অনলাইন ডেস্ক
নয়াদিল্লির প্রধান রাস্তাগুলো জি২০ সম্মেলনের বিশাল বিশাল পোস্টার ব্যানারে ছেয়ে গেছে। প্রতিটি ট্রাফিক পয়েন্টে শুভ্র চুল দাঁড়ি বিশিষ্ট একজন ব্যক্তির সৌম্য হাসি শোভা পাচ্ছে, যাকে সবার থেকে সহজেই আলাদা করা যায়, তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
এত গেল রাস্তার ব্যানার পোস্টারে বিজ্ঞাপন; ভারতের প্রধান প্রধান সংবাদপত্রের প্রথম পাতায়ও মোদি থাকছেন নিয়মিত, ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো তাঁকে ‘বিশ্ব গুরু’ বা বিশ্ব নেতা অভিহিত করে বাকি বিশ্বের নেতাদের সঙ্গে ছবি ও ফুটেজ প্রকাশ করছে। জনসাধারণের সামনে বক্তৃতায়, টকশোতে, গণমাধ্যমের সামনে মন্ত্রীরা সমানে নরেন্দ্র মোদিকে উদীয়মান ভারতের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে উপস্থাপন করছেন।
জনতুষ্টির রাজনীতি, এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক অতিপ্রচারমূলক সরকার এবং কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী একটি রাজনৈতিক দলের জন্য আগামী জি২০ সম্মেলন একটি পাশার দানই হতে যাচ্ছে। এত বড় আয়োজনের স্বাগতিক দেশ হতে পারা ভারতের জন্য কতটা সম্মানের ও মর্যাদার তার ব্যাপক প্রচার চালিয়ে সব কৃতিত্ব গুঁজে দেওয়া হচ্ছে মোদির পকেটে।
এই ঘটনা বিজেপি সমর্থকদের মধ্যে নরেন্দ্র মোদির প্রতি অপ্রতিরোধ্য শ্রদ্ধা এবং ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে অকুণ্ঠ সমর্থনের ক্ষেত্র তৈরির করছে। উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে ভারতকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন এবং ভারতকে একটি উজ্জ্বল নতুন ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন মোদি—এমন ভাবমূর্তিই তৈরির চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি বার্তা সংস্থা এএনআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই কথাগুলোই নরেন্দ্র মোদি গুছিয়ে বলেছেন। তিনি বৈশ্বিক দক্ষিণ অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্বের প্রতিনিধি হিসেবেই ভারতকে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু এই বিজ্ঞাপনের ঝলক মোদির ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষারও প্রদর্শন। নয়াদিল্লির ক্রমবর্ধমান ভূ–রাজনৈতিক প্রভাব এবং পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য নিজের ক্ষমতাকে সুসংহত করার কাজে ব্যবহার করতেই বেশি আগ্রহী নরেন্দ্র মোদি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের সভাপতিত্ব ভারতের জন্য একটি গর্বের মুহূর্ত, কিন্তু মোদির সরকার এটিকে নেতার ভাবমূর্তির বিপণন এবং আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে ভোটব্যাংক সংহত করার কাজে ব্যবহার করছে।
ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাগরিকা ঘোষ বলেন, ‘মোদি নিজেকে একজন বৈশ্বিক রাষ্ট্রনায়ক, একজন বিশ্ব চিন্তার নেতা?85এবং একটি উদীয়মান ভারতের কণ্ঠস্বর হিসেবে তুলে ধরছেন। আমি মনে করি, এসব কিছু মোদি কেন্দ্রিক যে কাল্ট তৈরি হয়েছে সেটিতে হাওয়া দিতেই ডিজাইন করা হয়েছে। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই ডিজাইন করা, খুব ভালোভাবে বিপণন চলছে। এটি এমন একটি জনগোষ্ঠীর কাছে আবেদন তৈরি করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে যারা উদীয়মান ভারতের প্রতিশ্রুতিগুলোর দ্বারা বেশ প্রভাবিত হবে।’
৯–১০ সেপ্টেম্বরের জি২০ শীর্ষ সম্মেলন। এখানে বিশ্বের ১৯টি ধনী দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা থাকবেন। ২০২৪ সালে ভারতে জাতীয় নির্বাচন। ফলে এই সম্মেলন আয়োজন মোদির জন্য বিশেষভাবে গুরুত্ব বহন করে। এই আয়োজনের মাধ্যমে সরকারের সক্ষমতা প্রদর্শন ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলকে অভ্যন্তরীণভাবে চাঙা করতে ব্যবহার করছেন নরেন্দ্র মোদি।
শীর্ষ সম্মেলনের আগে ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ, বিমানবন্দর এবং প্রধান ল্যান্ডমার্কগুলোতে এবারের জি২০ লোগো প্রদর্শন করা হচ্ছে। লোগোটিও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ডিজাইন করা হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। এতে ব্যবহার করা হয়েছে ভারতের জাতীয় পতাকার রং, একটি পদ্মের মাঝখানে ভূগোলকের ছবি। বিরোধীরা বলছেন, এটা কোনো কাকতালীয় নয় যে পদ্ম মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রতীক।
মোদি সরকারের কর্মকর্তারাও যোগব্যায়াম এবং সরকারের একটি অত্যন্ত সফল প্রকল্প ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থাসহ বিশ্বে ভারতের অবদানগুলো প্রদর্শন করতে নানা ইভেন্ট আয়োজন করছেন। স্কুলগুলোকে জি ২০ নিয়ে কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে বলা হয়েছে। মোদি নিজেই, তাঁর ধারাবাহিক রেডিও টক শো ‘মান কি বাত’–এ বলে আসছেন, ‘সেপ্টেম্বর মাস ভারতের সম্ভাবনার সাক্ষী হতে চলেছে।’
এদিকে, মন্ত্রীরা গলা ফাটাচ্ছেন, জি২০ শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের সব কৃতিত্ব একা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির।
বিজেপির অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গত ফেব্রুয়ারিতে একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘যদি জি২০ সম্মেলন তাঁর (মোদির) সময়েই দেশে অনুষ্ঠিত হয় এবং সাফল ভাবে সম্মেলন সম্পন্ন হয়, তাহলে তার পুরো কৃতিত্বই হবে তাঁর।’
বাস্তবতা হলো, জি২০ সম্মেলনের সভাপতিত্ব পর্যায়ক্রমে সদস্য দেশগুলো পায়, ফলে এই মর্যাদাটি মূলত প্রতীকী। শীর্ষ সম্মেলনের সাফল্য প্রায়শই চূড়ান্ত যোগাযোগের ওপর নির্ভর করে। তবে এবারের ভারতে অনুষ্ঠিত অন্য বৈঠকগুলোর একটিও সে অর্থে সফল হয়নি। ঘুরেফিরে সব বৈঠকই আটকে গেছে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান নিয়ে পাল্টাপাল্টি শব্দের খেলা এবং তা থেকে সৃষ্ট অচলাবস্থা।
জি২০ সম্মেলনের সফলতা নিয়েও এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ এ সম্মেলনে থাকছেন না গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতা—রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। ওদিকে বিশ্ব নেতাদের অনুপস্থিতির কারণে জৌলুস হারিয়েছে জাকার্তায় চলমান আসিয়ান সম্মেলন।
তা সত্ত্বেও মোদি সরকার জোরেসোরেই প্রচার করছে যে, ভারত এখন উন্নয়নশীল বিশ্বের পক্ষে সেতু হিসেবে কাজ করছে। কর্মকর্তারা যুক্তি দিচ্ছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ এবং ঋণ সংকটের সমস্যাগুলো মোকাবিলার জন্য ভারতই এখন উপযুক্ত অবস্থানে রয়েছে। মোদির প্রশাসন প্রধান পশ্চিমা দেশগুলোর সমান্তরালে ক্রমবর্ধমান শক্তি হিসেবে ভারতের অবস্থানকেও তুলে ধরছেন। বিশেষ করে গত জুনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভারত সফরের পর থেকে এই ধরনের প্রচার–প্রচারণা বেড়েছে।
এই ধারাবাহিকতায় বিজেপি সরকার নরেন্দ্র মোদিকে ভারতের অর্থনৈতিক সাফল্যের কারিগর হিসেবে উপস্থাপন করছে। এসব সাফল্যের মধ্যে রয়েছে— সৌরবিদ্যুতে অগ্রগতি, ডিজিটাল লেনদেন প্রযুক্তি এবং চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে সফল অবতরণের অতি সাম্প্রতিক কীর্তি। শেষোক্তটিকে ভারতীয়রা পররাষ্ট্রনীতির প্রধান বিজয় হিসেবে দেখছে।
এটা সত্য যে, ভারতের পররাষ্ট্রনীতি মোদির অধীনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে। কিন্তু ঘরের বিভাজন তিনিই বাড়িয়েছেন। বিভক্ত ভারতের মুখ হয়ে উঠেছেন নরেন্দ্র মোদি। সমালোচকেরা তাঁকে, ভারতের গণতান্ত্রিক এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রের স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের ওপর আক্রমণের অগ্রণী বলে অভিহিত করেছেন।
যদিও ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার বিষয়ে ভারতের অবস্থানে সূক্ষ্মভাবে ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে মোদি সরকার। বিরোধীরা অবশ্য বলছেন, ২০২০ সালে প্রতিবেশী দুই এশীয় শক্তির মধ্যে সীমান্ত বিরোধকে কেন্দ্র মারাত্মক সংঘর্ষের পর চীনকে মোকাবিলায় মোদি সরকার তেমন কিছুই করেনি।
তবে মোদি কাল্ট এতে তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ভক্তদের মধ্যে নরেন্দ্র মোদি এখনো ব্যাপক জনপ্রিয়। ভারতকে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে যাওয়া একমাত্র সক্ষম নেতা হিসেবে মোদিকেই দেখেন তাঁরা।
মোদির ভক্ত এবং গণমাধ্যম ব্যক্তি অজয় সাহাই জাসরা বলেন, ‘এই প্রথম, বিশ্ব জানতে পেরেছে যে ভারত নিজের পক্ষে অবস্থান নিতে পারে। ভারতের স্বার্থ যেখানে রক্ষা হবে ভারত সেটাই করবে।’
কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস–এর সাউথ এশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক মিলান বৈষ্ণব বলেন, ‘মোদি যে পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন তা কার্যকর করার চেষ্টা করছেন। তাঁর লক্ষ্য ভারতকে একটি বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ দেশে পরিণত করা। এটি ভারতের ঘরোয়া রাজনীতির প্রকৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। আমি মনে করি, জনগণের মধ্যে একটি সাধারণ ধারণা রয়েছে যে, ভারত বিশ্ব মঞ্চে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রণী ভূমিকায় চলে যাচ্ছে।’
যদিও ভারতকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী এমন ধারণা এখনো পাকাপোক্ত হয়নি, বলতে গেলে শিশু পর্যায়ে রয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে পরিচালিত ২৪টি দেশে ৩০ হাজারের বেশি মানুষের ওপর পরিচালিত পিউ রিসার্চ সেন্টারের সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৪০ শতাংশ মানুষ মনে করছেন, বৈশ্বিক পর্যায়ে সঠিক কাজটি করার ক্ষেত্রে মোদির প্রতি আস্থা রাখা যায় না। যেখানে ৩৭ শতাংশ আত্মবিশ্বাসী যে মোদি সেটি পারবেন এবং করবেন।
রাজনীতি বিশ্লেষক ঘোষ বলছেন, জি২০ সম্মেলন নিয়ে অতি প্রচার-প্রচারণার কারণে মোদির অধীনে ঘনীভূত হওয়া ভারতের আরও গভীর সমস্যাগুলো উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। যেমন: গণতন্ত্রে পিছিয়ে পড়া, মানবাধিকারকর্মীদের ওপর নিপীড়ন, ভিন্নমতের কণ্ঠস্বরকে অবরুদ্ধ করা এবং গণমাধ্যমের মুখ বন্ধ করা।
এরপরও জি২০ শীর্ষ সম্মেলন মোদির জন্য উপকারীই হবে বলে মনে করছেন ঘোষ।
‘তিনি প্রেসিডেন্ট জো বিডেনের সঙ্গে কাঁধ মেলাবেন। অন্য বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে পাশাপাশি বসবেন, কথা বলবেন। আমি মনে করি, এটি তাঁকে ২০২৪ সালের নির্বাচনে এগিয়ে রাখতে সাহায্য করবে’, যোগ করেন ঘোষ।
এপি থেকে অনুবাদ করেছেন জাহাঙ্গীর আলম
নয়াদিল্লির প্রধান রাস্তাগুলো জি২০ সম্মেলনের বিশাল বিশাল পোস্টার ব্যানারে ছেয়ে গেছে। প্রতিটি ট্রাফিক পয়েন্টে শুভ্র চুল দাঁড়ি বিশিষ্ট একজন ব্যক্তির সৌম্য হাসি শোভা পাচ্ছে, যাকে সবার থেকে সহজেই আলাদা করা যায়, তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
এত গেল রাস্তার ব্যানার পোস্টারে বিজ্ঞাপন; ভারতের প্রধান প্রধান সংবাদপত্রের প্রথম পাতায়ও মোদি থাকছেন নিয়মিত, ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো তাঁকে ‘বিশ্ব গুরু’ বা বিশ্ব নেতা অভিহিত করে বাকি বিশ্বের নেতাদের সঙ্গে ছবি ও ফুটেজ প্রকাশ করছে। জনসাধারণের সামনে বক্তৃতায়, টকশোতে, গণমাধ্যমের সামনে মন্ত্রীরা সমানে নরেন্দ্র মোদিকে উদীয়মান ভারতের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে উপস্থাপন করছেন।
জনতুষ্টির রাজনীতি, এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক অতিপ্রচারমূলক সরকার এবং কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী একটি রাজনৈতিক দলের জন্য আগামী জি২০ সম্মেলন একটি পাশার দানই হতে যাচ্ছে। এত বড় আয়োজনের স্বাগতিক দেশ হতে পারা ভারতের জন্য কতটা সম্মানের ও মর্যাদার তার ব্যাপক প্রচার চালিয়ে সব কৃতিত্ব গুঁজে দেওয়া হচ্ছে মোদির পকেটে।
এই ঘটনা বিজেপি সমর্থকদের মধ্যে নরেন্দ্র মোদির প্রতি অপ্রতিরোধ্য শ্রদ্ধা এবং ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে অকুণ্ঠ সমর্থনের ক্ষেত্র তৈরির করছে। উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে ভারতকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন এবং ভারতকে একটি উজ্জ্বল নতুন ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন মোদি—এমন ভাবমূর্তিই তৈরির চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি বার্তা সংস্থা এএনআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই কথাগুলোই নরেন্দ্র মোদি গুছিয়ে বলেছেন। তিনি বৈশ্বিক দক্ষিণ অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্বের প্রতিনিধি হিসেবেই ভারতকে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু এই বিজ্ঞাপনের ঝলক মোদির ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষারও প্রদর্শন। নয়াদিল্লির ক্রমবর্ধমান ভূ–রাজনৈতিক প্রভাব এবং পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য নিজের ক্ষমতাকে সুসংহত করার কাজে ব্যবহার করতেই বেশি আগ্রহী নরেন্দ্র মোদি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের সভাপতিত্ব ভারতের জন্য একটি গর্বের মুহূর্ত, কিন্তু মোদির সরকার এটিকে নেতার ভাবমূর্তির বিপণন এবং আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে ভোটব্যাংক সংহত করার কাজে ব্যবহার করছে।
ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাগরিকা ঘোষ বলেন, ‘মোদি নিজেকে একজন বৈশ্বিক রাষ্ট্রনায়ক, একজন বিশ্ব চিন্তার নেতা?85এবং একটি উদীয়মান ভারতের কণ্ঠস্বর হিসেবে তুলে ধরছেন। আমি মনে করি, এসব কিছু মোদি কেন্দ্রিক যে কাল্ট তৈরি হয়েছে সেটিতে হাওয়া দিতেই ডিজাইন করা হয়েছে। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই ডিজাইন করা, খুব ভালোভাবে বিপণন চলছে। এটি এমন একটি জনগোষ্ঠীর কাছে আবেদন তৈরি করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে যারা উদীয়মান ভারতের প্রতিশ্রুতিগুলোর দ্বারা বেশ প্রভাবিত হবে।’
৯–১০ সেপ্টেম্বরের জি২০ শীর্ষ সম্মেলন। এখানে বিশ্বের ১৯টি ধনী দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা থাকবেন। ২০২৪ সালে ভারতে জাতীয় নির্বাচন। ফলে এই সম্মেলন আয়োজন মোদির জন্য বিশেষভাবে গুরুত্ব বহন করে। এই আয়োজনের মাধ্যমে সরকারের সক্ষমতা প্রদর্শন ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলকে অভ্যন্তরীণভাবে চাঙা করতে ব্যবহার করছেন নরেন্দ্র মোদি।
শীর্ষ সম্মেলনের আগে ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ, বিমানবন্দর এবং প্রধান ল্যান্ডমার্কগুলোতে এবারের জি২০ লোগো প্রদর্শন করা হচ্ছে। লোগোটিও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ডিজাইন করা হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। এতে ব্যবহার করা হয়েছে ভারতের জাতীয় পতাকার রং, একটি পদ্মের মাঝখানে ভূগোলকের ছবি। বিরোধীরা বলছেন, এটা কোনো কাকতালীয় নয় যে পদ্ম মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রতীক।
মোদি সরকারের কর্মকর্তারাও যোগব্যায়াম এবং সরকারের একটি অত্যন্ত সফল প্রকল্প ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থাসহ বিশ্বে ভারতের অবদানগুলো প্রদর্শন করতে নানা ইভেন্ট আয়োজন করছেন। স্কুলগুলোকে জি ২০ নিয়ে কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে বলা হয়েছে। মোদি নিজেই, তাঁর ধারাবাহিক রেডিও টক শো ‘মান কি বাত’–এ বলে আসছেন, ‘সেপ্টেম্বর মাস ভারতের সম্ভাবনার সাক্ষী হতে চলেছে।’
এদিকে, মন্ত্রীরা গলা ফাটাচ্ছেন, জি২০ শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের সব কৃতিত্ব একা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির।
বিজেপির অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গত ফেব্রুয়ারিতে একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘যদি জি২০ সম্মেলন তাঁর (মোদির) সময়েই দেশে অনুষ্ঠিত হয় এবং সাফল ভাবে সম্মেলন সম্পন্ন হয়, তাহলে তার পুরো কৃতিত্বই হবে তাঁর।’
বাস্তবতা হলো, জি২০ সম্মেলনের সভাপতিত্ব পর্যায়ক্রমে সদস্য দেশগুলো পায়, ফলে এই মর্যাদাটি মূলত প্রতীকী। শীর্ষ সম্মেলনের সাফল্য প্রায়শই চূড়ান্ত যোগাযোগের ওপর নির্ভর করে। তবে এবারের ভারতে অনুষ্ঠিত অন্য বৈঠকগুলোর একটিও সে অর্থে সফল হয়নি। ঘুরেফিরে সব বৈঠকই আটকে গেছে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান নিয়ে পাল্টাপাল্টি শব্দের খেলা এবং তা থেকে সৃষ্ট অচলাবস্থা।
জি২০ সম্মেলনের সফলতা নিয়েও এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ এ সম্মেলনে থাকছেন না গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতা—রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। ওদিকে বিশ্ব নেতাদের অনুপস্থিতির কারণে জৌলুস হারিয়েছে জাকার্তায় চলমান আসিয়ান সম্মেলন।
তা সত্ত্বেও মোদি সরকার জোরেসোরেই প্রচার করছে যে, ভারত এখন উন্নয়নশীল বিশ্বের পক্ষে সেতু হিসেবে কাজ করছে। কর্মকর্তারা যুক্তি দিচ্ছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ এবং ঋণ সংকটের সমস্যাগুলো মোকাবিলার জন্য ভারতই এখন উপযুক্ত অবস্থানে রয়েছে। মোদির প্রশাসন প্রধান পশ্চিমা দেশগুলোর সমান্তরালে ক্রমবর্ধমান শক্তি হিসেবে ভারতের অবস্থানকেও তুলে ধরছেন। বিশেষ করে গত জুনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভারত সফরের পর থেকে এই ধরনের প্রচার–প্রচারণা বেড়েছে।
এই ধারাবাহিকতায় বিজেপি সরকার নরেন্দ্র মোদিকে ভারতের অর্থনৈতিক সাফল্যের কারিগর হিসেবে উপস্থাপন করছে। এসব সাফল্যের মধ্যে রয়েছে— সৌরবিদ্যুতে অগ্রগতি, ডিজিটাল লেনদেন প্রযুক্তি এবং চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে সফল অবতরণের অতি সাম্প্রতিক কীর্তি। শেষোক্তটিকে ভারতীয়রা পররাষ্ট্রনীতির প্রধান বিজয় হিসেবে দেখছে।
