অনলাইন ডেস্ক
ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বিগত ৭৫ বছরে ইসরায়েলি বাহিনী প্রতিদিনই ভূখণ্ড দখল করেছে। হত্যা করেছে ফিলিস্তিনিদের। দীর্ঘ এই সময়ে দেশটি কেবল অস্ত্রের ভাষায় কথা বলেনি, অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে অর্থনীতিকেও। সোজা কথায়, ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের বিশেষ করে গাজাবাসীকে বিগত কয়েক দশকে কেবল অস্ত্র দিয়ে হত্যা করেনি; মেরেছে ভাতে-পানিতেও। চলমান যুদ্ধের এই সময়ে এসেও ইসরায়েল একই পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা করছে।
গত ৭ অক্টোবরের ঘটনার পর ইসরায়েল গাজায় যেভাবে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে গাজা নরকে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ফিলিস্তিনি মারা গেছে, আহত হয়েছে আরও সাড়ে ১৫ হাজার। অস্ত্রের আঘাতে মারা যাওয়ার বিষয়টি অনেক বেশি সামনে এলেও ইসরায়েলি অবরোধের কারণে গাজাবাসীর জীবনে খাদ্য, পানি, ওষুধসহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের যে অভাব দেখা দিয়েছে, তা খুব সামান্য উঠে আসছে গণমাধ্যমে।
বিগত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গাজা একপ্রকার অবরুদ্ধ। এই দীর্ঘ সময় ধরে অঞ্চলটি বিদেশি সহায়তায় টিকে আছে। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েলের প্রবল অবরোধে বিদেশি সহায়তাও বন্ধ হওয়ার পথে। সর্বশেষ গত ১৮ অক্টোবর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সামান্য পরিমাণ ত্রাণসহায়তা গাজায় ঢুকতে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেন। সেই ধারাবাহিকতায় গতকাল শনিবার মিসর থেকে ত্রাণবাহী ২০টি ট্রাক গাজায় প্রবেশ করে। মানবিক দিক বিবেচনায় নিলেও ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য হলো গাজায় হামাসকে যেকোনো মূল্যে হীনবল করা এবং এটি করতে গিয়ে যদি অর্থনীতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হয়, ইসরায়েল সেটি করতেও দ্বিধা করবে না।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত অসলো অ্যাকর্ডের পর ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তি অনুসারে, ইসরায়েল ও গাজা-পশ্চিম তীরে একটি মাত্র বাজারব্যবস্থা চালু থাকবে। এই চুক্তির মূল ধারণা ছিল, ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলে কাজের সুযোগ পাবে। ফলে ইসরায়েলি মূলধন ফিলিস্তিনে আসবে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফিলিস্তিনি ধনকুবেররা আবারও ফিলিস্তিনে ফিরে বিনিয়োগ শুরু করবে। কিন্তু বাস্তবে সেটি হয়নি। কারণ খাতা-কলমে চুক্তি হলেও ইসরায়েলি বিধিনিষেধ সব সময়ই বহাল ছিল এবং সে কারণেই ফিলিস্তিনিদের জীবন বিদেশি সাহায্যে ওপর নির্ভরশীল।
এই অবস্থায় বিগত কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি সাধারণ জনগণের জীবনমানের মধ্যকার পার্থক্য ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয়েছে। এই যুদ্ধ শুরুর আগেও গড়ে একজন ইসরায়েলি একজন ফিলিস্তিনির তুলনায় ১৫ গুণ বেশি সম্পদশালী ছিল। কেবল সম্পদের দিক থেকেই নয়, জীবনযাত্রার মানেও ফিলিস্তিনিরা অনেক পিছিয়ে। পশ্চিম তীরের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের কাছে উন্নত পয়োপ্রণালির সুবিধা রয়েছে এবং ১০ শতাংশ পশ্চিম তীরবাসীর কাছে সরাসরি পানি সংগ্রহের কোনো সুবিধা নেই। এত কিছুর পরও ইসরায়েল সেই চুক্তি এখনো বহাল রেখেছে, কিন্তু এর কোনো বাস্তবিক প্রয়োগ নেই। যেমন—পশ্চিম তীরের যেসব ফিলিস্তিনি ইসরায়েলে কাজ করেন, তাঁদের কেবল কায়িক শ্রম ও কম দক্ষতার প্রয়োজন হয় এমন কাজে যুক্ত করা হয়। পাশাপাশি তাঁদের চলাফেরার সুযোগ-সুবিধাও অনেকটাই সীমিত রাখা হয়।
গাজার পরিস্থিতি পশ্চিম তীরের তুলনায় অনেক বেশি খারাপ। ২০০৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পশ্চিম তীরের লোকজনের বাৎসরিক গড় জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু একই সময়ে গাজাবাসীর প্রবৃদ্ধি ছিল নেতিবাচক। ২০০৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে আড়াই শতাংশ হারে সংকুচিত হয়েছে। ২০০৭ সাল থেকেই গাজা ইসরায়েলি অবরোধের শিকার। এর বাইরে গাজার জিডিপি সংকুচিত হওয়ার কারণ হলো ইসরায়েলের সঙ্গে লড়া বেশ কয়েকটি যুদ্ধ। ২০০৮, ২০১৪ ও ২০২১ সালে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তিনটি যুদ্ধে লড়েছে হামাস এবং এসব যুদ্ধে যে পরিমাণ ব্যয় হয়েছে, তা গাজার এক বছরের জিডিপির সমান।
যদি কোনো একটি অর্থনীতিতে উৎপাদন না থাকে, তবে সেই অর্থনীতির কেবল প্রবৃদ্ধিই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, অনেক সমস্যাই দেখা দেয়। বেকারত্ব বাড়ে। আইএমএফের হিসাব বলছে, ২০২১ সালে গাজার অর্ধেকেরও বেশি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। গাজায় আয়ের অল্প কয়েকটি উপায়ই আছে। তার একটি হলো, টানেল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সমুদ্রপথে চোরাচালান। কিন্তু মিসর তার সমুদ্রসীমায় পাহারা কঠোর করার পর থেকে সেই সুযোগও কমে গেছে। গাজার আরেকটি ব্যবসাখাত হলো কনস্ট্রাকশন বা নির্মাণ। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার কনস্ট্রাকশন বা নির্মাণ খাত ২০২২ সালে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। চলমান যুদ্ধ শেষে হয়তো এই খাত আরও প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে।
গাজাবাসীর আয়ের আরেকটি উৎস ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। গাজার প্রায় ৭০ হাজার অধিবাসী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের চাকরি করছে এবং তাদের থেকে বেতনও গ্রহণ করছে। যদিও হামাস গাজা থেকে ২০০৭ সালে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে বের করে দিয়ে নিজস্ব প্রশাসন সাজিয়েছে, তার পরও এসব গাজাবাসী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বেতন পাচ্ছে নিয়মিত। মজার ব্যাপার হলো, বেতন নিলেও এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী কোনো কাজই করেন না। এর বাইরে কাতার গাজার অধিবাসীদের বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ দিয়ে সহায়তা করে। আরও মজার বিষয় হলো, গাজায় ইসরায়েল থেকে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ আসে, তার বিলও পরিশোধ করে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। ইসরায়েল পশ্চিম তীর থেকে যে খাজনা সংগ্রহ করে, সেই টাকা থেকে বিদ্যুতের বিল কেটে রাখে। গাজার শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থাও করে জাতিসংঘ।
গাজাবাসীর আয়ের অপর একটি উৎস হামাসের সরকার। গোষ্ঠীটির প্রায় ২০ থেকে ৫০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন, যাঁরা সরাসরি হামাসের কাছ থেকে বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন। তবে বিদ্যুৎ, শিক্ষাসহ অনেক খাতেই এখনো ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তাদের অর্থায়ন বজায় রেখেছে। এ কারণে হামাস অন্যান্য খাতে ইচ্ছামতো খরচ করার প্রয়াস পায়।
ইসরায়েলের সঙ্গে গাজার সরাসরি বাণিজ্য নেই, রয়েছে মিসরের সঙ্গে। সম্প্রতি মিসরের সঙ্গে হামাসের বাণিজ্য বেড়েছে। বাণিজ্য বেড়েছে পশ্চিম তীরের সঙ্গেও। হামাস মিসর থেকে আসা প্রায় সব ধরনের পণ্যের ওপরই কর আরোপ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শিশুখাদ্য থেকে শুরু করে জিন্সের পোশাকে সাড়ে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত কর আরোপ করে থাকে। এমনকি জেলেরা যে মাছ ধরে গাজার বাজারে বিক্রি করেন, তার ওপর প্রতি কেজিতে ৩ শেকেল পরিমাণ কর সংগ্রহ করে থাকে। সব মিলিয়ে হামাস বছরে ১৬০ কোটি শেকেল আয় করে।
এর বাইরে হামাস ও গাজার অন্যান্য ইসলামি গোষ্ঠী প্রতিবছর ইরানের কাছ থেকে অন্তত ১০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা পেয়ে থাকে। এ ছাড়া পশ্চিমা বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকেও সহায়তা লাভ করে থাকে হামাস। তবে ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো বিদেশ থেকে হামাসের সাহায্যের উৎস বন্ধ করতে লন্ডন, ইস্তাম্বুলসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে হামাস ও এর সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে।
পশ্চিম তীরের সঙ্গে গাজার সম্পর্ক নিয়েও দ্বিধার মধ্যে ইসরায়েলি নীতিনির্ধারকেরা। পশ্চিম তীরে জনশক্তির এক-চতুর্থাংশই কাজ করে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে অথবা পশ্চিম তীরের ইসরায়েলি বসতিতে। এ ছাড়া পশ্চিম তীরের বাণিজ্যের অধিকাংশই সম্পন্ন হয় ইসরায়েলের সঙ্গে। এই বাণিজ্যের সময় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ যে পরিমাণ শুল্ক/কর আরোপ করে, তা থেকেই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের বাজেটের দুই-তৃতীয়াংশ উঠে আসে। এই বাজেটের একটি বড় অংশই কিন্তু ব্যয় হয় গাজায়। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হয়ে এসব কর সংগ্রহ করায় ইসরায়েলি নীতিনির্ধারকদের একাংশ চান ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহ না করতে, যাতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অর্থ গাজায় প্রবেশ করতে না পারে। তবে একটি অংশ মনে করে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের আরও বেশি অর্থের প্রয়োজন, যাতে শান্তি পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত করা যায়।
যদিও ইসরায়েল বর্তমানে চায় হামাসকে ধ্বংস করতে, কিন্তু এটি করতে গিয়ে দেশটিকে দ্বিমুখী সংকটে পড়তে হয়েছে। একটা সময় ছিল যখন ইসরায়েল হামাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। সেটি করতে গিয়ে তারা হামাসকে গাজা থেকে কর সংগ্রহ করতে সহায়তা করেছে, যার কোনো মানে ছিল না। কিন্তু এখন আবার যখন ইসরায়েল হামাসকে ধ্বংস করতে চায়, তখনো তাদের গাজায় অর্থ, খাদ্য ও অন্যান্য সরবরাহ নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য হতে হচ্ছে। কিন্তু সামরিক দিক থেকে হামাসকে নির্মূল করতে চাইলে আবার এমন বেসামরিক সহায়তার কোনো মানেই হয় না।
অনুবাদ: আব্দুর রহমান
ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বিগত ৭৫ বছরে ইসরায়েলি বাহিনী প্রতিদিনই ভূখণ্ড দখল করেছে। হত্যা করেছে ফিলিস্তিনিদের। দীর্ঘ এই সময়ে দেশটি কেবল অস্ত্রের ভাষায় কথা বলেনি, অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে অর্থনীতিকেও। সোজা কথায়, ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের বিশেষ করে গাজাবাসীকে বিগত কয়েক দশকে কেবল অস্ত্র দিয়ে হত্যা করেনি; মেরেছে ভাতে-পানিতেও। চলমান যুদ্ধের এই সময়ে এসেও ইসরায়েল একই পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা করছে।
গত ৭ অক্টোবরের ঘটনার পর ইসরায়েল গাজায় যেভাবে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে গাজা নরকে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ফিলিস্তিনি মারা গেছে, আহত হয়েছে আরও সাড়ে ১৫ হাজার। অস্ত্রের আঘাতে মারা যাওয়ার বিষয়টি অনেক বেশি সামনে এলেও ইসরায়েলি অবরোধের কারণে গাজাবাসীর জীবনে খাদ্য, পানি, ওষুধসহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের যে অভাব দেখা দিয়েছে, তা খুব সামান্য উঠে আসছে গণমাধ্যমে।
বিগত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গাজা একপ্রকার অবরুদ্ধ। এই দীর্ঘ সময় ধরে অঞ্চলটি বিদেশি সহায়তায় টিকে আছে। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েলের প্রবল অবরোধে বিদেশি সহায়তাও বন্ধ হওয়ার পথে। সর্বশেষ গত ১৮ অক্টোবর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সামান্য পরিমাণ ত্রাণসহায়তা গাজায় ঢুকতে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেন। সেই ধারাবাহিকতায় গতকাল শনিবার মিসর থেকে ত্রাণবাহী ২০টি ট্রাক গাজায় প্রবেশ করে। মানবিক দিক বিবেচনায় নিলেও ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য হলো গাজায় হামাসকে যেকোনো মূল্যে হীনবল করা এবং এটি করতে গিয়ে যদি অর্থনীতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হয়, ইসরায়েল সেটি করতেও দ্বিধা করবে না।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত অসলো অ্যাকর্ডের পর ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তি অনুসারে, ইসরায়েল ও গাজা-পশ্চিম তীরে একটি মাত্র বাজারব্যবস্থা চালু থাকবে। এই চুক্তির মূল ধারণা ছিল, ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলে কাজের সুযোগ পাবে। ফলে ইসরায়েলি মূলধন ফিলিস্তিনে আসবে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফিলিস্তিনি ধনকুবেররা আবারও ফিলিস্তিনে ফিরে বিনিয়োগ শুরু করবে। কিন্তু বাস্তবে সেটি হয়নি। কারণ খাতা-কলমে চুক্তি হলেও ইসরায়েলি বিধিনিষেধ সব সময়ই বহাল ছিল এবং সে কারণেই ফিলিস্তিনিদের জীবন বিদেশি সাহায্যে ওপর নির্ভরশীল।
এই অবস্থায় বিগত কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি সাধারণ জনগণের জীবনমানের মধ্যকার পার্থক্য ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয়েছে। এই যুদ্ধ শুরুর আগেও গড়ে একজন ইসরায়েলি একজন ফিলিস্তিনির তুলনায় ১৫ গুণ বেশি সম্পদশালী ছিল। কেবল সম্পদের দিক থেকেই নয়, জীবনযাত্রার মানেও ফিলিস্তিনিরা অনেক পিছিয়ে। পশ্চিম তীরের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের কাছে উন্নত পয়োপ্রণালির সুবিধা রয়েছে এবং ১০ শতাংশ পশ্চিম তীরবাসীর কাছে সরাসরি পানি সংগ্রহের কোনো সুবিধা নেই। এত কিছুর পরও ইসরায়েল সেই চুক্তি এখনো বহাল রেখেছে, কিন্তু এর কোনো বাস্তবিক প্রয়োগ নেই। যেমন—পশ্চিম তীরের যেসব ফিলিস্তিনি ইসরায়েলে কাজ করেন, তাঁদের কেবল কায়িক শ্রম ও কম দক্ষতার প্রয়োজন হয় এমন কাজে যুক্ত করা হয়। পাশাপাশি তাঁদের চলাফেরার সুযোগ-সুবিধাও অনেকটাই সীমিত রাখা হয়।
গাজার পরিস্থিতি পশ্চিম তীরের তুলনায় অনেক বেশি খারাপ। ২০০৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পশ্চিম তীরের লোকজনের বাৎসরিক গড় জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু একই সময়ে গাজাবাসীর প্রবৃদ্ধি ছিল নেতিবাচক। ২০০৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে আড়াই শতাংশ হারে সংকুচিত হয়েছে। ২০০৭ সাল থেকেই গাজা ইসরায়েলি অবরোধের শিকার। এর বাইরে গাজার জিডিপি সংকুচিত হওয়ার কারণ হলো ইসরায়েলের সঙ্গে লড়া বেশ কয়েকটি যুদ্ধ। ২০০৮, ২০১৪ ও ২০২১ সালে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তিনটি যুদ্ধে লড়েছে হামাস এবং এসব যুদ্ধে যে পরিমাণ ব্যয় হয়েছে, তা গাজার এক বছরের জিডিপির সমান।
যদি কোনো একটি অর্থনীতিতে উৎপাদন না থাকে, তবে সেই অর্থনীতির কেবল প্রবৃদ্ধিই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, অনেক সমস্যাই দেখা দেয়। বেকারত্ব বাড়ে। আইএমএফের হিসাব বলছে, ২০২১ সালে গাজার অর্ধেকেরও বেশি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। গাজায় আয়ের অল্প কয়েকটি উপায়ই আছে। তার একটি হলো, টানেল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সমুদ্রপথে চোরাচালান। কিন্তু মিসর তার সমুদ্রসীমায় পাহারা কঠোর করার পর থেকে সেই সুযোগও কমে গেছে। গাজার আরেকটি ব্যবসাখাত হলো কনস্ট্রাকশন বা নির্মাণ। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার কনস্ট্রাকশন বা নির্মাণ খাত ২০২২ সালে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। চলমান যুদ্ধ শেষে হয়তো এই খাত আরও প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে।
গাজাবাসীর আয়ের আরেকটি উৎস ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। গাজার প্রায় ৭০ হাজার অধিবাসী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের চাকরি করছে এবং তাদের থেকে বেতনও গ্রহণ করছে। যদিও হামাস গাজা থেকে ২০০৭ সালে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে বের করে দিয়ে নিজস্ব প্রশাসন সাজিয়েছে, তার পরও এসব গাজাবাসী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বেতন পাচ্ছে নিয়মিত। মজার ব্যাপার হলো, বেতন নিলেও এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী কোনো কাজই করেন না। এর বাইরে কাতার গাজার অধিবাসীদের বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ দিয়ে সহায়তা করে। আরও মজার বিষয় হলো, গাজায় ইসরায়েল থেকে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ আসে, তার বিলও পরিশোধ করে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। ইসরায়েল পশ্চিম তীর থেকে যে খাজনা সংগ্রহ করে, সেই টাকা থেকে বিদ্যুতের বিল কেটে রাখে। গাজার শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থাও করে জাতিসংঘ।
গাজাবাসীর আয়ের অপর একটি উৎস হামাসের সরকার। গোষ্ঠীটির প্রায় ২০ থেকে ৫০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন, যাঁরা সরাসরি হামাসের কাছ থেকে বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন। তবে বিদ্যুৎ, শিক্ষাসহ অনেক খাতেই এখনো ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তাদের অর্থায়ন বজায় রেখেছে। এ কারণে হামাস অন্যান্য খাতে ইচ্ছামতো খরচ করার প্রয়াস পায়।
ইসরায়েলের সঙ্গে গাজার সরাসরি বাণিজ্য নেই, রয়েছে মিসরের সঙ্গে। সম্প্রতি মিসরের সঙ্গে হামাসের বাণিজ্য বেড়েছে। বাণিজ্য বেড়েছে পশ্চিম তীরের সঙ্গেও। হামাস মিসর থেকে আসা প্রায় সব ধরনের পণ্যের ওপরই কর আরোপ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শিশুখাদ্য থেকে শুরু করে জিন্সের পোশাকে সাড়ে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত কর আরোপ করে থাকে। এমনকি জেলেরা যে মাছ ধরে গাজার বাজারে বিক্রি করেন, তার ওপর প্রতি কেজিতে ৩ শেকেল পরিমাণ কর সংগ্রহ করে থাকে। সব মিলিয়ে হামাস বছরে ১৬০ কোটি শেকেল আয় করে।
এর বাইরে হামাস ও গাজার অন্যান্য ইসলামি গোষ্ঠী প্রতিবছর ইরানের কাছ থেকে অন্তত ১০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা পেয়ে থাকে। এ ছাড়া পশ্চিমা বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকেও সহায়তা লাভ করে থাকে হামাস। তবে ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো বিদেশ থেকে হামাসের সাহায্যের উৎস বন্ধ করতে লন্ডন, ইস্তাম্বুলসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে হামাস ও এর সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে।
পশ্চিম তীরের সঙ্গে গাজার সম্পর্ক নিয়েও দ্বিধার মধ্যে ইসরায়েলি নীতিনির্ধারকেরা। পশ্চিম তীরে জনশক্তির এক-চতুর্থাংশই কাজ করে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে অথবা পশ্চিম তীরের ইসরায়েলি বসতিতে। এ ছাড়া পশ্চিম তীরের বাণিজ্যের অধিকাংশই সম্পন্ন হয় ইসরায়েলের সঙ্গে। এই বাণিজ্যের সময় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ যে পরিমাণ শুল্ক/কর আরোপ করে, তা থেকেই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের বাজেটের দুই-তৃতীয়াংশ উঠে আসে। এই বাজেটের একটি বড় অংশই কিন্তু ব্যয় হয় গাজায়। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হয়ে এসব কর সংগ্রহ করায় ইসরায়েলি নীতিনির্ধারকদের একাংশ চান ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহ না করতে, যাতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অর্থ গাজায় প্রবেশ করতে না পারে। তবে একটি অংশ মনে করে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের আরও বেশি অর্থের প্রয়োজন, যাতে শান্তি পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত করা যায়।
যদিও ইসরায়েল বর্তমানে চায় হামাসকে ধ্বংস করতে, কিন্তু এটি করতে গিয়ে দেশটিকে দ্বিমুখী সংকটে পড়তে হয়েছে। একটা সময় ছিল যখন ইসরায়েল হামাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। সেটি করতে গিয়ে তারা হামাসকে গাজা থেকে কর সংগ্রহ করতে সহায়তা করেছে, যার কোনো মানে ছিল না। কিন্তু এখন আবার যখন ইসরায়েল হামাসকে ধ্বংস করতে চায়, তখনো তাদের গাজায় অর্থ, খাদ্য ও অন্যান্য সরবরাহ নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য হতে হচ্ছে। কিন্তু সামরিক দিক থেকে হামাসকে নির্মূল করতে চাইলে আবার এমন বেসামরিক সহায়তার কোনো মানেই হয় না।
অনুবাদ: আব্দুর রহমান
সম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
২ ঘণ্টা আগেএকটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলো
১০ ঘণ্টা আগেট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
২ দিন আগেকোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
৫ দিন আগে