জেলে থেকেও যেভাবে নির্বাচনে জয়ের পরিকল্পনা করেছেন ইমরান খান

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২২: ৩৯
আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২২: ৫৩

৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচনে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দল পিএমএল-এন সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করবে কিংবা একক বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হবে, এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে। পিএমএল-এন দলটির জয়ের এমন পূর্বাভাস মূলত দেশটির প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থনের কারণে। আরও খোলাসা করে বললে সেনাবাহিনীর সমর্থনের কারণে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কে হবেন—সেই সিদ্ধান্ত সাধারণত দেশটির সেনাবাহিনীই নিয়ে থাকে। 

টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক নিবন্ধে বিষয়টিকে বলা হয়েছে এভাবে—পাকিস্তানে একজন প্রধানমন্ত্রী সাধারণত বাছাইকৃত হন, নির্বাচিত হন না। এটা এমন এক গোপন বিষয়, যা সবাই জানে। সেনাবাহিনীই ইমরান খানকে গত নির্বাচনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে সাহায্য করেছিল।

তবে ইমরান খানের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সেই সেনাবাহিনী। ফলস্বরূপ, নির্বাচন সামনে রেখে এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনটি সাজার মুখোমুখি হয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারছেন না নির্বাচনেও। তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফকে (পিটিআই) ‘ব্যাট’ প্রতীক থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। 

এসব বিষয় বিবেচনা করলে আপাতদৃষ্টে ৭১ বছর বয়সী ইমরান খানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের ইতি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দেশের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হিসেবে একসময় অসম্ভব অবস্থান থেকেও ম্যাচ জেতানোর অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। আর পাকিস্তান এমন এক দেশ, যেখানে ডজন ডজন রাজনীতিবিদকে কারাদণ্ডিত হতে দেখা যায়, আবার তাঁদের প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে এসব রায় উল্টে যেতেও দেখা যায়। 

এ অবস্থায় ‘বন্দী নম্বর-৮০৪’ বা ইমরান খান কি পারবেন কোনো অসম্ভব ক্রিকেট ম্যাচের মতো আসন্ন নির্বাচনে তাঁর দলকে জয়ী করতে? সেই চেষ্টা কিন্তু তিনি এখনো করে যাচ্ছেন! 

পাকিস্তানের চলমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বিশ্লেষকেরা মত দিয়েছেন, রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনে ইমরান ও তাঁর দল পিটিআই এখনো হাল ছাড়েনি। পিএমএল-এন, পিপিপি যেখানে প্রকাশ্যে জনসমাবেশ, নির্বাচনী শোভাযাত্রা ও প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে; সেখানে কোণঠাসা হয়ে যাওয়া ইমরানের লাখ লাখ সমর্থক ভিড় করছে ভার্চুয়াল মাধ্যমে। সহজ কথায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ইমরান খানের দল পিটিআই তার লাখ লাখ সমর্থককে একত্র করতে প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেই ব্যবহার করছে। 

এ ক্ষেত্রে পিটিআই-এর একটি কৌশল হলো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ভয়েস জেনারেশন। দলটি কারাগার থেকে আইনজীবীদের পাচার করা ইমরানের দিক-নির্দেশনা থেকে ভাষণ তৈরি করতে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। পরে এসব ভাষণ বিভিন্ন জনসভায় বড় পর্দায় সম্প্রচার করা হচ্ছে। অনলাইনেও এসব ভাষণ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। বলা যায়, জেলে থেকেও ইমরান খানের কাছ থেকে এখনো অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনা পাচ্ছে তাঁর সমর্থকেরা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেরও সদ্ব্যবহার করছে পিটিআই। জনপ্রিয় ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ টিকটকে ইমরান খানের এক কোটির বেশি ফলোয়ার আছে। সেই অ্যাকাউন্ট থেকে ছোট ছোট ভিডিও ও বক্তব্য প্রচার করে সমর্থকদের উজ্জীবিত রাখছে দলটি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাহায্যে তরুণ ও শহুরে ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। মূলত এই ভোটাররাই ইমরান খান তথা তাঁর দল পিটিআই-এর মূল ভিত্তি। 

রাওয়ালপিন্ডির গ্যারিসন শহরে নতুন ভোটার হয়েছেন ১৮ বছর বয়সী ইমরান আজিজ। সংবাদ সংস্থা এএফপিকে আজিজ বলেন, ‘তারা যা খুশি নিষিদ্ধ করতে পারে। নিষিদ্ধ করতে পারে ইউটিউব কিংবা টিকটককে। তবে আমাদের ভোট ইমরান খানের জন্য।’ 

উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য নতুন প্রার্থীদের ওপর নির্ভর করছে পিটিআই, যাদের অনেকে অনভিজ্ঞ বা অপরিচিত। দলটির প্রথম সারির নেতাদের বিরুদ্ধে সরকারের দমন-পীড়নের ফলে নিরাপদ প্রার্থী বাছাই করতে হয়েছে। আর পছন্দমতো ‘ব্যাট’ প্রতীক না পাওয়ায় বিভিন্ন প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র হয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে হচ্ছে দলটির প্রার্থীদের। উদাহরণস্বরূপ, পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে পিটিআইয়ের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন রেহেনা দার নামে ৭০ বছর বয়সী এক নারী। নির্বাচনে তাঁর প্রতীক হিসেবে রয়েছে একটি শিশুর খাট।

নির্বাচন সামনে রেখে ইমরান খানসহ শীর্ষ নেতাদের সাজাই শুধু নয়, নির্বাচনী প্রচারেও অনেক বাধা এবং চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে পিটিআই। এগুলোর মধ্যে রয়েছে পোস্টার ও ব্যানারের সেন্সরশিপ, ঠিকমতো মিডিয়া কভারেজ না পাওয়া, আর শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর প্রভাব তো রয়েছেই। মূলত সেনাবাহিনীই দেশটির গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই দলটিকে পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন), পাকিস্তান পিপলস পার্টিসহ (পিপিপি) আরও বেশ কয়েকটি ছোট দলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। 

একসময় পাকিস্তানে দায়িত্ব পালন করা ভারতীয় হাইকমিশনার টিসিএ রাঘবন পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক কলামে লিখেছেন, ইমরান খানের ক্যারিশমাটিক আবেদন এবং তিনি যে সুপ্ত সামরিক বিরোধী মনোভাবকে সংগঠিত করেছেন, তাকে খাটো করে দেখা উচিত নয়। নির্বাচন এখনো একটি আশ্চর্যজনক ফল দিতে পারে।

তবে ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টার থিঙ্কট্যাঙ্কের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, পাকিস্তানের মতো দেশে এআই ব্যবহার এবং ভার্চুয়াল প্রচারাভিযানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ, দেশটির জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়।

আবার বিশেষজ্ঞরা এটাও মনে করেন, পিটিআইয়ের সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হলে তাঁরা দলের সঙ্গে থাকতে বাধ্য নন এবং তাঁরা অন্য দলগুলোতে ভিড়ে যাওয়ার কথাও বিবেচনা করতে পারেন। বিশেষ করে, ইমরান খান যখন জেলে, তখন তাঁদের এ ধরনের সিদ্ধান্তগুলো তাঁদের প্রভাবিত করতে পারে। নির্বাচনের পর সরকার গঠনের জন্য কোনো দলকে প্রয়োজনীয় সংসদীয় আসনের জন্য পিটিআইয়ের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের আনুগত্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত