ফজলুল কবির
রাস্তায় বেরোলেই শিশুদের দিকে চোখ যায় ইদানীং। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এমনিতে অবশ্য শিশুদের তেমন দেখা যায় না। অলিগলিতে বিকেলবেলা তেমন কোলাহলও দেখা যায় না। করোনা মহামারিতে দেড় বছর ঘরবন্দী থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়া মধ্য ও নিম্ন–মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুরা বিভিন্ন ডিভাইসে বুঁদ হয়ে থাকছে। এ খবর মোটামুটি সবাই এখন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম মারফত জানে। এ নিয়ে সচেতন নাগরিক মহল থেকে উদ্বেগও প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এই উদ্বেগের মধ্যেই শুভংকরের ফাঁকি হিসেবে হিসাবের বাইরে পড়ে থাকছে নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুরা, যাদের আসক্ত হওয়ার মতো ডিভাইসই নেই। সমাজের এ অংশ নিয়ে মোটাদাগে একটি কথা বলা হয়, তারা বিভিন্ন শ্রমের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।
এই সবগুলো বিষয়ই আমলে নেওয়ার মতো। কোনোটিই উড়িয়ে দেওয়ার জো নেই। কিন্তু যখন রাতে বিভিন্ন সড়ক ফাঁকা হয়ে পড়ে, তখন দলবদ্ধ কিছু শিশুর দিকে চোখ আটকে পড়বেই। বিভিন্ন সড়কের ফুটপাতে বা মোড়ে তারা ঘুরছে, নয়তো পড়ে থাকছে। জেগে ঘুমানোর এক অসম্ভব চেষ্টায় রত সবাই। হাতে হাতে ঝুলছে এক অব্যর্থ পলিথিন। সেই পলিথিনের একেবারে তলানিতে ভালো করে তাকালে চোখে পড়বে হলুদাভ একটা পদার্থ। হ্যাঁ, এটিই ডান্ডি। ভালো করে বললে ডেনড্রাইট অ্যাডহেসিভ, যা আঠা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই আঠাই এখন এই পথশিশুরা নেশাদ্রব্য হিসেবে ব্যবহার করছে।
এমন নয় যে, আগে এমন দৃশ্য চোখে পড়ত না। পড়ত। কিন্তু এখন এই দৃশ্য এত বেশি চোখে পড়ছে যে, তা রীতিমতো ভয় ধরিয়ে দেয়। দৃশ্যটি রাতে বেশি চোখে পড়ে রাস্তা ফাঁকা থাকার কারণে। দিনের অন্য সময় মানুষের ভিড়ে এই দৃশ্যগুলো আড়ালে পড়ে যায়।
আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ইদানীং শিশুদের এই নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকা বা নেশা গ্রহণের দৃশ্য অনেক বেশি চোখে পড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে—এও কি করোনার প্রভাব?
দেশে এ ধরনের কোনো পরিসংখ্যান সেভাবে না থাকলেও পশ্চিমা দেশগুলো কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ভেবেছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের সাম্প্রতিক এক জরিপের তথ্য বলছে, করোনায় সারা বিশ্বে শিশুরা সবচেয়ে বেশি দরিদ্র হয়েছে। বিশ্বের অগ্রসর অর্থনীতির দেশগুলোরই এ অবস্থা।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্যমতে, গত বছরের তুলনায় উন্নত বিশ্বের অর্থনীতির উন্নতি হলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আশাব্যাঞ্জক তো নয় মোটেই, বরং কপালে ভাঁজ তুলে দেওয়ার মতো। উন্নত বিশ্বের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশের অর্থনীতিতে ঊর্ধ্বগতি বেশ চোখে পড়ার মতো। কিন্তু স্পেন, ইতালি, জাপান, ফ্রান্স, গ্রিস, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা এখনো ভালো নয়।
বিভিন্ন দেশ করোনার ধকল কাটিয়ে উঠতে শুরু করলেও শিশুদের অবস্থা ভালো নয়। গত ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত পরিচালিত জরিপের তথ্য তুলে ধরে পিউ রিসার্চ সেন্টার বলছে, এই সময়ে যে শিশুরা বেড়ে উঠছে, তাদের ৬৪ শতাংশই বড় হয়ে তাদের মা–বাবার চেয়ে দরিদ্র হবে। অর্থনৈতিকভাবে মা–বাবার চেয়ে ভালো অবস্থায় থাকার সম্ভাবনা রয়েছে মাত্র ৩২ শতাংশ শিশুর।
বিশ্বের ১৭টি দেশে পরিচালিত এ জরিপে শুধু সুইডেন ও সিঙ্গাপুরের অবস্থাই তুলনামূলক ভালো। এ দুই দেশের ৫০ শতাংশ শিশুর অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা প্রকাশ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা বেশ বাজে বলতে হবে। দেশটির ৬৮ শতাংশ শিশুই তাদের অভিভাবকের তুলনায় গরিব হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে জরিপ প্রতিবেদনে। সবচেয়ে বাজে অবস্থা ফ্রান্স ও জাপানের। দুটি দেশরই ৭৭ শতাংশ শিশুর অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ তাদের অভিভাবকের তুলনায় খারাপ।
এ তো গেল পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপের তথ্য। মার্কিন গবেষণা সংস্থা চাইল্ড ট্রেন্ডের তথ্য আরও সুস্পষ্ট কিছু তথ্য দিচ্ছে। তারা বলছে, করোনার কারণে নতুন করে ১২ লাখ শিশু দরিদ্রের কাতারে যুক্ত হয়েছে। মার্কিন জনগণনার তথ্যকে সন্নিবেশিত করে সংস্থাটি এই তথ্য জানাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় তথ্যভান্ডারের বরাত দিয়ে সংস্থাটি বলছে, ২০১৯ সালের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে দরিদ্র শিশুর সংখ্যা বেড়েছে ১ দশমিক ৮ শতাংশ পয়েন্ট। দেশটিতে ২০১৯ সালে মোট শিশুর ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল দরিদ্রের কাতারে। ২০২০ সালে এ হার বেড়ে ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে। বর্তমানে দেশটিতে দরিদ্র শিশুর সংখ্যা ১ কোটি ২৫ লাখের বেশি।
দরিদ্র বলতে এখানে দিনে যাদের ক্রয়ক্ষমতা ২ ডলারের কম, তাদের বোঝানো হয়েছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দরিদ্র বললে এর চেয়েও কম ক্রয়ক্ষমতাকে বুঝতে হয়। এই হিসাবকে আমলে নিয়ে ইউনিসেফ একটি গড় হিসাব জানিয়েছে। গত বছরের শেষ নাগাদ প্রকাশিত ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা বিশ্বে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে নিমজ্জিত শিশুর সংখ্যা বেড়ে ১২০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। শুধু করোনার এক বছরে বেড়েছে ১৫ কোটি দরিদ্র শিশু। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এই শিশু দারিদ্র্য বেড়েছে ১৫ শতাংশ।
দেশে করোনার এই সময়ে বাড়া দারিদ্র্যের একটা মোটাদাগে হিসাব যদিও সামনে আসে, কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব ঠিক কী, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। গত ২০ এপ্রিল বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এ বিষয়ে এক জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে। সেখানে জানানো হয়, কোভিডের আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। এর আগে গত জানুয়ারির শেষ দিকে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম আরেক জরিপের ফল প্রকাশ করে। সেখানে জানানো হয়, করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার (আপার পোভার্টি রেট) বেড়ে ৪২ শতাংশ দাঁড়িয়েছে।
কোভিডের কারণে সারা দেশে দারিদ্র্য বাড়ছে—এটা মোটামুটি এক কথায় সবাই স্বীকার করছেন। সঙ্গে এও স্বীকার করছেন—এই দারিদ্র্য সমান হারে বাড়ছে না। সমাজের নিম্ন স্তরে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে। অর্থাৎ, বৈষম্য বেড়েছে। সামজের উঁচু স্তরে কোভিডের প্রভাব পড়লেও তার প্রভাব এবং নিম্ন স্তরের ওপর পড়া প্রভাব এক নয়। গরিব আরও গরিব হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত দরিদ্র এবং দরিদ্র শ্রেণি অতি দরিদ্র শ্রেণির দিকে যাচ্ছে। এটা অনেকটা চক্রের মতো।
