অনলাইন ডেস্ক
গাজাকে কেন্দ্র করে হামাস-ইসরায়েলের সংঘাত চলছে প্রায় এক মাস ধরে। এই যুদ্ধ নিয়ে নানাজনের নানা মত রয়েছে। তবে যুদ্ধ থেকে হামাস কী ধরনের রাজনৈতিক মুনাফা অর্জন করতে চায়, সে বিষয়ে খুব একটা আলাপ-আলোচনা হচ্ছে না। কিন্তু গাজার পরিস্থিতি, হামাসের শক্তিমত্তা, আন্তর্জাতিক চাপ ইত্যাদি কারণে ইসরায়েলের জন্য গাজার ভেতরে শহুরে গেরিলা লড়াই চালিয়ে যাওয়া সহজ হবে না। এ বিষয়টিই হামাসকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে বলে দাবি সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর নেতাদের।
হামাসের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দুটি সূত্র নামপ্রকাশ না করে বলেছে, প্রলম্বিত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস। এই গোষ্ঠী বিশ্বাস করে, তারা ইসরায়েলি বাহিনীকে গাজায় ঠেকিয়ে দিয়ে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে বন্দী ফিলিস্তিনিদের মুক্তি দিতে বাধ্য করতে পারবে। পাশাপাশি হামাসের সুবিধাজনক শর্তে যুদ্ধবিরতিও বাস্তবায়ন করতে পারবে।
ওই সূত্র দুটি জানায়, গাজায় হামাসের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ, ক্ষেপণাস্ত্র, খাদ্য ও চিকিৎসা রসদ রয়েছে। তারা জানায়, হামাস যেকোনো পরিস্থিতিতে বাইরের সহায়তা ছাড়াই গাজার বিস্তৃত টানেল নেটওয়ার্কে কয়েক মাস টিকে থাকতে পারবে। কেবল তা-ই নয়, এই টানেল নেটওয়ার্ক হামাসের যোদ্ধাদের ইসরায়েলি সেনাদের বিপরীতে শহুরে গেরিলা যুদ্ধে বাড়তি সুবিধা দেবে।
হামাস মনে করে, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় প্রাণহানি বাড়তে থাকায় আন্তর্জাতিক চাপের কারণে ইসরায়েলর ওপরই যুদ্ধবিরতিতে যাওয়ার তাগিদ বেশি। আর ইসরায়েলের এই অবস্থানই হামাসকে ফিলিস্তিনি জিম্মিদের মুক্ত করার ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা দেবে। হামাসের চার কর্মকর্তা জানান, জিম্মি বা বন্দিবিনিময়ের ক্ষেত্রে হামাসের চাওয়া কাতারের মাধ্যমে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে হামাস।
এ তো গেল, তাৎক্ষণিক লাভ। দীর্ঘ মেয়াদে হামাস চায়, গাজায় ইসরায়েল ১৭ বছর ধরে যে অবরোধ আরোপ করে রেখেছে, তা শেষ হোক। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অবৈধ ইসরায়েলি বসতি স্থাপন বন্ধ হোক। একই সঙ্গে পবিত্র ভূমি আল-আকসা মসজিদ কমপ্লেক্সে ইসরায়েলি সেনাদের যেকোনো ধরনের উসকানিমূলক আচরণ চিরতরে বন্ধ হোক।
কিন্তু হামাসের চাওয়ার পাল্টায় ইসরায়েলেরও চাওয়া আছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এরই মধ্যে হামাসকে চিরতরে নির্মূল করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় তীব্র হামলা অব্যাহত রেখেছে। এ হামলায় মারা গেছে প্রায় ৯ হাজার ৩০০ ফিলিস্তিনি।
এই অবস্থায় জাতিসংঘ বলেছে, গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি দরকার। কারণ, অবরুদ্ধ এই অঞ্চলের লোকজন ‘ভয়াবহ গণহত্যার ঝুঁকিতে’ রয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বান সত্ত্বেও শিগগিরই এই সংকট শেষ হয়ে যাবে—এমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের ফেলো ও জর্ডানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারওয়ান আল-মুআশার বলেন, ‘হামাসকে ধ্বংস করার যে মিশন তা অর্জন করা খুব একটা সহজ হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই সংকটের কোনো সামরিক সমাধান নেই। আমরা এমন এক অন্ধকার সময়ে আছি, যা খুব সহজেই শেষ হবে না।’
গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে আকস্মিক হামলা চালিয়ে ১ হাজার ৪০০ জনকে হত্যা করে; ২৩৯ জনকে জিম্মি করে আনে। এর পর থেকে ইসরায়েল তার বিমানবাহিনীর মাধ্যমে গাজা উপত্যকায় ব্যাপক হামলা চালায়। টানা ২৯ দিন ধরে চলা হামলায় গাজা কার্যত একক প্রচেষ্টায় টিকে আছে। পানি, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা এমনকি আশ্রয়হীন হয়ে গেছে সব গাজাবাসী।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী ঘোষণা দিয়েছে, তারা হামাসকে নির্মূল না করে থামবে না। তারা আরও বলেছে, হামাসকে মোকাবিলা করতে গিয়ে তাদের কী ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে, তা নিয়ে কোনো ধরনের বিভ্রান্তির মধ্যে নেই। যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সাবেক ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানো বলেছেন, দীর্ঘ ও কষ্টকর যুদ্ধের জন্য ইসরায়েল প্রস্তুত আছে।
ইসরায়েলি পার্লামেন্ট নেসেটের সাবেক এই আইনপ্রণেতা আরও বলেন, ‘আমরা জানি, পরিণামে আমরাই জয়ী হব, হামাসকে পরাজিত করতে পারব। এখন প্রশ্ন হলো, এর জন্য কী মূল্য আমাদের চোকাতে হবে। আমাদের খুবই সাবধান হতে হবে এবং বিশেষ করে আমাদের বুঝতে হবে, এটি এমন এক শহুরে যুদ্ধ যেখানে চলাফেরাই কঠিন।’
ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও এরই মধ্যে পরিষ্কার করে দিয়েছে, তারাও কোনো ধরনের যুদ্ধবিরতি চায় না। তবে দেশটি গাজায় প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছে। হামাসও সম্ভবত এখনই যুদ্ধবিরতির পথে হাঁটতে চায় না। গোষ্ঠীটি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা কাতার ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক আদিবু জিয়াদা বলেছেন, দীর্ঘদিন ইসরায়েলকে মোকাবিলা করতে হবে—এমন প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছে হামাস।
জিয়াদা বলেছেন, ‘যারা ৭ অক্টোবরের মতো পূর্ণাঙ্গ দক্ষতা, নির্ভুলতা এবং যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়েছে, তারা একটি দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত বলেই মনে হয়। ফলাফল কী হতে পারে তা অনুমান না করেই হামাস এমন অভিযান চালিয়েছে, তা মানা সম্ভব নয়।’
নামপ্রকাশ না করার শর্তে ওয়াশিংটনের এক কর্মকর্তা বলেন, মার্কিন প্রশাসনের অনুমান—হামাস সম্ভবত গাজায় শহুরে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ইসরায়েলি বাহিনীকে ‘পুঁতে ফেলতে’ চায়। পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে ইসরায়েলি অভিযানের ওপর থেকে সে দেশের মানুষের সমর্থন প্রত্যাহার করাতে চায়।
তবে ওই কর্মকর্তার মতে, ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেছেন, তারা হামাসের গেরিলা কৌশলের মোকাবিলার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সমালোচনা সহ্য করার জন্য প্রস্তুত। তবে দেশটির হামাসকে নির্মূল করার সক্ষমতা আছে কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
হামাসের দাবি, তাদের ৪০ হাজার নিয়মিত সেনার সঙ্গে বিপুল অস্ত্রসম্ভার রয়েছে। তবে যে বিষয়টি তাদের সবচেয়ে বেশি সুবিধা দেবে, তা হলো মাটির নিচের কয়েক শ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল। কিছু কিছু জায়গায় এসব টানেল ৮০ মিটার পর্যন্ত গভীরে অবস্থিতি। হামাস বিগত কয়েক বছর ধরে এসব টানেল সুরক্ষিত করেছে।
গত সপ্তাহের মঙ্গলবারেও বিভিন্ন ভিডিও থেকে দেখা গেছে, হামাসের যোদ্ধার টানেল থেকে বেরিয়ে ইসরায়েলি ট্যাংকে হামলা চালিয়ে আবারও টানেলে অদৃশ্য হয়ে গেছে। হামাসের টানেল নিয়ে চিন্তিত হলেও বসে নেই ইসরায়েলি বাহিনীও। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষাবাহিনী বলেছে, তাদের জাহালম স্পেশাল কমব্যাট ইঞ্জিনিয়ারিং ফোর্স হামাসের টানেলের প্রবেশ পথ ধ্বংস করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
হামাস বিগত কয়েক দশকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে লড়েছে এবং প্রতিবারই নতুন কিছু না কিছু করে ইসরায়েলকে চমকে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন লেবাননে নির্বাসিত হামাস নেতা আলি বারাকাহ। তিনি বলেন বলেন, ‘প্রয়োজনই আবিষ্কারের প্রসূতি। ২০০৮ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের সময় হামাসের রকেটের পাল্লা ছিল মাত্র ৪০ কিলোমিটার। সেই পাল্লা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩০ কিলোমিটার বা তার বেশিতে।’
হামাসের অন্যতম মিত্র লেবাননের হিজবুল্লাহর এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, বিগত প্রায় ৪ সপ্তাহ ধরে ইসরায়েল গাজায় হামলা চালালেও এখনো হামাসের সক্ষমতা পুরোপুরি অক্ষত। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, প্রয়োজন হলে হিজবুল্লাহ হামাসের পাশে দাঁড়াবে।
১৯৮৮ সালে হামাসের প্রথম সাংগঠনিক দলিল প্রকাশ করা হয়। সেখানে ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনের শত্রু আখ্যা দিয়ে একে ধ্বংস করার কথা বলা হয়। পরে হামাসকে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, মিসর ও জাপান সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দেয়। পরে ২০১৭ সালে অবশ্য হামাস ১৯৬৭ সালের সীমানার ভিত্তিতে দুই রাষ্ট্র সমাধান মেনে নেয়। কিন্তু ইসরায়েল সেই অবস্থান প্রত্যাখ্যান করেছে।
হামাসের নেতা ওসমান হামাদান বলেন, ৭ অক্টোবরের হামলা ও গাজা যুদ্ধের ফলে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ইস্যু আবারও বাস্তবতায় ফিরে আসবে। তিনি আরও বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য তাদের (ইসরায়েল ও বিশ্ববাসীকে) বলার সুযোগ যে, আমরা নিজ হাতে আমাদের ভাগ্য তৈরি করতে পারি। আমরা এই অঞ্চলের সমীকরণকে এমনভাবে সাজাতে পারি যেটা আমাদের স্বার্থে কাজ করে।’
১৯৯৩ সালের অসলো শান্তি চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সংঘাত নিরসনের একটা প্রচেষ্টা এগিয়েছিল। কিন্তু তা বর্তমানে মুখ থুবড়ে পড়েছে। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো নেতানিয়াহু ক্ষমতায় আসেন। তিনি তখন থেকেই সেই শান্তি চুক্তির বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। সর্বশেষ তাঁর নেতৃত্বের কট্টর ডানপন্থী জোট সরকার আবারও সেই অবস্থান প্রত্যাখ্যান করেছে।
এরপর ২০০২ সাল থেকে ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরব বিশ্ব একটি প্রস্তাব রাখে। সেই প্রস্তাবের ধারাবাহিকতায় আরব বিশ্বের অনেক দেশই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। বিপরীতে শর্ত ছিল স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। মিসর, জর্ডানের পর সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন মরক্কো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। সেই একই পথে এগিয়ে যাচ্ছিল সৌদি আরব। কিন্তু এসব প্রচেষ্টার কোনোটাতেই ফিলিস্তিনিরা সরাসরি যুক্ত ছিল না। তবে তার আগেই বাধ সেধেছে হামাসের অতর্কিত হামলা।
এই হামলাই সব সমীকরণ উলটপালট করে দিয়েছে। মারওয়ান আল-মুআশার বলেন, এই আক্রমণের মাধ্যমে হামাস একটি বিষয় পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনকে বাদ দিয়ে সংকটের সমাধান কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এর মাধ্যমে মূলত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের সব রাজনীতি এখন নতুন সমীকরণের পথ ধরেছে।
রয়টার্স থেকে অনুবাদ করেছে আব্দুর রহমান
গাজাকে কেন্দ্র করে হামাস-ইসরায়েলের সংঘাত চলছে প্রায় এক মাস ধরে। এই যুদ্ধ নিয়ে নানাজনের নানা মত রয়েছে। তবে যুদ্ধ থেকে হামাস কী ধরনের রাজনৈতিক মুনাফা অর্জন করতে চায়, সে বিষয়ে খুব একটা আলাপ-আলোচনা হচ্ছে না। কিন্তু গাজার পরিস্থিতি, হামাসের শক্তিমত্তা, আন্তর্জাতিক চাপ ইত্যাদি কারণে ইসরায়েলের জন্য গাজার ভেতরে শহুরে গেরিলা লড়াই চালিয়ে যাওয়া সহজ হবে না। এ বিষয়টিই হামাসকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে বলে দাবি সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর নেতাদের।
হামাসের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দুটি সূত্র নামপ্রকাশ না করে বলেছে, প্রলম্বিত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস। এই গোষ্ঠী বিশ্বাস করে, তারা ইসরায়েলি বাহিনীকে গাজায় ঠেকিয়ে দিয়ে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে বন্দী ফিলিস্তিনিদের মুক্তি দিতে বাধ্য করতে পারবে। পাশাপাশি হামাসের সুবিধাজনক শর্তে যুদ্ধবিরতিও বাস্তবায়ন করতে পারবে।
ওই সূত্র দুটি জানায়, গাজায় হামাসের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ, ক্ষেপণাস্ত্র, খাদ্য ও চিকিৎসা রসদ রয়েছে। তারা জানায়, হামাস যেকোনো পরিস্থিতিতে বাইরের সহায়তা ছাড়াই গাজার বিস্তৃত টানেল নেটওয়ার্কে কয়েক মাস টিকে থাকতে পারবে। কেবল তা-ই নয়, এই টানেল নেটওয়ার্ক হামাসের যোদ্ধাদের ইসরায়েলি সেনাদের বিপরীতে শহুরে গেরিলা যুদ্ধে বাড়তি সুবিধা দেবে।
হামাস মনে করে, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় প্রাণহানি বাড়তে থাকায় আন্তর্জাতিক চাপের কারণে ইসরায়েলর ওপরই যুদ্ধবিরতিতে যাওয়ার তাগিদ বেশি। আর ইসরায়েলের এই অবস্থানই হামাসকে ফিলিস্তিনি জিম্মিদের মুক্ত করার ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা দেবে। হামাসের চার কর্মকর্তা জানান, জিম্মি বা বন্দিবিনিময়ের ক্ষেত্রে হামাসের চাওয়া কাতারের মাধ্যমে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে হামাস।
এ তো গেল, তাৎক্ষণিক লাভ। দীর্ঘ মেয়াদে হামাস চায়, গাজায় ইসরায়েল ১৭ বছর ধরে যে অবরোধ আরোপ করে রেখেছে, তা শেষ হোক। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অবৈধ ইসরায়েলি বসতি স্থাপন বন্ধ হোক। একই সঙ্গে পবিত্র ভূমি আল-আকসা মসজিদ কমপ্লেক্সে ইসরায়েলি সেনাদের যেকোনো ধরনের উসকানিমূলক আচরণ চিরতরে বন্ধ হোক।
কিন্তু হামাসের চাওয়ার পাল্টায় ইসরায়েলেরও চাওয়া আছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এরই মধ্যে হামাসকে চিরতরে নির্মূল করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় তীব্র হামলা অব্যাহত রেখেছে। এ হামলায় মারা গেছে প্রায় ৯ হাজার ৩০০ ফিলিস্তিনি।
এই অবস্থায় জাতিসংঘ বলেছে, গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি দরকার। কারণ, অবরুদ্ধ এই অঞ্চলের লোকজন ‘ভয়াবহ গণহত্যার ঝুঁকিতে’ রয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বান সত্ত্বেও শিগগিরই এই সংকট শেষ হয়ে যাবে—এমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের ফেলো ও জর্ডানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারওয়ান আল-মুআশার বলেন, ‘হামাসকে ধ্বংস করার যে মিশন তা অর্জন করা খুব একটা সহজ হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই সংকটের কোনো সামরিক সমাধান নেই। আমরা এমন এক অন্ধকার সময়ে আছি, যা খুব সহজেই শেষ হবে না।’
গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে আকস্মিক হামলা চালিয়ে ১ হাজার ৪০০ জনকে হত্যা করে; ২৩৯ জনকে জিম্মি করে আনে। এর পর থেকে ইসরায়েল তার বিমানবাহিনীর মাধ্যমে গাজা উপত্যকায় ব্যাপক হামলা চালায়। টানা ২৯ দিন ধরে চলা হামলায় গাজা কার্যত একক প্রচেষ্টায় টিকে আছে। পানি, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা এমনকি আশ্রয়হীন হয়ে গেছে সব গাজাবাসী।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী ঘোষণা দিয়েছে, তারা হামাসকে নির্মূল না করে থামবে না। তারা আরও বলেছে, হামাসকে মোকাবিলা করতে গিয়ে তাদের কী ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে, তা নিয়ে কোনো ধরনের বিভ্রান্তির মধ্যে নেই। যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সাবেক ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানো বলেছেন, দীর্ঘ ও কষ্টকর যুদ্ধের জন্য ইসরায়েল প্রস্তুত আছে।
ইসরায়েলি পার্লামেন্ট নেসেটের সাবেক এই আইনপ্রণেতা আরও বলেন, ‘আমরা জানি, পরিণামে আমরাই জয়ী হব, হামাসকে পরাজিত করতে পারব। এখন প্রশ্ন হলো, এর জন্য কী মূল্য আমাদের চোকাতে হবে। আমাদের খুবই সাবধান হতে হবে এবং বিশেষ করে আমাদের বুঝতে হবে, এটি এমন এক শহুরে যুদ্ধ যেখানে চলাফেরাই কঠিন।’
ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও এরই মধ্যে পরিষ্কার করে দিয়েছে, তারাও কোনো ধরনের যুদ্ধবিরতি চায় না। তবে দেশটি গাজায় প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছে। হামাসও সম্ভবত এখনই যুদ্ধবিরতির পথে হাঁটতে চায় না। গোষ্ঠীটি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা কাতার ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক আদিবু জিয়াদা বলেছেন, দীর্ঘদিন ইসরায়েলকে মোকাবিলা করতে হবে—এমন প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছে হামাস।
জিয়াদা বলেছেন, ‘যারা ৭ অক্টোবরের মতো পূর্ণাঙ্গ দক্ষতা, নির্ভুলতা এবং যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়েছে, তারা একটি দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত বলেই মনে হয়। ফলাফল কী হতে পারে তা অনুমান না করেই হামাস এমন অভিযান চালিয়েছে, তা মানা সম্ভব নয়।’
নামপ্রকাশ না করার শর্তে ওয়াশিংটনের এক কর্মকর্তা বলেন, মার্কিন প্রশাসনের অনুমান—হামাস সম্ভবত গাজায় শহুরে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ইসরায়েলি বাহিনীকে ‘পুঁতে ফেলতে’ চায়। পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে ইসরায়েলি অভিযানের ওপর থেকে সে দেশের মানুষের সমর্থন প্রত্যাহার করাতে চায়।
তবে ওই কর্মকর্তার মতে, ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেছেন, তারা হামাসের গেরিলা কৌশলের মোকাবিলার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সমালোচনা সহ্য করার জন্য প্রস্তুত। তবে দেশটির হামাসকে নির্মূল করার সক্ষমতা আছে কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
হামাসের দাবি, তাদের ৪০ হাজার নিয়মিত সেনার সঙ্গে বিপুল অস্ত্রসম্ভার রয়েছে। তবে যে বিষয়টি তাদের সবচেয়ে বেশি সুবিধা দেবে, তা হলো মাটির নিচের কয়েক শ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল। কিছু কিছু জায়গায় এসব টানেল ৮০ মিটার পর্যন্ত গভীরে অবস্থিতি। হামাস বিগত কয়েক বছর ধরে এসব টানেল সুরক্ষিত করেছে।
গত সপ্তাহের মঙ্গলবারেও বিভিন্ন ভিডিও থেকে দেখা গেছে, হামাসের যোদ্ধার টানেল থেকে বেরিয়ে ইসরায়েলি ট্যাংকে হামলা চালিয়ে আবারও টানেলে অদৃশ্য হয়ে গেছে। হামাসের টানেল নিয়ে চিন্তিত হলেও বসে নেই ইসরায়েলি বাহিনীও। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষাবাহিনী বলেছে, তাদের জাহালম স্পেশাল কমব্যাট ইঞ্জিনিয়ারিং ফোর্স হামাসের টানেলের প্রবেশ পথ ধ্বংস করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
হামাস বিগত কয়েক দশকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে লড়েছে এবং প্রতিবারই নতুন কিছু না কিছু করে ইসরায়েলকে চমকে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন লেবাননে নির্বাসিত হামাস নেতা আলি বারাকাহ। তিনি বলেন বলেন, ‘প্রয়োজনই আবিষ্কারের প্রসূতি। ২০০৮ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের সময় হামাসের রকেটের পাল্লা ছিল মাত্র ৪০ কিলোমিটার। সেই পাল্লা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩০ কিলোমিটার বা তার বেশিতে।’
হামাসের অন্যতম মিত্র লেবাননের হিজবুল্লাহর এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, বিগত প্রায় ৪ সপ্তাহ ধরে ইসরায়েল গাজায় হামলা চালালেও এখনো হামাসের সক্ষমতা পুরোপুরি অক্ষত। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, প্রয়োজন হলে হিজবুল্লাহ হামাসের পাশে দাঁড়াবে।
১৯৮৮ সালে হামাসের প্রথম সাংগঠনিক দলিল প্রকাশ করা হয়। সেখানে ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনের শত্রু আখ্যা দিয়ে একে ধ্বংস করার কথা বলা হয়। পরে হামাসকে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, মিসর ও জাপান সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দেয়। পরে ২০১৭ সালে অবশ্য হামাস ১৯৬৭ সালের সীমানার ভিত্তিতে দুই রাষ্ট্র সমাধান মেনে নেয়। কিন্তু ইসরায়েল সেই অবস্থান প্রত্যাখ্যান করেছে।
হামাসের নেতা ওসমান হামাদান বলেন, ৭ অক্টোবরের হামলা ও গাজা যুদ্ধের ফলে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ইস্যু আবারও বাস্তবতায় ফিরে আসবে। তিনি আরও বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য তাদের (ইসরায়েল ও বিশ্ববাসীকে) বলার সুযোগ যে, আমরা নিজ হাতে আমাদের ভাগ্য তৈরি করতে পারি। আমরা এই অঞ্চলের সমীকরণকে এমনভাবে সাজাতে পারি যেটা আমাদের স্বার্থে কাজ করে।’
১৯৯৩ সালের অসলো শান্তি চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সংঘাত নিরসনের একটা প্রচেষ্টা এগিয়েছিল। কিন্তু তা বর্তমানে মুখ থুবড়ে পড়েছে। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো নেতানিয়াহু ক্ষমতায় আসেন। তিনি তখন থেকেই সেই শান্তি চুক্তির বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। সর্বশেষ তাঁর নেতৃত্বের কট্টর ডানপন্থী জোট সরকার আবারও সেই অবস্থান প্রত্যাখ্যান করেছে।
এরপর ২০০২ সাল থেকে ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরব বিশ্ব একটি প্রস্তাব রাখে। সেই প্রস্তাবের ধারাবাহিকতায় আরব বিশ্বের অনেক দেশই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। বিপরীতে শর্ত ছিল স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। মিসর, জর্ডানের পর সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন মরক্কো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। সেই একই পথে এগিয়ে যাচ্ছিল সৌদি আরব। কিন্তু এসব প্রচেষ্টার কোনোটাতেই ফিলিস্তিনিরা সরাসরি যুক্ত ছিল না। তবে তার আগেই বাধ সেধেছে হামাসের অতর্কিত হামলা।
এই হামলাই সব সমীকরণ উলটপালট করে দিয়েছে। মারওয়ান আল-মুআশার বলেন, এই আক্রমণের মাধ্যমে হামাস একটি বিষয় পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনকে বাদ দিয়ে সংকটের সমাধান কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এর মাধ্যমে মূলত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের সব রাজনীতি এখন নতুন সমীকরণের পথ ধরেছে।
রয়টার্স থেকে অনুবাদ করেছে আব্দুর রহমান
ইউক্রেনের ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র সারা বিশ্বে আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও, রাশিয়ার এ ধরনের আক্রমণকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে—যেমনটি ইসরায়েল উত্তর গাজাকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে হয়েছে।
১৬ ঘণ্টা আগেট্রাম্প ফিরে আসায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের ধারাবাহিকতাই বজায় থাকতে পারে, সামান্য কিছু পরিবর্তন নিয়ে। ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান পেছনের সারিতে থাকলেও বাংলাদেশ,
১ দিন আগেড. ইউনূস যখন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন পুরো জাতি তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল। তবে তাঁকে পরিষ্কারভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে যে, তিনি কীভাবে দেশ শাসন করবেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
২ দিন আগেসম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
৩ দিন আগে