আব্দুর রহমান
মালদ্বীপের সবচেয়ে নিকট ও বড় প্রতিবেশী ভারত। কিন্তু দেশটির নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু ভারত সফরে না গিয়ে চীনকে বেছে নিয়েছেন তাঁর সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় সফরের গন্তব্য হিসেবে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি আর ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অন্যতম পরাশক্তি চীনের মধ্যকার দ্বন্দ্বে মালদ্বীপ দুই দেশের আধিপত্য বিস্তারের অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
অবস্থানগত কারণে মালদ্বীপ ভারত ও চীন উভয় দেশের কাছেই গুরুত্ব বহন করে। সম্প্রতি মালদ্বীপের মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘কটূক্তি’ করায় অভিযোগে। তার আগে, প্রেসিডেন্ট হয়েই ভারতকে মালদ্বীপ থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করেন মুইজ্জু, বাতিল করেন হাইড্রোগ্রাফিক সমীক্ষা চুক্তিও। এসবের ঠিক পরপরই তিনি পাঁচ দিনের সফরে যান বেইজিং। যেখানে চীনের প্রেসিডেন্ট তাঁকে ‘পুরোনো বন্ধু’ বলে আখ্যা দেন।
নিকট অতীতে মালদ্বীপের প্রায় কোনো প্রেসিডেন্টই ভারত ডিঙিয়ে চীন সফরে যাননি। ২০০৮ সালে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মোহাম্মদ নাশিদ প্রথম সফরের গন্তব্য হিসেবে ভারতকেই বেছে নিয়েছিলেন। এরপর ২০১২ সালে মোহাম্মদ ওয়াহিদ ও ২০১৪ সালে আবদুল্লাহ ইয়ামিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম বিদেশ সফরের গন্তব্য হিসেবে ভারতকেই বেছে নিয়েছিলেন। পরের দুজন ভারতের প্রতি তুলনামূলক কম সহানুভূতিশীল হওয়ার পরও ভারতকেই তাদের প্রথম বিদেশ সফরের গন্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু মুইজ্জুর বেইজিং সফর এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর কর্মকাণ্ড বলে দিচ্ছে, মালদ্বীপের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের প্যারাডাইম শিফট হয়েছে।
বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়, সি চিনপিংয়ের সঙ্গে মুইজ্জুর স্বাক্ষরিত ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা চুক্তি সাক্ষরের বিষয়টি থেকে। বেইজিংয়ে দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকের পর চীন-মালদ্বীপ ব্যাপক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য একটি কর্মপরিকল্পনায় স্বাক্ষর করে। পাশাপাশি বেল্ট অ্যান্ড রোড, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অর্থনীতি ও প্রযুক্তি, অবকাঠামো নির্মাণ এবং জনগণের জীবিকা, সবুজ উন্নয়ন এবং ব্লু ও ডিজিটাল অর্থনীতি বিষয়ে সহযোগিতার নথিপত্রে স্বাক্ষর করে দেশ দুটি।
বৈঠকে চীনের প্রেসিডেন্ট মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টকে বলেছেন—চীন মালদ্বীপের সঙ্গে সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে, উন্নয়ন কৌশলের সমন্বয় শক্তিশালী করতে, উচ্চমানের বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতার এগিয়ে নিতে এবং চীন-মালদ্বীপের বন্ধুত্বের এক নতুন মানদণ্ড স্থাপন করতে প্রস্তুত। বিপরীতে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট চীন তাঁর দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মূল্যবান সহায়তা প্রদান করেছে। তিনি বলেন, মালদ্বীপের জনগণ বিআরআই থেকে অনেক উপকৃত হয়েছে, মালদ্বীপ-চীন মৈত্রী সেতুকে দুই দেশের মধ্যে বন্ধনের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করে।
এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, মালদ্বীপ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের বিষয়টিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে এবং চীনের সঙ্গে দেশটি এই বিষয়ক সহায়তা এগিয়ে নিয়ে যেতে আগ্রহী। এই অবস্থায় ঠিক নাকের ডগায় চীনের সরব উপস্থিতি ভারতের জন্য যে স্বস্তিদায়ক হবে না তা সাধারণ দৃষ্টিতেই বোঝা সম্ভব। সব মিলিয়ে ভারত ও চীনের কাছে মালদ্বীপের গুরুত্ব মূলত কৌশলগত কারণে।
সাংহাই ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের গবেষণা ফেলো জাও গ্যানচং বলেছেন, যদিও জনসংখ্যা, আকার-আয়তনের দিক থেকে মালদ্বীপ অনেক ছোট কিন্তু ভূরাজনীতির বিবেচনায় দেশটির উচ্চ কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। তিনি বলেন, ‘ভারত মহাসাগর আমাদের থেকে অনেক দূরে। কিন্তু আমাদের দেশের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার জন্য তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই চীনের উচিত এই অঞ্চলে বন্ধু তৈরির সর্বোত্তম প্রচেষ্টা চালানো।’
গ্যানচংয়ের কথাই যেন প্রতিফলিত হয়েছে চীনা প্রেসিডেন্টের মুখ থেকে। মুইজ্জুর সঙ্গে বৈঠকের সময় তিনি বলেছেন, চীন মালদ্বীপকে দেশটির জন্য উপযোগী উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে সম্মান করে ও সমর্থন করে। মালদ্বীপের জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও জাতীয় মর্যাদা রক্ষার লড়াইকেও দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে চীন। বিপরীতে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুও ‘এক চীন’ নীতির প্রতি মালের দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।
বৈঠকে মুইজ্জু আরও বলেছেন, মালদ্বীপ চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং প্রবর্তিত বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ, বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগ এবং বৈশ্বিক সভ্যতা উদ্যোগকে সমর্থন করে এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ইস্যুতে মালদ্বীপ চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রেখে কাজ করতে চায় মালে।
সাংহাই একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসের গবেষণা ফেলো হু ঝিয়াং বলেছেন, মুইজ্জুর চীন সফর দেখায় যে, মালদ্বীপ আন্তরিকভাবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে ও বিদ্যমান সহযোগিতা জোরদার করতে চায়। তিনি বলেছেন, মালদ্বীপের জনগণের কাছে মুইজ্জুর যে অঙ্গীকার—মালদ্বীপে কোনো বিদেশি সামরিক উপস্থিতি থাকবে না—তা ভারতকে ক্ষুব্ধ করেছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট অবশ্যই আশা করবেন যে, চীন তাঁর দেশকে নয়াদিল্লির চাপ মোকাবিলায় সহায়তা করতে পারে।
চীনা বিশ্লেষকদের দাবি, চীন-মালদ্বীপ সম্পর্ক তৃতীয় কোনো দেশকে লক্ষ্যবস্তু করে না। কিন্তু প্রতিবেশীদের প্রতি ভারতের আগ্রাসী মনোভাবের কারণে সেই চাপ কাটাতে স্বাভাবিকভাবে এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলো তাদের জাতীয় সার্বভৌমত্ব, মর্যাদা ও স্বার্থ রক্ষায় চীনের মতো বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইবে।
এর ক্ষেত্র অবশ্য অনেক আগেই তৈরি হয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে ভারত-চীন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চাইলেও তা বাস্তবে সম্ভব হয়নি। ভারতের সঙ্গে চীন সীমান্তে দফায় দফায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক নীতির কারণে দেশটির সঙ্গে ভারতের অতিরিক্ত সখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আঞ্চলিক জোট কোয়াডে ভারতে যোগদান—যা মূলত চীনকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলতে গঠন করা হয় বলেই দাবি করেন চীনা বিশ্লেষকেরা—চীনকে ক্ষুব্ধ করে।
তারও আগে, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের ‘পার্ল অব স্ট্রিং’ বা ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন বিন্দুতে চীনা অবস্থান নিশ্চিত করে ভারতকে সেই অঞ্চলে আটকে ফেলার মতো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে চীনের তরফ থেকে। এই বিষয়গুলো উভয় দেশকেই পরস্পরের বিরুদ্ধে অবিশ্বাসী করে তুলেছে।
তবে চীন ভারতের মধ্যে সম্প্রতি সম্পর্ক বেশি খারাপ হয়েছে ২০২০ সালের জুন থেকে। পশ্চিম হিমালয় রেঞ্জে চীন ও ভারতের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। সে সময় ভারতের ২০ সেনা ও চীনের ৪ সেনা নিহত হয়। এর পর দেশটির শীর্ষ পর্যায়ে আর কোনো আলোচনা বা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। যাই হোক, বিষয়টি চীন-ভারত সম্পর্কের তিক্ততা আরও বাড়িয়েছে। এই অবস্থায় ভারতীয় বিশ্লেষকেরা বলছেন, মালদ্বীপের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে চীন মূলত এই অঞ্চলে বিনিয়োগ আরও বাড়ানোর পথ সুগম করছে। এরই মধ্যে ভারতের আরেক নিকট প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কায় এই বিষয়টি ঘটেছে।
তবে চীনের সঙ্গে মালদ্বীপের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার বিষয়টি নয়া দিল্লির নীতি নির্ধারকদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বিষয়টি কেবল নীতি নির্ধারণী পর্যায়েই নেই, উদ্বেগ আর প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যেও। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, এরই মধ্যে ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্কের উত্তেজনার মধ্যেই ভারতের তরফ থেকে ‘মালদ্বীপ বয়কট’ প্রচারণা শুরু হয়েছে। বিপরীতে মুইজ্জুও চীনের প্রতি মালদ্বীপে আরও বেশি বেশি পর্যটক পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
চীনা বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারতীয়দের বয়কট আন্দোলনের মুখে মালদ্বীপের পর্যটন খাত খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এ বিষয়ে চীনের সিংহুয়া ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ইনস্টিটিউটের পরিচালক চিয়ান ফং বলেন, চীনা পর্যটকেরা মহামারি পরবর্তী যুগে ধাপে ধাপে মালদ্বীপে যাওয়া বাড়াচ্ছেন। কারণ এটি চীনা জনসাধারণের কাছে পর্যটনের সুপরিচিত স্বর্গ। তথাকথিত কোনো রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক কার্যকলাপ বিষয়টিকে প্রভাবিত করবে না।
তবে চীন-মালদ্বীপের সম্পর্ককে কেবল পর্যটক দিয়ে বিবেচনা করাটা হবে অদূরদৃষ্টি ও সংকীর্ণ চিন্তা। এর বাইরেও, জলবায়ু সংকট ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের বাড়বাড়ন্ত সময়ে দুই দেশ মালদ্বীপের উপকূলীয় সুরক্ষা ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা বাড়াতে পারে। একই সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে সামুদ্রিক অর্থনীতির বিকাশও ঘটতে পারে। এর বাইরে মালদ্বীপের জনস্বাস্থ্য খাতে চীনের অংশগ্রহণ ও বিনিয়োগ আরও বাড়তে পারে।
তথ্যসূত্র: গ্লোবাল টাইমস, এনডিটিভি, দ্য হিন্দু ও সিনহুয়া
মালদ্বীপের সবচেয়ে নিকট ও বড় প্রতিবেশী ভারত। কিন্তু দেশটির নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু ভারত সফরে না গিয়ে চীনকে বেছে নিয়েছেন তাঁর সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় সফরের গন্তব্য হিসেবে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি আর ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অন্যতম পরাশক্তি চীনের মধ্যকার দ্বন্দ্বে মালদ্বীপ দুই দেশের আধিপত্য বিস্তারের অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
অবস্থানগত কারণে মালদ্বীপ ভারত ও চীন উভয় দেশের কাছেই গুরুত্ব বহন করে। সম্প্রতি মালদ্বীপের মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘কটূক্তি’ করায় অভিযোগে। তার আগে, প্রেসিডেন্ট হয়েই ভারতকে মালদ্বীপ থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করেন মুইজ্জু, বাতিল করেন হাইড্রোগ্রাফিক সমীক্ষা চুক্তিও। এসবের ঠিক পরপরই তিনি পাঁচ দিনের সফরে যান বেইজিং। যেখানে চীনের প্রেসিডেন্ট তাঁকে ‘পুরোনো বন্ধু’ বলে আখ্যা দেন।
নিকট অতীতে মালদ্বীপের প্রায় কোনো প্রেসিডেন্টই ভারত ডিঙিয়ে চীন সফরে যাননি। ২০০৮ সালে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মোহাম্মদ নাশিদ প্রথম সফরের গন্তব্য হিসেবে ভারতকেই বেছে নিয়েছিলেন। এরপর ২০১২ সালে মোহাম্মদ ওয়াহিদ ও ২০১৪ সালে আবদুল্লাহ ইয়ামিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম বিদেশ সফরের গন্তব্য হিসেবে ভারতকেই বেছে নিয়েছিলেন। পরের দুজন ভারতের প্রতি তুলনামূলক কম সহানুভূতিশীল হওয়ার পরও ভারতকেই তাদের প্রথম বিদেশ সফরের গন্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু মুইজ্জুর বেইজিং সফর এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর কর্মকাণ্ড বলে দিচ্ছে, মালদ্বীপের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের প্যারাডাইম শিফট হয়েছে।
বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়, সি চিনপিংয়ের সঙ্গে মুইজ্জুর স্বাক্ষরিত ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা চুক্তি সাক্ষরের বিষয়টি থেকে। বেইজিংয়ে দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকের পর চীন-মালদ্বীপ ব্যাপক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য একটি কর্মপরিকল্পনায় স্বাক্ষর করে। পাশাপাশি বেল্ট অ্যান্ড রোড, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অর্থনীতি ও প্রযুক্তি, অবকাঠামো নির্মাণ এবং জনগণের জীবিকা, সবুজ উন্নয়ন এবং ব্লু ও ডিজিটাল অর্থনীতি বিষয়ে সহযোগিতার নথিপত্রে স্বাক্ষর করে দেশ দুটি।
বৈঠকে চীনের প্রেসিডেন্ট মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টকে বলেছেন—চীন মালদ্বীপের সঙ্গে সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে, উন্নয়ন কৌশলের সমন্বয় শক্তিশালী করতে, উচ্চমানের বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতার এগিয়ে নিতে এবং চীন-মালদ্বীপের বন্ধুত্বের এক নতুন মানদণ্ড স্থাপন করতে প্রস্তুত। বিপরীতে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট চীন তাঁর দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মূল্যবান সহায়তা প্রদান করেছে। তিনি বলেন, মালদ্বীপের জনগণ বিআরআই থেকে অনেক উপকৃত হয়েছে, মালদ্বীপ-চীন মৈত্রী সেতুকে দুই দেশের মধ্যে বন্ধনের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করে।
এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, মালদ্বীপ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের বিষয়টিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে এবং চীনের সঙ্গে দেশটি এই বিষয়ক সহায়তা এগিয়ে নিয়ে যেতে আগ্রহী। এই অবস্থায় ঠিক নাকের ডগায় চীনের সরব উপস্থিতি ভারতের জন্য যে স্বস্তিদায়ক হবে না তা সাধারণ দৃষ্টিতেই বোঝা সম্ভব। সব মিলিয়ে ভারত ও চীনের কাছে মালদ্বীপের গুরুত্ব মূলত কৌশলগত কারণে।
সাংহাই ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের গবেষণা ফেলো জাও গ্যানচং বলেছেন, যদিও জনসংখ্যা, আকার-আয়তনের দিক থেকে মালদ্বীপ অনেক ছোট কিন্তু ভূরাজনীতির বিবেচনায় দেশটির উচ্চ কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। তিনি বলেন, ‘ভারত মহাসাগর আমাদের থেকে অনেক দূরে। কিন্তু আমাদের দেশের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার জন্য তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই চীনের উচিত এই অঞ্চলে বন্ধু তৈরির সর্বোত্তম প্রচেষ্টা চালানো।’
গ্যানচংয়ের কথাই যেন প্রতিফলিত হয়েছে চীনা প্রেসিডেন্টের মুখ থেকে। মুইজ্জুর সঙ্গে বৈঠকের সময় তিনি বলেছেন, চীন মালদ্বীপকে দেশটির জন্য উপযোগী উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে সম্মান করে ও সমর্থন করে। মালদ্বীপের জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও জাতীয় মর্যাদা রক্ষার লড়াইকেও দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে চীন। বিপরীতে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুও ‘এক চীন’ নীতির প্রতি মালের দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।
বৈঠকে মুইজ্জু আরও বলেছেন, মালদ্বীপ চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং প্রবর্তিত বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ, বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগ এবং বৈশ্বিক সভ্যতা উদ্যোগকে সমর্থন করে এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ইস্যুতে মালদ্বীপ চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রেখে কাজ করতে চায় মালে।
সাংহাই একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসের গবেষণা ফেলো হু ঝিয়াং বলেছেন, মুইজ্জুর চীন সফর দেখায় যে, মালদ্বীপ আন্তরিকভাবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে ও বিদ্যমান সহযোগিতা জোরদার করতে চায়। তিনি বলেছেন, মালদ্বীপের জনগণের কাছে মুইজ্জুর যে অঙ্গীকার—মালদ্বীপে কোনো বিদেশি সামরিক উপস্থিতি থাকবে না—তা ভারতকে ক্ষুব্ধ করেছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট অবশ্যই আশা করবেন যে, চীন তাঁর দেশকে নয়াদিল্লির চাপ মোকাবিলায় সহায়তা করতে পারে।
চীনা বিশ্লেষকদের দাবি, চীন-মালদ্বীপ সম্পর্ক তৃতীয় কোনো দেশকে লক্ষ্যবস্তু করে না। কিন্তু প্রতিবেশীদের প্রতি ভারতের আগ্রাসী মনোভাবের কারণে সেই চাপ কাটাতে স্বাভাবিকভাবে এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলো তাদের জাতীয় সার্বভৌমত্ব, মর্যাদা ও স্বার্থ রক্ষায় চীনের মতো বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইবে।
এর ক্ষেত্র অবশ্য অনেক আগেই তৈরি হয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে ভারত-চীন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চাইলেও তা বাস্তবে সম্ভব হয়নি। ভারতের সঙ্গে চীন সীমান্তে দফায় দফায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক নীতির কারণে দেশটির সঙ্গে ভারতের অতিরিক্ত সখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আঞ্চলিক জোট কোয়াডে ভারতে যোগদান—যা মূলত চীনকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলতে গঠন করা হয় বলেই দাবি করেন চীনা বিশ্লেষকেরা—চীনকে ক্ষুব্ধ করে।
তারও আগে, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের ‘পার্ল অব স্ট্রিং’ বা ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন বিন্দুতে চীনা অবস্থান নিশ্চিত করে ভারতকে সেই অঞ্চলে আটকে ফেলার মতো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে চীনের তরফ থেকে। এই বিষয়গুলো উভয় দেশকেই পরস্পরের বিরুদ্ধে অবিশ্বাসী করে তুলেছে।
তবে চীন ভারতের মধ্যে সম্প্রতি সম্পর্ক বেশি খারাপ হয়েছে ২০২০ সালের জুন থেকে। পশ্চিম হিমালয় রেঞ্জে চীন ও ভারতের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। সে সময় ভারতের ২০ সেনা ও চীনের ৪ সেনা নিহত হয়। এর পর দেশটির শীর্ষ পর্যায়ে আর কোনো আলোচনা বা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। যাই হোক, বিষয়টি চীন-ভারত সম্পর্কের তিক্ততা আরও বাড়িয়েছে। এই অবস্থায় ভারতীয় বিশ্লেষকেরা বলছেন, মালদ্বীপের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে চীন মূলত এই অঞ্চলে বিনিয়োগ আরও বাড়ানোর পথ সুগম করছে। এরই মধ্যে ভারতের আরেক নিকট প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কায় এই বিষয়টি ঘটেছে।
তবে চীনের সঙ্গে মালদ্বীপের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার বিষয়টি নয়া দিল্লির নীতি নির্ধারকদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বিষয়টি কেবল নীতি নির্ধারণী পর্যায়েই নেই, উদ্বেগ আর প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যেও। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, এরই মধ্যে ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্কের উত্তেজনার মধ্যেই ভারতের তরফ থেকে ‘মালদ্বীপ বয়কট’ প্রচারণা শুরু হয়েছে। বিপরীতে মুইজ্জুও চীনের প্রতি মালদ্বীপে আরও বেশি বেশি পর্যটক পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
চীনা বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারতীয়দের বয়কট আন্দোলনের মুখে মালদ্বীপের পর্যটন খাত খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এ বিষয়ে চীনের সিংহুয়া ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ইনস্টিটিউটের পরিচালক চিয়ান ফং বলেন, চীনা পর্যটকেরা মহামারি পরবর্তী যুগে ধাপে ধাপে মালদ্বীপে যাওয়া বাড়াচ্ছেন। কারণ এটি চীনা জনসাধারণের কাছে পর্যটনের সুপরিচিত স্বর্গ। তথাকথিত কোনো রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক কার্যকলাপ বিষয়টিকে প্রভাবিত করবে না।
তবে চীন-মালদ্বীপের সম্পর্ককে কেবল পর্যটক দিয়ে বিবেচনা করাটা হবে অদূরদৃষ্টি ও সংকীর্ণ চিন্তা। এর বাইরেও, জলবায়ু সংকট ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের বাড়বাড়ন্ত সময়ে দুই দেশ মালদ্বীপের উপকূলীয় সুরক্ষা ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা বাড়াতে পারে। একই সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে সামুদ্রিক অর্থনীতির বিকাশও ঘটতে পারে। এর বাইরে মালদ্বীপের জনস্বাস্থ্য খাতে চীনের অংশগ্রহণ ও বিনিয়োগ আরও বাড়তে পারে।
তথ্যসূত্র: গ্লোবাল টাইমস, এনডিটিভি, দ্য হিন্দু ও সিনহুয়া
ইউক্রেনের ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র সারা বিশ্বে আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও, রাশিয়ার এ ধরনের আক্রমণকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে—যেমনটি ইসরায়েল উত্তর গাজাকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে হয়েছে।
১১ ঘণ্টা আগেট্রাম্প ফিরে আসায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের ধারাবাহিকতাই বজায় থাকতে পারে, সামান্য কিছু পরিবর্তন নিয়ে। ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান পেছনের সারিতে থাকলেও বাংলাদেশ,
১৭ ঘণ্টা আগেড. ইউনূস যখন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন পুরো জাতি তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল। তবে তাঁকে পরিষ্কারভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে যে, তিনি কীভাবে দেশ শাসন করবেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
২ দিন আগেসম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
২ দিন আগে