এটা সত্য যে, ভারতের পররাষ্ট্রনীতি মোদির অধীনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে। কিন্তু ঘরের বিভাজন তিনিই বাড়িয়েছেন। বিভক্ত ভারতের মুখ হয়ে উঠেছেন নরেন্দ্র মোদি। সমালোচকেরা তাঁকে, ভারতের গণতান্ত্রিক এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রের স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের ওপর আক্রমণের অগ্রণী বলে অভিহিত করেছেন।
যদিও ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার বিষয়ে ভারতের অবস্থানে সূক্ষ্মভাবে ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে মোদি সরকার। বিরোধীরা অবশ্য বলছেন, ২০২০ সালে প্রতিবেশী দুই এশীয় শক্তির মধ্যে সীমান্ত বিরোধকে কেন্দ্র মারাত্মক সংঘর্ষের পর চীনকে মোকাবিলায় মোদি সরকার তেমন কিছুই করেনি।
তবে মোদি কাল্ট এতে তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ভক্তদের মধ্যে নরেন্দ্র মোদি এখনো ব্যাপক জনপ্রিয়। ভারতকে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে যাওয়া একমাত্র সক্ষম নেতা হিসেবে মোদিকেই দেখেন তাঁরা।
মোদির ভক্ত এবং গণমাধ্যম ব্যক্তি অজয় সাহাই জাসরা বলেন, ‘এই প্রথম, বিশ্ব জানতে পেরেছে যে ভারত নিজের পক্ষে অবস্থান নিতে পারে। ভারতের স্বার্থ যেখানে রক্ষা হবে ভারত সেটাই করবে।’
কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস–এর সাউথ এশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক মিলান বৈষ্ণব বলেন, ‘মোদি যে পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন তা কার্যকর করার চেষ্টা করছেন। তাঁর লক্ষ্য ভারতকে একটি বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ দেশে পরিণত করা। এটি ভারতের ঘরোয়া রাজনীতির প্রকৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। আমি মনে করি, জনগণের মধ্যে একটি সাধারণ ধারণা রয়েছে যে, ভারত বিশ্ব মঞ্চে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রণী ভূমিকায় চলে যাচ্ছে।’
যদিও ভারতকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী এমন ধারণা এখনো পাকাপোক্ত হয়নি, বলতে গেলে শিশু পর্যায়ে রয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে পরিচালিত ২৪টি দেশে ৩০ হাজারের বেশি মানুষের ওপর পরিচালিত পিউ রিসার্চ সেন্টারের সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৪০ শতাংশ মানুষ মনে করছেন, বৈশ্বিক পর্যায়ে সঠিক কাজটি করার ক্ষেত্রে মোদির প্রতি আস্থা রাখা যায় না। যেখানে ৩৭ শতাংশ আত্মবিশ্বাসী যে মোদি সেটি পারবেন এবং করবেন।
রাজনীতি বিশ্লেষক ঘোষ বলছেন, জি২০ সম্মেলন নিয়ে অতি প্রচার-প্রচারণার কারণে মোদির অধীনে ঘনীভূত হওয়া ভারতের আরও গভীর সমস্যাগুলো উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। যেমন: গণতন্ত্রে পিছিয়ে পড়া, মানবাধিকারকর্মীদের ওপর নিপীড়ন, ভিন্নমতের কণ্ঠস্বরকে অবরুদ্ধ করা এবং গণমাধ্যমের মুখ বন্ধ করা।
এরপরও জি২০ শীর্ষ সম্মেলন মোদির জন্য উপকারীই হবে বলে মনে করছেন ঘোষ।
‘তিনি প্রেসিডেন্ট জো বিডেনের সঙ্গে কাঁধ মেলাবেন। অন্য বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে পাশাপাশি বসবেন, কথা বলবেন। আমি মনে করি, এটি তাঁকে ২০২৪ সালের নির্বাচনে এগিয়ে রাখতে সাহায্য করবে’, যোগ করেন ঘোষ।
এপি থেকে অনুবাদ করেছেন জাহাঙ্গীর আলম
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
২ দিন আগেকোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
৪ দিন আগেনবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
৮ দিন আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
১২ দিন আগে