জাহাঙ্গীর আলম, ঢাকা
গত শনিবার ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের সদস্যরা ৯ শতাধিক মানুষকে হত্যা এবং বহুজনকে জিম্মি করেন। তাৎক্ষণিকভাবে এ ঘটনার নিন্দা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি এক্স প্ল্যাটফর্মে লেখেন, ‘ইসরায়েলে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে এবং এই কঠিন সময়ে ভারত ইসরায়েলের পাশে রয়েছে।’ পরদিন এক্সে বিজেপি লিখেছে, ‘গতকাল ইসরায়েল একটি কাপুরুষোচিত সন্ত্রাসী হামলার মুখোমুখি হয়েছে। যেভাবে ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর মুম্বাইকে টার্গেট করা হয়েছিল। ইসরায়েল যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং তাদের সেনাবাহিনী পাল্টা জবাব দিয়েছে।’
ভারত স্পষ্ট করেই হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলেছে। সেই সঙ্গে ফিলিস্তিনের অধিকার এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে। বিপরীতে বিরোধী দল কংগ্রেস, এ হামলার নিন্দা জানালেও হামাসের নাম উল্লেখ করেনি। পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকারের দাবিগুলোকে ইসরায়েলের বৈধ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে কেবল আলোচনার মধ্যে দিয়েই সমাধান করা উচিত বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে।
মূলত কংগ্রেসের অবস্থানই ইসরায়েল নিয়ে ভারতের এত দিনের কৌশলগত অবস্থানের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ভারত কিছুটা ইসরায়েলের দিকে ঝুঁকে থাকলেও কৌশলগত কারণে সব সময় ভারসাম্য রক্ষা করে চলার চেষ্টা করেছে। এমনকি বিজেপির অটল বিহারি বাজপেয়ি সরকারের আমলেও এমন অবস্থানই ছিল। প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ি নিজেও ইসরায়েলের সার্বভৌমত্বের সুরক্ষার পাশাপাশি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষেও ভারতের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেছেন।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার আর কোনো রাখঢাক করছে না। পর্যবেক্ষকেরা বলেন, দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মুসলিম হওয়ার কারণেই ভোটের রাজনীতিতে সব সময় ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে ভারত। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির বিজেপি যেভাবে রাজনীতির মেরুকরণ করেছে, মুসলিম বিদ্বেষী প্রোপাগান্ডা এবং সরকারি পদক্ষেপ যেভাবে ভারতকে ধর্মীয় বিভক্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে সেটি ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে আবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ইসরায়েলের ওপর হামাসের হামলায় ভারতের মানুষের মধ্যে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তাতে একপক্ষ সম্পূর্ণভাবে ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। আর আরেক পক্ষ ফিলিস্তিনিদের অধিকারের আর লড়াইয়ের প্রশ্ন তুলছেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে চোখ রাখলে বোঝাই যাচ্ছে, এই দুটি পক্ষের ধর্মীয় পরিচয় এক দশকের বেশি সময় ধরে ভারতে যা ঘটছে তার ব্যতিক্রম কিছু নয়।
ভারত-ইসরায়েল সম্পর্কের ইতিহাস
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে নেতারা বক্তৃতা করলেও ১৯৪৭ সালে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে জাতিসংঘের পরিকল্পনার বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল ভারত। ইসরায়েলের প্রতি ভারতের অবস্থান তখনই অনেকখানি স্পষ্ট হয়। ১৯৫০ সালে নয়াদিল্লি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৫৩ সালে মুম্বাইয়ে ইসরায়েল কনস্যুলেট খোলে।
পুরো স্নায়ুযুদ্ধ কালে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্লকে ছিল। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকার পেছনে ভারতেরও অবদান আছে। আবার ওই সময় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) অন্যতম রূপকার ছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। দুই ব্লকের সঙ্গে আপাত দূরত্ব বজায় রাখার কৌশল নেওয়ার কারণেই সম্ভবত সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের সঙ্গে প্রকাশ্য সম্পর্ক এড়িয়ে চলেছে ভারত।
তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আর নিজেদের গুটিয়ে রাখেনি নয়াদিল্লি। ১৯৯২ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। ২০০২ সালে মহাকাশ গবেষণা সহযোগিতার জন্য ইসরায়েলি মহাকাশ সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে।
১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের সময় ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র চায় ভারত। এ সময় তো বটেই, ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালেও ভারতকে অস্ত্র দেয় ইসরায়েল। অবশ্য ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র চাওয়ার আরেকটি কারণও ছিল—১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত ও পাকিস্তানের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েতের পতনের পর ইসরায়েলের অস্ত্রের বৃহত্তম ক্রেতায় পরিণত হয় ভারত। ২০১৯ সালেই ২৫০ কোটি ডলারের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়তে যৌথ কর্মসূচি নেয় ভারত ও ইসরায়েল।
চীনও ইসরায়েলের অস্ত্রের বড় ক্রেতা ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাগড়ায় সেটি আর এগোতে পারেনি। ২০০১ সালে জুলাইয়ে চীনের সঙ্গে চারটি ফ্যালকন র্যাডার সিস্টেম চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হয় ইসরায়েল। ফলে এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারতের মতো ক্রেতা লুফে নিয়েছে তেল আবিব। সমরাস্ত্র বেচাকেনা পর্যবেক্ষকদের হিসাবে, ভারত এখন ইসরায়েলের অস্ত্রের বৃহত্তম ক্রেতা। যেখানে প্রতিবছর ১০০ কোটি ডলারের বেশি অস্ত্রের বাণিজ্য হয় এই দুই দেশে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাবে, ২০২১ সালে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যয় ৭৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। সে হিসাবে, এ খাতে ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরই ভারতের অবস্থান। আর ২০১৭–২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশে পরিণত হয় ভারত ও সৌদি আরব। বৈশ্বিক অস্ত্র আমদানির ১১ শতাংশই করে ভারত।
ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক শুধু প্রতিরক্ষা খাতেই সীমাবদ্ধ রাখেনি ভারত। ২০০৬ সালে দুই দেশের মধ্যে কৃষি সহযোগিতাবিষয়ক চুক্তি হয়। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর এই সম্পর্ক নতুন মোড় নেয়।
২০১৮ সালে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইসরায়েল সফরে যান মোদি। সেখানে এক ভাষণে নেতানিয়াহুকে ‘বন্ধু’ সম্বোধন করেন তিনি। এরপর একই বছর ছয় দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে আসেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
১৫ বছরের মধ্যে প্রথম ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারত সফরে নেতানিয়াহু সঙ্গে নিয়ে আসেন ১৩০ জনের প্রতিনিধিদল। এই সফরে দুই দেশের মধ্যে সাইবার নিরাপত্তা, জ্বালানি, মহাকাশে সহযোগিতা ও চলচ্চিত্র নির্মাণ খাতে চুক্তি হয়েছে। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে এর আগে স্বাক্ষরিত প্রযুক্তি, পানি ও কৃষিবিষয়ক চুক্তিগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়।
মূলত ২০১৭ সাল থেকে স্টার্ট-আপ ইকোসিস্টেমে অংশীদারত্ব দুই দেশের মধ্যে ক্রমেই বেড়েছে। ভারত এবং ইসরায়েল ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সাইবার নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই করে। ২০২০ সালে ভারতীয় কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম (সার্ট-ইন) এবং ইসরায়েলের ন্যাশনাল ডিরেক্টরেট অব সাইবার সিকিউরিটির (আইএসিডি) মধ্যে অপারেশনাল সহযোগিতার বিষয়ে একটি চুক্তি সাক্ষর হয়। আর ২০২২-এর জুনে দুই দেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আরও গভীর করার লক্ষ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। এ নিয়ে পাকিস্তান ও চীন বরাবরই তাদের উদ্বেগ জানিয়ে এসেছে।
এ তো গেল দুই দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের বিষয়। কিন্তু মোদি সরকারের অধীনে ভারতে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিভেদ যেভাবে চরমে উঠেছে, তাতে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে ইসরায়েল-প্রীতিও সমান তালে বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকারের সময় নরেন্দ্র মোদি ও সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ্য হয়েছে বারবার। মূলত ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির আড়ালে মুসলিম বিদ্বেষী অবস্থানকে উদ্যাপন করেছে ভারত সরকার। ভারতে ট্রাম্পের পূজাও হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি নিজে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ভারতীয় ডায়াস্পোরার এক সমাবেশে ট্রাম্পের পক্ষে ভোট চেয়েছেন।
যদিও পবিত্র জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বীকৃতি প্রত্যাহারের পক্ষে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব অনুমোদন হয়, সেই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় ভারত। এর কারণ মূলত ওই সময় ভারত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতের বাইরে অবস্থান নিতে চায়নি। ওই প্রস্তাবে ভোট দিয়েছিল ১২৮টি সদস্য দেশ।
ভারতের নীতি হলো, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কে কিছুটা ভারসাম্য বজায় রেখে চলা। এর একটি কারণ, নিজ দেশে বিপুলসংখ্যক মুসলিম ভোট। অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—ইরান ও আরব দেশগুলোর ওপর জ্বালানি তেল ও রেমিট্যান্সে নির্ভরশীলতা। এই দেশগুলো স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে। তাদের নাখোশ করতে চায় না নয়াদিল্লি। ইসরায়েল অবশ্য সেটি বোঝে। বোঝে বলেই ‘শুধু ভোট দিয়ে সম্পর্ক বিচার করা যায় না’ বলে পরে মন্তব্য করেছেন নেতানিয়াহু।
মোদি সরকার এখন ভারতকে যে পরিস্থিতিতে নিয়ে গেছে, তাতে মুসলিম ভোটের আর আশা হয়তো বিজেপি করে না। এখন দরকার হিন্দুত্ববাদী জোশ। সামনে জাতীয় নির্বাচন। বিজেপি সেই উসকানি আরও বেশি করেই দেবে। হামাস-ইসরায়েল চলমান সংঘাতে বিপুলসংখ্যক ভারতীয়ের ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নেওয়া নিঃসন্দেহেই বিজেপির ভোট ব্যাংকের নিশ্চয়তা দিচ্ছে!
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
গত শনিবার ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের সদস্যরা ৯ শতাধিক মানুষকে হত্যা এবং বহুজনকে জিম্মি করেন। তাৎক্ষণিকভাবে এ ঘটনার নিন্দা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি এক্স প্ল্যাটফর্মে লেখেন, ‘ইসরায়েলে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে এবং এই কঠিন সময়ে ভারত ইসরায়েলের পাশে রয়েছে।’ পরদিন এক্সে বিজেপি লিখেছে, ‘গতকাল ইসরায়েল একটি কাপুরুষোচিত সন্ত্রাসী হামলার মুখোমুখি হয়েছে। যেভাবে ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর মুম্বাইকে টার্গেট করা হয়েছিল। ইসরায়েল যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং তাদের সেনাবাহিনী পাল্টা জবাব দিয়েছে।’
ভারত স্পষ্ট করেই হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলেছে। সেই সঙ্গে ফিলিস্তিনের অধিকার এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে। বিপরীতে বিরোধী দল কংগ্রেস, এ হামলার নিন্দা জানালেও হামাসের নাম উল্লেখ করেনি। পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকারের দাবিগুলোকে ইসরায়েলের বৈধ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে কেবল আলোচনার মধ্যে দিয়েই সমাধান করা উচিত বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে।
মূলত কংগ্রেসের অবস্থানই ইসরায়েল নিয়ে ভারতের এত দিনের কৌশলগত অবস্থানের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ভারত কিছুটা ইসরায়েলের দিকে ঝুঁকে থাকলেও কৌশলগত কারণে সব সময় ভারসাম্য রক্ষা করে চলার চেষ্টা করেছে। এমনকি বিজেপির অটল বিহারি বাজপেয়ি সরকারের আমলেও এমন অবস্থানই ছিল। প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ি নিজেও ইসরায়েলের সার্বভৌমত্বের সুরক্ষার পাশাপাশি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষেও ভারতের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেছেন।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার আর কোনো রাখঢাক করছে না। পর্যবেক্ষকেরা বলেন, দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মুসলিম হওয়ার কারণেই ভোটের রাজনীতিতে সব সময় ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে ভারত। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির বিজেপি যেভাবে রাজনীতির মেরুকরণ করেছে, মুসলিম বিদ্বেষী প্রোপাগান্ডা এবং সরকারি পদক্ষেপ যেভাবে ভারতকে ধর্মীয় বিভক্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে সেটি ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে আবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ইসরায়েলের ওপর হামাসের হামলায় ভারতের মানুষের মধ্যে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তাতে একপক্ষ সম্পূর্ণভাবে ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। আর আরেক পক্ষ ফিলিস্তিনিদের অধিকারের আর লড়াইয়ের প্রশ্ন তুলছেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে চোখ রাখলে বোঝাই যাচ্ছে, এই দুটি পক্ষের ধর্মীয় পরিচয় এক দশকের বেশি সময় ধরে ভারতে যা ঘটছে তার ব্যতিক্রম কিছু নয়।
ভারত-ইসরায়েল সম্পর্কের ইতিহাস
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে নেতারা বক্তৃতা করলেও ১৯৪৭ সালে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে জাতিসংঘের পরিকল্পনার বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল ভারত। ইসরায়েলের প্রতি ভারতের অবস্থান তখনই অনেকখানি স্পষ্ট হয়। ১৯৫০ সালে নয়াদিল্লি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৫৩ সালে মুম্বাইয়ে ইসরায়েল কনস্যুলেট খোলে।
পুরো স্নায়ুযুদ্ধ কালে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্লকে ছিল। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকার পেছনে ভারতেরও অবদান আছে। আবার ওই সময় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) অন্যতম রূপকার ছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। দুই ব্লকের সঙ্গে আপাত দূরত্ব বজায় রাখার কৌশল নেওয়ার কারণেই সম্ভবত সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের সঙ্গে প্রকাশ্য সম্পর্ক এড়িয়ে চলেছে ভারত।
তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আর নিজেদের গুটিয়ে রাখেনি নয়াদিল্লি। ১৯৯২ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। ২০০২ সালে মহাকাশ গবেষণা সহযোগিতার জন্য ইসরায়েলি মহাকাশ সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে।
১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের সময় ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র চায় ভারত। এ সময় তো বটেই, ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালেও ভারতকে অস্ত্র দেয় ইসরায়েল। অবশ্য ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র চাওয়ার আরেকটি কারণও ছিল—১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত ও পাকিস্তানের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েতের পতনের পর ইসরায়েলের অস্ত্রের বৃহত্তম ক্রেতায় পরিণত হয় ভারত। ২০১৯ সালেই ২৫০ কোটি ডলারের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়তে যৌথ কর্মসূচি নেয় ভারত ও ইসরায়েল।
চীনও ইসরায়েলের অস্ত্রের বড় ক্রেতা ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাগড়ায় সেটি আর এগোতে পারেনি। ২০০১ সালে জুলাইয়ে চীনের সঙ্গে চারটি ফ্যালকন র্যাডার সিস্টেম চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হয় ইসরায়েল। ফলে এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারতের মতো ক্রেতা লুফে নিয়েছে তেল আবিব। সমরাস্ত্র বেচাকেনা পর্যবেক্ষকদের হিসাবে, ভারত এখন ইসরায়েলের অস্ত্রের বৃহত্তম ক্রেতা। যেখানে প্রতিবছর ১০০ কোটি ডলারের বেশি অস্ত্রের বাণিজ্য হয় এই দুই দেশে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাবে, ২০২১ সালে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যয় ৭৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। সে হিসাবে, এ খাতে ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরই ভারতের অবস্থান। আর ২০১৭–২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশে পরিণত হয় ভারত ও সৌদি আরব। বৈশ্বিক অস্ত্র আমদানির ১১ শতাংশই করে ভারত।
ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক শুধু প্রতিরক্ষা খাতেই সীমাবদ্ধ রাখেনি ভারত। ২০০৬ সালে দুই দেশের মধ্যে কৃষি সহযোগিতাবিষয়ক চুক্তি হয়। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর এই সম্পর্ক নতুন মোড় নেয়।
২০১৮ সালে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইসরায়েল সফরে যান মোদি। সেখানে এক ভাষণে নেতানিয়াহুকে ‘বন্ধু’ সম্বোধন করেন তিনি। এরপর একই বছর ছয় দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে আসেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
১৫ বছরের মধ্যে প্রথম ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারত সফরে নেতানিয়াহু সঙ্গে নিয়ে আসেন ১৩০ জনের প্রতিনিধিদল। এই সফরে দুই দেশের মধ্যে সাইবার নিরাপত্তা, জ্বালানি, মহাকাশে সহযোগিতা ও চলচ্চিত্র নির্মাণ খাতে চুক্তি হয়েছে। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে এর আগে স্বাক্ষরিত প্রযুক্তি, পানি ও কৃষিবিষয়ক চুক্তিগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়।
মূলত ২০১৭ সাল থেকে স্টার্ট-আপ ইকোসিস্টেমে অংশীদারত্ব দুই দেশের মধ্যে ক্রমেই বেড়েছে। ভারত এবং ইসরায়েল ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সাইবার নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই করে। ২০২০ সালে ভারতীয় কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম (সার্ট-ইন) এবং ইসরায়েলের ন্যাশনাল ডিরেক্টরেট অব সাইবার সিকিউরিটির (আইএসিডি) মধ্যে অপারেশনাল সহযোগিতার বিষয়ে একটি চুক্তি সাক্ষর হয়। আর ২০২২-এর জুনে দুই দেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আরও গভীর করার লক্ষ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। এ নিয়ে পাকিস্তান ও চীন বরাবরই তাদের উদ্বেগ জানিয়ে এসেছে।
এ তো গেল দুই দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের বিষয়। কিন্তু মোদি সরকারের অধীনে ভারতে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিভেদ যেভাবে চরমে উঠেছে, তাতে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে ইসরায়েল-প্রীতিও সমান তালে বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকারের সময় নরেন্দ্র মোদি ও সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ্য হয়েছে বারবার। মূলত ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির আড়ালে মুসলিম বিদ্বেষী অবস্থানকে উদ্যাপন করেছে ভারত সরকার। ভারতে ট্রাম্পের পূজাও হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি নিজে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ভারতীয় ডায়াস্পোরার এক সমাবেশে ট্রাম্পের পক্ষে ভোট চেয়েছেন।
যদিও পবিত্র জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বীকৃতি প্রত্যাহারের পক্ষে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব অনুমোদন হয়, সেই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় ভারত। এর কারণ মূলত ওই সময় ভারত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতের বাইরে অবস্থান নিতে চায়নি। ওই প্রস্তাবে ভোট দিয়েছিল ১২৮টি সদস্য দেশ।
ভারতের নীতি হলো, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কে কিছুটা ভারসাম্য বজায় রেখে চলা। এর একটি কারণ, নিজ দেশে বিপুলসংখ্যক মুসলিম ভোট। অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—ইরান ও আরব দেশগুলোর ওপর জ্বালানি তেল ও রেমিট্যান্সে নির্ভরশীলতা। এই দেশগুলো স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে। তাদের নাখোশ করতে চায় না নয়াদিল্লি। ইসরায়েল অবশ্য সেটি বোঝে। বোঝে বলেই ‘শুধু ভোট দিয়ে সম্পর্ক বিচার করা যায় না’ বলে পরে মন্তব্য করেছেন নেতানিয়াহু।
মোদি সরকার এখন ভারতকে যে পরিস্থিতিতে নিয়ে গেছে, তাতে মুসলিম ভোটের আর আশা হয়তো বিজেপি করে না। এখন দরকার হিন্দুত্ববাদী জোশ। সামনে জাতীয় নির্বাচন। বিজেপি সেই উসকানি আরও বেশি করেই দেবে। হামাস-ইসরায়েল চলমান সংঘাতে বিপুলসংখ্যক ভারতীয়ের ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নেওয়া নিঃসন্দেহেই বিজেপির ভোট ব্যাংকের নিশ্চয়তা দিচ্ছে!
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
২ দিন আগেকোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
৪ দিন আগেনবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
৮ দিন আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
১২ দিন আগে