করোনায় অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। অনেকে কাজ না হারালেও নিয়মিত আয়ের নিশ্চয়তা হারিয়েছেন। ফলে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন সমাজের একটি বড় অংশ। বিশেষত খেটে খাওয়া মানুষেরা ঋণগ্রস্ত হয়েছেন বেশি। রাস্তায় বেরোলে রিকশা বা সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করতে গেলে বাড়তি ভাড়া মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্তের চোখ কপালে তুলে দিচ্ছে। কিন্তু একটু আলাপ করলেই দেখা যাচ্ছে, করোনায় যান চলাচল বন্ধ থাকার সময় ওই ব্যক্তি তার পরিবার ঋণ করে চালিয়েছে। ব্যক্তি বা স্থানীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে উচ্চ সুদে নেওয়া সে ঋণ দ্রুত পরিশোধের তাগাদা তার রয়েছে।
এ অবস্থায় পরিবারের পাশে এসে দাঁড়াতে হচ্ছে ঘরের শিশু সন্তানকেও। ফলে শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। অনেক শিশুই নেমে আসছে রাস্তায়। অনেকে একেবারে ছিন্নমূল হয়ে ফিরছে শহরের রাস্তায়, যাদের একটি অংশ অনেকটা না বুঝেই আটকা পড়ছে নেশার ফাঁদে। জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কাজে।
এবার আবার সানেমের গবেষণার দিকে তাকানো যাক। তারা বলছে, কোভিডের কারণে বেড়ে যাওয়া এই দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষাগ্রহণ ব্যাহত হচ্ছে। এমনিতেই ২০১৮ ও ২০২০ সালের মধ্যে মাথাপিছু গড় শিক্ষাব্যয় কমেছে। অতিদরিদ্র পরিবারের মধ্যেই এই হার কমেছে সবচেয়ে বেশি। দেশের অতিদরিদ্র পরিবারের ৫৮ শতাংশেরই শিক্ষাব্যয় কমেছে। করোনার এই দেড় বছরে এটি আরও বাজে পরিস্থিতিতে গিয়ে ঠেকেছে নিশ্চিতভাবে। কিন্তু কতটা, তা নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। বিশেষত শিশুদের নিয়ে এমন জাতীয় পর্যায়ের সমীক্ষা এখানে হয়নি এই সময়ে। ফলে কোভিডের কারণে ঠিক কত সংখ্যক শিশু সরাসরি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে, তা স্থির করে বলার সুযোগ নেই।
তবে রাতের রাস্তার বেদনাদায়ক দৃশ্যগুলো বলছে, হারটি অনেক উচ্চ। এতটাই যে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে তা দুর্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়বে দেশের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নানা খাতে। দারিদ্র্যের হার হিসাবের সময় শুধু ক্রয়ক্ষমতা বিচারের যে রেওয়াজ, তা আদতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকারহীনতাকে ঠিক সামনে আনে না। কারণ, দারিদ্র্যের সঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যয়ের মতো বিষয়গুলো সরাসরি জড়িত। ফলে শিশুদের দারিদ্র্য বাড়া কত বড় ধারাবাহিক প্রভাব ফেলতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এত বড় একটি বিষয় নিয়ে রাষ্ট্র থেকে শুরু করে নাগরিক সমাজ বলা যায় এক রকম নিশ্চুপ। কেউ বিষয়টির খোঁজই রাখছে না বা ইচ্ছে করেই চোখ বুঁজে থাকছে। শিশু দারিদ্র্য বা এর ফলে পথশিশুদের মধ্যে বেড়ে যাওয়া নেশা ও অপরাধ প্রবণতা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ বা এমন কোনো পরিকল্পনা তো অনেক দূরের ব্যাপার। অথচ বিষয়টি নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
রাস্তায় বেরোলেই শিশুদের দিকে চোখ যায় ইদানীং। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এমনিতে অবশ্য শিশুদের তেমন দেখা যায় না। অলিগলিতে বিকেলবেলা তেমন কোলাহলও দেখা যায় না। করোনা মহামারিতে দেড় বছর ঘরবন্দী থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়া মধ্য ও নিম্ন–মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুরা বিভিন্ন ডিভাইসে বুঁদ হয়ে থাকছে। এ খবর মোটামুটি সবাই এখন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম মারফত জানে। এ নিয়ে সচেতন নাগরিক মহল থেকে উদ্বেগও প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এই উদ্বেগের মধ্যেই শুভংকরের ফাঁকি হিসেবে হিসাবের বাইরে পড়ে থাকছে নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুরা, যাদের আসক্ত হওয়ার মতো ডিভাইসই নেই। সমাজের এ অংশ নিয়ে মোটাদাগে একটি কথা বলা হয়, তারা বিভিন্ন শ্রমের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।
এই সবগুলো বিষয়ই আমলে নেওয়ার মতো। কোনোটিই উড়িয়ে দেওয়ার জো নেই। কিন্তু যখন রাতে বিভিন্ন সড়ক ফাঁকা হয়ে পড়ে, তখন দলবদ্ধ কিছু শিশুর দিকে চোখ আটকে পড়বেই। বিভিন্ন সড়কের ফুটপাতে বা মোড়ে তারা ঘুরছে, নয়তো পড়ে থাকছে। জেগে ঘুমানোর এক অসম্ভব চেষ্টায় রত সবাই। হাতে হাতে ঝুলছে এক অব্যর্থ পলিথিন। সেই পলিথিনের একেবারে তলানিতে ভালো করে তাকালে চোখে পড়বে হলুদাভ একটা পদার্থ। হ্যাঁ, এটিই ডান্ডি। ভালো করে বললে ডেনড্রাইট অ্যাডহেসিভ, যা আঠা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই আঠাই এখন এই পথশিশুরা নেশাদ্রব্য হিসেবে ব্যবহার করছে।
এমন নয় যে, আগে এমন দৃশ্য চোখে পড়ত না। পড়ত। কিন্তু এখন এই দৃশ্য এত বেশি চোখে পড়ছে যে, তা রীতিমতো ভয় ধরিয়ে দেয়। দৃশ্যটি রাতে বেশি চোখে পড়ে রাস্তা ফাঁকা থাকার কারণে। দিনের অন্য সময় মানুষের ভিড়ে এই দৃশ্যগুলো আড়ালে পড়ে যায়।
আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ইদানীং শিশুদের এই নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকা বা নেশা গ্রহণের দৃশ্য অনেক বেশি চোখে পড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে—এও কি করোনার প্রভাব?
দেশে এ ধরনের কোনো পরিসংখ্যান সেভাবে না থাকলেও পশ্চিমা দেশগুলো কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ভেবেছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের সাম্প্রতিক এক জরিপের তথ্য বলছে, করোনায় সারা বিশ্বে শিশুরা সবচেয়ে বেশি দরিদ্র হয়েছে। বিশ্বের অগ্রসর অর্থনীতির দেশগুলোরই এ অবস্থা।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্যমতে, গত বছরের তুলনায় উন্নত বিশ্বের অর্থনীতির উন্নতি হলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আশাব্যাঞ্জক তো নয় মোটেই, বরং কপালে ভাঁজ তুলে দেওয়ার মতো। উন্নত বিশ্বের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশের অর্থনীতিতে ঊর্ধ্বগতি বেশ চোখে পড়ার মতো। কিন্তু স্পেন, ইতালি, জাপান, ফ্রান্স, গ্রিস, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা এখনো ভালো নয়।
বিভিন্ন দেশ করোনার ধকল কাটিয়ে উঠতে শুরু করলেও শিশুদের অবস্থা ভালো নয়। গত ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত পরিচালিত জরিপের তথ্য তুলে ধরে পিউ রিসার্চ সেন্টার বলছে, এই সময়ে যে শিশুরা বেড়ে উঠছে, তাদের ৬৪ শতাংশই বড় হয়ে তাদের মা–বাবার চেয়ে দরিদ্র হবে। অর্থনৈতিকভাবে মা–বাবার চেয়ে ভালো অবস্থায় থাকার সম্ভাবনা রয়েছে মাত্র ৩২ শতাংশ শিশুর।
বিশ্বের ১৭টি দেশে পরিচালিত এ জরিপে শুধু সুইডেন ও সিঙ্গাপুরের অবস্থাই তুলনামূলক ভালো। এ দুই দেশের ৫০ শতাংশ শিশুর অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা প্রকাশ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা বেশ বাজে বলতে হবে। দেশটির ৬৮ শতাংশ শিশুই তাদের অভিভাবকের তুলনায় গরিব হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে জরিপ প্রতিবেদনে। সবচেয়ে বাজে অবস্থা ফ্রান্স ও জাপানের। দুটি দেশরই ৭৭ শতাংশ শিশুর অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ তাদের অভিভাবকের তুলনায় খারাপ।
এ তো গেল পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপের তথ্য। মার্কিন গবেষণা সংস্থা চাইল্ড ট্রেন্ডের তথ্য আরও সুস্পষ্ট কিছু তথ্য দিচ্ছে। তারা বলছে, করোনার কারণে নতুন করে ১২ লাখ শিশু দরিদ্রের কাতারে যুক্ত হয়েছে। মার্কিন জনগণনার তথ্যকে সন্নিবেশিত করে সংস্থাটি এই তথ্য জানাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় তথ্যভান্ডারের বরাত দিয়ে সংস্থাটি বলছে, ২০১৯ সালের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে দরিদ্র শিশুর সংখ্যা বেড়েছে ১ দশমিক ৮ শতাংশ পয়েন্ট। দেশটিতে ২০১৯ সালে মোট শিশুর ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল দরিদ্রের কাতারে। ২০২০ সালে এ হার বেড়ে ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে। বর্তমানে দেশটিতে দরিদ্র শিশুর সংখ্যা ১ কোটি ২৫ লাখের বেশি।
দরিদ্র বলতে এখানে দিনে যাদের ক্রয়ক্ষমতা ২ ডলারের কম, তাদের বোঝানো হয়েছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দরিদ্র বললে এর চেয়েও কম ক্রয়ক্ষমতাকে বুঝতে হয়। এই হিসাবকে আমলে নিয়ে ইউনিসেফ একটি গড় হিসাব জানিয়েছে। গত বছরের শেষ নাগাদ প্রকাশিত ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা বিশ্বে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে নিমজ্জিত শিশুর সংখ্যা বেড়ে ১২০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। শুধু করোনার এক বছরে বেড়েছে ১৫ কোটি দরিদ্র শিশু। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এই শিশু দারিদ্র্য বেড়েছে ১৫ শতাংশ।
দেশে করোনার এই সময়ে বাড়া দারিদ্র্যের একটা মোটাদাগে হিসাব যদিও সামনে আসে, কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব ঠিক কী, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। গত ২০ এপ্রিল বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এ বিষয়ে এক জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে। সেখানে জানানো হয়, কোভিডের আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। এর আগে গত জানুয়ারির শেষ দিকে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম আরেক জরিপের ফল প্রকাশ করে। সেখানে জানানো হয়, করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার (আপার পোভার্টি রেট) বেড়ে ৪২ শতাংশ দাঁড়িয়েছে।
কোভিডের কারণে সারা দেশে দারিদ্র্য বাড়ছে—এটা মোটামুটি এক কথায় সবাই স্বীকার করছেন। সঙ্গে এও স্বীকার করছেন—এই দারিদ্র্য সমান হারে বাড়ছে না। সমাজের নিম্ন স্তরে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে। অর্থাৎ, বৈষম্য বেড়েছে। সামজের উঁচু স্তরে কোভিডের প্রভাব পড়লেও তার প্রভাব এবং নিম্ন স্তরের ওপর পড়া প্রভাব এক নয়। গরিব আরও গরিব হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত দরিদ্র এবং দরিদ্র শ্রেণি অতি দরিদ্র শ্রেণির দিকে যাচ্ছে। এটা অনেকটা চক্রের মতো।
করোনায় অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। অনেকে কাজ না হারালেও নিয়মিত আয়ের নিশ্চয়তা হারিয়েছেন। ফলে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন সমাজের একটি বড় অংশ। বিশেষত খেটে খাওয়া মানুষেরা ঋণগ্রস্ত হয়েছেন বেশি। রাস্তায় বেরোলে রিকশা বা সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করতে গেলে বাড়তি ভাড়া মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্তের চোখ কপালে তুলে দিচ্ছে। কিন্তু একটু আলাপ করলেই দেখা যাচ্ছে, করোনায় যান চলাচল বন্ধ থাকার সময় ওই ব্যক্তি তার পরিবার ঋণ করে চালিয়েছে। ব্যক্তি বা স্থানীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে উচ্চ সুদে নেওয়া সে ঋণ দ্রুত পরিশোধের তাগাদা তার রয়েছে।
এ অবস্থায় পরিবারের পাশে এসে দাঁড়াতে হচ্ছে ঘরের শিশু সন্তানকেও। ফলে শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। অনেক শিশুই নেমে আসছে রাস্তায়। অনেকে একেবারে ছিন্নমূল হয়ে ফিরছে শহরের রাস্তায়, যাদের একটি অংশ অনেকটা না বুঝেই আটকা পড়ছে নেশার ফাঁদে। জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কাজে।
এবার আবার সানেমের গবেষণার দিকে তাকানো যাক। তারা বলছে, কোভিডের কারণে বেড়ে যাওয়া এই দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষাগ্রহণ ব্যাহত হচ্ছে। এমনিতেই ২০১৮ ও ২০২০ সালের মধ্যে মাথাপিছু গড় শিক্ষাব্যয় কমেছে। অতিদরিদ্র পরিবারের মধ্যেই এই হার কমেছে সবচেয়ে বেশি। দেশের অতিদরিদ্র পরিবারের ৫৮ শতাংশেরই শিক্ষাব্যয় কমেছে। করোনার এই দেড় বছরে এটি আরও বাজে পরিস্থিতিতে গিয়ে ঠেকেছে নিশ্চিতভাবে। কিন্তু কতটা, তা নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। বিশেষত শিশুদের নিয়ে এমন জাতীয় পর্যায়ের সমীক্ষা এখানে হয়নি এই সময়ে। ফলে কোভিডের কারণে ঠিক কত সংখ্যক শিশু সরাসরি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে, তা স্থির করে বলার সুযোগ নেই।
তবে রাতের রাস্তার বেদনাদায়ক দৃশ্যগুলো বলছে, হারটি অনেক উচ্চ। এতটাই যে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে তা দুর্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়বে দেশের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নানা খাতে। দারিদ্র্যের হার হিসাবের সময় শুধু ক্রয়ক্ষমতা বিচারের যে রেওয়াজ, তা আদতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকারহীনতাকে ঠিক সামনে আনে না। কারণ, দারিদ্র্যের সঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যয়ের মতো বিষয়গুলো সরাসরি জড়িত। ফলে শিশুদের দারিদ্র্য বাড়া কত বড় ধারাবাহিক প্রভাব ফেলতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এত বড় একটি বিষয় নিয়ে রাষ্ট্র থেকে শুরু করে নাগরিক সমাজ বলা যায় এক রকম নিশ্চুপ। কেউ বিষয়টির খোঁজই রাখছে না বা ইচ্ছে করেই চোখ বুঁজে থাকছে। শিশু দারিদ্র্য বা এর ফলে পথশিশুদের মধ্যে বেড়ে যাওয়া নেশা ও অপরাধ প্রবণতা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ বা এমন কোনো পরিকল্পনা তো অনেক দূরের ব্যাপার। অথচ বিষয়টি নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
ইউক্রেনের ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র সারা বিশ্বে আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও, রাশিয়ার এ ধরনের আক্রমণকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে—যেমনটি ইসরায়েল উত্তর গাজাকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে হয়েছে।
১৪ ঘণ্টা আগেট্রাম্প ফিরে আসায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের ধারাবাহিকতাই বজায় থাকতে পারে, সামান্য কিছু পরিবর্তন নিয়ে। ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান পেছনের সারিতে থাকলেও বাংলাদেশ,
১৯ ঘণ্টা আগেড. ইউনূস যখন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন পুরো জাতি তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল। তবে তাঁকে পরিষ্কারভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে যে, তিনি কীভাবে দেশ শাসন করবেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
২ দিন আগেসম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
২ দিন আগে