হামাসের হামলায় মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতি ওলট-পালট

হুসাইন আহমদ, ঢাকা
প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৩, ১৫: ৪৮
আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২৩, ০০: ০১

মধ্যপ্রাচ্য তুলনামূলক শান্ত বলে গত সপ্তাহের শেষ পর্যন্ত স্বস্তিতেই ছিল জো বাইডেনের প্রশাসন। এই অঞ্চলকে ঘিরে নিজের দ্বিমুখী কৌশল নীরবে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এই কৌশল হলো একদিকে ইসরায়েল ও সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করায় মধ্যস্থতা করা, অন্যদিকে ইরানের পারমাণবিক উচ্চাভিলাষকে আটকে রাখা।

গত শনিবার ইসরায়েলের ভেতরে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশ্রস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের অতর্কিত ও নজিরবিহীন হামলা যুক্তরাষ্ট্রের সেই কৌশলকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। হামাস যোদ্ধারা গেরিলা কায়দায় চারদিক থেকে ইসরায়েলের শহরগুলোতে ঢুকে তাণ্ডব চালিয়েছে। তাদের হামলায় শত শত মানুষ নিহত হয়েছে এবং অনেককে অপহরণ করা হয়েছে।

প্রতিশোধ হিসেবে ইসরায়েল গাজার উপকূলীয় ছিটমহল গুঁড়িয়ে দিচ্ছে; শত শত ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। পুরো গাজাকে অবরুদ্ধ করে পানি, বিদ্যুৎ, খাবারসহ জরুরি পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছে। সেখানে মুহুর্মুহু বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরাইলি বাহিনী। এখন নতুন করে স্থলপথে হামলার পরিকল্পনা করছে।

ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনিদের কঠিন সংঘাতকে কিছুটা দূরেই সরিয়ে রেখেছিলেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। কিন্তু এখন হঠাৎ করেই এমন এক সংকটের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করলেন, যেটা তাকে মধ্যপ্রাচ্য নীতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। পাশাপাশি তাকে কট্টর ডানপন্থী ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে অস্বস্তিকর জোট গঠনের পথে ঠেলে দিচ্ছে।

এর ফলে ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে এক ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মুখে পড়লেন বাইডেন। কারণ, এই সংঘাতে একদিকে যেমন তেলের বাজার অস্থিতিশীল হতে পারে। আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতিতে আটকে থাকা যুক্তরাষ্ট্রকে এখন সম্পদ ও মনোযোগ অন্যদিকে সরাতে হবে।

বাইডেনের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের যুগান্তকারী চুক্তির প্রচেষ্টাকে বড় ধাক্কা দিয়েছে হামাসের হামলা। যুক্তরাষ্ট্রে ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ হিসেবে তালিকাভুক্ত হলেও ইরান হামাসের দীর্ঘকালের হিতৈষী। আর তাই ইরানের প্রতি ওয়াশিংটনের দৃষ্টিভঙ্গি আরও বৈরী হয়ে উঠছে।

গাজা সিটিতে ইসরায়েলি হামলার পর ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। ছবি: এএফপিযদিও দীর্ঘদিনের দুই শত্রু ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা সংকট কাটিয়ে উঠে সফল হবে বলে আশা করছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। তবে অনেক বিশেষজ্ঞই সে ক্ষেত্রে হতাশা ছাড়া আর কিছু দেখছেন না।

ওয়াশিংটনভিত্তিক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক প্রোগ্রামের প্রধান জন অল্টারম্যানের সুরে সেই হতাশা স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ভাষ্যের বিপরীতে তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিকীকরণের সমস্ত প্রচেষ্টা যে অদূর ভবিষ্যতের জন্য আটকে গেল, তা খুব সহজেই বলা যায়।’

সৌদি আরব ও ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনের সবচেয়ে শক্তিশালী দুই মিত্র। এদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ার বাইডেনের প্রচেষ্টা মার্কিন প্রশাসনের কাছে একইসঙ্গে তেহরানের বিরুদ্ধে এবং তেলসমৃদ্ধ উপসাগরে চীনের প্রবেশে মোকাবিলায় শক্ত প্রতিরোধ গড়ার কৌশল।

হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জন কারবি সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনা স্থগিত বা পিছিয়ে গেছে—এমন কড়া কথা তিনি বলতে চান না। তবে ওয়াশিংটন আপাতত শুধু ইসরায়েলকে ‘আত্মরক্ষায়’ সহায়তা দেবে।

মধ্যপ্রাচ্যে সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জোনাথন প্যানিকফ বলছেন, নতুন এই যুদ্ধের পরে স্বাভাবিকীকরণের গন্তব্যে যাবে না আরবের পথ। কারণ, এরই মধ্যে ইসরায়েলি হামলা গাজার বেশিরভাগ অঞ্চল মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে।

সৌদি আরব সংশ্লিষ্ট এক সূত্র একই সুরে গলা মিলিয়ে বলছে, আরেকটি আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের কথা বলা বোধহয় কঠিন হবে।

তবে ইসরায়েল-সৌদি আরব নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যাপক সমালোচনা কুড়িয়েছে। অনেকেই এই প্রচেষ্টাকে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিকে চাপিয়ে রাখা হিসেবে দেখছেন। যুক্তরাষ্ট্র ‘ফিলিস্তিনিদের উপেক্ষা করে’ সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ফিলিস্তিনের সাবেক উপদেষ্টা খালেদ এলজিন্দি।

গত মার্চে চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি–ইরান চুক্তি হয়। ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এবং চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। ছবি: সংগৃহীতমিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটে কর্মরত এই কূটনীতিক বলেন, ‘এখন আমরা যা যা দেখছি, তা কেন দেখছি বুঝতে হলে এই যে অবহেলা তাকে বিবেচনায় নিতে হবে।’

ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা ও আঞ্চলিক সূত্রগুলোর মতে, ফিলিস্তিনিদের উপেক্ষা করে ইসরাইলকে নিরাপত্তা দেওয়া মেনে নিচ্ছে না হামাস। কারণ, তাহলে সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক যত দূর এগিয়েছে, তা বাধাগ্রস্ত হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘকাল স্থগিত থাকা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন আলোচনা আবার চালু করার চেষ্টার জন্য এটি সঠিক সময় নয়। কারণ, উভয় পক্ষ থেকে অনড় অবস্থানের অভিযোগ আছে। তবে ইরানকে ঠেকাতে মার্কিন নিরাপত্তার জন্য সৌদি আরব দীর্ঘমেয়াদে আলোচনার টেবিলে ফিরতে পারে বলে মনে করেন প্যানিকফ।

হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরায়েলকে সহায়তা এবং আমেরিকানসহ বহু জিম্মিকে মুক্ত করার প্রচেষ্টার মধ্যেও বাইডেন প্রশাসন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিকল্পকে বাঁচিয়ে রাখার কৌশল খুঁজতে পারে বলে মনে করেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। 

কিন্তু হামাসের হামলা ও জিম্মি সংকটের মুখে পড়া নেতানিয়াহু কোনো ছাড় দেবেন না বলেই মনে হয়। কারণ, এরই মধ্যে ওয়াশিংটন ও রিয়াদের চাওয়া অনুযায়ী ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সমঝোতার প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।

বড় ধাক্কা খেল চীনের উচ্চাভিলাষ ও ভারতের করিডর

মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠার চীনা উচ্চাভিলাষ এই হামলায় বড় ধাক্কা খেয়েছে। গত মার্চে চীনের মধ্যস্ততায় সৌদি-ইরান চুক্তির পর ওয়াশিংটনের দীর্ঘ আধিপত্য বলয়ে থাকা এই অঞ্চলে বেইজিংয়ের নজরকাড়া উপস্থিতি নিয়ে দেশটির গণমাধ্যমে বেশ হই চই হয়। বিশ্বজুড়ে ‘হটস্পট ইস্যু’ বা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় চীন গঠনমূলক অবদান রাখবে বলে তখন দেশটির শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই ঘোষণা দেন।

কিন্তু হামলার পর চীন সরকারের মুখপাত্র যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, তাতে হামাসকে নিন্দা না জানিয়ে ‘উত্তেজনা প্রশমনের’ ডাক দেওয়া হয় এবং সংকট মোকাবিলায় ফিলিস্তিনে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ‘দুই রাষ্ট্র নীতি’ গ্রহণে উভয় পক্ষকে আহ্বান জানানো হয়। বিষয়টি নিয়ে চীনের শীর্ষ নেতা সি চিনপিং মুখ খুলেননি।

চীন-মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেন নেদারল্যান্ডসের ইউনিভার্সিটি অব গ্রোনিনজেনের সহকারী অধ্যাপক বিল ফিগোয়েরোয়া। তিনি বলছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে চীনের বড় খেলোয়াড় হয়ে ওঠার যে প্রপাগান্ডা ছড়ানো হয়েছিল, এই যুদ্ধ নিঃসন্দেহে তাতে ফুটো তৈরি করেছে।’

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমালোচনা কুড়ালেও চীনের এই ‘ঝুঁকি এড়িয়ে চলা’র নীতি নতুন নয়, গতানুতিক কূটনীতিরই বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জন্য অবদান রাখার হাকডাক করে চীন যে ভাবমূর্তি তৈরি করল, তাতে চিড় ধরাল ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ। আর তাই চীনকে কৌশল নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

এদিকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলার যে নীতি নয়াদিল্লি বহুদিন ধরে অনুসরণ করে আসছিল, তা যাবৎকালে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়েছে। এই যুদ্ধ শুরুর মাত্র এক মাস আগে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) পাল্টায় যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবকে সঙ্গে নিয়ে ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ করিডর (আইএমইসি) প্রকল্পের ঘোষণা আসে।

কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর আরব বিশ্বের পরিবর্তিত অবস্থানের প্রেক্ষাপটে এই করিডরের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। কারণ, এর মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরায়েলের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।সেটা আরব দেশগুলো মেনে নেবে না। আর এই করিডর যেহেতু ইসরাইলকে সংযুক্ত করবে, সেহেতু এই উদ্যোগ যে অদূর ভবিষ্যতে আলোর দেখবে তা আশা করা কঠিন।

জল্পনায় ইরানের উসকানি

হামাসের হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ইরানবিষয়ক নীতি পর্যালোচনায় বাধ্য হতে পারে। কারণ, ইরান হামলায় জড়িত বলে মনে করছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। তবে তেহরানের সরাসরি জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ তাঁদের কাছে নেই। দেশটি হামাসের হামলার প্রশংসা করলেও এতে ভূমিকা থাকার কথা অস্বীকার করেছে।

যদিও ইসরায়েল অভিযোগ, তেহরান হামাসকে ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে হামলা চালিয়েছে বলে। দ্য গার্ডিয়ানের কূটনীতি-বিষয়ক সম্পাদক প্যাট্রিক উইনটরের মতে, ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার যেকোনো প্রচেষ্টাকে ইরান অসম্ভব করে তুলতে চায়।

হামাসের হামলার পেছনে আল আকসা মসজিদ নিয়ে উসকানি দেওয়াসহ নেতানিয়াহু জোটের কয়েক মাসের কর্মকাণ্ডে সৃষ্ট ক্ষোভ প্রভাবক হিসেবে কাজ করলেও ইরান ও তার মদদপুষ্ট বাহিনীর দীর্ঘদিনের কৌশলগত অবস্থানকে খারিজ করা যাবে না।

