লকডাউন দিয়ে কি ডেলটাকে থামানো গেল?

ইয়াসিন আরাফাত 
প্রকাশ : ১১ আগস্ট ২০২১, ০৯: ০০

গত ফ্রেব্রুয়ারি পর্যন্ত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিস্তার বেশ নিয়ন্ত্রণেই ছিল। এরপর হঠাৎ করে লাগাম ছাড়া হয়ে গেলে গত এপ্রিল থেকে নানা মাত্রায় ‘নানা নামে’ বিধিনিষেধ দিয়ে যাচ্ছে সরকার। প্রথম পর্যায়ের লকডাউনে সংক্রমণ কিছুটা কমলেও ডেলটা ধরন ছড়িয়ে পড়ায় কঠোর এবং কঠোরতম বিধিনিষেধের মধ্যেও মৃত্যু ও শনাক্তের রেকর্ড দেখেছে দেশ। 

এদিকে পরিস্থিতি বিবেচনায় বিধিনিষেধ আর বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না সরকারের পক্ষে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, লকডাউন শিথিলের পর আরও বাড়তে পারে সংক্রমণ। তবে তাঁদের মতে, স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে ঠেকানো যেতে পারে এই ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার। পাশাপাশি করোনা রোগী চিহ্নিত করে আইসোলেশনে রাখার প্রতিও জোর দিয়েছেন তাঁরা। আর সেই সঙ্গে গণ টিকা দান কর্মসূচি বাস্তবায়ন ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের কোনো উপায় তাঁরা দেখছেন না। 

চলতি বছরের মার্চে দেশে শুরু হয় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। তখন শনাক্ত ও মৃত্যু প্রতিদিনই রেকর্ড ছাড়ায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ৫ এপ্রিল থেকে শুরু করে চলাচলে বিধিনিষেধ। কখনো শিথিল কখনো কড়াকড়ি–এভাবে ২৪ মে পর্যন্ত চলে। ওই সময় রোগী শনাক্তের হার ও মৃত্যু কিছুটা কমেছিল। যেখানে ৫ এপ্রিল দেশে ৭ হাজার ৭৭৫ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়। আর মারা যান ৫২ জন। সেদিন নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে করোনা রোগী শনাক্তের হার ছিল ২৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। সেখানে ২৪ মে দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয় ১ হাজার ৪৪১ জন। মৃত্যু ৫২ থেকে নেমে আসে ২৫ জনে। ওই সময় শনাক্তের হার ছিল ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। 

গত এপ্রিলে বাংলাদেশে ডেলটা ধরন শনাক্ত হওয়ার পর এর সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে শুরু করে। সে প্রমাণ পাওয়া যায় সংক্রমণ শনাক্তের হারে। মোট করোনাভাইরাস পজিটিভ নমুনার মধ্যে মে মাসে ৪৫ শতাংশ এবং জুন মাসে ৭৮ শতাংশই ছিল ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট। দ্রুত সংক্রমণ বিস্তারে সক্ষম এ ভ্যারিয়েন্ট নিয়ন্ত্রণে আবারও বিধিনিষেধ আরোপরে সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। গত ১ জুলাই থেকে আসে কঠোর বিধিনিষেধ। এ সময় গত এপ্রিল–মে মাসের চেয়েও কঠোর হয় প্রশাসন। তবে এতেও চিত্র পাল্টায়নি। 

গত ১ জুলাই কঠোর লকডাউনের প্রথম দিনে বাংলাদেশ করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৮ হাজার ৩০১ জন। ওই সময় করোনায় মৃত্যু হয়েছিল ১৪৩ জনের। ওই সময় শনাক্তের হার ছিল ২৮ দশমিক ২৭ শতাংশ। এদিকে সোমবার (৯ আগস্ট) দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয় ১১ হাজার ৪৬৩ জন। আর মারা যান ২৪৫ জন। আর রোগী শনাক্তের হার ছিল ২৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। 

