আবদুল বাছেদ, ঢাকা
সম্প্রতি চায়ের দোকান থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, আলোচনা–সমালোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে হিজড়া–ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু। প্রথম গোষ্ঠীর সকল অধিকার নিশ্চিতে অধিকাংশ মানুষ আপাত একমত হলেও দ্বিতীয় শ্রেণির বেলায় কেউ জ্বলে উঠছেন তেলে–বেগুনে, আবার কেউ বোধ করছেন চরম অস্বস্তি। এসব দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, একটি গোষ্ঠীর প্রতি বহু মানুষের এই ক্ষোভ ও অস্বস্তির শেকড় কোথায়?
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সাবেক খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাব সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ‘শরীফ থেকে শরীফা’ গল্পের পাতা ছিঁড়ে ও অন্যদের একই কাজ করতে উসকানি দিয়ে আগুনে ঢেলেছেন ঘি। আসিফ মাহতাব এবং এমন অনেক বিশ্বাসীর মতে, ইসলামে ট্রান্সজেন্ডার/লিঙ্গ রূপান্তর নিষিদ্ধ, হারাম, একে প্রতিরোধ করতেই হবে। ট্রান্সজেন্ডারকে সমকামিতা বলেও মনে করছেন অনেকে।
বাংলাদেশে কয়েক শ্রেণির লিঙ্গ–বৈচিত্র্যপূর্ণ মানুষদের একত্রে হিজড়া ডাকা হয়। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন—অকুয়া, জানকা, জেনানা, ছিবড়ি, কোতি, ভাবরাজের হিজড়া প্রভৃতি। তাঁদের মধ্যে মিশে গেছেন ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামীরাও। এরা একই সঙ্গে হিজড়াদের ডেরায় থাকেন। ফলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রকৃত হিজড়া থেকে ট্রান্সজেন্ডার বা অন্য জেন্ডারের মানুষদের আলাদা করা বেশ জটিল। তাই পাঠ্যবইতেও লিঙ্গ বৈচিত্র্যপূর্ণ এই গোষ্ঠীকে সার্বিকভাবে হিজড়া বলেই চিহ্নিত করা হয়। সে নিয়েও বেঁধেছে গোল।
প্রশ্ন ওঠে, ইসলামে ট্রান্সজেন্ডার নিষিদ্ধ হলে ইসলামি বিপ্লবের দেশ ইরানে সেটি বৈধ কেন? আবার তা কোনো সেক্যুলার আইনে নয় বরং দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ মুসাভি খোমেনি, যার নেতৃত্বেই দেশটিতে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হয়, তিনিই সার্জারির মাধ্যমে লিঙ্গ রূপান্তরের পক্ষে ফতোয়া দিয়েছেন।
আয়াতুল্লাহ খোমেনি ১৯৬৪ সালে তাঁর বই ‘তাহরির আল–ওয়াসিলা’তে একবার ও ১৯৮২ সালে ইসলামি বিপ্লবের পরে আরেকবার জৈবিক লিঙ্গের সঙ্গে মানসিক লিঙ্গের সমন্বয় করতে না পারা এবং এ নিয়ে সমস্যায় থাকা ব্যক্তিদের সার্জারির মাধ্যমে লিঙ্গান্তর করা এবং লিঙ্গ নিশ্চিতকরণের বিষয়ে একটি ফতোয়া জারি করেন।
ইরানে ট্রান্সজেন্ডাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় ফেরেদুন মুলকারা নামের এক পুরুষের লিঙ্গ পরিবর্তনে ফতোয়া দেওয়ার মাধ্যমে। নারীসূলভ ফেরেদুন মুলকারা নিজের লৈঙ্গিক পরিচয়ের স্বীকৃতি পেতে প্রায় আট বছর লড়াই করেন। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর তাঁর জন্য নারীদের পোশাক পরা নিষিদ্ধ করা হয়, দেওয়া হয় হরমোন থেরাপি। এতে ফেরেদুনের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে থাকে।
বাধ্য হয়ে দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতের সময়ই খোমেনি তাঁর আস্থাভাজন তিনজন চিকিৎসকের সঙ্গে ফেরেদুনের বিষয়ে কথা বলেন। এর মাত্র আধাঘণ্টার মধ্যেই খোমেনি ট্রান্সজেন্ডারদের সার্জারির মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তনের অনুমোদন দিয়ে ফতোয়া জারি করেন। আয়াতুল্লাহ খোমেনি ট্রান্সজেন্ডারদের প্রসঙ্গে ফতোয়া জারি করে বলেন, ‘নির্ভরযোগ্য চিকিৎসকেরা সুপারিশ করলে শরিয়তের বিধানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন করা নিষিদ্ধ নয়।’
দেশটির ইসলামি সরকার ফতোয়াটিকে পরবর্তীতে আইনে পরিণত করে। আর ১৯৯৭ সালে ফেরেদুন সার্জারির মাধ্যমে লিঙ্গ পারির্তন করেন, নিজের নাম বদলে রাখেন মারিয়াম খাতুন মুলকারা। বতর্মানে ইরানে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরা নতুন জন্মসনদ, নতুন পরিচয়পত্র এবং নতুন পাসপোর্ট পেয়ে থাকেন।
ইরানের আইনবিদদের মতে, যেহেতু ‘আত্মাকে’ পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, কিন্তু চিকিৎসার মাধ্যমে শারীরিক পরিবর্তন আনা সম্ভব, তাই লিঙ্গান্তর করা অনুমোদিত। তদুপরি, ইরানের দেওয়ানি আইন অনুসারে, প্রতিটি ব্যক্তি লিঙ্গের ভিত্তিতে উত্তরাধিকারের একটি অংশ পান। উদাহরণস্বরূপ, একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী অন্য জন্মগত নারীদের মতোই উত্তরাধিকার সম্পত্তি পান।
ইরানের সিভিল কোডের ৯৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির মধ্যে যেই লিঙ্গের লক্ষণ বেশি সেই ব্যক্তি ওই লিঙ্গের নিয়মের অধীনে পড়বেন। দেশটিতে ২০১২ সালে গৃহীত ‘পারিবারিক সুরক্ষা আইন’ অনুসারে, যেকোনো ব্যক্তি লিঙ্গান্তরের জন্য আবেদন করতে পারিবারিক আদালতে যেতে পারেন।
আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ইরানের আইনে সেক্সুয়াল রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি (এসআরএস) এবং কনভারশন থেরাপির মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। ইরানে কনভারশন থেরাপি বা রিপারেটিভ থেরাপি নয় বরং এসআরএসে উৎসাহিত করা হয়। দেশটিতে এসআরএস করার একটি নির্দেশিকা রয়েছে এবং এর রূপরেখা তৈরি ও অনুমোদন দেয় ওয়ার্ল্ড প্রফেশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর ট্রান্সজেন্ডার পিপল (ডব্লিউপিএটিএইচ)। ইউএনএইচসিআরের ২০০১ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইরানে লিঙ্গ পরিবর্তনের সার্জারি ঘন ঘন এবং প্রকাশ্যেই করা হয়।
ইরানের ইমাম কমিটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মোতাবেক লিঙ্গ পরিবর্তনের অস্ত্রোপচারের জন্য ট্রান্সজেন্ডারদের সরকারি ভর্তুকি ও সুদমুক্ত ঋণও দিয়ে থাকে।
এদিকে আশির দশকের গোড়ার দিকে মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল অনুষদের শিক্ষার্থী সাইয়্যিদ আবদুল্লাহ নিজের লিঙ্গ নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েন। একজন মনোবিজ্ঞানীর কাছে গেলে তাঁর ‘সাইকোলজিক্যাল হারমাফ্রোডিটিজম’ ধরা পড়ে। ওই মনোবিজ্ঞানী তিন বছর ধরে সাইয়্যিদকে চিকিৎসা দেন, তাঁর পুরুষ যৌনপরিচয় প্রধান করার চেষ্টা করেন। অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে মনোবিজ্ঞানী জানান, বয়ঃসন্ধিকালের পর এই ধরনের চিকিৎসা কার্যকরী নয়।
সাইয়্যিদ এরপর দ্বিতীয় মনোবিজ্ঞানীর দ্বারস্থ হন। তিনিও ব্যর্থ হয়ে জানান, সার্জারি করে লিঙ্গ পরিবর্তন করাই সাইয়্যিদের জন্য একমাত্র সুরাহা। সার্জারি করার পর সাইয়্যিদ নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন স্যালি। তবে তাঁকে মেনে নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়, দিতে দেয়নি পরীক্ষা। তাঁর লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে সংকট দেখা দেয় মিশরে। এ নিয়ে চলে মামলা–মোকদ্দমা। তদন্ত কমিটি জানায়, সার্জারি ছাড়া আসলেই কোনো উপায় ছিল না সাইয়্যিদের।
এরপর মিসরের তৎকালীন সরকারের ফতোয়া বিভাগের প্রধান মুহাম্মাদ সায়্যিদ তানতাভি সার্জারির মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তনের পক্ষে ফতোয়া জারি করেন। ফতোয়ায় তানতাভি উল্লেখ করেন, যদি কোনো পুরুষ সত্যিকার অর্থেই নিজের নারীত্ব কাটিয়ে উঠতে অক্ষম হন এবং ডাক্তার লিঙ্গ পরিবর্তনের পরামর্শ দেন, সে ক্ষেত্রে তাঁর জন্য লিঙ্গ পরিবর্তন করা জায়েজ। নারী থেকে পুরুষ হওয়ার ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য।
খোমেনি এবং আল–তানতাভি ইসলামের ধ্রুপদি পদ্ধতি ইজতিহাদের মাধ্যমে এই ধরনের ফতোয়া জারি করেন বলে বিশ্লেষক ও ধর্মবেত্তারা মত দেন।
ইসলামি পরিভাষায় হিজড়াদের বলা হয় খুনসা ও ট্রান্সজেন্ডারদের বলা হয় মুখান্নাস। সুনান আবু দাউদ ৪১ খণ্ডের ৪৯১০ নম্বর হাদিসে বলা হয়েছে, হাতে পায়ে মেহেদি রাঙানো একজন মুখান্নাসকে নবীর কাছে নিয়ে আসা হলো। নবী জিজ্ঞেস করলেন: এই লোকের কী হয়েছে? তাঁকে বলা হলো: হে আল্লাহর রাসুল! সে নারীদের চলন–বলনের অনুকরণ করে। তখন নবী (সা.) তাঁর ব্যাপারে আদেশ জারি করলেন এবং তাঁকে আন–নাক্বি নামক স্থানে নির্বাসন দেওয়া হলো। লোকে বলল: আল্লাহর রাসুল! আমাদের কি তাকে হত্যা করা উচিত নয়? তিনি বললেন: যারা নামাজ পড়ে তাদের হত্যা করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে।
এই হাদিসের উপযুক্ত ব্যাখ্যা বিজ্ঞ মুফতি ও ফক্বীহগণ দিতে পারবেন। তবে স্পষ্টত মহানবী (সা.) লোকটিকে কোনো শাস্তি দেননি বা এটিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে মনে করেননি।
হানাফি মাজহাব মতে, যদি কারও মাঝে সৃষ্টিগতভাবে চলাফেরা ও কথায় নারীদের মতো লাজুকতা ও নম্রতা থাকে, নারীদের প্রতি প্রবৃত্তি না থাকে, পাপ কাজ না করে, তাহলে এই ধরনের মুখান্নাসকে নারীদের কাছে রাখার রোখছত বর্ণনা করেছেন অনেক মাশায়েখ। (মাবসুত (১২ / ৩৮২), আল-বাহরুর রায়েক শারহু কানযিদ দাকায়েক (৬ / ৫০)।
শাফেয়ি মাজহাব মতে, ভঙ্গিমা ও কর্মের ক্ষেত্রে যে সৃষ্টিগতভাবে মেয়েলি আচরণ করে, তার জন্য কোনো গোনাহ নেই। (মুগনিল মুহতাজ ইলা মা’রিফাতি মাআনি আলফাজিল মিনহাজ (৪ / ৪৩০)। হাম্বলি মাজহাব অনুযায়ী, যেই মুখান্নাসের কোনো যৌন–প্রবৃত্তি নেই, সে নারীদের জন্য মাহরামের হুকুমের অধীন। আর যদি কোনো মুখান্নাসের নারীদের প্রতি প্রবৃত্তি থাকে, তাহলে তার হুকুম (সকল ইসলামি বিধিবিধান) অন্য পুরুষদের মতোই। (আল–মুগনি (৭ / ৪৬২)।
এ ছাড়া ২০১৪ সালে মালয়েশিয়ায় লিঙ্গ রূপান্তরের পক্ষে ফতোয়া জারি, ২০১৮ সালে পাকিস্তানে ট্রান্সজেন্ডার অধিকার আইন পাস, ২০১৪ সালে লেবাননের আপিল বিভাগ লিঙ্গ রূপান্তরের পক্ষে ডিক্রি জারি এবং ২০১৬ সালে আরব আমিরাতও সার্জারির মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তনের পক্ষে রায় দিয়েছে।
ফলে মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশে ট্রান্সজেন্ডার প্রশ্নের উত্তর খুব কঠিন নয়, একটু সহমর্মী হলেই হয়।
সম্প্রতি চায়ের দোকান থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, আলোচনা–সমালোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে হিজড়া–ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু। প্রথম গোষ্ঠীর সকল অধিকার নিশ্চিতে অধিকাংশ মানুষ আপাত একমত হলেও দ্বিতীয় শ্রেণির বেলায় কেউ জ্বলে উঠছেন তেলে–বেগুনে, আবার কেউ বোধ করছেন চরম অস্বস্তি। এসব দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, একটি গোষ্ঠীর প্রতি বহু মানুষের এই ক্ষোভ ও অস্বস্তির শেকড় কোথায়?
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সাবেক খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাব সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ‘শরীফ থেকে শরীফা’ গল্পের পাতা ছিঁড়ে ও অন্যদের একই কাজ করতে উসকানি দিয়ে আগুনে ঢেলেছেন ঘি। আসিফ মাহতাব এবং এমন অনেক বিশ্বাসীর মতে, ইসলামে ট্রান্সজেন্ডার/লিঙ্গ রূপান্তর নিষিদ্ধ, হারাম, একে প্রতিরোধ করতেই হবে। ট্রান্সজেন্ডারকে সমকামিতা বলেও মনে করছেন অনেকে।
বাংলাদেশে কয়েক শ্রেণির লিঙ্গ–বৈচিত্র্যপূর্ণ মানুষদের একত্রে হিজড়া ডাকা হয়। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন—অকুয়া, জানকা, জেনানা, ছিবড়ি, কোতি, ভাবরাজের হিজড়া প্রভৃতি। তাঁদের মধ্যে মিশে গেছেন ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামীরাও। এরা একই সঙ্গে হিজড়াদের ডেরায় থাকেন। ফলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রকৃত হিজড়া থেকে ট্রান্সজেন্ডার বা অন্য জেন্ডারের মানুষদের আলাদা করা বেশ জটিল। তাই পাঠ্যবইতেও লিঙ্গ বৈচিত্র্যপূর্ণ এই গোষ্ঠীকে সার্বিকভাবে হিজড়া বলেই চিহ্নিত করা হয়। সে নিয়েও বেঁধেছে গোল।
প্রশ্ন ওঠে, ইসলামে ট্রান্সজেন্ডার নিষিদ্ধ হলে ইসলামি বিপ্লবের দেশ ইরানে সেটি বৈধ কেন? আবার তা কোনো সেক্যুলার আইনে নয় বরং দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ মুসাভি খোমেনি, যার নেতৃত্বেই দেশটিতে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হয়, তিনিই সার্জারির মাধ্যমে লিঙ্গ রূপান্তরের পক্ষে ফতোয়া দিয়েছেন।
আয়াতুল্লাহ খোমেনি ১৯৬৪ সালে তাঁর বই ‘তাহরির আল–ওয়াসিলা’তে একবার ও ১৯৮২ সালে ইসলামি বিপ্লবের পরে আরেকবার জৈবিক লিঙ্গের সঙ্গে মানসিক লিঙ্গের সমন্বয় করতে না পারা এবং এ নিয়ে সমস্যায় থাকা ব্যক্তিদের সার্জারির মাধ্যমে লিঙ্গান্তর করা এবং লিঙ্গ নিশ্চিতকরণের বিষয়ে একটি ফতোয়া জারি করেন।
ইরানে ট্রান্সজেন্ডাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় ফেরেদুন মুলকারা নামের এক পুরুষের লিঙ্গ পরিবর্তনে ফতোয়া দেওয়ার মাধ্যমে। নারীসূলভ ফেরেদুন মুলকারা নিজের লৈঙ্গিক পরিচয়ের স্বীকৃতি পেতে প্রায় আট বছর লড়াই করেন। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর তাঁর জন্য নারীদের পোশাক পরা নিষিদ্ধ করা হয়, দেওয়া হয় হরমোন থেরাপি। এতে ফেরেদুনের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে থাকে।
বাধ্য হয়ে দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতের সময়ই খোমেনি তাঁর আস্থাভাজন তিনজন চিকিৎসকের সঙ্গে ফেরেদুনের বিষয়ে কথা বলেন। এর মাত্র আধাঘণ্টার মধ্যেই খোমেনি ট্রান্সজেন্ডারদের সার্জারির মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তনের অনুমোদন দিয়ে ফতোয়া জারি করেন। আয়াতুল্লাহ খোমেনি ট্রান্সজেন্ডারদের প্রসঙ্গে ফতোয়া জারি করে বলেন, ‘নির্ভরযোগ্য চিকিৎসকেরা সুপারিশ করলে শরিয়তের বিধানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন করা নিষিদ্ধ নয়।’
দেশটির ইসলামি সরকার ফতোয়াটিকে পরবর্তীতে আইনে পরিণত করে। আর ১৯৯৭ সালে ফেরেদুন সার্জারির মাধ্যমে লিঙ্গ পারির্তন করেন, নিজের নাম বদলে রাখেন মারিয়াম খাতুন মুলকারা। বতর্মানে ইরানে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরা নতুন জন্মসনদ, নতুন পরিচয়পত্র এবং নতুন পাসপোর্ট পেয়ে থাকেন।
ইরানের আইনবিদদের মতে, যেহেতু ‘আত্মাকে’ পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, কিন্তু চিকিৎসার মাধ্যমে শারীরিক পরিবর্তন আনা সম্ভব, তাই লিঙ্গান্তর করা অনুমোদিত। তদুপরি, ইরানের দেওয়ানি আইন অনুসারে, প্রতিটি ব্যক্তি লিঙ্গের ভিত্তিতে উত্তরাধিকারের একটি অংশ পান। উদাহরণস্বরূপ, একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী অন্য জন্মগত নারীদের মতোই উত্তরাধিকার সম্পত্তি পান।
ইরানের সিভিল কোডের ৯৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির মধ্যে যেই লিঙ্গের লক্ষণ বেশি সেই ব্যক্তি ওই লিঙ্গের নিয়মের অধীনে পড়বেন। দেশটিতে ২০১২ সালে গৃহীত ‘পারিবারিক সুরক্ষা আইন’ অনুসারে, যেকোনো ব্যক্তি লিঙ্গান্তরের জন্য আবেদন করতে পারিবারিক আদালতে যেতে পারেন।
আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ইরানের আইনে সেক্সুয়াল রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি (এসআরএস) এবং কনভারশন থেরাপির মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। ইরানে কনভারশন থেরাপি বা রিপারেটিভ থেরাপি নয় বরং এসআরএসে উৎসাহিত করা হয়। দেশটিতে এসআরএস করার একটি নির্দেশিকা রয়েছে এবং এর রূপরেখা তৈরি ও অনুমোদন দেয় ওয়ার্ল্ড প্রফেশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর ট্রান্সজেন্ডার পিপল (ডব্লিউপিএটিএইচ)। ইউএনএইচসিআরের ২০০১ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইরানে লিঙ্গ পরিবর্তনের সার্জারি ঘন ঘন এবং প্রকাশ্যেই করা হয়।
ইরানের ইমাম কমিটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মোতাবেক লিঙ্গ পরিবর্তনের অস্ত্রোপচারের জন্য ট্রান্সজেন্ডারদের সরকারি ভর্তুকি ও সুদমুক্ত ঋণও দিয়ে থাকে।
এদিকে আশির দশকের গোড়ার দিকে মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল অনুষদের শিক্ষার্থী সাইয়্যিদ আবদুল্লাহ নিজের লিঙ্গ নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েন। একজন মনোবিজ্ঞানীর কাছে গেলে তাঁর ‘সাইকোলজিক্যাল হারমাফ্রোডিটিজম’ ধরা পড়ে। ওই মনোবিজ্ঞানী তিন বছর ধরে সাইয়্যিদকে চিকিৎসা দেন, তাঁর পুরুষ যৌনপরিচয় প্রধান করার চেষ্টা করেন। অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে মনোবিজ্ঞানী জানান, বয়ঃসন্ধিকালের পর এই ধরনের চিকিৎসা কার্যকরী নয়।
সাইয়্যিদ এরপর দ্বিতীয় মনোবিজ্ঞানীর দ্বারস্থ হন। তিনিও ব্যর্থ হয়ে জানান, সার্জারি করে লিঙ্গ পরিবর্তন করাই সাইয়্যিদের জন্য একমাত্র সুরাহা। সার্জারি করার পর সাইয়্যিদ নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন স্যালি। তবে তাঁকে মেনে নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়, দিতে দেয়নি পরীক্ষা। তাঁর লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে সংকট দেখা দেয় মিশরে। এ নিয়ে চলে মামলা–মোকদ্দমা। তদন্ত কমিটি জানায়, সার্জারি ছাড়া আসলেই কোনো উপায় ছিল না সাইয়্যিদের।
এরপর মিসরের তৎকালীন সরকারের ফতোয়া বিভাগের প্রধান মুহাম্মাদ সায়্যিদ তানতাভি সার্জারির মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তনের পক্ষে ফতোয়া জারি করেন। ফতোয়ায় তানতাভি উল্লেখ করেন, যদি কোনো পুরুষ সত্যিকার অর্থেই নিজের নারীত্ব কাটিয়ে উঠতে অক্ষম হন এবং ডাক্তার লিঙ্গ পরিবর্তনের পরামর্শ দেন, সে ক্ষেত্রে তাঁর জন্য লিঙ্গ পরিবর্তন করা জায়েজ। নারী থেকে পুরুষ হওয়ার ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য।
খোমেনি এবং আল–তানতাভি ইসলামের ধ্রুপদি পদ্ধতি ইজতিহাদের মাধ্যমে এই ধরনের ফতোয়া জারি করেন বলে বিশ্লেষক ও ধর্মবেত্তারা মত দেন।
ইসলামি পরিভাষায় হিজড়াদের বলা হয় খুনসা ও ট্রান্সজেন্ডারদের বলা হয় মুখান্নাস। সুনান আবু দাউদ ৪১ খণ্ডের ৪৯১০ নম্বর হাদিসে বলা হয়েছে, হাতে পায়ে মেহেদি রাঙানো একজন মুখান্নাসকে নবীর কাছে নিয়ে আসা হলো। নবী জিজ্ঞেস করলেন: এই লোকের কী হয়েছে? তাঁকে বলা হলো: হে আল্লাহর রাসুল! সে নারীদের চলন–বলনের অনুকরণ করে। তখন নবী (সা.) তাঁর ব্যাপারে আদেশ জারি করলেন এবং তাঁকে আন–নাক্বি নামক স্থানে নির্বাসন দেওয়া হলো। লোকে বলল: আল্লাহর রাসুল! আমাদের কি তাকে হত্যা করা উচিত নয়? তিনি বললেন: যারা নামাজ পড়ে তাদের হত্যা করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে।
এই হাদিসের উপযুক্ত ব্যাখ্যা বিজ্ঞ মুফতি ও ফক্বীহগণ দিতে পারবেন। তবে স্পষ্টত মহানবী (সা.) লোকটিকে কোনো শাস্তি দেননি বা এটিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে মনে করেননি।
হানাফি মাজহাব মতে, যদি কারও মাঝে সৃষ্টিগতভাবে চলাফেরা ও কথায় নারীদের মতো লাজুকতা ও নম্রতা থাকে, নারীদের প্রতি প্রবৃত্তি না থাকে, পাপ কাজ না করে, তাহলে এই ধরনের মুখান্নাসকে নারীদের কাছে রাখার রোখছত বর্ণনা করেছেন অনেক মাশায়েখ। (মাবসুত (১২ / ৩৮২), আল-বাহরুর রায়েক শারহু কানযিদ দাকায়েক (৬ / ৫০)।
শাফেয়ি মাজহাব মতে, ভঙ্গিমা ও কর্মের ক্ষেত্রে যে সৃষ্টিগতভাবে মেয়েলি আচরণ করে, তার জন্য কোনো গোনাহ নেই। (মুগনিল মুহতাজ ইলা মা’রিফাতি মাআনি আলফাজিল মিনহাজ (৪ / ৪৩০)। হাম্বলি মাজহাব অনুযায়ী, যেই মুখান্নাসের কোনো যৌন–প্রবৃত্তি নেই, সে নারীদের জন্য মাহরামের হুকুমের অধীন। আর যদি কোনো মুখান্নাসের নারীদের প্রতি প্রবৃত্তি থাকে, তাহলে তার হুকুম (সকল ইসলামি বিধিবিধান) অন্য পুরুষদের মতোই। (আল–মুগনি (৭ / ৪৬২)।
এ ছাড়া ২০১৪ সালে মালয়েশিয়ায় লিঙ্গ রূপান্তরের পক্ষে ফতোয়া জারি, ২০১৮ সালে পাকিস্তানে ট্রান্সজেন্ডার অধিকার আইন পাস, ২০১৪ সালে লেবাননের আপিল বিভাগ লিঙ্গ রূপান্তরের পক্ষে ডিক্রি জারি এবং ২০১৬ সালে আরব আমিরাতও সার্জারির মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তনের পক্ষে রায় দিয়েছে।
ফলে মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশে ট্রান্সজেন্ডার প্রশ্নের উত্তর খুব কঠিন নয়, একটু সহমর্মী হলেই হয়।
একটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলো
৪ ঘণ্টা আগেট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
২ দিন আগেকোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
৪ দিন আগেনবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
৮ দিন আগে