উইনটর বলছেন, সৌদি আরব ও ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র সহজে শেকড় গাঁড়বে বলে মনে করে ইরান। আর একবার যদি সেটা সফল হয়, তাহলে ফিলিস্তিনিরা তাদের মদতদাতা হারাবে।

‘উপসাগরের যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে মদদ দিয়েছে, তারা ভুল ঘোড়ার ওপর সওয়ার হয়েছে’ বলে কয়েক দিন আগে কড়া সাংকেতিক বার্তা দেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যমে তিনি বলেন, ‘যেসব  সরকার ইহুদিবাদী শাসনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জুয়া খেলায় মত্ত, তারা ক্ষতির মুখে পড়বে।’

তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন ইসলামিক জিহাদের প্রধান জিয়াদ আল-নাখালা। গত শুক্রবার তিনি বলেন, ‘যারা ইহুদিবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দিকে ছুটছেন, তাঁরা এরই মধ্যে স্বীকার করে নিয়েছেন, ফিলিস্তিন আমাদের নয়, আল আকসা মসজিদসহ জেরুজালেমও নয়।’

বিশ্লেষকেরা বলছেন, হামাসের এক হামলায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ‘অপ্রতিরোধ্য’ বলে খ্যাতি ধসে গেছে। এর ফলে ইসরায়েলের সঙ্গে ‘ছায়া যুদ্ধে’ ইরানের সাহস বাড়বে। দেশটি এখন যুক্তরাষ্ট্রকে ঠেকাতে ‘প্রক্সি যুদ্ধে’ অর্থাৎ তার পক্ষ হয়ে প্রতিবেশীদের ব্যবহার করবে।

আটলান্টিক কাউন্সিলের গবেষক প্যানিকফ বলেন, ‘ইরান এখন আর নিরুৎসাহে বসে থাকবে না। কারণ, তাহলে সরকার সামরিক সংঘাতে জড়িত হতে বা ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে ইচ্ছুক নয় বলে ভাবমূর্তি তৈরি হবে।’

কিন্তু গত মাসে মার্কিন বন্দী বিনিময়ের জন্য ইরানের ৬০০ কোটি ডলারের তহবিল অবমুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র। এতে রিপাবলিকানদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে বাইডেন প্রশাসনকে। সে কারণেই ইরানকে নতুন করে হিসাব-নিকাশ করতে হতে পারে। যদিও ন্দী বিনিময়ের উদ্যোগকে ‘আস্থা তৈরির পদক্ষেপ’ হিসেবে দেখিয়েছেন মার্কিন কর্মকর্তারা।

কোন পথে যাবে সৌদি আরব

হামাসের হামলা থেকে সৃষ্ট যুদ্ধে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে সৌদি আরব। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক সব পক্ষীয় উদ্যোগের সঙ্গেই আছে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে নতুন রাজতন্ত্র। সৌদি আরব যেমন বিদেশি বিনিয়োগের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে এবং ইসরায়েলের প্রযুক্তির জন্যও ক্ষুধার্ত। তার উপর ওয়াশিংটনের কাছ থেকেও প্রতিরক্ষা নিরাপত্তা চায় রিয়াদ।

গত সেপ্টেম্বরে বাহরাইনকে সামরিক সরঞ্জাম দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এর চেয়ে শক্তিশালী না হলেও সমকক্ষ অস্ত্র এবং বেসামরিক পারমাণবিক জ্বালানি চায় সৌদি আরব। আবার ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংলাপ শুরুর দৃশ্যমান অগ্রগতিও দেখতে চায় দেশটি।  আলোচনার জন্য আগামী সপ্তাহে সৌদি আরব সফরে কথা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। ছবি এএফপিকিন্তু এর মধ্যেই ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধে হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে। হামাসের হামলার পর রিয়াদ প্রাথমিক যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তা থেকে কূটনৈতিক পরিণতি নিয়ে ভাবনা আন্দাজ করা যায়। সেখানে ফিলিস্তিনের ‘উপদল ও দখলদার বাহিনীর’ মধ্যে ‘অভূতপূর্ব পরিস্থিতি’র কথা তুলে ধরে সব পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে সৌদি আরব।

ইসরায়েলের নাম না ধরে ‘টানা দখলদারিত্ব, বৈধ অধিকার থেকে ফিলিস্তিনি জনগণকে বঞ্চিত রাখা এবং পবিত্র স্থানে (আকসা) যাওয়া নিষেধাজ্ঞা এবং পদ্ধতিগত উসকানির পুনরাবৃত্তির ফলে পরিস্থিতি যে বিস্ফোরিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে, সে বিষয়ে আগের সতর্কবাণী’ স্মরণ করিয়ে দেয় রিয়াদ। ফিলিস্তিনে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ওপরও জোর দিয়েছে রিয়াদ। কিন্তু এই প্রতিক্রিয়ায় তো ইসরায়েলের খুশি হওয়ার কথা না।

পরিস্থিতি নিয়ে ব্লিঙ্কেন, ইইউ প্রতিনিধি জোসেপ বোরেল ও উপসাগরীয় প্রতিটি দেশের প্রতিপক্ষের সঙ্গে কথা বলছেন সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সেই আলোচনার ফল মিলতে পারে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি অধিবেশনে। তবে অনেক পশ্চিমা কূটনীতিক গোপনে স্বীকার করেছেন, নিজেদের নীতির কারণেই মধ্যপ্রাচ্য সংকট তাঁদের নাগালের বাইরে।

তবে প্রকৃত কূটনৈতিক আলোচনা গোপনেই হবে। স্বল্প মেয়াদে তুরস্ক ও মিসর মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে পারে। নির্বাচনের দুই মাস বাকি থাকতে মিশর গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ হজম করতে পারবে না। এদিকে হিজবুল্লাহও গাজায় ব্যাপক হামলার সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে মিসরের মাধ্যমে ইসরায়েলকে আগেই বার্তাও পাঠিয়েছে। তবু ইসরায়েল হামলার তীব্রতা বাড়াচ্ছে এবং এখন স্থলভাগ দিয়ে গাজায় প্রবেশের পরিকল্পনা করছে। কিন্তু হিজবুল্লাহও পাল্টা হামলায় অংশ নিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা প্রশমনে, স্থলভাগে হামলার পরিকল্পনা বন্ধ রাখতে, হামাসকে আলোচনায় বাধ্য করতে গাজার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার মতো পদক্ষেপের সীমাবদ্ধ থাকতে ইসরায়েলকে আহ্বান জানাচ্ছে। এদিকে দেশের ভেতর থেকেও শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি উঠছে। কিন্তু জনগণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং গোয়েন্দা বাহিনীর ব্যর্থতা নিয়েও সমালোচনার মুখে পড়ে নেতানিয়াহু আরও আগ্রাসী হয়ে উঠছেন। রাজনৈতিক দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে এর মধ্যেই জাতীয় সরকারও গঠন করেছেন তিনি।

অনেকে বলছেন, ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধের ছয় মাসের মধ্যে গোল্ডা মেয়ারের প্রধানমন্ত্রীর পদে চলে গিয়েছিল। তারপর মেনাখেম বিগিন এসে ১৯৭৮ সালে মিশরের আনোয়ার সাদাতের সঙ্গে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির পথ করে দিয়েছিলেন। তবে এই মুহূর্তে তেমন আশাবাদী ঘটনাবলির পুনরাবৃত্তির কল্পনা কঠিন। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপনে কোন ধরনের কূটনীতি সফল হবে— সেটাই দেখার অপেক্ষা।

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

তথ্যসূত্র: রয়টার্স, দ্য গার্ডিয়ান, ফরেন পলিসি, আল-জাজিরা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত