মারুফ ইসলাম
বেশ কয়েক মাস আগে শ্রীলঙ্কায় নজিরবিহীন বিক্ষোভ হয়েছিল। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের বাসভবনে হামলা চালিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের আশপাশ দখল করে রেখেছিল। প্রেসিডেন্টের সুইমিংপুলে সাঁতার কেটেছিল। বিক্ষোভে টিকতে না পেরে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। সেই বিক্ষোভকারীরা এখন কোথায়?
বিক্ষোভের শুরু হয়েছিল গত বছরের ৩০ মার্চে। তখন দেশটি ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও জ্বালানি তেল পাচ্ছিল না শ্রীলঙ্কার মানুষ। দ্রব্যমূল্য আকাশ ছুঁয়েছিল। বিদ্যুৎ থাকত না দিনের পর দিন। কাগজের অভাবে স্কুল-কলেজে পরীক্ষা নিতে পারছিল না সরকার।
ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে কলম্বোর পথে নেমেছিল শ্রীলঙ্কার মানুষ। তারা এ দুরবস্থার জন্য গোতাবায়া সরকারের দুর্নীতি, লুটপাট, স্বজনপ্রীতি ও রাজাপক্ষের পরিবারতন্ত্রকে দায়ী করে বিক্ষোভ করতে শুরু করেছিল।
প্রায় পাঁচ মাস বিক্ষোভ স্থায়ী হয়েছিল। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে একে একে দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করেছিলেন গোতাবায়ার ভাইয়েরা, যারা সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। শেষে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া নিজেও পালিয়ে যান মালদ্বীপে। সেখান থেকে সিঙ্গাপুরে। সিঙ্গাপুর থেকে থাইল্যান্ডে যান গোতাবায়া। পরে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেও শেষমেশ শ্রীলঙ্কাতেই ফিরে এসেছেন গোতাবায়া।
গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরেছেন গোতাবায়া। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কার নদীগুলোতে অনেক জল গড়িয়েছে। নতুন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে দায়িত্ব নিয়েছেন। বিক্ষোভকারীরা ঘরে ফিরে গেছেন।
কিন্তু শ্রীলঙ্কার অবস্থার কি খুব বেশি ইতরবিশেষ হয়েছে? সরকারের দুর্নীতি, লুটপাট বন্ধ হয়েছে? স্বজনতোষণ বন্ধ হয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে সচ্ছলতা ফিরেছে?
শ্রীলঙ্কার ক্যাথলিক ধর্মযাজক ফাদার জিওয়ান্তা পিরিস বলেছেন, ‘যেসব কারণে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়েছিল, সেসবের সমাধান হয়নি।’
তাহলে সেই বিক্ষোভকারীরা এখন কোথায়?
দিন কয়েক আগে বড় দিনের উৎসব গেল। এ দিন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ভবনের পাশে প্রায় ৮০ ফুট লম্বা ক্রিসমাস ট্রি দেখা গেছে। আরও ছিল আলোকসজ্জা, খাবারের স্টল, আতশবাজি, গানের আসর।
ক্যারোলাস গায়কেরা (যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান শোনান) সাধারণ মানুষদের গান গেয়ে শোনাচ্ছেন। কে বলবে, মাত্র কয়েক মাস আগেই এই জায়গাটি বিক্ষোভে উত্তাল ছিল।
প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থনৈতিক সংকটের এই দুর্দিনে সরকার কেন এত জাঁকজমক করতে গেল। বিশ্লেষকেরা বলছেন, অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তির নানা পথ খুঁজছে শ্রীলঙ্কা সরকার। এর একটি পথ হচ্ছে বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করা। শ্রীলঙ্কার পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে বিদেশিদের যত বেশি আনাগোনা বাড়তে থাকবে, তত বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আসবে। সরকার সেই চেষ্টাই করছে।
কিন্তু সরকারের এসব চেষ্টাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখছে না লঙ্কানরা। স্বস্তিকা অরুলিঙ্গম নামের এক নারী বিবিসিকে বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে এ ধরনের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন স্রেফ জঘন্য। কারণ আমাদের এখন ফুটানি করার মতো অর্থ নেই। এটি সম্পদের অশ্লীল প্রদর্শন ছাড়া আর কিছুই নয়। সরকার জনগণের দুর্ভোগ-দুর্দশা কমানোর চেষ্টা না করে ফুটানি করে বেড়াচ্ছে।’
স্বস্তিকা অরুলিঙ্গম ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘এই আলোকসজ্জার পেছনে বিদ্যুৎ বোর্ডের অন্তত দেড়শ বিলিয়ন রুপি খরচ হয়েছে। এই অযাচিত ব্যয়ের কোনো দরকারই ছিল না।’
শ্রীলঙ্কায় আবারও দৈনিক লোডশেডিংয়ের হার বেড়েছে। খাদ্যের উচ্চমূল্য এখনো বহাল। পরিবহন ভাড়া লাগাম ছাড়া। শিশুদের শিক্ষাব্যয় ঊর্ধ্বগামী। নতুন বছরে সরকার করহার বাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা আরও বেড়েছে।
স্বস্তিকা অরুলিঙ্গম বলেছেন, শ্রীলঙ্কা সরকারের ঠাটবাট দেখে তা বোঝার মুশকিল। মনে হচ্ছে পরিস্থিতি স্থিতিশীল। এটি আসলে ‘ছদ্ম স্থিতিশীলতা’। ভেতরে-ভেতরে মানুষেরা ক্ষয়ে যাচ্ছে। জীবন চালাতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের।
গত বছর প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে শ্রীলঙ্কায় খাদ্য ও জ্বালানি সংকট তীব্র ছিল। মহামারি করোনার ধাক্কায় পর্যটন খাতে ধস নেমেছিল। বৈদেশিক রিজার্ভ কমতে কমতে দেশটি প্রায় দেউলিয়া হতে বসেছিল। কয়েক মাস ধরে তীব্র লোডশেডিংয়ের পর জুলাই মাসে রাস্তায় নেমে এসেছিল বিক্ষুব্ধ মানুষ। তারা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের কার্যালয় ও বাসভবনে ঢুকে তাণ্ডব চালিয়েছিল। দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন গোতাবায়া। পরবর্তীতে নানা জটিলতা পেরিয়ে শ্রীলঙ্কার হাল ধরেছেন রনিল বিক্রমাসিংহে।
ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে প্রায় ছয় মাস। গোতাবায়া দেশে ফিরেছেন। তাঁর সমর্থকেরা আগাম নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী মাসে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
তবে যাই ঘটুক, সাধারণ মানুষের জীবনে অস্থিরতা কাটেনি। জীবনযাপনের ব্যয়ে হেরফের হয়নি। স্বস্তি আসেনি জনজীবনে। এ অবস্থায় কি আবার আগের মতো বিক্ষোভ শুরু হতে পারে? আগের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিক্ষোভ থামাতে ব্যাপক দমন-পীড়ন করেছিলেন গোতাবায়া সরকার। এবার যদি বিক্ষোভ শুরু হয়, তবে কী আগের কায়দাতেই বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করা হবে?
শ্রীলঙ্কার একজন মানবাধিকার কর্মী শ্রীন সারুর বলেছেন, ‘শ্রীলঙ্কায় এই মুহূর্তে যেকোনো ধরনের প্রতিবাদ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। বিক্রমাসিংসে নিজের ক্ষমতা অটুট রাখতে যা যা করা দরকার, তাই করবেন। প্রয়োজনে তিনি সামরিক বাহিনীকেও ডাকতে পারেন।’
গত বছরের বিক্ষোভের অন্যতম এক নেতা ক্যাথলিক ধর্মযাজক ফাদার জিওয়ান্তা পিরিস। তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা করা হয়েছে। এ ছাড়া ফৌজদারি মামলাও করা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ফাদার জিওয়ান্তা পিরিস এসব মামলাকে ‘ভিত্তিহীন অভিযোগ’ বলেছেন এবং আদালতে লড়াই করছেন।
ফাদার জিওয়ান্তা পিরিস বলেছেন, ‘যেসব কারণে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়েছিল, সেসবের সমাধান হয়নি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, সংকটের সমাধান হয়েছে। কিন্তু এটা আসলে চোরাবালি। বালির নিচে চোরাস্রোত বইছে। আসল রোগের চিকিৎসা এখনো করা হয়নি। দুর্নীতি আগের মতোই চলছে। ওষুধের সংকটে মানুষ আগের মতোই চিকিৎসা পাচ্ছে না। অপুষ্টিতে মারা যাচ্ছে শিশুরা। মুদ্রাস্ফীতির চাবুকের আঘাতে নিম্নবিত্ত মানুষেরা দিশেহারা।’
‘রাষ্ট্র তার স্বভাবমতো নাগরিকদের ভয় দেখিয়ে যাচ্ছে’ মন্তব্য করে ফাদার জিওয়ান্তা পিরিস বলেছেন, ‘অর্থ লুটপাটকারী ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিচার না করা পর্যন্ত এই সংকটের সমাধান হবে না। দেশের কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন দরকার।’
গত বছর বিক্ষোভের সময়ে প্রচুর বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করেছে গোতাবায়া সরকার। বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়া অনেক নেতা এখনো কারাগারে ধুঁকছেন। অনেকের ঘাড়ে অসংখ্য মামলা ঝুলছে। অনেকে গোয়েন্দা বাহিনীর নজরদারিতে আছেন। ফলে সব মিলিয়ে সিংহলি ভাষায় যাকে বলে ‘আরাগালা’ অর্থাৎ বিক্ষোভ ঝিমিয়ে পড়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভসের প্রতিষ্ঠাতা ডা. পাইকিয়াসোথি সারাভানামুত্তু বলেছেন, ‘এটি জাতীয় আন্দোলন ছিল। শ্রীলঙ্কা কী হতে পারে তার একটি রূপকল্প ছিল আন্দোলনে। কিন্তু মধ্যবিত্তরা এ আন্দোলনকে শেষমেশ পরিত্যাগ করেছে। এমনকি নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষেরাও এ আন্দোলন থেকে সরে গেছে।’
প্রবীণ রাজনীতিকেরা বিক্রমাসিংহেকে মুক্তির ত্রাতা ভেবেছিলেন। কিন্তু কার্যত তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। এখন নতুন পথ খোঁজা উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন ডা. পাইকিয়াসোথি সারাভানামুত্তু।
শ্রীলঙ্কা এখন চীন ও অন্যান্য ঋণদাতাদের কাছে থেকে অর্থ পাওয়ার আশায় আছে। তত দিন পর্যন্ত মানুষ হয়তো অপেক্ষা করবে। কিন্তু জীবনযাপনের ব্যয় ও অন্যান্য অস্থিরতা যেভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে আবারও গণবিক্ষোভ দেখা দিতে পারে বলে মনে করেন ডা. পাইকিয়াসোথি সারাভানামুত্তু। তিনি বলেছেন, ‘এবার বিক্ষোভ শুরু হতে পারে কলম্বোর বাইরে। কারণ রাজধানীর বাইরে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। ক্রমবর্ধমান খাদ্য ব্যয় ও জ্বালানি ঘাটতি সেসব মানুষকে বিক্ষুব্ধ হতে বাধ্য করবে। এসব মানুষ সংবিধান সংশোধন, দায়মুক্তি এসব বোঝে না। তারা শুধু খেয়ে পরে একটু বেঁচে থাকতে চায়। সুতরাং যে গণবিক্ষোভটি চোখ রাঙাচ্ছে, তা হবে আগের বিক্ষোভের চেয়ে বিপজ্জনক। লড়াইটা হবে তাদের বনাম আমাদের।’
সূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, দ্য ডিপ্লোম্যাট ও আল জাজিরা
বেশ কয়েক মাস আগে শ্রীলঙ্কায় নজিরবিহীন বিক্ষোভ হয়েছিল। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের বাসভবনে হামলা চালিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের আশপাশ দখল করে রেখেছিল। প্রেসিডেন্টের সুইমিংপুলে সাঁতার কেটেছিল। বিক্ষোভে টিকতে না পেরে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। সেই বিক্ষোভকারীরা এখন কোথায়?
বিক্ষোভের শুরু হয়েছিল গত বছরের ৩০ মার্চে। তখন দেশটি ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও জ্বালানি তেল পাচ্ছিল না শ্রীলঙ্কার মানুষ। দ্রব্যমূল্য আকাশ ছুঁয়েছিল। বিদ্যুৎ থাকত না দিনের পর দিন। কাগজের অভাবে স্কুল-কলেজে পরীক্ষা নিতে পারছিল না সরকার।
ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে কলম্বোর পথে নেমেছিল শ্রীলঙ্কার মানুষ। তারা এ দুরবস্থার জন্য গোতাবায়া সরকারের দুর্নীতি, লুটপাট, স্বজনপ্রীতি ও রাজাপক্ষের পরিবারতন্ত্রকে দায়ী করে বিক্ষোভ করতে শুরু করেছিল।
প্রায় পাঁচ মাস বিক্ষোভ স্থায়ী হয়েছিল। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে একে একে দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করেছিলেন গোতাবায়ার ভাইয়েরা, যারা সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। শেষে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া নিজেও পালিয়ে যান মালদ্বীপে। সেখান থেকে সিঙ্গাপুরে। সিঙ্গাপুর থেকে থাইল্যান্ডে যান গোতাবায়া। পরে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেও শেষমেশ শ্রীলঙ্কাতেই ফিরে এসেছেন গোতাবায়া।
গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরেছেন গোতাবায়া। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কার নদীগুলোতে অনেক জল গড়িয়েছে। নতুন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে দায়িত্ব নিয়েছেন। বিক্ষোভকারীরা ঘরে ফিরে গেছেন।
কিন্তু শ্রীলঙ্কার অবস্থার কি খুব বেশি ইতরবিশেষ হয়েছে? সরকারের দুর্নীতি, লুটপাট বন্ধ হয়েছে? স্বজনতোষণ বন্ধ হয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে সচ্ছলতা ফিরেছে?
শ্রীলঙ্কার ক্যাথলিক ধর্মযাজক ফাদার জিওয়ান্তা পিরিস বলেছেন, ‘যেসব কারণে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়েছিল, সেসবের সমাধান হয়নি।’
তাহলে সেই বিক্ষোভকারীরা এখন কোথায়?
দিন কয়েক আগে বড় দিনের উৎসব গেল। এ দিন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ভবনের পাশে প্রায় ৮০ ফুট লম্বা ক্রিসমাস ট্রি দেখা গেছে। আরও ছিল আলোকসজ্জা, খাবারের স্টল, আতশবাজি, গানের আসর।
ক্যারোলাস গায়কেরা (যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান শোনান) সাধারণ মানুষদের গান গেয়ে শোনাচ্ছেন। কে বলবে, মাত্র কয়েক মাস আগেই এই জায়গাটি বিক্ষোভে উত্তাল ছিল।
প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থনৈতিক সংকটের এই দুর্দিনে সরকার কেন এত জাঁকজমক করতে গেল। বিশ্লেষকেরা বলছেন, অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তির নানা পথ খুঁজছে শ্রীলঙ্কা সরকার। এর একটি পথ হচ্ছে বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করা। শ্রীলঙ্কার পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে বিদেশিদের যত বেশি আনাগোনা বাড়তে থাকবে, তত বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আসবে। সরকার সেই চেষ্টাই করছে।
কিন্তু সরকারের এসব চেষ্টাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখছে না লঙ্কানরা। স্বস্তিকা অরুলিঙ্গম নামের এক নারী বিবিসিকে বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে এ ধরনের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন স্রেফ জঘন্য। কারণ আমাদের এখন ফুটানি করার মতো অর্থ নেই। এটি সম্পদের অশ্লীল প্রদর্শন ছাড়া আর কিছুই নয়। সরকার জনগণের দুর্ভোগ-দুর্দশা কমানোর চেষ্টা না করে ফুটানি করে বেড়াচ্ছে।’
স্বস্তিকা অরুলিঙ্গম ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘এই আলোকসজ্জার পেছনে বিদ্যুৎ বোর্ডের অন্তত দেড়শ বিলিয়ন রুপি খরচ হয়েছে। এই অযাচিত ব্যয়ের কোনো দরকারই ছিল না।’
শ্রীলঙ্কায় আবারও দৈনিক লোডশেডিংয়ের হার বেড়েছে। খাদ্যের উচ্চমূল্য এখনো বহাল। পরিবহন ভাড়া লাগাম ছাড়া। শিশুদের শিক্ষাব্যয় ঊর্ধ্বগামী। নতুন বছরে সরকার করহার বাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা আরও বেড়েছে।
স্বস্তিকা অরুলিঙ্গম বলেছেন, শ্রীলঙ্কা সরকারের ঠাটবাট দেখে তা বোঝার মুশকিল। মনে হচ্ছে পরিস্থিতি স্থিতিশীল। এটি আসলে ‘ছদ্ম স্থিতিশীলতা’। ভেতরে-ভেতরে মানুষেরা ক্ষয়ে যাচ্ছে। জীবন চালাতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের।
গত বছর প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে শ্রীলঙ্কায় খাদ্য ও জ্বালানি সংকট তীব্র ছিল। মহামারি করোনার ধাক্কায় পর্যটন খাতে ধস নেমেছিল। বৈদেশিক রিজার্ভ কমতে কমতে দেশটি প্রায় দেউলিয়া হতে বসেছিল। কয়েক মাস ধরে তীব্র লোডশেডিংয়ের পর জুলাই মাসে রাস্তায় নেমে এসেছিল বিক্ষুব্ধ মানুষ। তারা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের কার্যালয় ও বাসভবনে ঢুকে তাণ্ডব চালিয়েছিল। দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন গোতাবায়া। পরবর্তীতে নানা জটিলতা পেরিয়ে শ্রীলঙ্কার হাল ধরেছেন রনিল বিক্রমাসিংহে।
ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে প্রায় ছয় মাস। গোতাবায়া দেশে ফিরেছেন। তাঁর সমর্থকেরা আগাম নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী মাসে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
তবে যাই ঘটুক, সাধারণ মানুষের জীবনে অস্থিরতা কাটেনি। জীবনযাপনের ব্যয়ে হেরফের হয়নি। স্বস্তি আসেনি জনজীবনে। এ অবস্থায় কি আবার আগের মতো বিক্ষোভ শুরু হতে পারে? আগের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিক্ষোভ থামাতে ব্যাপক দমন-পীড়ন করেছিলেন গোতাবায়া সরকার। এবার যদি বিক্ষোভ শুরু হয়, তবে কী আগের কায়দাতেই বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করা হবে?
শ্রীলঙ্কার একজন মানবাধিকার কর্মী শ্রীন সারুর বলেছেন, ‘শ্রীলঙ্কায় এই মুহূর্তে যেকোনো ধরনের প্রতিবাদ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। বিক্রমাসিংসে নিজের ক্ষমতা অটুট রাখতে যা যা করা দরকার, তাই করবেন। প্রয়োজনে তিনি সামরিক বাহিনীকেও ডাকতে পারেন।’
গত বছরের বিক্ষোভের অন্যতম এক নেতা ক্যাথলিক ধর্মযাজক ফাদার জিওয়ান্তা পিরিস। তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা করা হয়েছে। এ ছাড়া ফৌজদারি মামলাও করা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ফাদার জিওয়ান্তা পিরিস এসব মামলাকে ‘ভিত্তিহীন অভিযোগ’ বলেছেন এবং আদালতে লড়াই করছেন।
ফাদার জিওয়ান্তা পিরিস বলেছেন, ‘যেসব কারণে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়েছিল, সেসবের সমাধান হয়নি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, সংকটের সমাধান হয়েছে। কিন্তু এটা আসলে চোরাবালি। বালির নিচে চোরাস্রোত বইছে। আসল রোগের চিকিৎসা এখনো করা হয়নি। দুর্নীতি আগের মতোই চলছে। ওষুধের সংকটে মানুষ আগের মতোই চিকিৎসা পাচ্ছে না। অপুষ্টিতে মারা যাচ্ছে শিশুরা। মুদ্রাস্ফীতির চাবুকের আঘাতে নিম্নবিত্ত মানুষেরা দিশেহারা।’
‘রাষ্ট্র তার স্বভাবমতো নাগরিকদের ভয় দেখিয়ে যাচ্ছে’ মন্তব্য করে ফাদার জিওয়ান্তা পিরিস বলেছেন, ‘অর্থ লুটপাটকারী ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিচার না করা পর্যন্ত এই সংকটের সমাধান হবে না। দেশের কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন দরকার।’
গত বছর বিক্ষোভের সময়ে প্রচুর বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করেছে গোতাবায়া সরকার। বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়া অনেক নেতা এখনো কারাগারে ধুঁকছেন। অনেকের ঘাড়ে অসংখ্য মামলা ঝুলছে। অনেকে গোয়েন্দা বাহিনীর নজরদারিতে আছেন। ফলে সব মিলিয়ে সিংহলি ভাষায় যাকে বলে ‘আরাগালা’ অর্থাৎ বিক্ষোভ ঝিমিয়ে পড়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভসের প্রতিষ্ঠাতা ডা. পাইকিয়াসোথি সারাভানামুত্তু বলেছেন, ‘এটি জাতীয় আন্দোলন ছিল। শ্রীলঙ্কা কী হতে পারে তার একটি রূপকল্প ছিল আন্দোলনে। কিন্তু মধ্যবিত্তরা এ আন্দোলনকে শেষমেশ পরিত্যাগ করেছে। এমনকি নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষেরাও এ আন্দোলন থেকে সরে গেছে।’
প্রবীণ রাজনীতিকেরা বিক্রমাসিংহেকে মুক্তির ত্রাতা ভেবেছিলেন। কিন্তু কার্যত তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। এখন নতুন পথ খোঁজা উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন ডা. পাইকিয়াসোথি সারাভানামুত্তু।
শ্রীলঙ্কা এখন চীন ও অন্যান্য ঋণদাতাদের কাছে থেকে অর্থ পাওয়ার আশায় আছে। তত দিন পর্যন্ত মানুষ হয়তো অপেক্ষা করবে। কিন্তু জীবনযাপনের ব্যয় ও অন্যান্য অস্থিরতা যেভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে আবারও গণবিক্ষোভ দেখা দিতে পারে বলে মনে করেন ডা. পাইকিয়াসোথি সারাভানামুত্তু। তিনি বলেছেন, ‘এবার বিক্ষোভ শুরু হতে পারে কলম্বোর বাইরে। কারণ রাজধানীর বাইরে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। ক্রমবর্ধমান খাদ্য ব্যয় ও জ্বালানি ঘাটতি সেসব মানুষকে বিক্ষুব্ধ হতে বাধ্য করবে। এসব মানুষ সংবিধান সংশোধন, দায়মুক্তি এসব বোঝে না। তারা শুধু খেয়ে পরে একটু বেঁচে থাকতে চায়। সুতরাং যে গণবিক্ষোভটি চোখ রাঙাচ্ছে, তা হবে আগের বিক্ষোভের চেয়ে বিপজ্জনক। লড়াইটা হবে তাদের বনাম আমাদের।’
সূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, দ্য ডিপ্লোম্যাট ও আল জাজিরা
ইউক্রেনের ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র সারা বিশ্বে আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও, রাশিয়ার এ ধরনের আক্রমণকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে—যেমনটি ইসরায়েল উত্তর গাজাকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে হয়েছে।
১ দিন আগেট্রাম্প ফিরে আসায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের ধারাবাহিকতাই বজায় থাকতে পারে, সামান্য কিছু পরিবর্তন নিয়ে। ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান পেছনের সারিতে থাকলেও বাংলাদেশ,
১ দিন আগেড. ইউনূস যখন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন পুরো জাতি তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল। তবে তাঁকে পরিষ্কারভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে যে, তিনি কীভাবে দেশ শাসন করবেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
২ দিন আগেসম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
৩ দিন আগে