মিয়ানমারের নৃশংস জান্তাকে থামাবে কে

মারুফ ইসলাম
প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৩, ১৪: ৩০
আপডেট : ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০০: ০১

গত দুই বছরে এই পৃথিবীর একটি দেশে ২ হাজার ৬০০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এবং আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৭ হাজার। ভাবছেন, দেশটির নাম ইউক্রেন? না, মিয়ানমার। 

শুধু অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবেই মিয়ানমার বিশ্বজুড়ে আলোচিত-সমালোচিত, তা নয়; বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি মাদক, অস্ত্র, জাতিগত নিধন, শিশু নির্যাতন, যৌন হয়রানিসহ নানা কারণে সব সময় আলোচনার তুঙ্গে থাকে। 

মিয়ানমারে বছর দুয়েক আগে ঘটে যাওয়া অভ্যুত্থান জান্তাবিরোধী যে বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল, তা দমাতে এরই মধ্যে শত শত মানুষকে মেরে ফেলেছে সেনাবাহিনী। গণমানুষের অশ্রু আর রক্তে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার দেশটির প্রকৃতি ভারী হয়ে উঠলেও জান্তাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের অবশ্য কিছুই এসে যায়নি। 

তিনি দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ইউনিফর্ম পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মিয়ানমারে লোকমুখে একটি কথা প্রচলিত—যে স্বৈরশাসকের শরীরে যত বেশি পদক, তিনি তত বেশি ভণ্ড ও বিপজ্জনক। জেনারেল মিন অং হ্লাইং ইতিমধ্যে বিক্ষোভ দমনের নামে গ্রামে গ্রামে, স্কুল-কলেজ-হাসপাতালে বোমা ফেলে এবং লাখ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে ইতিহাসে ‘ঘাতক’ হিসেবে নিজের নাম স্থায়ী করেছেন। 

মিয়ানমারে অভ্যুত্থান জান্তাবিরোধী যে বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল, তা দমাতে এরই মধ্যে শত শত মানুষকে মেরে ফেলেছে সেনাবাহিনীজেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের দুর্নামের অন্ত নেই। দিন কয়েক আগে তিনি গণতন্ত্রপন্থী নেতা অং সাং সু চিকে কারাগারে থাপ্পড় মেরেছেন। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত এই নেতাকেই তিনি দুই বছর আগে ক্ষমতাচ্যুত করে সরকারে বসেছেন। এখন পাঁয়তারা করছেন এ বছর একটি জাল নির্বাচন করার। 

পাঁয়তারা না করে উপায় নেই। কারণ, সিংহভাগ সাধারণ মানুষ তাঁকে পছন্দ করে না। গত সপ্তাহেই মিয়ানমারের ৭৫তম স্বাধীনতাবার্ষিকী উপলক্ষে বিশাল কুচকাওয়াজের আয়োজন করেছিলেন জান্তাপ্রধান। কিন্তু সেই আয়োজন নীরবে বর্জন করেছে সাধারণ বার্মিজরা। এ থেকেই প্রমাণিত হয়, তিনি কতটা অজনপ্রিয়।

অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের অনেক দেশ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মিয়ানমারের ওপর। আবার অনেক দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করছে। সেই প্রসঙ্গ টেনে স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায় মিন অং বলেছেন, ‘আমরা চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, লাওস ও বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি...সীমান্ত স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ এ সময় তিনি তাঁর প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ রাশিয়ার কথাও উল্লেখ করেছেন। 

তবে যে সত্যটি স্বীকার করেননি মিন, তা হচ্ছে তাঁর মাথার ওপর ছাতা হয়ে থাকা পিপলস ডিফেন্স ফোর্স ও এথনিক আর্মড অর্গানাইজেশন (ইএও) ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। এর বিপরীতে জনগণ কি খুব শক্তিশালী হয়ে উঠেছে? তা-ও নয়। 

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত স্কট মার্সিয়েল বলেছেন, ‘জান্তা সরকারের প্রবল নৃশংসতার কারণে মিয়ানমারের বেশির ভাগ অংশ বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বিদ্রোহীরা ঐক্যবদ্ধ নয়। তারা যদি জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে সফল হতে চায়, তবে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা ছাড়া উপায় নেই।’ 

মিয়ানমারের জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইংতবে আশার কথাও শুনিয়েছেন স্কট মার্সিয়েল। তিনি বলেন, ‘জান্তা সরকার হয়তো বর্বরতা চালিয়ে আরও কিছুদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে। তবে তারা দেশকে স্থিতিশীল করতে পারবে কিংবা জনসমর্থন আদায় করে কার্যকরভাবে দেশ শাসন করতে পারবে এমন নিশ্চয়তা নেই।’ 

মিন অং হ্লাইংকে ক্ষমতায় থাকতে হলে অবশ্যই জনগণের সাহায্যের দরকার হবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তাহলে করণীয় কী? 

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলতে বিশ্ববাসী আসলে যুক্তরাষ্ট্রকেই বোঝে। অনেকের আশা, যুক্তরাষ্ট্রই শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করবে। এ বছর বাইডেন প্রশাসন মিয়ানমারের রাজনৈতিক বন্দী ও নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা গোষ্ঠীগুলোকে অপ্রাণঘাতী অস্ত্র ও অর্থসহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত হোয়াইট হাউস কী করবে, তা স্পষ্ট নয়। 

যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো যদি সত্যিই মিয়ানমারের দুর্ভোগের অবসান চায় এবং মিন অং হ্লাইংকে বাগে আনতে চায়, তবে চীনকে সঙ্গে নিয়েই তা করতে হবে। কারণ, মিয়ানমারে চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের বাইরে মিয়ানমারের গণতন্ত্র নিয়ে চীনের খুব একটা মাথাব্যথা নেই।

তাহলে মিয়ানমারে স্থিতিশীলতা আসবে কী করে? বিশ্লেষকেরা মনে করেন, মিয়ানমারের স্থিতিশীলতার প্রশ্নে জাতিসংঘেও ঐক্যবদ্ধ জোটগত অবস্থান দরকার। দ্য গার্ডিয়ানের সিমন টিসডাল মনে করেন, এই জোটে ভারত, বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডকে রাখতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশকে তো রাখতেই হবে। কারণ, দেশটি ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। থাইল্যান্ড আসিয়ানের সদস্য; সংগত কারণে তাকেও রাখতে হবে।

গত দুই বছরে ২ হাজার ৬০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে মিয়ানমারে

কিন্তু আসিয়ান (অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান ন্যাশনস) নানাভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। নিজেদের মধ্যেই ঐক্য নেই। সংগঠনটির ‘পাঁচ দফা ঐকমত্য’ পরিকল্পনা স্থবির হয়ে পড়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, আসিয়ানভুক্ত কয়েকটি দেশ হয়তো জান্তা সরকারের জাল নির্বাচনকে বৈধতা দেবে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা বার্মা ক্যাম্পেইন ইউকের পরিচালক মার্ক ফারম্যানার বলেছেন, ‘জাতিসংঘের প্রস্তাবের কোনো কার্যকারিতা নেই। এসব শুধু লোকদেখানো। সেই প্রস্তাবে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার কোনো উল্লেখ নেই। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদেশ রাশিয়া, চীন ও ভারত দিব্যি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে অস্ত্র ব্যবসা করে যাচ্ছে।’

এই যখন পরিস্থিতি, তখন জান্তাকে আটকাবে কে? এখন একমাত্র আশার আলো দেখাতে পারেন ধর্মীয় নেতারা, অর্থাৎ বুড্ডিস্টরা। কিন্তু তাঁরাও তো জান্তার উর্দির নিচেই আছেন। জান্তা সরকার বৌদ্ধদের ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা করছে। তার একটি ছোট্ট উদাহরণ দেখা গেল গত সপ্তাহে। একজন কুখ্যাত বৌদ্ধনেতা উইরাথুকে সম্মানিত করেছে জান্তা সরকার। অথচ এই নেতার বিরুদ্ধে মুসলিমবিদ্বেষের অভিযোগ আছে। তাঁকে বলা হয় ‘বৌদ্ধ সন্ত্রাসের মুখপাত্র’।

সবচেয়ে হতাশাজনক ব্যাপার হচ্ছে, ক্যাথলিক নেতারা ইয়াঙ্গুনের হলি ট্রিনিটি ক্যাথেড্রালে ক্রিসমাসের সময় মিন অং হ্লাইংকে সংবর্ধনা দিয়েছেন।

অর্থাৎ, কোথাও আশার আলো নেই। বিশ্বের বড় বড় ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলো মিয়ানমারের সঙ্গে আঁতাত করে অস্ত্রের ব্যবসা করে যাচ্ছে। ১৬ জানুয়ারি জাতিসংঘ এক প্রতিবেদনে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ভারত, জাপানসহ বিশ্বের অন্তত ১৩টি দেশের কোম্পানি অস্ত্র তৈরিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে সহায়তা করছে। অন্যদিকে আসিয়ান বহুধাবিভক্ত। ধর্মীয় নেতারা মুখ লুকিয়েছে জান্তার উর্দির নিচে। তাহলে জান্তাকে ঠেকাবে কে? 

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, আল জাজিরা, বিবিসি ও রয়টার্স

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত