অনলাইন ডেস্ক
ভারতের নির্বাচন কমিশন দেশটির রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থদাতাদের তালিকা প্রকাশ করেছে গত ১৪ মার্চ। ওই তালিকায় নাম থাকা কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের নানা দুর্নীতি থেকে রেহাই ও নানা সুযোগ–সুবিধা পেতে রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থ দিয়েছিল। যথারীতি তারা পেয়েছেও সেসব ছাড়।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরা এসব প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক আঁতাত নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে ইলেকটোরাল বন্ড স্কিম চালু করার পর থেকে ৩০টি ধাপে ১৬ হাজার ৫১৮ কোটি রুপির বন্ড ছাড়া হয়। বন্ড কেনায় শীর্ষে রয়েছে বিতর্কিত লটারি ব্যবসায়ী মার্টিন সান্তিয়াগোর সংস্থা ‘ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস’। এই প্রতিষ্ঠান কিনেছে মোট ১ হাজার ৩৬৮ কোটি রুপির বন্ড।
বন্ড কেনায় টাকার অঙ্কে তাদের পরেই রয়েছে বিখ্যাত তেলুগু ব্যবসায়ী কৃষ্ণা রেড্ডির সংস্থা ‘মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড’। তারা ৯৬৬ কোটি রুপির নির্বাচনী বন্ড কিনেছে। মূলত হায়দরাবাদ কেন্দ্রিক এই সংস্থা একাধিক সরকারি প্রকল্পের ঠিকাদারি পেয়েছে। এ ছাড়া মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সহযোগী সংস্থা ‘ওয়েস্টার্ন ইউপি পাওয়ার ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড’ ২২০ কোটি রুপির বন্ড কিনেছে।
ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঁচ বছর ধরে তহবিল জোগানো শীর্ষ কোম্পানির মধ্যে রয়েছে বেদান্ত লিমিটেড, ভারতী এয়ারটেল, আরপিএসজি গ্রুপ ও এসেল মাইনিংসহ অন্য বৃহত্তম ভারতীয় কোম্পানি। এদের মধ্য কেবল সান্তিয়াগোর সংস্থাই নয়, বন্ড কেনার দিক থেকে প্রথম ৩০টি সংস্থার ১৪ টিতেই গত কয়েক বছরে তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে সিবিআই, ইডি কিংবা আয়কর দপ্তর (আইটি)।
বিজেপির নির্বাচনী বন্ড কেনার পর ফিউচার গেমিংয়ের ওপর ভারতীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরদারি কমেছে। বলতে গেলে এরপরই অন্য ভারতীয় কোম্পানিগুলোও নির্বাচনী বন্ড কেনার দিকে ঝুঁকতে থাকে।
রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার সূচনা
ভারতের বৃহত্তম রিয়েল এস্টেট কোম্পানি হয়ে ওঠার আগে ডিএলএফ গ্রুপ বিপদে পড়লেই সাহায্যের জন্য কংগ্রেস নেতাদের কাছে ধরনা দিত। ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটি আশির দশকে কুশল পাল সিংয়ের নেতৃত্বে বড় সফলতার মুখ দেখে। সিং আত্মজীবনীতে লিখেছেন, কংগ্রেস নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সঙ্গে তাঁর একাধিকবার সাক্ষাৎ হয়েছে। গ্রেপ্তার এড়ানোসহ তাঁকে রক্ষা করতেও এগিয়ে এসেছিলেন রাজীব গান্ধী।
২০১২ সালে কংগ্রেস শাসিত হরিয়ানা রাজ্যের গুরগাঁওয়ে একজন আমলা ডিএলএফ গ্রুপ এবং গান্ধী পরিবারের জামাতা রবার্ট ভদ্রর (প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর স্বামী) মধ্যে জমিজমা সংক্রান্ত একটি চুক্তি বাতিল করেন। এ ঘটনা নিয়ে সমালোচনা সৃষ্টি হলে রাজনৈতিক তদন্ত শুরু হয়।
এ নিয়ে সিং আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘রাজীব না থাকলে গুরগাঁওয়ের কাজটা কখনোই হতো না।’ ওই কর্মকর্তাকে সরকার পরে বদলি করে। ঘটনাগুলো বিজেপির প্রচারের খোরাক হয়ে ওঠে। দলটি অভিযোগ করে, এই ঘটনায় গান্ধী পরিবারের দুর্নীতির স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে।
এরপর ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার আগে হরিয়ানায় একটি সমাবেশে বলেছিলেন, ‘তারা (গান্ধী পরিবার) সোনার চামচ নিয়ে জন্মেছে, যেখানে আমি রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে চা বিক্রি করে বড় হয়েছি। রাহুল গান্ধীর একটি সুপরিচিত বংশ আছে, যেখানে আমি শুধুই সৎ।’
ওই বছর বিজেপি দুর্নীতি বিরোধী প্রচার চালিয়েই জাতীয় নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং প্রথমবার হরিয়ানায় ক্ষমতায় আসে। পাল্টে যায় ডিএলএফের খাতিরের জায়গায়ও। ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের নভেম্বরের মধ্যে ডিএলএফ গ্রুপ বিজেপির ১৭০ কোটি রুপির নির্বাচনী বন্ড কেনে।
যাইহোক, এরপর ২০২৩ সালের এপ্রিলে হরিয়ানার বিজেপি সরকার—পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টকে জানায়, ডিএলএফ–ভদ্রর জমিজমা চুক্তিতে ‘কোনো বিধি লঙ্ঘন হয়নি।’
তবে ডিএলএফের কাছে তাদের অনুদানের ধরন এবং সময় সম্পর্কে মন্তব্যর জন্য যোগাযোগ করলে তারা আল জাজিরার অনুরোধে সাড়া দেয়নি।
কড়ির বদলে কড়ি
২০১৯ সালের অক্টোবরে বিজেপি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন আয়কর বিভাগ কর ফাঁকির অভিযোগে ভারতজুড়ে ১৫টি শহরে মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের (এমইএআইএল) সঙ্গে যুক্ত অনেক বাসভবন এবং গেস্ট হাউসে অভিযান চালায়। এরপর থেকে এমইএআইএল এবং বিজেপি সরকারের মধ্যে সম্পর্ক ‘গভীর’ হয়ে ওঠে।
প্রকৃতপক্ষে, এমইএআইএল গত পাঁচ বছরে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপিকে ৬৭০ কোটি রুপি দিয়েছে, যার বেশির ভাগই অক্টোবরের অভিযানের পর। এতে এমইএআইএল কোনো দলের একক বৃহত্তম দাতায় পরিণত হয়েছে।
এরপর ২০২২ সালের মার্চে চীন সীমান্তের কাছে লাদাখে কৌশলগত জোজি–লা টানেলের ঠিকাদারি পাওয়ায় ভারত সরকারের পরিবহন মন্ত্রী নিতিন গড়করি সংসদে প্রতিষ্ঠানটির প্রশংসা করেন।
নিলামে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোকে পরাজিত করায় গড়করি বলেন, ‘মেঘা (এমইএআইএল) নিলাম কেনায় সরকারের ৫ হাজার কোটি রুপি বেঁচে গেছে।’
এদিকে ২০২৩ সালের অক্টোবরে তেলেঙ্গানা রাজ্যে নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে এমইএআইএল নির্মিত লিফট–সেচ প্রকল্পের মেডিগড্ডা ব্যারেজের কিছু অংশ ধসে পড়ে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বিজেপির চুক্তি নিয়ে রাজ্যে রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়।
এরপর তেলেঙ্গানা রাজ্যসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে। ফলে রাজনৈতিক হাওয়া বদল হলে এমইএআইএলের অনুদানের ঠিকানাও পরিবর্তিত হয়।
জনমত জরিপ অনুসারে, ২০২৩ সালে রাজ্য নির্বাচনের দৌড়ে প্রতিষ্ঠানটি সহযোগী সংস্থা ওয়েস্টার্ন ইউপি পাওয়ার ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের অধীনে আরও বেশি বন্ড কেনে। যার মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছে প্রায় ১০০ কোটি রুপি। ফলে তারা কংগ্রেসেরও শীর্ষ দাতা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে।
মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করলে এমইএআইএল আল জাজিরার অনুরোধে সাড়া দেয়নি। তবে বিজেপির মতো কংগ্রেসও দাবি করেছে, এসব অনুদান নির্বাচনের ফলাফলের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জ্যেষ্ঠ নেতা আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমাদের দাতা করপোরেটরা এটি করেছে, কারণ আমাদের শাসনের একটি ভালো রেকর্ড রয়েছে।’
এদিকে ২০২০ সালের ২৫ জুন কলকাতাভিত্তিক স্পিরিট প্রস্তুতকারী ও সি–ফুড সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আইএফবি এগ্রো লিমিটেডে ১৫০ জনেরও বেশি সশস্ত্র লোক হামলা চালায় ও ভাঙচুর করে। এরপর প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। পরদিন কোম্পানিটি ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে চিঠি লিখে জানায়, হামলার সময় পুলিশ কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর মন্ত্রিসভা থেকেও হস্তক্ষেপের আবেদন নিষ্ফল ছিল।
এরপর রাজ্য সরকারের পণ্য ও পরিষেবা কর কর্মকর্তারা কোম্পানির নুরপুর শাখায় অভিযান চালায়। উপায়ন্তর না পেয়ে কোম্পানিটি নির্বাচনী বন্ড কেনা শুরু করে।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে দেওয়া নথিপত্র অনুসারে, ২০২২ সালে কোম্পানিটি ৪০ কোটি রুপি মূল্যের বন্ড কেনে। পরে প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারি নির্দেশনা অনুসারে এসব বন্ড কেনা হয়েছিল।’ তৃণমূল কংগ্রেসকে ইঙ্গিত করে কথাটি বললেও তিনি সরাসরি কোনো দলের নাম মুখে নেননি।
কোম্পানিটি ৯২ কোটি রুপি মূল্যের বন্ড কিনেছে। এর মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের (টিএমসি) ভাগে পড়েছে ৪২ কোটি রুপি। আইএফবি এগ্রো অন্যান্য দলকেও অল্প পরিমাণ অনুদান দিয়েছে। ওডিশা রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজু জনতা দলকে দিয়েছে ৬ কোটি ৩০ লাখ রুপি; বিহারের প্রভাবশালী আঞ্চলিক দল রাষ্ট্রীয় জনতা দলকে ৩৫ কোটি রুপি এবং কংগ্রেসকে দিয়েছে ৫ কোটি রুপি।
তৃণমূলের সর্বভারতীয় মুখপাত্র গোখলে বলেছেন, আইএফবি এগ্রোর নির্বাহীদের দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। বিজেপি সরকারের অধীনে কেন্দ্রীয় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর হুমকি ও চাপে এমন মন্তব্য করেছে।
বিজেপি এবং কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গোখলে আরও বলেন, তৃণমূল অনুদান বেশি পেয়েছে রাজনৈতিক সফলতার জন্য। এর বেশি কিছু নয়। যেই দল নির্বাচনে জিতবে কোম্পানিগুলো তো সেই দলেরই বন্ড কিনবে! এটাই স্বাভাবিক। আপনি তো টাকা অযথা জলে ফেলতে চাইবেন না!
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের অর্থ বিলের মাধ্যমে আইনে একগুচ্ছ সংশোধনী এনে মোদী সরকার ২০১৮ সাল থেকে ইলেকটোরাল বন্ড চালু করে। এর ফলে কোনো ব্যক্তি বা করপোরেট রাজনৈতিক দলগুলোকে চাঁদা দিতে চাইলে, ব্যাংকের মাধ্যমে বন্ড কিনতে পারে। ১ হাজার, ১০ হাজার, ১ লাখ, ১০ লাখ এবং ১ কোটি রুপি মূল্যের বন্ড ছাড়া হয়। রাজনৈতিক দলগুলো নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে সেই বন্ড ভাঙিয়ে নিতে পারে। কিন্তু দাতার পরিচয় গোপন থাকে।
এই বন্ডের ফলে করপোরেট সংস্থার পাশাপাশি বিদেশিরাও রাজনৈতিক দলগুলোকে টাকা দিতে পারে। যার বিনিময়ে ব্যক্তি বা সংস্থা ১০০ শতাংশ কর ছাড় পায়। এই ব্যবস্থায় কোম্পানিগুলো নিজেদের পরিচয় গোপন করে রাজনৈতিক প্রচারে সীমাহীন চাঁদা দিতে পারে। তবে এ নিয়ে নানা সমালোচনার সৃষ্টি হলে গত ফেব্রুয়ারিতে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট এই বন্ড প্রথাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেন।
ভারতের নির্বাচন কমিশন দেশটির রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থদাতাদের তালিকা প্রকাশ করেছে গত ১৪ মার্চ। ওই তালিকায় নাম থাকা কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের নানা দুর্নীতি থেকে রেহাই ও নানা সুযোগ–সুবিধা পেতে রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থ দিয়েছিল। যথারীতি তারা পেয়েছেও সেসব ছাড়।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরা এসব প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক আঁতাত নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে ইলেকটোরাল বন্ড স্কিম চালু করার পর থেকে ৩০টি ধাপে ১৬ হাজার ৫১৮ কোটি রুপির বন্ড ছাড়া হয়। বন্ড কেনায় শীর্ষে রয়েছে বিতর্কিত লটারি ব্যবসায়ী মার্টিন সান্তিয়াগোর সংস্থা ‘ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস’। এই প্রতিষ্ঠান কিনেছে মোট ১ হাজার ৩৬৮ কোটি রুপির বন্ড।
বন্ড কেনায় টাকার অঙ্কে তাদের পরেই রয়েছে বিখ্যাত তেলুগু ব্যবসায়ী কৃষ্ণা রেড্ডির সংস্থা ‘মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড’। তারা ৯৬৬ কোটি রুপির নির্বাচনী বন্ড কিনেছে। মূলত হায়দরাবাদ কেন্দ্রিক এই সংস্থা একাধিক সরকারি প্রকল্পের ঠিকাদারি পেয়েছে। এ ছাড়া মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সহযোগী সংস্থা ‘ওয়েস্টার্ন ইউপি পাওয়ার ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড’ ২২০ কোটি রুপির বন্ড কিনেছে।
ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঁচ বছর ধরে তহবিল জোগানো শীর্ষ কোম্পানির মধ্যে রয়েছে বেদান্ত লিমিটেড, ভারতী এয়ারটেল, আরপিএসজি গ্রুপ ও এসেল মাইনিংসহ অন্য বৃহত্তম ভারতীয় কোম্পানি। এদের মধ্য কেবল সান্তিয়াগোর সংস্থাই নয়, বন্ড কেনার দিক থেকে প্রথম ৩০টি সংস্থার ১৪ টিতেই গত কয়েক বছরে তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে সিবিআই, ইডি কিংবা আয়কর দপ্তর (আইটি)।
বিজেপির নির্বাচনী বন্ড কেনার পর ফিউচার গেমিংয়ের ওপর ভারতীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরদারি কমেছে। বলতে গেলে এরপরই অন্য ভারতীয় কোম্পানিগুলোও নির্বাচনী বন্ড কেনার দিকে ঝুঁকতে থাকে।
রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার সূচনা
ভারতের বৃহত্তম রিয়েল এস্টেট কোম্পানি হয়ে ওঠার আগে ডিএলএফ গ্রুপ বিপদে পড়লেই সাহায্যের জন্য কংগ্রেস নেতাদের কাছে ধরনা দিত। ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটি আশির দশকে কুশল পাল সিংয়ের নেতৃত্বে বড় সফলতার মুখ দেখে। সিং আত্মজীবনীতে লিখেছেন, কংগ্রেস নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সঙ্গে তাঁর একাধিকবার সাক্ষাৎ হয়েছে। গ্রেপ্তার এড়ানোসহ তাঁকে রক্ষা করতেও এগিয়ে এসেছিলেন রাজীব গান্ধী।
২০১২ সালে কংগ্রেস শাসিত হরিয়ানা রাজ্যের গুরগাঁওয়ে একজন আমলা ডিএলএফ গ্রুপ এবং গান্ধী পরিবারের জামাতা রবার্ট ভদ্রর (প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর স্বামী) মধ্যে জমিজমা সংক্রান্ত একটি চুক্তি বাতিল করেন। এ ঘটনা নিয়ে সমালোচনা সৃষ্টি হলে রাজনৈতিক তদন্ত শুরু হয়।
এ নিয়ে সিং আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘রাজীব না থাকলে গুরগাঁওয়ের কাজটা কখনোই হতো না।’ ওই কর্মকর্তাকে সরকার পরে বদলি করে। ঘটনাগুলো বিজেপির প্রচারের খোরাক হয়ে ওঠে। দলটি অভিযোগ করে, এই ঘটনায় গান্ধী পরিবারের দুর্নীতির স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে।
এরপর ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার আগে হরিয়ানায় একটি সমাবেশে বলেছিলেন, ‘তারা (গান্ধী পরিবার) সোনার চামচ নিয়ে জন্মেছে, যেখানে আমি রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে চা বিক্রি করে বড় হয়েছি। রাহুল গান্ধীর একটি সুপরিচিত বংশ আছে, যেখানে আমি শুধুই সৎ।’
ওই বছর বিজেপি দুর্নীতি বিরোধী প্রচার চালিয়েই জাতীয় নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং প্রথমবার হরিয়ানায় ক্ষমতায় আসে। পাল্টে যায় ডিএলএফের খাতিরের জায়গায়ও। ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের নভেম্বরের মধ্যে ডিএলএফ গ্রুপ বিজেপির ১৭০ কোটি রুপির নির্বাচনী বন্ড কেনে।
যাইহোক, এরপর ২০২৩ সালের এপ্রিলে হরিয়ানার বিজেপি সরকার—পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টকে জানায়, ডিএলএফ–ভদ্রর জমিজমা চুক্তিতে ‘কোনো বিধি লঙ্ঘন হয়নি।’
তবে ডিএলএফের কাছে তাদের অনুদানের ধরন এবং সময় সম্পর্কে মন্তব্যর জন্য যোগাযোগ করলে তারা আল জাজিরার অনুরোধে সাড়া দেয়নি।
কড়ির বদলে কড়ি
২০১৯ সালের অক্টোবরে বিজেপি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন আয়কর বিভাগ কর ফাঁকির অভিযোগে ভারতজুড়ে ১৫টি শহরে মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের (এমইএআইএল) সঙ্গে যুক্ত অনেক বাসভবন এবং গেস্ট হাউসে অভিযান চালায়। এরপর থেকে এমইএআইএল এবং বিজেপি সরকারের মধ্যে সম্পর্ক ‘গভীর’ হয়ে ওঠে।
প্রকৃতপক্ষে, এমইএআইএল গত পাঁচ বছরে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপিকে ৬৭০ কোটি রুপি দিয়েছে, যার বেশির ভাগই অক্টোবরের অভিযানের পর। এতে এমইএআইএল কোনো দলের একক বৃহত্তম দাতায় পরিণত হয়েছে।
এরপর ২০২২ সালের মার্চে চীন সীমান্তের কাছে লাদাখে কৌশলগত জোজি–লা টানেলের ঠিকাদারি পাওয়ায় ভারত সরকারের পরিবহন মন্ত্রী নিতিন গড়করি সংসদে প্রতিষ্ঠানটির প্রশংসা করেন।
নিলামে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোকে পরাজিত করায় গড়করি বলেন, ‘মেঘা (এমইএআইএল) নিলাম কেনায় সরকারের ৫ হাজার কোটি রুপি বেঁচে গেছে।’
এদিকে ২০২৩ সালের অক্টোবরে তেলেঙ্গানা রাজ্যে নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে এমইএআইএল নির্মিত লিফট–সেচ প্রকল্পের মেডিগড্ডা ব্যারেজের কিছু অংশ ধসে পড়ে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বিজেপির চুক্তি নিয়ে রাজ্যে রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়।
এরপর তেলেঙ্গানা রাজ্যসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে। ফলে রাজনৈতিক হাওয়া বদল হলে এমইএআইএলের অনুদানের ঠিকানাও পরিবর্তিত হয়।
জনমত জরিপ অনুসারে, ২০২৩ সালে রাজ্য নির্বাচনের দৌড়ে প্রতিষ্ঠানটি সহযোগী সংস্থা ওয়েস্টার্ন ইউপি পাওয়ার ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের অধীনে আরও বেশি বন্ড কেনে। যার মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছে প্রায় ১০০ কোটি রুপি। ফলে তারা কংগ্রেসেরও শীর্ষ দাতা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে।
মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করলে এমইএআইএল আল জাজিরার অনুরোধে সাড়া দেয়নি। তবে বিজেপির মতো কংগ্রেসও দাবি করেছে, এসব অনুদান নির্বাচনের ফলাফলের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জ্যেষ্ঠ নেতা আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমাদের দাতা করপোরেটরা এটি করেছে, কারণ আমাদের শাসনের একটি ভালো রেকর্ড রয়েছে।’
এদিকে ২০২০ সালের ২৫ জুন কলকাতাভিত্তিক স্পিরিট প্রস্তুতকারী ও সি–ফুড সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আইএফবি এগ্রো লিমিটেডে ১৫০ জনেরও বেশি সশস্ত্র লোক হামলা চালায় ও ভাঙচুর করে। এরপর প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। পরদিন কোম্পানিটি ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে চিঠি লিখে জানায়, হামলার সময় পুলিশ কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর মন্ত্রিসভা থেকেও হস্তক্ষেপের আবেদন নিষ্ফল ছিল।
এরপর রাজ্য সরকারের পণ্য ও পরিষেবা কর কর্মকর্তারা কোম্পানির নুরপুর শাখায় অভিযান চালায়। উপায়ন্তর না পেয়ে কোম্পানিটি নির্বাচনী বন্ড কেনা শুরু করে।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে দেওয়া নথিপত্র অনুসারে, ২০২২ সালে কোম্পানিটি ৪০ কোটি রুপি মূল্যের বন্ড কেনে। পরে প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারি নির্দেশনা অনুসারে এসব বন্ড কেনা হয়েছিল।’ তৃণমূল কংগ্রেসকে ইঙ্গিত করে কথাটি বললেও তিনি সরাসরি কোনো দলের নাম মুখে নেননি।
কোম্পানিটি ৯২ কোটি রুপি মূল্যের বন্ড কিনেছে। এর মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের (টিএমসি) ভাগে পড়েছে ৪২ কোটি রুপি। আইএফবি এগ্রো অন্যান্য দলকেও অল্প পরিমাণ অনুদান দিয়েছে। ওডিশা রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজু জনতা দলকে দিয়েছে ৬ কোটি ৩০ লাখ রুপি; বিহারের প্রভাবশালী আঞ্চলিক দল রাষ্ট্রীয় জনতা দলকে ৩৫ কোটি রুপি এবং কংগ্রেসকে দিয়েছে ৫ কোটি রুপি।
তৃণমূলের সর্বভারতীয় মুখপাত্র গোখলে বলেছেন, আইএফবি এগ্রোর নির্বাহীদের দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। বিজেপি সরকারের অধীনে কেন্দ্রীয় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর হুমকি ও চাপে এমন মন্তব্য করেছে।
বিজেপি এবং কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গোখলে আরও বলেন, তৃণমূল অনুদান বেশি পেয়েছে রাজনৈতিক সফলতার জন্য। এর বেশি কিছু নয়। যেই দল নির্বাচনে জিতবে কোম্পানিগুলো তো সেই দলেরই বন্ড কিনবে! এটাই স্বাভাবিক। আপনি তো টাকা অযথা জলে ফেলতে চাইবেন না!
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের অর্থ বিলের মাধ্যমে আইনে একগুচ্ছ সংশোধনী এনে মোদী সরকার ২০১৮ সাল থেকে ইলেকটোরাল বন্ড চালু করে। এর ফলে কোনো ব্যক্তি বা করপোরেট রাজনৈতিক দলগুলোকে চাঁদা দিতে চাইলে, ব্যাংকের মাধ্যমে বন্ড কিনতে পারে। ১ হাজার, ১০ হাজার, ১ লাখ, ১০ লাখ এবং ১ কোটি রুপি মূল্যের বন্ড ছাড়া হয়। রাজনৈতিক দলগুলো নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে সেই বন্ড ভাঙিয়ে নিতে পারে। কিন্তু দাতার পরিচয় গোপন থাকে।
এই বন্ডের ফলে করপোরেট সংস্থার পাশাপাশি বিদেশিরাও রাজনৈতিক দলগুলোকে টাকা দিতে পারে। যার বিনিময়ে ব্যক্তি বা সংস্থা ১০০ শতাংশ কর ছাড় পায়। এই ব্যবস্থায় কোম্পানিগুলো নিজেদের পরিচয় গোপন করে রাজনৈতিক প্রচারে সীমাহীন চাঁদা দিতে পারে। তবে এ নিয়ে নানা সমালোচনার সৃষ্টি হলে গত ফেব্রুয়ারিতে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট এই বন্ড প্রথাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেন।
সম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
৮ ঘণ্টা আগেএকটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলো
১৬ ঘণ্টা আগেট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
২ দিন আগেকোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
৫ দিন আগে