এর মধ্যে গত মে মাসে লকডাউন মাথায় নিয়ে ঈদুল ফিতর উদযাপন করে বাংলাদেশের মানুষ। ওই সময় লকডাউন চললেও বাড়ি ফিরতে ঘরমুখী মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায় বাংলাবাজার–শিমুলিয়া, পাটুরিয়া–দৌলতিয়া ঘটে। সেই সঙ্গে ঈদের সময় খুলে যায় দোকনাপাটও। এর প্রভাব দেখা যায় জুন মাসে। যখন করোনা আক্রান্ত ৭৮ শতাংশ রোগীর দেহে ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়। 

এদিকে ঈদুল আজহার আগে অর্থনীতি বাঁচানোর দোহাই দিয়ে গত ১৫ জুলাই লকডাউন শিথিল করে সরকার। ওই সময়েও খুলে দেওয়া হয় গণপরিবহন, আন্তঃজেলা বাস। সরকার কয়েক দিনের জন্য পশুর হাট বসানোর অনুমতি দেয়। সম্প্রতি চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে ৯৩ শতাংশ রোগী ডেলটায় সংক্রমিত। অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্ত শতভাগ শিশুই ডেলটা ধরনে সংক্রমিত। আর এসময় সারা দেশে সংক্রমণের হার ৩০ শতাংশের আশেপাশেই থেকেছে। 

এখন প্রশ্ন উঠেছে এপ্রিল–মে–এর লকডাউনে সংক্রমণ কমলেও কেন এবারের লকডাউনে সংক্রমণ কমানো সম্ভব হয়নি? 
 
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, অতি সংক্রামক ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ায় ব্যর্থ হয়েছে অপরিকল্পিত লকডাউন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে–নজির আহমেদ বলেন, লকডাউন দিয়ে সংক্রমণ কমছে না। আর এটি একটি চিন্তার বিষয়। কারণ আমাদের শেষ অস্ত্রই ছিল লকডাউন। 

সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বর্তমান করোনা আক্রান্তদের ৯৮ শতাংশ ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। এ ছাড়া আক্রান্তদের মধ্যে ১ শতাংশের দেহে বেটা ভ্যারিয়েন্ট এবং একজন রোগীর দেহে মরিশাস বা নাইজেরিয়ান ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে ৯৩ শতাংশ রোগী ডেলটায় সংক্রমিত। অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্ত শতভাগ শিশুই ডেলটা ধরনে সংক্রমিত। পরিস্থিতি এমন হলেও বুধবার (১১ আগস্ট) থেকে উঠে যাচ্ছে লকডাউন। 

এদিকে গত ২ আগস্ট থেকে ধারাবাহিকভাবে সংক্রমণের হার কমছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার (১০ আগস্ট) সংক্রমণ শনাক্তের হার ২৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লকডাউন উঠিয়ে দিলে বাড়তে পারে সংক্রমণ। 
 
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ ডা. বে–নজির আহমেদ বলেন, লকডাউন তুলে দিলে অবশ্যই (সংক্রমণের) উর্ধ্বগামিতা থাকবে। আগামী মাসগুলোতে আমাদের দেশের পরিস্থিতি খুব ভালো মনে হচ্ছে না। 

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, বাস্তবতার নিরিখে দীর্ঘ লকডাউন কোনো সমাধান নয়। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, যারা দিন আনে দিন খায় তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা–এগুলো মেন্টেইন করতে না পারলে লকডাউন কখনো কার্যকর হবে না। 

এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা এবং করোনা রোগীর আইসোলেশনের ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এ নিয়ে ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, মাস্ক পরতে হবে, শারীরিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। এসব যারা করে না তাদের বাধ্য করাতে হবে প্রশাসনকে। 

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে–নজির আহমেদ বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আইসোলেশন। উৎসমুখটি যাতে বন্ধ করতে পারি আমাদের সেই জায়গায় কাজ করতে হবে। পাশাপাশি ব্যাপকভাবে গণটিদান কর্মসূচি সফলভাবে সম্পন্ন করার ওপরও জোর দিতে হবে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত