Ajker Patrika

কেমন হতে পারে ভবিষ্যতের স্মার্টফোন 

আব্দুর রহমান
আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০২২, ১৮: ১২
কেমন হতে পারে ভবিষ্যতের স্মার্টফোন 

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মোবাইল ফোন একটি নিত্য অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কল থেকে শুরু করে ব্যাংকিং সেবা—কী নেই এতে? এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার আমাদের জীবন বদলে দেওয়ার পাশাপাশি আমাদের অভ্যাস এমনকি সংস্কৃতি-সভ্যতাকেও অনেকটা বদলে দিয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তির অগ্রগতি এত দ্রুত হচ্ছে যে এখন নতুন করে ভাবতে হচ্ছে স্মার্টফোনের এই রমরমা সময় আর কত দিন? কোন প্রযুক্তি প্রতিস্থাপন করবে স্মার্টফোনকে? 

স্মার্টফোনের ভবিষ্যৎ কী—এর যথোপযুক্ত জবাব দেওয়া কঠিন। তবে এরই মধ্যে স্মার্টফোনের বিকল্প হওয়ার মতো একাধিক প্রযুক্তি হাজির হয়েছে বাজারে। প্রখ্যাত মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে তিনটি প্রযুক্তি অগ্রগণ্য। সেগুলো হলো—ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি (ভিআর), অগমেন্টেড রিয়্যালিটি (এআর) ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ভয়েস কমান্ড। বলা হচ্ছে, এই প্রযুক্তিগুলো স্মার্টফোনের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। এমনকি এসব প্রযুক্তি স্মার্টফোনকে ধুলোয় মিশিয়েও দিতে পারে।

অগমেন্টেড রিয়্যালিটির চশমা হয়ে উঠতে পারে আপনার স্মার্টফোন। ছবি: টুইটার ২০১৬ সালের পর থেকে স্মার্টফোনের বিক্রি ক্রমশ কমেছে। বিপরীতে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি হেডসেট, অগমেন্টেড রিয়্যালিটি হেডসেট ও গ্লাসের বিক্রি ক্রমশ বেড়েছে। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক নিবন্ধে এই তথ্য দেওয়া হয়েছে। ফোর্বস ও ইকোনমিস্ট উভয় সাময়িকীর নিবন্ধকারদের বক্তব্য হলো—আগামী দিন হতে যাচ্ছে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি (ভিআর), অগমেন্টেড রিয়্যালিটি (এআর) ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ভয়েস কমান্ডের। আগামী দিনের প্রযুক্তি বাজারে বিশেষ করে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তিগুলোই আধিপত্য বিস্তার করবে। 

স্মার্টফোনের বিকল্প হিসেবে কেন এই তিনের ওপরই বাজি ধরছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা, তা এই তিন প্রযুক্তির বৈশিষ্ট্যের ওপর নজর দিলেই বোঝা যাবে। ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি হলো কম্পিউটার নির্মিত এমন একধরনের ত্রিমাত্রিক সিমুলেশন, যা আপাতদৃষ্টিতে বাস্তব বলে মনে হয় এবং যেখানে ব্যবহারকারী বিশেষ ধরনের হেডসেট ও গ্লাভস ব্যবহার করে সেই সিমুলেশনে নিজের উপস্থিতি বজায় রাখতে পারেন। অন্যদিকে, অগমেন্টেড রিয়্যালিটি হলো এমন একটি প্রযুক্তি, যেখানে ব্যবহারকারীর সামনে বাস্তব জগতের কম্পিউটার নির্মিত ত্রিমাত্রিক চিত্র হাজির করে। তবে এ ক্ষেত্রেও ব্যবহারকারীর বিশেষ ধরনের গ্লাস চোখে পরার প্রয়োজন হয়। আর ভয়েস কমান্ড বিষয়টির সঙ্গে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। আজকাল তো বিশ্বের প্রায় সব ভাষায় কমান্ড নিতে পারে গুগলের ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট। বিশ্বের বড় বড় প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এই তিন প্রযুক্তিতে আরও বেশি ফিচার সংযুক্ত করার চেষ্টা করছে। 

 দ্য ইকোনমিস্টের ভবিষ্যদ্বাণী, এই তিনের মধ্যে ভার্চুয়াল ও অগমেন্টেড রিয়্যালিটির সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, আজকের স্মার্টফোন যেখানে হাতে বহন করতে হয়, সেখানে চোখের সামনে থাকা চশমার মাধ্যমেই যদি কল করাসহ স্মার্টফোনের সব ফিচার পাওয়া সম্ভব হয়, তবে কেন তা সমাদৃত হবে না! 

বিশ্বের প্রযুক্তি খাতের প্রধান প্রধান শক্তিগুলো বিশেষ করে অ্যাপল, মেটা ও মাইক্রোসফট উল্লিখিত প্রযুক্তিগুলোতে এরই মধ্যে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে অ্যামাজন, গুগল ও টিকটকের মালিক প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্সও। তালিকায় রয়েছে প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সনি করপোরেশনও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মালিক প্রতিষ্ঠান মেটা তো এরই মধ্যে অগমেন্টেড ও ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির সম্মিলিত প্রযুক্তির মেটাভার্সের ঘোষণা দিয়েছে। ফলে এ ক্ষেত্রে যে সামনের দিনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়বে, তা খুব সহজেই অনুমেয়। 

বাজারে না থাকলেও সিরকেট ব্রেসলেটের সম্ভাবনাও প্রবলএ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে চিপের আকার এত ছোট হয়ে গেছে যে, এখন তা চশমার কাজেও ব্যবহার করা যায়। এবং এই উৎকর্ষই ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি, অগমেন্টেড রিয়্যালিটি প্রযুক্তিকে স্মার্টফোনের বিকল্প হিসেবে ভাবার সুযোগ দিচ্ছে। একই সঙ্গে এসব গ্লাস বা চশমা আকারে ছোট ও সস্তা হওয়ায় তা স্মার্টফোনের বিকল্প হিসেবে বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি বলছে, এ ক্ষেত্রে মূল বাজি থাকবে টেক জায়ান্ট অ্যাপলের ওপরই। অন্যান্য টেক জায়ান্ট যেমন—গুগল, মাইক্রোসফট, ফেসবুক (মেটা) ও আমাজনও স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে থাকতে চাইবে না। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব টেক জায়ান্ট ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি, অগমেন্টেড রিয়্যালিটি ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ভয়েস কমান্ড প্রযুক্তির উন্নয়নে প্রতিনিয়ত পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং বিপুল বিনিয়োগ করছে। তবে বিনিয়োগের বিষয়টি স্পষ্ট হলেও এখনো এ বিষয়টি স্পষ্ট নয় যে এই তিন প্রযুক্তি আসলে কীভাবে কোন রূপ নিয়ে স্মার্টফোনের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। সে জন্য হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে। 

এই তিনের বাইরে আরও বেশ কয়েকটি প্রযুক্তি স্মার্টফোনের ভবিষ্যৎকে চোখ রাঙাচ্ছে। এর মধ্যে একটির ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস নিজেই। বিখ্যাত স্প্যানিশ সাময়িকী মার্কা এ নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে। বিল গেটস ‘ইলেকট্রনিক ট্যাটু’ নামক এক প্রযুক্তির কথা বলেছেন, যেটা আগামী দিনে স্মার্টফোনের বিকল্প হতে পারে। এই প্রযুক্তির মূল বিষয় হলো, একধরনের বিশেষ ট্যাটুর সাহায্যে ত্বকে স্মার্টফোনের চিপগুলো স্থাপন করা হবে। সেই চিপগুলো ব্যবহার করেই ত্বকের ওপরই স্মার্টফোনের সব সুবিধা ব্যবহার করা সম্ভব হবে। তবে মার্কার প্রতিবেদন অনুসারে এই প্রযুক্তি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। 

স্মার্টফোনের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রতিদ্বন্দ্বী স্মার্টওয়াচ। ছবি: রয়টার্স এ ছাড়া স্মার্টফোন প্রতিস্থাপন করার মতো আরও কিছু প্রযুক্তি হলো—স্মার্টওয়াচ, ব্রেসলেট, রিং, স্পাইডার ফোন ইত্যাদি। আজকাল আমরা সবাই স্মার্টওয়াচের সঙ্গে কমবেশি পরিচিত। এরই মধ্যে আমরা দেখছি যে, স্মার্টফোনের বেশ কিছু সুবিধা যুক্ত হয়েছে স্মার্টওয়াচে। ফলে এই স্মার্টওয়াচকেই বরং স্মার্টফোনের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বলা যায়। 

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম মিডিয়ামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্মার্টফোনের আরেক বিকল্প হতে পারে ব্রেসলেট। ফ্রান্সের একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ছিল সিকরেট ব্রেসলেট। এই ব্রেসলেট থেকে লেজার রশ্মি বেরিয়ে হাতের কবজির ত্বকের ওপর স্মার্টফোনের অপশন-সংবলিত একটি ইন্টারেকটিভ স্ক্রিন দেখাবে এবং ব্যবহারকারী সেই স্ক্রিনেই অস্থায়ীভাবে স্মার্টফোনের সব সুবিধা ব্যবহার করতে পারবেন। এবং প্রয়োজনমতো আবার সেই স্ক্রিন গায়েব করে দিতে পারবেন। তবে মিডিয়ামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফরাসি উদ্যোগটি এখন আর সক্রিয় নয়। ব্রেসলেটের মতো রিংয়ের ব্যাপারটিও একই। 

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সই আগামীর স্মার্টফোনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে উঠতে যাচ্ছেএসব প্রযুক্তির স্মার্টফোনের জায়গা দখলের ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। প্রযুক্তির কল্যাণে চিপের আকার একেবারে ক্ষুদ্র হয়ে এলেও চোখের সামনের এক জোড়া কিংবা একটি মাত্র ছোট আকারের গ্লাসে স্মার্টফোনের সব ফিচার পাওয়া সম্ভব কি না, সেটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। পেলেও তা কতটা ইউজার ফ্রেন্ডলি হবে, সেটিও ভাবার বিষয়। আবার এসব প্রযুক্তি আমজনতার জন্য কতটা সহজলভ্য হবে, তা নিয়েও রয়েছে জল্পনা। কারণ, স্মার্টফোনের সে রকম কোনো সুবিধা-সংবলিত গুগল গ্লাসের দামই রাখা হয়েছে ১ হাজার ডলারের কাছাকাছি। সে ক্ষেত্রে স্মার্টফোনের ফিচারযুক্ত হলে গ্লাসের দাম এবং আকার কেমন হবে সেটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে হাজির হয়েছে প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের সামনে। 

কেবল তা-ই নয়। অগমেন্টেড, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ও ভয়েস কমান্ড নিয়ে সতর্কতার প্রয়োজনও রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। গবেষকেরা বলছেন—এসব ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগের আগে প্রচুর ভেবেচিন্তে আগানো প্রয়োজন। কারণ, এসব ক্ষেত্রে প্রায়ই ভুল উদ্যোগ গৃহীত হতে পারে। তবে সব মিলিয়ে আগামী দিনে স্মার্টফোনের ভবিষ্যৎ যে বেশ কিছুটা হুমকির মুখে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিশ্লেষণ সম্পর্কিত পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত