চীনকে ঠেকাতেই কি পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ চান ট্রাম্প

অনলাইন ডেস্ক    
প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪: ২২
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪: ২৬
Thumbnail image
পানামা খাল নিয়ে তবে কী ভূরাজনৈতিক জটিলতা তৈরি হতে যাচ্ছে আগামী দিনে—এমন প্রশ্নই এখন বেশ জোরেশোরে চাউর হয়েছে। ছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীন, কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর শুল্কের হুমকি দেওয়ার পর এবার পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কথা বলছেন। ঠিক সেই সময়ে, ট্রাম্পের ছেলে এরিক ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একটি ছবি পোস্ট করেছেন। যেখানে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র গ্রিনল্যান্ড, পানামা খাল এবং কানাডাকে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আমাজনের শপিং কার্টে যোগ করছে। ট্রাম্প তাৎক্ষণিক মন্তব্যের জন্য পরিচিত হলেও, তাঁর মন্তব্য পানামার সঙ্গে সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়ার ইঙ্গিত দেওয়ার পাশাপাশি চীনকে সতর্ক করার একটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ ছিল।

পানামা খাল মধ্য আমেরিকার দেশ পানামায় অবস্থিত ৮২ কিলোমিটার দীর্ঘ এক জলপথ। এটি প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরকে সংযুক্ত করেছে। ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র এই খাল নির্মাণ করে এবং এর পরের কয়েক দশক খালের আশপাশের একটি এলাকা ওয়াশিংটনের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। ১৯৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র খালটি পানামার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার চুক্তি করে। তবে খালটির নিয়ন্ত্রণ পানাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এর পর থেকে খালটি পরিচালনা করছে পানামা সরকার। এই খাল হয়ে পারাপার হওয়া জাহাজ ও শিপিং কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে পাওয়া ফি পানামা আয়ের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ২০২৩ সালে দেশটি এই খাল থেকে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে।

পানামা খালের সবচেয়ে বড় উপযোগিতা হলো—এটি এশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এবং যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ও পূর্ব উপকূলের দূরত্ব অনেক কমিয়ে দিয়েছে। এই খাল নির্মাণের আগে যুক্তরাষ্ট্রকে বিপজ্জনক জলপথ পাড়ি দিয়ে এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য পরিচালনা করতে হতো। এই খাল দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ প্রান্তের বরফাচ্ছন্ন ও ঝঁঞ্চাপ্রবণ ম্যাজেলান প্রণালি ঘুরে যাওয়ার পরিবর্তে কয়েক হাজার কিলোমিটার পথ ও কয়েক সপ্তাহের ভ্রমণ সময় কমিয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে নিউইয়র্ক পর্যন্ত যাত্রাপথে পানামা খাল ব্যবহার করায় ১৩ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব কমে এবং ২২ দিন কম সময় লাগে।

প্রতি বছর প্রায় ১৫ হাজার জাহাজ পানামা খাল দিয়ে চলাচল করে। এর বেশির ভাগই মালবাহী জাহাজ। তবে বেশ কিছু সামরিক জাহাজও এই জলপথ পার হয়। খালের প্রধান ব্যবহারকারী দেশগুলো হলো—যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পর চীন পানামা খালের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যবহারকারী। এখানেই ভূরাজনীতি এবং বৃহৎ শক্তির প্রতিযোগিতার বিষয়টি এসে যায়।

পানামা খাল যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৩ সালে এই খালের মাধ্যমে চলাচলকারী কার্গোর ৭৫ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রে গেছে বা সেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছে। কিন্তু এটি আরেকটি কারণে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। চীনের সঙ্গে কোনো সামরিক সংঘাতের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে তার জাহাজ এবং অন্যান্য সরঞ্জাম ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিতে হলে এই খালের প্রয়োজন হবে। আর এ কারণেই লাতিন আমেরিকার সরকার এবং অর্থনীতির ওপর ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি সমস্যা হয়ে উঠতে পারে।

পানামায় চীনের বিশাল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ আছে। ২০১৭ সালে পানামা তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এই অবস্থায় বেশ কয়েকটি প্রশ্ন হাজির হয়েছে। বিশেষ করে, যদি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায়, তবে পানামা কী করবে?

চীন হয়তো পানামা খাল সরাসরি নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনা করে না, তবে হংকংভিত্তিক সিকে হাচিসন হোল্ডিংসের একটি সহায়ক প্রতিষ্ঠান খালের ক্যারিবিয়ান এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্রবেশপথের দুটি বন্দর পরিচালনা করে। এই অবস্থায় তাইওয়ান নিয়ে চীনের সঙ্গে কোনো সংঘাত হলে যুক্তরাষ্ট্র কি খাল ব্যবহার করতে পারবে? এ ছাড়া, ১৯৭৭ সালের যুক্তরাষ্ট্র-পানামা চুক্তি খালটিতে সব দেশের জন্য ন্যায্য প্রবেশাধিকার এবং অ-বৈষম্যমূলক ফি নিশ্চিত করে। কোনো সংঘাতময় পরিস্থিতিতে এটি কি এই দুটি দেশ এবং অন্যান্যরা মানবে?

সম্ভবত এমন চিত্রকল্প সামনে রেখেই ট্রাম্প তাঁর নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যাল শেয়ার করা এক পোস্টে বলেছেন, পানামা খালের নিরাপদ, কার্যকর এবং নির্ভরযোগ্য কার্যক্রম বজায় রাখার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ জড়িত। তিনি আরও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে বা ভবিষ্যতে কখনোই পানামা খাল ভুল হাতে পড়তে দেবে না।

নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র খাল নির্মাণ করে দিয়েছে সহযোগিতার নিদর্শন হিসেবে, অন্যদের বাড়তি সুবিধার জন্য নয় এবং এটি কেবল পানামার হাতেই পরিচালিত হওয়ার জন্য, চীন বা অন্য কারও জন্য নয়। ট্রাম্পের অপর এক অভিযোগ—পানামা কর্তৃপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী এবং বাণিজ্য জাহাজকে এই খালে প্রবেশের ক্ষেত্রে অবিচার করেছে। তিনি বলেছেন, পানামা এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যে অযৌক্তিক ফি নেয় তা এবং এর নামে যে প্রতারণা করছে তা বন্ধ হওয়া উচিত।

পরিহাসের বিষয় হলো—ট্রাম্প যেদিন এই হুমকি দিয়েছেন—২০ ডিসেম্বর—সেদিন ছিল পানামায় মার্কিন আগ্রাসনের ৩৫ তম বার্ষিকী। ২০ ডিসেম্বর পানামায় জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই দিনটি পানামায় রাষ্ট্রীয় ছুটি। ১৯৮৯ সালের মার্কিন আগ্রাসনে নিহত পানামাবাসীদের স্মরণে পালিত হয় এই দিনটি।

পানামার প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনো দ্রুতই ট্রাম্পের বক্তব্যের জবাব দেন। তিনি এক্সে শেয়ার করা একটি বিবৃতিতে বলেন, পানামা খাল এবং এর আশপাশের প্রতিটি বর্গমিটার পানামার এবং তা পানামারই থাকবে। তিনি আরও বলেন, পানামার সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতা আলোচনার বাইরে। তিনি জাহাজ এবং শিপিং কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে নেওয়া ফি-কে সঠিক এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত বলেও দাবি করেন।

মুলিনো দেশটির তিন সাবেক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে স্বাক্ষরিত এক যৌথ বিবৃতিতে পানামা খালের ওপর তাঁর দেশের সার্বভৌমত্ব পুনর্ব্যক্ত করেন। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট পানামার সমর্থনে এগিয়ে আসেন। মেক্সিকোর পাশাপাশি বলিভারিয়ান অ্যালায়েন্স ফর দ্য পিপলস অব আওয়ার আমেরিকা—পিপলস ট্রেড ট্রিটি এক বিবৃতিতে জানায়, তারা ট্রাম্পের বক্তব্য দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে। মুলিনো ট্রাম্পের এই অভিযোগও নাকচ করেন যে, চীনারা অবৈধভাবে খাল পরিচালনা করছে।

তবে এত কিছুর পরও অনেক প্রশ্নই এখনো সামনে উপস্থিত আছে। বিশেষ করে, ট্রাম্পের মতো একজন ব্যক্তি আগামী ২০ জানুয়ারি যখন আনুষ্ঠানিকভাবে হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করবেন, তখন পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় সেদিকে সবার নজর। আপাতত, পানামা শুধু অপেক্ষা করতে পারে এবং দেখতে পারে ভবিষ্যতে কী ঘটবে।

ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ডিডি নিউজ থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত