইপারসোনিক মিসাইলসহ দেশটির সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির অঙ্গীকারও করেন।
যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর উত্তর কোরিয়ার পরমাণু অস্ত্র তৈরি বন্ধে যে আলোচনা চলমান ছিল, তা স্থবির হয়ে গেছে। এ ছাড়া চলতি মাসের প্রথম দিকে কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোর জবাবে যুক্তরাষ্ট্র আবারও নতুন করে উত্তর কোরিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। তাই, সোমবারের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষাকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ‘কড়া জবাব’ বলে আখ্যায়িত করছেন, দক্ষিণ কোরিয়ার এওহা উইমেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর কোরিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ পার্ক উন-গন। তিনি বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে উত্তর কোরিয়া বলতে চায়, যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের কারণে তারা ভীত নয়।
এখানে চীনের অংশ কোথায়
মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের এ সম্পর্কিত এক বিশ্লেষণে বলা হয়, উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানো ও এর কারণে সৃষ্ট উত্তেজনা এমন এক সময়ে বাড়ছে, যখন চীন প্রস্তুতি নিচ্ছে শীতকালীন অলিম্পিকের আয়োজনের জন্য। আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি বেইজিংয়ে বসছে শীতকালীন অলিম্পিকের আসর। আবার দক্ষিণ কোরিয়ায় চলছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রস্তুতি। দেশটিতে আগামী ৯ মার্চ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সব মিলিয়ে গোটা অঞ্চলের জন্যই সময়টি গুরুত্বপূর্ণ। চীনের কাছে শীতকালীন অলিম্পিকের মহা আয়োজনটি রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্মানজনক। উত্তর কোরিয়াবিষয়ক আরেক বিশেষজ্ঞ শাদ ও’ক্যারল এ সম্পর্কিত এক টুইটে বলেছেন, ‘বেইজিং অলিম্পিকের প্রাক্কালে চীন তাদের ঘরের পেছনে এমন পরীক্ষাকে কোনোভাবেই স্বাগত জানাবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি এমন চলতে থাকে, তাহলে চীন-উত্তর কোরিয়া সম্পর্ক কিছুটা হলেও শীতল হবে না—এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
তবে এ প্রসঙ্গে অঙ্কিত পান্ডার বক্তব্য হলো—‘হয়তো চীন এই পরীক্ষাগুলোর কারণে সন্তুষ্ট নয়। কিন্তু তারা হয়তো এ ক্ষেত্রে ধৈর্যের পরিচয় দেবে।’
চীনের সঙ্গে আবারও বাণিজ্য শুরু হতে যাওয়ার বিষয়ে আলোকপাত করে আরেক উত্তর কোরীয় বিশেষজ্ঞ লেইফ এরিক ইজলি বিবিসিকে বলেন, ‘বাণিজ্য পুনরায় আরম্ভ করার এই সময়ই বলে দেয় চীনের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক যতটা ধারণা করা হয়, তার চেয়েও জটিল। চীন উত্তর কোরিয়াকে অর্থনৈতিক ও সামরিক উভয়ভাবেই সাহায্য করছে।’
তবে ধারণা করা যায়, উত্তর কোরিয়া হয়তো চীনের সঙ্গে তাদের কৌশলগত সম্পর্কের কথা বিবেচনা করে বেইজিং অলিম্পিকের আগে আরও পরীক্ষা চালানো থেকে বিরত থাকবে।
আছে আরও সমীকরণ
উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি ও পরীক্ষা চালানোর প্রসঙ্গে সবচেয়ে বেশি যে দেশটির নাম উচ্চারিত হয়, তা হলো যুক্তরাষ্ট্র। আর যুক্তরাষ্ট্রের নামটি জড়িয়ে আছে তাদের আঞ্চলিক মিত্র জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার কারণে। দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য আগামী কয়েক মাস বেশ গুরুত্বপূর্ণ, তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কারণেই। এই সময়ে তারা কোনো সংকট দেখতে চায় না। কিন্তু তারাই আবার ওয়াশিংটনের সঙ্গে মিলে যৌথ মহড়া চালাচ্ছে। এটি নিশ্চিতভাবেই পিয়ংইয়ংকে রুষ্ট করে থাকবে। সঙ্গে এশিয়া অঞ্চলে বাইডেন প্রশাসনের বর্ধিত আগ্রহের বিষয়টি যোগ করে নেওয়া যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেন ইস্যুতে আলোচনায় ব্যস্ত। আলোচনার মাঝপথেই যদিও তারা মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। একই কাজ তারা করেছে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রেও। একদিকে তারা পিয়ংইয়ংকে আলোচনার টেবিলে বসার আহ্বান জানাচ্ছে, অন্যদিকে আরোপ করছে নিষেধাজ্ঞা। এ অবস্থায় নিরাপত্তার কথা বলে কিম জং উনও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা বাড়াচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, ২০১৯ সালের পর থেকে তাদের পরীক্ষা চালানো ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আগের চেয়ে শক্তিশালী, যা দক্ষিণ, কোরিয়া, জাপান এবং অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রকে ভাবনায় ফেলার জন্য যথেষ্ট। ২০১৯ সালে হ্যানয়ে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলন ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই উত্তর কোরিয়া বলছে, তারা আলোচনার প্রাক্কালে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে বাধ্য নয়।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনেও ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যকার আলোচনার বিষয়টি উঠে এসেছে। সেখানে বলা হচ্ছে, ২০১৯ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উনের বৈঠক কোনো ফল আনতে পারেনি। হ্যানয়ের সেই সম্মেলনের ব্যর্থতা উত্তর কোরিয়াকে আশাহত করেছে। এখন জো বাইডেন বিনা শর্তে আলোচনার জন্য পিয়ংইয়ংকে ডাকছেন। কিন্তু কিম এতে কোনো আশ্বাস পাচ্ছেন না। দেশটির পক্ষ থেকে স্পষ্ট বলা হয়েছে—ওয়াশিংটন কূটনৈতিক আলাপের কথা বললেও ওয়াশিংটন তাদের পুরোনো চাপ প্রয়োগ ও একঘরে করার নীতিতে চলছে। তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে এই ভাষ্যের প্রমাণ হিসেবে সরাসরি ‘নিষেধাজ্ঞার’ কথা বলা হয়েছে।
সব মিলিয়ে উত্তর কোরিয়া আসলে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে নিরাপত্তা প্রশ্নে একটি নিশ্চয়তা চাইছে। তাহলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় ফিরছে না কেন? সোজা উত্তর—অবিশ্বাস। আর এই অবিশ্বাস থেকেই তারা পাল্টা চাপ প্রয়োগের নীতি নিয়েছে। আর চাপ প্রয়োগের জন্য তারা এই সময়টিকে বেছে নিয়েছে কারণ, এটি সংশ্লিষ্ট সবগুলো পক্ষের জন্যই ভীষণভাবে সংবেদনশীল একটা সময়। যুক্তরাষ্ট্রের সামনে আছে ইউক্রেন সূত্রে রাশিয়া, চীনের সামনে আছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের শৌর্য প্রদর্শনের উপলক্ষ, দক্ষিণ কোরিয়ার সামনে অভ্যন্তরীণ গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন। মূল লক্ষ্য দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থবহ আলোচনায় ফেরাতে তাই এই সময়টিই বেছে নিয়েছে দেশটি, যেখানে তারা চায় চীনও পরোক্ষে অংশ নিক।
এই লক্ষ্যে তারা কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। অন্তত চীনকে এ খেলার গ্যালারিতে ডেকে আনা গেছে। উত্তর কোরিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে চীন এরই মধ্যে বলেছে, ‘কোরীয় উপসাগরের সংকটে নিষেধাজ্ঞা কোনো সমাধান তো আনতে পারবেই না, বরং আক্রমণাত্মক মনোভাব বাড়াবে।’
বিশ্লেষণ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
ইউক্রেনের ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র সারা বিশ্বে আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও, রাশিয়ার এ ধরনের আক্রমণকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে—যেমনটি ইসরায়েল উত্তর গাজাকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে হয়েছে।
১ দিন আগেট্রাম্প ফিরে আসায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের ধারাবাহিকতাই বজায় থাকতে পারে, সামান্য কিছু পরিবর্তন নিয়ে। ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান পেছনের সারিতে থাকলেও বাংলাদেশ,
১ দিন আগেড. ইউনূস যখন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন পুরো জাতি তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল। তবে তাঁকে পরিষ্কারভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে যে, তিনি কীভাবে দেশ শাসন করবেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
২ দিন আগেসম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
৩ দিন আগে